গল্প - দিলশাদ চৌধুরী
Posted in গল্পবৃষ্টি শেষ হতে চলল। যদিও এই বৃষ্টি থাকা না থাকা প্রায় সমান। মেঘ থেকে মাটি অব্দি না পৌঁছাতেই ফিনিক্সের মত যেন বাষ্প হয়ে আবার মেঘের কাছেই ফিরে যায়। দিনের বেলা আকাশ কালো হয়ে থাকে ঠিকই, কিন্ত যুতসই বৃষ্টি আসেনা। ছিটেফোঁটা পড়ে দুই এক দফা।তাতে অবশ্য লাভ কিছুই হয়না, শরীরের জ্বালাপোড়া বাড়ে। ঝুমিয়ে বৃষ্টি আসে রাত গভীর হলে, ঝিরিঝিরি অবিরাম চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে বাচ্চু। বৃষ্টি ধরে আসায় আকাশ পরিস্কার, এদিক ওদিক তারাও দেখা যাচ্ছে। আকাশটাকে দেখাচ্ছে বিরাট এক চিতই পিঠার মত, তারাগুলো যেন পিঠার উপরের ভিনিভিনি ছিদ্র। ভাদ্র মাস চলে এসেছে, তালের দিন ভাদ্রমাস। তালের শিরনি দিয়ে চিতই পিঠা মাখিয়ে যে একবার খেয়েছে, স্বাদ ভুলতে পারেনি। চোখ বন্ধ করে যেন চোখের সামনে দেখতে পায় বাচ্চু। রহিমা বসে আছে চুলার ধারে, খোলায় দিয়ে দিচ্ছে গোলানো চালের গুড়া। আরেক চুলায় তালের শিরনি গন্ধ ছড়াচ্ছে। সে টিনের পিরিচটা নিয়ে বসে আছে চুলার পাশে, তাকিয়ে আছে রহিমার ঘামে ভেজা মুখের দিকে।
আমনের সময় শেষ হয়ে যায়নি এখনও। জমি চষে, সার দিয়ে ধান বুনতে হবে। এক একর জমিতে তিনবারে আশি কেজি ইউরিয়া লাগে। প্রথমবার চারা লাগানোর ১৫/২০ দিন পর, দ্বিতীয় দফা ৩০/৪০ দিন পর আর শেষ দফা ৫০/৬০ দিন পর। ঝাঁকা দিয়ে লাউ আর শিমের বীজ পুতবে। ঘরের আর কি, ঘর তো জায়গায় দাঁড়িয়েই আছে। তবুও লাগলে নাহয় ঘরটাকেও একটু মেরামত করবে। রহিমা বহুদিন ধরে বলছিল পাকঘরের চালাটা গুছিয়ে দিতে। বেশি বয়সে বিয়ে করেছে বাচ্চু, রহিমার সাথে বয়সের ভেদ রয়েছে। যখন বয়স ছিল তখন বিয়ে করে দুটো পেট চালানোর সামর্থ্য ছিলনা। রহিমা যদিও তাতে অখুশি না, বেশ সেবাযত্ন করে। কোলে সন্তান আসল গতবছর, তাতেও ঘরের কাজকর্মের কোন এদিকওদিক হয়নি। নাহ, ধানের ফলন ভালো হলে রহিমাকে একটা নতুন শাড়ি দিতে হবে। দুই হাত মাথার নিচে দিয়ে চিত হয়ে পায়ের উপর পা তুলে চোখ বুজে যেন নতুন শাড়ি পড়া রহিমাকে দেখতে থাকে বাচ্চু।
বাচ্চুর ছেলেটা হয়েছে বাপের মতই কালো। কিন্তু ভারী সুন্দর গোটাগোটা চক্ষু। বাচ্চুর শাশুড়ি ছেলের নাম রেখেছিল কাজল, বাচ্চুর নাম বেশি পছন্দ হয়নি। কালো হলেই কি নাম কাজল রাখতে হবে নাকি! তবুও শাশুড়ির সম্মানে কাজল বলেই ডাকে। তবে সে কাগজে কলমে ছেলের ভালো নাম রেখেছে ইলিয়াস কাঞ্চন। বেদের মেয়ে জোছনা দেখে সে এত কেঁদেছিল যে সেদিনই ঠিক করে ফেলেছিল যে ছেলে হলে এই নায়কের নামেই নাম রাখবে। বাচ্চু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে নামের ভারে অনেক কিছু হয়। তার নিজের নাম মোহম্মদ বাচ্চু মিয়া, এজন্যই হয়ত সে চাষা। তার নাম বাচ্চু না হয়ে বচ্চন হলে তো সে নায়কই হয়ে যেত।
- কে? কে ওইখানে?
- আমি...
- আমি কে?
- দারোগা সাব, আমি বাচ্চু। বাচ্চু মিয়া।
- কোন গ্রাম?
- লহরকান্দি।
- লহরকান্দি?! লহরকান্দির তো সবাইরেই আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হইছে। তুমি এইহানে কি কইরবার লাগিছ টিনের চালের উপর শুয়ে ?
- ওই.. ওইযে.. মানে আশ্রয়কেন্দ্রে কতক সাংবাদিক আইছিল শহর থাইকে। হেরা কইল ২০০ টেকা দিব, নৌকায় কইরে হেগো লগে যাইয়ে ফটো তুলতে হইবে।
- আর কেউ আছে আশেপাশে?
- জানিনা সাব। আরও কয়েকজন আইছিল বুড়া বুড়া, মনে হয় অন্য গেরামের। আমারে কইল এই ডুইব্যা যাওয়া ঘরডার টিনের ওপর কপালে হাত দিয়া বইসে থাকতে। হেরা নৌকা দিয়া ছবি তুলব। হেরপর কইল তুমি এইখানে বসো, আমরা ছবি তুইলে আইসে তোমারে লইয়া যামু।তারপর তারা নৌকা লইয়া সামনে আগাইল। তারপর মনে হয় নৌকা ঘুরাইয়া অন্যদিক দিয়া চইলে গেছে, আমার কথা আর মনে নাই। ট্যাহাও দিয়া যায়নাই, কয়েন দেহি!
- আচ্ছা, আহো। নৌকায় উডে আহো। ভাগ্যিস বাইর হইছিলাম টহল দিতে। আহো, উডে আহো।
বাচ্চু নৌকায় উঠে পড়ে। চারিদিকে থইথই পানি, মাঝেমধ্যে জমাট আঁধারের মত ঘরের চাল আর গাছের ঝাকড়া মাথা দেখা যাচ্ছে।
- পানি নাইমা যাইব তো, দারোগা সাব?
- কি যে কও! পানি উঠছে আর নামে নাই এরাম হইছে কোনদিন! পানি নাইমা যাইব, পলি পড়ব, জমাট পলি। সোনা ফলব সোনা।
বানের উছলে ওঠা পানিতে ঘরহীন সঞ্চয়হীন বাচ্চুর চোখের পলি সোনা ফলার স্বপ্নে চকচকে হয়ে ওঠে।
0 comments: