গল্প - অমিতাভ সরকার
Posted in গল্পসিকুয়েন্স একঃ ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস
সকাল ন’টা। যেতে যেতে মিটিং-এর প্রেজেন্টেশনের পাওয়ার-পয়েন্টটা শেষবারের মত দেখে নিতে ল্যাপটপ খুললেন অর্ক রায়। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ইস্টার্ন রিজিয়ানের এক্সিকিউটভ। হঠাৎ আচমকা ব্রেকের ঝাঁকুনিতে বিরক্তিতে তাকালেন সামনের দিকে। মিলনমেলা পেরিয়ে চারনম্বর ব্রিজের ক্রসিং। হৈ হৈ করে চারিপাশ থেকে লোকজনকে ছুটে আসতে দেখা গেল। ডিসগাস্টিং... দশটায় মিটিং শুরু....ঠিক এই কারণেই আগে বেরিয়েছেন অর্ক। কোলকাতার রাস্তা কখন কী হয়, কিচ্ছু বলা যায় না। ড্রাইভারকে এগিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে বললেন অর্ক। সেরকম হলে ব্যাক করে কসবা হয়ে যেতে হবে।
ড্রাইভারের ফিরে আসতে দেরী দেখে দরজা খুলে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যান। অর্ককে দেখে ড্রাইভার এগিয়ে আসেন...।
“অ্যাকসিডেন্ট হুয়া সাব। এক আদমী...”। এগিয়ে গেলেন অর্ক। ড্রাইভার লোকজনকে সরিয়ে অর্ককে দেখার জন্য জায়গা করে দিতেই ভীড়ের মধ্যে উঁকি দিলেন অর্ক, একজন রক্তাক্ত সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। পরনে রক্তেভেজা পায়জামা পাঞ্জাবী। একটা কাপড়ের সাইডব্যাগ পড়ে আছে একপাশে। কেমন যেন চেনাচেনা লাগলো অর্কের...।
ফ্ল্যাশব্যাক
দৃশ্য এক)
ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে ছাত্রছাত্রীর ভীড়। আজ ক্লাস বয়কটের ডাক দিয়েছে ইউনিয়ন। একটা বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখছেন তাদের ইউনিয়নের অন্যতম নেতা ‘অরিন্দম’। ইচ্ছাকৃত দাঙ্গার বাতাবারন তৈরি, ছাত্রছাত্রীদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা আইনে বিনা বিচারে গ্রেপ্তার ইত্যাদির বিরূদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্র অরিন্দম। অরিন্দমের পাশে দাঁড়িয়ে অর্ক, তার প্রিয় বন্ধু, আন্দোলনের সাথী। চারিদিকে হাততালির আওয়াজ, শ্লোগান...।
ফেডইন, দৃশ্য দুই)
ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের মিছিল রাজপথে। পুরোভাগে ফেস্টুন হাতে অরিন্দমের পাশে অর্ক। মাউথপিস হাতে গান গাইছেন অর্ক, গলা মেলাচ্ছেন অরিন্দম; ‘পথে এবার নামো সাথি, পথেই হবে পথ চেনা…”
বাউন্সব্যাক/ রিজুম
চকিতে মনে পড়ে গেল সবকিছু। সবাইকে ঠেলে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন অর্ক। চারদিকে একবার তাকিয়ে চীৎকার করে ড্রাইভারকে গাড়ীটা নিয়ে আসতে বললেন। স্থানীয় যুবকদের সহযোগিতায় অরিন্দম’কে পেছনের সিটে শুইয়ে দিলেন। রাস্তায় পড়ে থাকা সাইডব্যাগটা নিয়ে আলতো করে অরিন্দমের মাথা কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসলেন। ড্রাইভারকে পরমা আইল্যান্ডের দিকে ঘুরিয়ে কাছেই একটা কর্পোরেট হাসপাতালের নাম করে গাড়ি ঘোরাতে বললেন। প্রায় পনেরো বছর পর বন্ধুকে এভাবে দেখবেন ভাবতেই পারছেন না অর্ক। গাড়িতে বসে টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি ভিড় করে আসে।
ফ্ল্যাসব্যাক (কোলাজ)
ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে ব্রাইট ছাত্র অরিন্দম। সেই সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখার ফলে বেশ পপুলারিটি পেয়েছিল। অর্ক ছিল তার ছায়াসঙ্গী। ইউনিভার্সিটি পাট চুকিয়ে এক মামার সুবাদে ম্যানেজমেন্ট করতে অর্ক চলে যায় জার্মানি। এয়ারপোর্টে বিদায় দিতে এসেছিল অরিন্দম। বলেছিল; “এবার থেকে আমাদের দুজনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল রে...”। কথাটার মানে বুঝতে পারেনি সে সময়ে। সেই থেকে অরিন্দমের সঙ্গে দু’একবার যোগাযোগ হলেও, সেই যোগসুত্র ক্ষীণ হতে হতে ছিঁড়ে যায় একসময়। ফিরে এসে যোগাযোগ করার কথা মনে আসে নি অর্কর। অবশ্য বন্ধুবান্ধবদের মুখে শুনেছিলেন, বিতর্কিত লেখক হিসাবে বেশ নামযশ হয়েছে অরিন্দমের। বইপত্রও প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি। কর্পোরেট দুনিয়ায় থাকায় এ নিয়ে কোনোদিন উৎসাহ জাগে নি অর্কের।
“আ...গিয়া সাব...” ড্রাইভারের কথায় সম্বিৎ ফেরে অর্কর।
সিকুয়েন্স চারঃ সেন্ট্রাল জেল
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রক্তাক্ত অরিন্দমকে দেখে কিছু করার আগেই পুলিশে খবর দিল। চিকিৎসার জন্য হসপিটালের দাবী মেনে পঞ্চাশ হাজার টাকা পেমেন্ট করে দিলেন অর্ক। সই সবুদ করার পর কর্তৃপক্ষের লোকজন অরিন্দমকে নিয়ে গেলেন অপারেশন থিয়েটারে।
পুলিশ আসার পর...অর্কের পরিচয়, ঠিকানা, প্রফেশন, কীভাবে ঘটনা ঘটলো, প্রত্যক্ষদর্শী কারা ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেওয়া হয়নি কেন, ইত্যাদি প্রশ্নবাণে জেরবার অবস্থা...।
কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশদের মধ্যে তৎপরতা লক্ষ্য করলেন অর্ক। অপারেশন থিয়েটারের দরজার পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করাতে জানলেন, ইনটালিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে কোনও পদস্থ অফিসার আসবেন, তাই...
ইনটালিজেন্স ব্রাঞ্চ কেন? কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না অর্ক। ইতিমধ্যে কয়েকবার ফোন এসেছে কলিগদের কাছ থেকে। প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে মিটিংটা এক ঘন্টা পিছিয়ে দিতে বললেন।
নাঃ, আর দেরী করা ঠিক হবে না। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে...। অরিন্দমকে ওই অবস্থায় ফেলে রাখা ঠিক হতো না। পুলিশ ইন্সপেক্টটরকে বলে বিদায় নিতে হবে। অর্ক ওয়ালেট থেকে নিজের বিজনেস কার্ড বের করে ইন্সপেক্টটরকে দিতে এগিয়ে গেলেন ...।
“স্যরি মিস্টার, আপনি এখন যেতে পারবেন না”
“মানে ? আমি আপনার কাছে আমার, অফিসের ঠিকানা সব দিয়ে যাচ্ছি”
“আমি দুঃখিত, আমার কিছু করার নেই। ওপরওয়ালার নির্দেশ। আধঘন্টা বসুন, তার মধ্যে তাঁরা চলে আসবেন। প্লিজ, এ ব্যাপারে আমাকে অনুরোধ করবেন না।”
কেমন যেন মাথা ঘুরে যায় অর্কর। ধপ করে ইন্সপেক্টটরের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। আতঙ্কে চোখে অন্ধকার হয়ে আসে। গলার নেকটাই যেন ফাঁসির দড়ির মতো চেপে ধরে। গলা থেকে টান দিয়ে টাইটা খুলে ফেলে দেয়।
কিছুক্ষণের মধ্যে লালবাজার থেকে দু’জন উচ্চপদস্থ অফিসার এসে পড়েন। একবার আড় চোখে অর্ককে দেখে ইন্সপেক্টটরকে ডেকে নেয়। অফিসারকে দেখে অর্ক কিছু বলবে বলে উঠে দাঁড়ায়।
ইতিমধ্যে অপারেশন থিয়েটর থেকে সার্জেন্ট বেরিয়ে আসেন। ইন্সপেক্টটরকে ডেকে নেন, কিছু একটা বলেন। অর্কর সেই দিকে খেয়াল নেই, যে করে হোক ফিরতে হবে তার। ইতিমধ্যে একবার ফোন করেছিল বৃন্দা। ‘একটু কাজে আটকে গেছি, পরে কথা বলবো।’ মোবাইলের সুইচ অফ করে দিয়েছেন। এখন আর কথা বলার মত অবস্থায় নেই অর্ক।
অফিসার অর্কর সামনে এসে দাঁড়ায়। অর্ক কিছু বলার আগেই বলে, “আপনাকে আমাদের সঙ্গে একবার হেডকোয়াটার যেতে হবে”।
“কিন্তু আমি...” অর্ককে থামিয়ে দিয়ে অফিসার বলে “ভাববেন না, কিছু অফিসিয়াল ডেকোরাম আছে... কিছুক্ষণ পরেই ছেড়ে দেবো আপনাকে। চাইলে আপনার বাড়িতেও পৌঁছে দিতে পারি”।
সিকুয়েন্স তিনঃ পুলিশ হেডকোয়াটার
পুলিশ হেডকোয়াটারে নিজস্ব চেম্বারে অর্ককে বসায় গোয়েন্দা অফিসার মিস্টার এস. কে. কাপুর। চেম্বারে ঢোকার সময় পেতলের বোর্ডে লেখা দেখেছিলেন অর্ক।
“চা না... কফি?” খুব মোলায়েম স্বরে বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন মিঃ কাপুর। যদিও কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না অর্কের। এদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ, কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল অর্কের। তাই বলল “যা একটা কিছু দিলেই চলবে”
বেয়ারা দু’কাপ চা এনে সামনে রাখতেই মিস্টার কাপুর এক কাপ চা এগিয়ে দিলেন অর্কের দিকে।
“দেখুন মিস্টার... আপনি যাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন, তিনি একজন ‘আর্বান নকশাল’ অনেকদিন ধরেই ওয়ান্টেট।
“‘আর্বান নকশাল’!! মানে...? এখন তো...” অর্কের প্রশ্নের জবাব দেয় না মিস্টার কাপুর।
“আমাদের ধারণা, তিনি এই রাজ্যের সন্ত্রাসবাদীদের তাত্মিক নেতা। রিসেন্টলি আমাদের হোম মিনিস্টারের উপর যে আক্রমণ, সেটার মাস্টার মাইন্ড তাঁর”। অর্কর শরীরে যেন হিমশীতল স্রোত বয়ে যায়।
“সাধারণত এই ধরণের কেসে মানুষ পুলিশকে ফোন করে। কিন্তু আপনি তা করেন নি। আপনি কি তাকে চেনেন?”
“না, মানে ইউনিভার্সিটিতে আমার ক্লাসমেট ছিল। বহু বছর পর ওই ভাবে দেখলাম, তাই...”
“আমাদের ধারণা, আপনিও এর সঙ্গে কোনও ভাবে যুক্ত থাকতে পারেন। যতক্ষণ না আমরা আপনার নির্দোষের প্রমাণ পাচ্ছি, ততদিন আপনাকে আমাদের অতিথি হয়েই থাকতে হবে। চিন্তা করবেন না, আপনি যদি সত্যি নির্দোষ হন, তাহলে আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেড়ে দেব”।
“আমি কি আমার স্ত্রীকে ফোন করতে পারি?” অনেক কষ্ট করে কথাটা বললেন অর্ক।
“তা করতে পারেন। এ ব্যাপারে আমাদের কোনও আপত্তি নেই”। পকেট থেকে ফোন বের করে অন করতেই ফোন বেজে উঠলো বৃন্দার ফোন...
সিকুয়েন্স চারঃ সেন্ট্রাল জেল
প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল অর্ক সেন্ট্রাল জেলে। প্রথমদিকে অফিসের কলিগরা দেখা করতে আসতেন। মাস খানেক প্রায় দিনই আসতেন বৃন্দা। ফ্ল্যাটের ই.এম.আই দিতে না পারায় ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। বৃন্দা চাকরী নিয়েছেন একটা প্রাইভেট কম্পানীতে, মাসে দু’একবার দেখা করতে আসেন। তাদের একমাত্র পাঁচ বছরের পুত্র বৃন্দার মায়ের কাছে রেখে শহরতলীর নিম্নমধ্যবিত্ত পাড়ায় বৃন্দা ‘পেয়িংগেষ্ট’। বন্ধু অরিন্দম হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে এখন তার সঙ্গে, সেন্ট্রাল জেলের সেলে।
পরিশিষ্ট
কী করে যেন মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার হয়ে যায় অরিন্দমের গ্রেপ্তারের কথা। লেখকশিল্পী সংগঠন এবং মানব অধিকার সংগঠন একযোগে সরকারের অরিন্দমের বেআইনী গ্রেপ্তারের জন্য হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। শহরে জুড়ে মিটিং মিছিল সংগঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত প্রায় দুইমাস পর হাইকোর্টের নির্দেশে ছাড়া পায় অরিন্দম। আশায় বুক বাঁধে অর্ক...।
0 comments: