0

উপন্যাসিকা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in





















১ 

অনেকদিন হলো স্নেহময় বাইরের বারান্দায় বেরোন না। বাইরে যেতে বড় অনীহা তাঁর। ঘর আর উঠোনের চৌহদ্দিতেই কেটে যায়। তিনি তো জানেন, রোগ রোগ করলে কি হবে, রোগ তাঁর মনে। কৃত্তিকা বহুবার বলেছে, বাবা, একটা ফোন কিনে দিই তোমায়। স্নেহময় মাথা নেড়েছেন। দরকার নেই। এখন এই অবসর জীবনে কি হবে ফোনে? ফোন করে কথা বলবার মতো লোক কই তাঁর? এখন কাউকে মনে পড়লে, ফোন করলে, তারা মনে করে বুড়ো মানুষ, না জানি কি আবার দরকার পড়ল! স্নেহময় বেশ আছেন তাই। কেউ কেউ যে একদম আসেনা তা নয়, তবে ওই আর কি। তিনি এখনও বেঁচে কিনা সেটাই দেখতে আসা। 

একা তিনি দিব্য থাকেন। কাগজ পড়েন। খেলার চ্যানেল খুলে খেলা দেখেন। শান্তি সকাল বিকেল রেঁধেবেড়ে দিয়ে যায়। তিনি বেশ থাকেন। মাঝেমাঝে মনে হয়, এমন একার জীবন যদি শুরু থেকে কাটাতে পারতেন তাহলে জীবনে অনেক কিছুই অনায়াসে পেরিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু হয়নি। 

আজ সকালে বিকাশ ঘুম থেকে ওঠার পর আর দাঁড়ায়নি। দেরি হয়েছে বলে চলে গেছে দোকানে। ওর চায়ের দোকান খুলতে দেরি হলে রোজকার বাঁধা কাস্টোমার চলে যাবে। লোকসান হবে। বিকাশের রোজ তাঁর কাছে থাকার কথাটা এখনও গোপন। রাতেবিরেতে কিছু হলে দেখবে কে? তাই নিজেই তিনি ব্যবস্থাটা পাকা করেছেন। ছেলেটা রাতে এসে চুপ করে নিজের চৌকিটায় শুয়ে পরে। সকালে উঠে বাথরুম সেরে চা করে। নিজেও খায়, স্নেহময়কেও দেয়। তারপর বেরিয়ে যায়। বিকাশ থাকাকালেই শান্তি চলে আসে। জলখাবার দিয়ে রান্না সারে। দুপুরের খাবার গুছিয়ে টেবিলে রেখে চলে যায়। যাবার সময় বলে যায়, সময় করে খেয়ে নিও। দেরি কোরো না। স্নেহময় মনে মনে হাসেন। এই দরদ যে নিতান্তই ওপর ওপর সে কি আর উনি বোঝেন না? বরং বিকাশ অনেকটা মায়ায় পড়েই আসে। নিজেরও সুবিধে আছে। বাড়ি ভাড়া বেঁচে গেলো। এইসব ভাবতে ভাবতে স্নেহময়ের মাঝে মাঝে নিজের ওপরে বিতৃষ্ণা আসে। কই? এত ছোট মন তো তাঁর ছিলোনা? 

এইসব নানান সাতসতেরোর মধ্যেও লেখাটা চলে। কৃত্তিকা জানেনা। ডাক্তারের বারণ। আপনি মাথায় কোনও ভার নেবেননা। অযথা ওসব সাহিত্য টাহিত্য অনেক হলো। এখন শুধু বিশ্রাম। স্নেহময় হাসেন। এরা কি জানে? না লিখলে তিনি কবেই মরে যেতেন! একটা বড়সড় চাকরি, নিজের বাড়ি, কৃতী সন্তান, ব্যাস। আর কিচ্ছু চাইনা জীবনে? 

সবে সকাল ফুটি ফুটি করছে। বিছানায় থেকেই তিনি ফোনের আওয়াজ পাচ্ছেন। নাহ, একদম ধরবেন না। এই সাত সকালে উঠে মেয়ের অজস্র নির্দেশ শুনতে হবে। রোজ যেমন শুনতে হয়। তিনি পাশ ফিরে শুলেন। বেলার ফোন ধরবেন। বিকাশ চান করছে। উঠোনে শব্দ হচ্ছে জলের। ছেলেটা থাকতে থাকতে কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। চান করতে করতে উঠোনের ধারের কটা গাছে জল দেয় বালতি করে। উঠোনটা ধুয়ে ফ্যালে। চান সেরে রান্নাঘরে ঢুকে চা বসায়। নিজের চৌকির মাথার কাছে দুটো ছবি রেখেছে। সেখানে একটা ধুপ জ্বালে। খুব ভক্তিভরে চোখ বন্ধ করে নমস্কার করে। চা করে এনে স্নেহময়কে ডাকে। কাকু উঠে পড়ুন। চা খেয়ে বাথরুমে যান। স্নেহময় লক্ষ করেছেন, ছেলেটা তাঁর বাথরুম থেকে বেরোনো অবধি নানা ছুতোয় সময় কাটায়। কে জানে কেন। 

আজ অবশ্য বিকাশ বেরিয়ে গেছে। মাথার কাছে চায়ের পট রাখা। 

রাস্তার দিকের জানলাগুলো বন্ধই থাকে। এত ধুলো ধোঁয়া যে তাঁর শরীরের জন্য খারাপ। কোনোরকম ইনফেকশন হলে খুব মুশকিল। তিনি ভেতরের দিকে তাকান। ঘরের পরে দালান। তারপরে উঠোন। উঠোনের ধারে ধারে আম আর নারকেল সুপুরির গোটাছয়েক গাছ। কোনও ফুলের গাছ নেই। কিন্তু ওই গাছগুলোতেই এমন ছায়া ফেলে রাখে যে সূর্য মাথার ওপরে না উঠলে উঠোনে তত আলো থাকেনা। এই আলোআঁধারির পৃথিবী তাঁর প্রিয়। তিনি নীচু কাঠের ডেস্কটা বুকের কাছে টেনে নেন। 

ফাইলে আটকানো সাদা কাগজের দিস্তা। তিনি এখনও ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করেন। এ লেখাটা সবে শুরু করেছেন। তেমন বেঁধে ওঠেনি। কিন্তু শুরু করে দিলেন। খুব ভেবেচিন্তে প্লট তৈরি করে লেখেননা। লিখতে লিখতে নদীর ধারার মতো লেখা বয়ে যায়। আগাম হদিশ ছাড়াই বয়ে যায় নিজের খেয়ালে। এই স্পন্টেনিটি তাঁর নিজস্ব। 

লেখা শুরু করতে গিয়ে হঠাৎ চোখ গেলো সামনের ক্যাবিনেটে। ছেলেটার সাদাকালো ছবিটায় ধুলোর আস্তরণ জমেছে। উঠে পড়লেন। ধীরে ধীরে ছবির কাঁচ মুছে তাকিয়ে রইলেন খানিক। তাঁর মতন কি দেখতে ছিল? স্মৃতি এত তাড়াতাড়ি ঝাপসা হয়ে যায়? ডানদিক থেকে স্মিতার রঙিন ছবি উঁকি মারে। স্মিতা বেশ গেলেন। রোগে তত ভুগলেন না। স্নেহময় নিজেকে আবার ফিরিয়ে আনলেন। বেশ কাটে তাঁর। 



রোশনি অটো থেকে নেমে গলিটুকু পেরিয়ে যায়। বান্দ্রার অফিস থেকে রোজ এতটা পথ আসতে বেশ কষ্ট। তবু আসে মাঝে সাঝে। বন্ধ ঘরটা খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকতেই সেই সোঁদা গন্ধটা নাকে আসে। জানলা খুলে দিয়ে পর্দা সরিয়ে দেয়। একরাশ আলো ছিটকে পড়ে মেঝেয়। সেই আলোয় রোশনি দেখতে পায়, ধুলো জমেছে। কোথা থেকে যে বন্ধ ঘরে ধুলো ঢোকে! কিচেনে গিয়ে ট্যাপ চালিয়ে দেয়। সিঙ্কের ধুলোটা ধুয়ে যাবে। এক কাপ কফি খেতে গেলে এরকম টুকটাক পরিষ্কার করে নিতেই হবে। তারপর এপ্রন পরে ছোট্ট ফ্ল্যাটটা সে পরিষ্কার করতে শুরু করে। এই এক বেগার কাজ। কিন্তু আজ ছ’টা বছর হয়ে গেলো, সে এই বেগার খেটে চলেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ওড়নায় কপালের ঘাম মুছে সোফাটায় বসে পড়ে রোশনি। সোফার পাশেই সাইড টেবিলে রাখা ছবিটা। সে আর ইন্দ্র। ইন্দ্রজিৎ সান্যাল আর রোশনি সিং। ইন্দ্র যাবার পর সে আর এই ফ্ল্যাটে থাকেনা। রোশনি ছবিটা প্রতিবারের মতোই খুঁটিয়ে দেখে নেয়। ইন্দ্র কি ওকেও বিশ্বাস করতে পারলনা? সেদিনের কথাটা ঘুরেফিরে মনে আসে। 

আজ হাতে সময় আছে। সাউন্ড রেকর্ডিং এর কাজটা রোশনি প্রতাপ ভাইকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে। এসব ডকু ফিল্মের রেকর্ডিংএ প্রতাপ ভাই বেশ নিখুঁত কাজ করেন। রোশনি মনে মনে হাসে। ইন্দ্রর জন্যই ও এখনও ডকুমেন্টারি বানাবার বরাত পায়। কে চিনত ওকে? ইন্দ্র না থাকলে? ইন্দ্র। ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটা এসেছিল কলকাতা থেকে। তখনই সে ছোটখাট ছবি বানায়। প্রথম দেখায় রোশনির ওকে খুব দাম্ভিক মনে হয়েছিল। নিজেকে যেন আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড মনে করে। একমাথা কোঁকড়া চুল। কেয়ারলেস সাজপোশাক। টিপিকাল বাঙালি। বম্বের ইন্ডাস্ট্রিতে এসে কিন্তু সব্বার চেঞ্জ হয়। শুধু ইন্দ্র পাল্টায়নি। ওই বাঙালি ফ্লেবারটা নাকি ওর ইউএসপি। রোশনিও তখন লড়াই শুরু করেছে। দুজনে একসঙ্গে এই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। রুম শেয়ারিংএর কথাটা তখন কেউই বাড়িতে জানায়নি। বম্বের মতো জায়গাতে খরচ সামলাতে ওরা যা করেছিল সেটা বাড়িতে বললে কেউ বিশ্বাস করতনা। সেসময়ে এভাবে লিভ ইন করার কনসেপ্ট কেউ একসেপ্ট করতে পারতনা। ইন্দ্রর বাবা ফোনে যখন কথা বলতেন, কিংবা বম্বে আসছেন বলে জানাতেন তখন রোশনিকে চলে যেতে হতো কোনও বন্ধুবান্ধবের হোস্টেলে। উনি চলে গেলে আবার ফ্ল্যাটে ফিরত। উনি যদিও ফ্ল্যাটে থাকতেননা, উঠতেন কোনও বড়সড় হোটেলে, তবু। ইন্দ্রকে ডাকতেন ওনার সঙ্গে থাকতে। ইন্দ্র যেতনা। নিজের জেদ ছেড়ে বেরতে পারলনা মানুষটা। 

রোশনি আদরে মুছতে থাকে ছবিটা। কাল ফ্লোরে বাচ্চা এক্ট্রেস মেয়েটা বলছিল, আন্টি তোমাকে টায়ার্ড দেখাচ্ছে। বয়স তো হচ্ছে! নিজের জন্যেও তো দৌড়ে চলেছে রোশনি। একটা আলগা হাসি শুধু হেসেছে মেয়েটার কথা শুনে। ছেলেমানুষ। চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে স্বপ্ননগরীতে এসেছে। কুড়িটা বছর যদি চলে যায় তখন বুঝতে পারবে। অবশ্য ছ বছর আগে রোশনিকে আর এরকম লড়াই করতে হতোনা। বেশ শক্ত জমি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। শুধু ইন্দ্রর জন্য...। আবার যেন শুরু করতে হয়েছে লড়াইটা। সেই ঘটনার পর কাজ পাওয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কয়েকজন প্রকৃত বন্ধু না থাকলে রোশনি যে কি করত! বাড়ি ফেরার রাস্তা তারও বন্ধ বহুদিন। খারাপ মেয়ে। বিয়ে ছাড়া একটা লোকের সঙ্গে থাকে। ইন্ডাস্ট্রিতে এসব চলে। তাই বলে পরিবার মানবে? ইন্দ্রর বাবার কাছেও খবরটা চাপা থাকেনি। ভদ্রলোক একটু অদ্ভুত। ছেলে সম্পর্কে খুব দুর্বল। মেনেছেন কি মানেননি সে কথা পরিষ্কার করে বলেননি কোনোদিন। তবে ইন্দ্র কলকাতা যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল। রোশনির ভালোই। একা থাকতে হতোনা। 

ইন্দ্রর টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে দেখতে থাকে। যদিও এখানে এলেই সে ড্রয়ার ঘাঁটেনা। কিন্তু আজ যেন কেমন নেশায় পেয়েছে। ফাইলগুলো একটার পর একটা সাজানো। প্রতিটা ফিল্মের আলাদা আলাদা ফাইল। ভেতরে স্ক্রিপ্ট, কিছু স্টিল, কিছু চিঠি, এগ্রিমেন্টের কপি, সব থাক থাক সাজানো। একটার পর একটা ফাইল নাড়তে থাকে রোশনি। নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে আসে সেই সবুজ রঙের কভার ফাইল। সেই স্টিল ছবিটা। রোশনির চোখ জ্বালা করে। হট প্যান্ট আর ক্রপ টপ পরিহিত একটি মেয়ে। কি সরল মুখখানা! ওই প্রজেক্টে ও সিলেক্টেড হয়েছিল। একটা সাবানের অ্যাড ফিল্ম ছিল। বেলের শব্দে রোশনি উঠে দাঁড়ায়। ফ্ল্যাটের কলাপ্সিবল খোলা দেখে কেউ বেল দিয়েছে। ভাড়া তো ব্যাঙ্কেই জমা পড়ে। কে এসময়? 

ফ্ল্যাটের দরোয়ান এসে দাঁড়িয়েছে। দিওয়ালির বখশিস চাই। রোশনি টাকাটা এগিয়ে দেয়। এবার তাকেও বেরোতে হবে। ফাইলটা নিয়ে বড় সাইড ব্যাগে রাখে। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেয়। সব জানলা বন্ধ করে বেরিয়ে আসে। ফ্ল্যাটে চাবি দিয়ে অটোর জন্য হাঁটা শুরু করে। গলির মধ্যে এই দুপুরে অটো কম।


৩ 

-এই দাঁড়াও। রুটের অটোটাকে থামিয়ে নিলো বর্ষা। ভরদুপুরে লোকজন কম। অটোঅলা গড়িমসি করে চলছে। -কোথায় যাবেন? বর্ষা শুকনো উত্তর দেয়। রুটের অটো তাও কত মেজাজ। দশ টাকা লাগবে। অটোঅলা ঘ্যাঁচ করে স্টার্ট দেয়। -কেন? রোজ সাত টাকাতে যাই তো! –কটা লোক দেখেছেন? আপনাকে একা নিয়ে যেতে হলে কত টাকার তেল পুড়বে জানেন? শুধু রোয়াব দেখাতে জানেন। বর্ষা বিরক্তিতে ভরে যাচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। এই রোদ্দুরে হেঁটে হেঁটে এতটা পথ যেতে কষ্ট হবে। 

অটো থেকে নেমে বর্ষা আনমনে হাঁটতে শুরু করে। মাথাটা নীচু। আপনমনে হিসেব চলেছে। বুটিকের কস্তুরীদি আজ অনেক কাজ নিয়ে বসে আছেন। সকালেই বর্ষাকে বলেছেন। হাতে অনেকটা সময় নিয়ে এসো কিন্তু। নতুন মালপত্রগুলো সব ট্যাগ করতে হবে। সাজাতে হবে। সব তো শো করা হবেনা। তবুও। চৈত্র পরতে চলেছে। লোকে আসবে কিনবে। বাঙালি এখন নতুনভাবে নববর্ষ পালনে মেতেছে। বর্ষা শুনেছে ওদের বুটিকের সামনের ফুটপাত আর রাস্তা জুড়ে আল্পনা দেওয়া হবে। এবারের রেঞ্জের থিমও সাদা লাল। সঙ্গে সবুজ আর হলুদ কম্লার ব্রাইট কম্বিনেশন থাকছে। কাঁথা, এপ্লিক, আর ফেব্রিক দিয়ে কম্বিনেশন শাড়ি। কস্তুরীদি আবার তাঁতিকে দিয়ে শাঁখ আর পদ্মফুলের পুরনো নকশা তুলিয়েছেন। এখানে হিট হলে বিদেশের দরজা খোলা। বর্ষার এসবে কিছু এসে যায়না। ও মাস মাইনের সামান্য কর্মচারী। এইটুকুতেই মা আর মেয়ের সংসার জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হয়। 

বর্ষার মনে হলো, ও বেশ অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছে কিন্তু। এতটা সময় তো লাগেনা? অটো থেকে নেমে কয়েক পা এগোলেই তো চওড়া গলিটা পড়ে। সেখানে ঢুকলেই ওদের কস্তুরী বুটিক দেখা যায়। কিন্তু এ ও কোথায় এসেছে? রাস্তাঘাট এতটা অচেনা তো হতে পারেনা? বর্ষার কান্না পেলো। এমন জায়গায় এসে পড়েছে যে বড় রাস্তাটা বেশ দূরে। এই দুপুরে বাস অটো পাওয়া তো দুরূহ! বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ও ধপাস করে একটা বাড়ির বন্ধ জানলার তলায় বসে পড়ল। ফোনটা বের করে কস্তুরীদির নাম্বার ঘোরাতে গেলো। কিন্তু ফোন লাগলোনা। কি যে হয়েছে আজকাল! নেটওয়ার্কের সমস্যা। অর্ধেক সময় ফোন লাগেনা। কিন্তু আজকের দিনটা বেশ জটিল। বুটিকে পৌঁছতেই হবে। হতচ্ছাড়া অটোঅলা যে কোথায় নামিয়ে দিলো! এদিকে বলল এই রুটেরই অটো, আর নামাল কোনখানে কে জানে। সবুজ উড়নিটা দিয়ে বর্ষা মুখ মুছল। এ পাড়াটা বেশ চকচকে। রাস্তায় কোনও লোকজন নেই। কিন্তু কাউকে তো জিজ্ঞেস করতে হবে যে এটা কোথায় এসেছে সে! অগত্যা বন্ধ জানলায় ঠকঠক করল বর্ষা। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও শব্দ এলোনা। মহা মুশকিল। কলিং বেল খুঁজতে গিয়ে বাড়িটার পাশে গলিটায় ঢুকে এলো সে। আর তখনই চোখে পড়ল। ভেতরের জানলাটা খোলা। সেই জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সেই চির পরিচিত মুখ। চমকে উঠল বর্ষা। এ কি করে সম্ভব? ঝাঁকড়া চুলের বোঝা মাথায় মানুষটা বুকের কাছে ডেস্ক নিয়ে বসে লিখে চলেছেন। চশমার ফ্রেমটা পর্যন্ত তেমন মোটা, কালো। বর্ষা হতবাক হয়ে গেছে। সে ডাকতে গেলো- মামন! তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো কিনা কে জানে, সেই মুখ কিন্তু উঠলনা ডেস্ক থেকে। বর্ষা যেন দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছেনা। শরীর ঝিমঝিম করছে। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিরশিরানি নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। ওর গায়ের কামিজটা ঘামে সপসপে হয়ে গেছে। খানিকক্ষণ এভাবেই কেটে গেলো। ধীরে ধীরে পায়ের শক্তি ফিরে পেতে সময় লাগল। গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ছুটছে। বর্ষা বেরিয়ে এলো। গলির মাথা পর্যন্ত তো তাকে হাঁটতেই হবে। বেশ অনেকটা। কি করে যে সে এমন ভুলোমনে চলে এলো এখানে। কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘটনা কিছুতেই মন থেকে সরছেনা তার। 

বড় রাস্তায় পড়েও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা বর্ষা। না কস্তুরীদির ফোন পাওয়া গেলো, না সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া গেলো। মাঝখান থেকে মামনকে দেখে বর্ষা যেন ঘোরের মধ্যে ঢুকে গেছে। ঠিক তখনই সেই অটোঅলাটাকে চোখে পড়ল। নিশ্চয়ই ফিরছে এখন। খুব রাগ হলো বর্ষার। এই!! কোথায় আনলে আমাকে? চিৎকারের চোটে অটোঅলা ব্রেক কষলো। তীব্র দৃষ্টিতে দেখল ওকে। কেন? আপনি যেখানে যেতে চেয়েছেন সেখানেই নামিয়েছি। বর্ষা রেগে বলে উঠল- এটা ঠাকুর দাস লেনের মুখ? ঠাট্টা হচ্ছে? অটোওলা ইশারা করল উঠে বসতে। তার হাবভাবে একটা তাচ্ছিল্য ভাব। তবু বর্ষা রেগে উঠতে পারলনা। অটোটা গড়িয়ে এক কিলোমিটার গিয়েছে কি না গিয়েছে, গাড়ি থামিয়ে নেমে যেতে বলল অটোওলা। বর্ষা নেমে গিয়ে দেখল ঠিক ঠাকুর দাস লেনের মুখে সে দাঁড়িয়ে। 

ফোনে শব্দ হতে দেখল, কস্তুরীদির বারোটা মিসড কল। আশ্চর্য! খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে সে ঢুকে এলো বুটিকে। সাদা পালিশকরা ফ্লোরের ওপরে তখন নানা ধরনের শাড়ির স্তুপ। কস্তুরীদি একটা টুলে বসে এক এক করে মিলিয়ে নিচ্ছে। সামনে বসে শ্বেতা সরিয়ে রাখা শাড়িগুলোকে ভাঁজ করছে। ভেতরে এসির ঠাণ্ডায় ঢুকে বর্ষা একটু আরাম পেলো। কস্তুরীদি চোখ তুলে তাকাতেই বলে উঠল-স্যরি দিদি। ভুল করে দুটো স্টপেজ এগিয়ে গেছিলাম। কস্তুরীদির গলায় রাগ নেই, বিরক্তি আছে- দেরি খুব হয়নি যদিও, কিন্তু আমি বারবার ফোন করছি তুমি ধরছনা। বর্ষা হাঁফ ছাড়ল- ওঃ, সে তো সিগন্যাল ছিলনা। কস্তুরীদির কাছে বসে পড়ে এবার একটা একটা শাড়ি তুলে দেখতে লাগল বর্ষা। দিদির ওর ওপরে খুব ভরসা। ও কাপড়ের কোয়ালিটি চেনে ভালো। কোন তাঁত কত সুতোয় বোনা, সুতোর স্ট্যান্ডার্ড কেমন, এসব বোঝে। সিল্ক হাতে ধরে বলে দেয়। আর নকল তো চোখে দেখেই বলে। কস্তুরী অবশ্য সব ধরনের শাড়িই রাখেন। কমা বা নকল সিল্কের ওপরে একটু মোটা দাগের কাজ করিয়ে রাখেন। যারা তেমন খরচ করতে রাজি নয় তাদের জন্য। বর্ষা বসে বসে সব ধরনের শাড়ির আলাদা আলাদা থাক করতে লাগল। কোনও কোনওটা আবার খানিক কাজ হয়েই এসেছে। এখানে ওয়ার্কশপে বাকি কাজ করিয়ে এক্সক্লুসিভ করা হবে। শাড়ি ঘাঁটতে গিয়ে একটা র সিল্ক হাতে পড়ল বর্ষার। সেটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কস্তুরীদির পেছনে উঁচু তাকে সরিয়ে দিলো। কস্তুরী জানেন, ও শাড়িটা তার মানে অনেক দামী। কি মনে হতে বর্ষার দিকে তাকালেন। মেয়েটা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে। এরপর রঙ বাছাইয়ের কাজ আছে। এমন অন্যমনস্ক হলে তো মুশকিল। জিজ্ঞেস করলেন- কি হয়েছে বর্ষা? কোনও প্রবলেম? মা ভালো আছে? দাদা ফোন করেছিল? প্রথম দুটো প্রশ্ন নিরীহ। শেষ প্রশ্নে বর্ষা তেতো উত্তর দিলো। দাদা কি ফোন করে দিদি? খোঁজ নেয় আমাদের? কস্তুরী মাথা নামালেন। কি যে সব ছেলে! ওরকম একজন মানুষের ছেলে আর কি স্বার্থপর! এই মেয়েটা যে কিভাবে মাকে বাঁচিয়ে রেখেছে! কস্তুরী নেহাত চেনেন এদের। তাই নিজের কাজে টেনে নিয়েছেন। মেয়েটার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে কাপড় চেনার। তারপর তো কস্তুরী ওকে নিজের মতো সব শিখিয়ে নিয়েছেন। 



কল্লোল তোর ফ্ল্যাটে গেস্ট রুম খালি আছে? সৈকত জানতে চাইল। কেন বলতো? এই এক সমস্যা। তার ফ্ল্যাটটা একটু স্পেশাস বলে মাঝেমাঝেই বন্ধুদের গেস্টকেও থাকতে দেওয়ার আবদার আসে। এই নিয়ে তন্বী রাগারাগি করে আজকাল। কি এক মাগুন্তুরে স্বভাব বাঙালিদের। নিজেরা এডজাস্ট করে থাকো! অন্যের বাড়ির গেস্টরুম খালি কিনা চোখ দিয়ে বসে থাকা! ওদিকে বিদেশে এসে সব কিরকম সাহেবসুবো হয়েছে। এদিকে কাঙালেপনা গেলনা। তন্বীর কথা মনে করেই কল্লোল বলে ফেলল- এ সপ্তাহে আমাদেরও গেস্ট আসতে পারে। কথা শেষ হতে না হতেই সৈকত জোরে হেসে ফেলল। সে হাসি একেবারে থামতেই চায়না। কল্লোল বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল- এত হাসির কি আছে শুনি? নেহাত ক্যাফেটেরিয়া, নয়ত তোর এরকম অদ্ভুত হাসিটা শুনে সবাই কি ভাবত? সৈকত কোনোরকমে যেন খুব কষ্ট করে হাসি চাপতে চাপতে বলল- তোর বাড়িতে আমি আজ পর্যন্ত কোনও গেস্ট দেখিনি। মাইরি বলছি। আমরা বলাবলি করি শালা কর্তাগিন্নী দুটোই নিশ্চয় অনাথ নয়ত ত্যাজ্য। কেউ আসেনা! সৈকত হাসিমুখটা এরপর কালো করল- অবশ্য একদিক দিয়ে ভালো। তোদের জমে যাবে অনেক। আমাদের তো অতিথি আপ্যায়নেই গলে যায়। কথা কটা বলেই সৈকত খ্যা খ্যা করে হেসে বেরিয়ে গেলো। ল্যাপটপটা বিরক্তিতে বন্ধ করে দিলো কল্লোল। এরা কি জানবে? আজ যে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা ওই একপ্রকার অনাথ বলেই। বাড়ির দিক থেকে কোনও সাহায্য ছিল নাকি? হতিস শিল্পী বাবার সন্তান, বুঝতিস কত ধানে কত চাল। কর্তব্যজ্ঞানহীন। এখন সে দাঁড়িয়েছে। ভালো আছে। কিন্তু তারই বা কোনও কর্তব্য থাকবে কেন? কেন পারিবারিক দায়িত্বের বোঝা সে ঘাড়ে নেবে? বাবা নিয়েছিল? তবে বর্ষার জন্য মাঝে মাঝে ভাবনা হয়। কে জানে ওকে কিভাবে রেখেছে! বেচারা বোনটা। কিন্তু কল্লোল সে খোঁজ নেবার চেষ্টাই করেনা। যার যেমন কপাল। ওর কপাল আর অধ্যবস্যায় থেকে আজ ও এখানে। বর্ষার যদি চেষ্টা থাকে তবে নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কল্লোলের কি দায়? এই তো সেদিন এক ফেসবুক বান্ধবী লিখলেন। ইমিডিয়েট ফ্যামিলি মানে বউ আর ছেলেমেয়ে। ব্যাস। বাবা মা এক্সটেনডেড ফ্যামিলি। ভিসা নরম্যালি হয়না। আর ভাইবোন তো ডিসট্যান্ট ফ্যামিলি। প্রশ্নই নেই। কল্লোলের পোস্টটা খুব ভালো লেগেছিল। সে ওয়াও সাইন দিয়েছিল। তার কোনও বিবেকের দংশন নেই। স্বার্থপর হতে পারলে আজকের দুনিয়ায় সারভাইভ করা সোজা। নয়ত একটা মোটামুটি জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে থাকতে হয়। ফোনে মেসেজের টোন শুনে কল্লোল চোখ রাখল। তন্বীর মেসেজ। এই উইকেন্ডে একটা স্পট ঠিক করে ফেলেছে। জঙ্গলের মধ্যে একটা ঝর্ণার পাশে ক্যাম্প করবে। এদেশে ঠিক তেপান্তর বলে কিছু নেই। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বোধহয় এ জায়গাটাতে কেউ আসেনা। যোগাযোগ অতি ক্ষীণ এর সঙ্গে লোকালয়ের। কিন্তু তা নয়। যত দুর্গমই হোক না কেন ঠিক কমিউনিকেট করা যায়। সেরকমই একটা জায়গার ছবি দিয়েছে তন্বী। দুজনে মিলে গাড়ি নিয়ে চলে যাবে।

মন ভালো নিয়েই বাড়ি ফিরেছে কল্লোল। ওর চেয়ে তন্বীর গাড়িটা বড়। মাথার ওপরে ক্যাম্পের সরঞ্জাম, ছোট বোট অনায়াসে বয়ে নেওয়া যায়। আজ বৃহস্পতিবার। অতএব গ্রসারি থেকে প্রয়োজনীয় বাজার সেরে ফেলতে হবে। প্যাক করে রাখতে হবে। কিচেনে ঢুকে তন্বীর পোস্ট-ইট নজরে এলো। শুকনো খাবার বেশি করে। ঝর্ণার জল খাওয়া যাবে। এক্সট্রা টায়ার একটা দেখে রাখতে হবে। রাস্তাটা জঙ্গলের মধ্যে ন্যাচারাল রাখতে ওরকম এবড়োখেবড়োই রাখা আছে। কল্লোল বেশ উৎসাহ পেলো। যে কথাটা ও তন্বীকে বলতে পারেনা তা হলো, আজকাল বড্ড ডিপ্রেসান হচ্ছে। সেই এক জীবন। সকাল থেকে বিকেল গড়িয়ে রাত। বেড়াতে তারা যায়, তবে এডভেঞ্চার হয়না সেটা। এই প্রথম একটা এডভেঞ্চারের গন্ধ আসছে যেন। 

শুক্রবার সন্ধ্যেয় বেরিয়ে পড়া গেলো। তন্বীই ড্রাইভ করছে। ওর ছোট্ট করে কাটা চুলে একটা ব্যান্ড লাগানো। হাতকাটা একটা টপ আর শর্টস পরে, পায়ে স্নিকার তন্বী একদম মুডে। জঙ্গল এলাকা শুরু হয়ে গিয়েছে। এখানে খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। মাঝেমধ্যেই বন্য জানোয়ার রাস্তার মধ্যে চলে আসে। বড় বড় করে সাইন দেওয়া আছে। হরিণের চলার রাস্তা। তন্বীর গাড়ি কিছুক্ষণ থামিয়ে দিতে হয়েছিল। এক ঝাঁক হরিণ দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে গেলো। রাতে এই পথে আলো নেই। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখা গেলো। শেষ পর্যন্ত কাছাকাছি শেষ জনপদে ডিনার সেরে একটা মোটেলে উঠলো ওরা। ভোরের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়বে। এই মোটেলটা বাকি হাইওয়ের ওপরের মোটেলের মতোই বেশ শুনশান। দুজনে দিব্যি গাড়ির গায়ে দুটো ফোল্ডিঙ চেয়ার পেটে বসে আছে। আর তখনই একটা ফেরারি এসে থামল। মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তন্বী বলে উঠল- ওঃ! নিশ্চয় ওই এক জায়গায় ক্যাম্প করবে। সেই মানুষের ভিড়। বিরক্তি। এদিকে তো আর ডেসটিনেসান নেই! চাপা গলায় বললেও কল্লোল অস্বস্তি বোধ করছে। শুনতে পেলে কি হবে? ফেরারির দরজা খুলে কিন্তু একা একজন আরোহী নেমে এলো। আরোহী ঠিক নয়, আরোহিণী। তন্বী আর কল্লোলের চেয়ে বয়সে বেশ কিছুটা ছোট মনে হলো। একটি মেয়ে একা এডভেঞ্চারে! কল্লোল এখনও একটু রক্ষণশীল। এটা অবশ্য তন্বীর সামনে বলা যাবেনা। মেয়েটি পেছন ফিরে গাড়ি বন্ধ করছিল। সামনে ঘুরে এদিকে এগিয়ে আসতে কল্লোল লক্ষ করল, বড্ড চেনা লাগছে যেন! কি করে? স্পষ্ট করে দেখা যেতেই কল্লোল চমকে উঠলো। একি? মেয়েটি নিজেই এগিয়ে এসেছে। তন্বীর নির্লিপ্ত ভঙ্গীর সামনে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। হাই, দিস ইজ ভারসা। আয়াম ফ্রম রাশিয়া। কল্লোল একটি কথাও বলতে পারছেনা। এ মেয়ের নাম বর্ষা! রাশিয়ার মেয়ে! অথচ দেখতে তো ঠিক কল্লোলের বোন বর্ষার মতোই! আর মতোই বা কেন? এ তো বর্ষাই! একশো বার বর্ষা। কিন্তু এমন আপাদমস্তক পাল্টে যাওয়া বর্ষাকে কি বলবে ভেবে না পেয়ে সে বলে উঠল- ইউ রিসেম্বল এ লট উইদ মাই সিস! মেয়েটি হাসল। একটা গজ দাঁত বেরিয়ে এলো। বর্ষার গজদাঁতটা ও কি করে ভোলে? কল্লোলের একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। তন্বী কিছুই বুঝতে পারছেনা। রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে বলে উঠল- চলো, লেটস মুভ। দেরি হয়ে যাচ্ছে। 

ঘরে ঢুকেও শান্তি হচ্ছেনা। এ কি করে সম্ভব? বর্ষা এখানে এলো কি করে? এ মেয়েটি বর্ষাই। নিজেকে দারুন পাল্টেছে কিন্তু! একেবারে রাশিয়ান বলে পরিচয় দিচ্ছে। ভাঙা ভাঙা ইংরিজি দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ নতুন শিখেছে ভাষাটা। হতেই পারে কল্লোলের খোঁজে এসে পড়েছে এখানে। অদ্ভুত লাগছে কল্লোলের। একটু রাগও হচ্ছে। এসেই যখন পড়েছিস এত দূর, তখন দাদার কাছে নিজেকে লুকিয়ে কি লাভ? যাক, সকাল হলে বরং আড়ালে গিয়ে ধরা যাবে ওকে। 



দীপ্তির হয়েছে যত জ্বালা। অভাব তাঁর চিরকালের সঙ্গী। তবু প্রীতিময় থাকতে একটা সামাজিক অস্তিত্ব ছিল। সেটা বেশ প্রবলই ছিল। লেখকের খ্যাতি তো যথেষ্ট ছিল প্রীতিময়ের। তবে খ্যাতি থেকে অন্ন আসতনা। দীপ্তির মনে পড়ে, ছেলেমেয়ে দুটোর মধ্যে মেয়েটা চিরকাল বাপ মায়ের ওপরে টান। বাবার যেমন প্রতিভা ছিল মেয়েটারও ছিল। আর তাই জন্যই কস্তুরী ওকে ডেকে নিয়েছে। ভাগ্যিস ডেকেছে, তাইতে দুবেলা দুমুঠো খাদ্য জুটছে মা মেয়ের। এ বাড়িটা আজ বছর চল্লিশেক হলো। তখনও দীপ্তির বিয়ে হয়নি। প্রীতিময়ের প্রথম উপন্যাস দারুন হইচই ফেলল। প্রকাশক আনন্দে গদগদ। এ বাড়িটা উনিই দিয়েছিলেন। পরিবর্তে প্রীতিময়ের আগামী পাঁচ বছরের সমস্ত লেখার সত্ব কিনে নিয়েছিলেন। যাই হোক, ওনার জন্যই শেষ পর্যন্ত একটা মাথা গোঁজার জায়গা হয়েছিল। মনটাকে বেশি নাড়াচাড়া করতে ভালো লাগেনা। তবু মনে পড়ে। পুরনো বাড়িটা কেনা হয়েছিল। দীপ্তি যখন এলেন, প্রীতিময় হেসে বলেছিলেন, লিখে এর চেয়ে বেশি আশা করা যায়না। দীপ্তি জবাব দিয়েছিলেন, কেন? সুবিমল গাঙ্গুলী যে বিদেশে যান? সাহিত্য সভার ডাক আসে কত? তোমার কেন সেরকম অবস্থা হবেনা? প্রীতিময় হো হো শব্দে হেসেছিলেন। ওঃ! তুমি তাহলে মনে মনে ভেবেই রেখেছ যে আমি বিদেশে নিয়ে যাবো তোমায়? অপ্রস্তুত দীপ্তি নীচু স্বরে বলেছিলেন, তা নয়, তবে স্বচ্ছল জীবন, একটু আধটু সুখ তো আশা করাই যায়। প্রীতিময় গম্ভীর হয়েছিলেন- না, আশা করা উচিত নয়। অনেক কিছুর সঙ্গে আপোষ করতে হয় তাহলে। এই যে মিত্রবাবু বাড়িটা দিয়েছেন, পরিবর্তে আমার পাঁচ বছরের সব লেখা কিনে নিয়েছেন, সেটা বুঝতে পারছ? পাঁচ বছরে যা লিখব তাইই হয়ত আমার সারা জীবনের সৃষ্টি। একটা মানুষ কি অবিরত লিখে যেতে পারে? অমন জলের মতো লিখতে শুরু করলে একই লেখার চর্বিতচর্বণ হবে, নয়ত ট্র‍্যাস হবে। এমনকি নিজের অজান্তে অন্যের লেখা চুরিও হতে পারে। দীপ্তি হতবাক হয়ে গিয়েছেন। এসব কি বলছেন প্রীতিময়! পাঁচ বছরে কেউ শেষ হয়ে যায়? প্রীতিময় তাঁর বিস্ময় ভেঙে দিয়ে বলে উঠেছেন- সে তো হলো, এখন সংসার কি করে চলবে ভেবেছ? দীপ্তির মতো নরম মেয়েও রেগে উঠেছেন। প্রীতিময় করলেন বিয়ে, আর সংসার কি করে চলবে সেটা ভাববেন দীপ্তি? মুখে না বললেও তাঁর ফর্সা মুখে লাল আভা দেখে প্রীতিময় আশ্বাসের সুরে বলেছেন, উঠোনের ওপাশের ঘর দুটো ভাড়া দিয়েছি। ওই ভাড়া থেকে দুটো পেট চলে যাবে। 

এভাবেই কাটছিল বেশ। কিন্তু একদিন উল্টোরথের পাতায় বিজ্ঞাপন দেখা গেলো। উত্তমের সঙ্গে নতুন নায়িকার জুটি বেঁধে সিনেমা আসছে। কাহিনী প্রীতিময় গঙ্গোপাধ্যায়। ভীষণ খুশি হয়ে দীপ্তি দৌড়ে ঢুকে এসেছেন সামনের ঘরে। প্রীতিময় মুখ নীচু করে ডেস্কের ওপরে রাখা ফাইলবন্দী দিস্তে কাগজে লিখে চলেছেন। পুজোসংখ্যার লেখা। ফরমায়েশি। দীপ্তি মুখের সামনে খুলে ধরলেন বিজ্ঞাপনের পাতা। দ্যাখো কি দারুন ব্যাপার! প্রীতিময়ের হাসিতে একটু কি বিষাদ জড়ানো? ওটা মিত্রবাবু বিক্রি করেছেন। আমার নাম হবে, এটাই যা। দীপ্তি আবার রেগে উঠছেন। সেকি! লেখকের মালিকানা নেই? তোমার নিজের সৃষ্টির ওপরে তোমার অধিকার নেই? একমাথা চুল প্রীতিময়ের। মাথা নীচু করে নেড়েছেন। না, আমার অধিকার নেই। কেন? দীপ্তির গলায় কান্না আসে। প্রীতিময় কলমের মুখ বন্ধ করেন। পাশে রাখা দোয়াত সরিয়ে দিয়ে উঠে আসেন। বেতের চেয়ারে দীপ্তির মুখোমুখি বসে বলেন- একদিন বুঝতে পারবে। নিজের সৃষ্টির ওপরে অধিকার বহাল থাকেনা। আজ বোঝার সময় হয়নি তোমার। সত্যিই যখন কল্লোল চলে গেলো তখন দীপ্তি বুঝেছিলেন, সন্তানও তো সৃষ্টি! কই রইল অধিকার? কি অদ্ভুত স্বার্থপর ছেলে! প্রীতিময় পরবর্তী সময়ে লিখে রোজগার করেছেন। কিন্তু সেসব অনিয়মিত রোজগার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছে। তবু কল্লোলের পড়ার পেছনে টাকা খরচ করেছেন। কিন্তু ছেলে বলেছে, ওটা পর্যাপ্ত নয়। সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সুযোগ পাওয়ার মেধা ছিল বটে, পেয়েও ছিল, কিন্তু আরও বেশি ভালো রেজাল্টের জন্য অনেক বেশি খরচ করতে হতো। টিউটর, কোচিং অনেক দরকার ছিল। ছেলেটা যেভাবে বাবার সঙ্গে কথা বলত, মনে পড়লেই দীপ্তির বুকটা মুচড়ে ওঠে। কল্লোল কখনও ক্ষমা করতে পারেনি বাবাকে। একদিন দীপ্তি জিজ্ঞেস করেছিলেন। অনেকেই এরকম শিল্পী আছেন যারা ব্যাবহারিক জীবনে ততো ধনী নন। কি করা যাবে? এঁদের বাস্তববুদ্ধি একটু কমই হয়। তোর বাবা যে এরকম তার জন্য তুই মনে মনে গর্ব বোধ করিস না? কল্লোল শ্লেষের সুরে বলেছিল- না। যে এরকম হয় তার বিয়ে করে সংসার করা উচিত নয়। দীপ্তি হতবাক। কেন? আমি তো তোর বাবাকে নিয়ে খুশি! কল্লোল তীব্র ভাবে দেখছিল- ট্রাবলকে রোম্যানটিসাইজ করা কোনও কাজের কথা নয়। তবু যখন বললেই, তখন বলি, তুমি একাই সুখী থাকতে পারতে। আমাদের আনলে কেন? এই অদ্ভুত ইনডিসিপ্লিন্ড জীবন আমার একটুও ভালো লাগেনা। দীপ্তি মাথা নীচু করে বসেছিলেন। এত বড় আঘাত! বিয়ের পরপর তাঁর সন্তান হয়নি। মিত্রবাবুর পাঁচ বছরের চুক্তি শেষে যখন প্রীতিময় অন্য কাগজেও লেখা শুরু করলেন, তখন দীপ্তির কোলে এলো কল্লোল। এতদিন পর বুঝতে পারলেন যে নিজের সৃষ্টির ওপরে কি নির্মমভাবে অধিকার হারাতে হয়।

প্রীতিময় তখন একটু অসুস্থ। এমনিতে ঘরকুনো মানুষটা শীতের রাতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জলসায় গিয়েছিলেন। সঙ্গে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ লেখকবন্ধু। সেই শুরু। ঠাণ্ডা লেগেছে সামান্য। গা করেননি। কিন্তু তাই থেকেই ক্রমে হাঁপানি। কল্লোল বাড়িতে বেশি থাকত না। কলেজের শেষ পরীক্ষার ফল বেরিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ এসে জানালো, কি নাকি পরীক্ষা দিয়েছিল, সুযোগ পেয়েছে, বাইরে যাবে পড়তে। স্কলারশিপ পেয়েছে। কিন্তু যাওয়া আর দিন পনেরো ওখানে সাসটেন করার টাকাটা যোগাড় করে দিতে হবে। প্রীতিময় ঘোলা চোখে তাকিয়ে আছেন। বর্ষা তখন অনেক ছোট। সবে টেনে উঠেছে। বলে ফেলল- দাদা, বাবা কোথা থেকে এত টাকা পাবে? তুই এপ্লাই করার আগে বলিসনি কেন? কল্লোল একটা চড় মেরেছিল বর্ষাকে। প্রীতিময়ের মতো ঠাণ্ডা মানুষও স্থির গলায় বলেছিলেন- তোমাকে আমি শিক্ষাটা দিতে পারিনি। বোনের গায়ে হাত দিলে? এখন এ ঘর থেকে যাও। আমি দেখছি কি করে টাকা যোগাড় করতে পারি। কল্লোল আর দাঁড়ায়নি। শুধু ঘর থেকেই নয়, এ বাড়ির জীবন থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। সম্পর্ক রাখেনি। দীপ্তি ওর কলেজের এক বন্ধুর মারফত জেনেছিলেন। ও ভালো আছে। আর খবর নেননি। প্রীতিময় সেই অসুস্থতা আর ছেলের চলে যাওয়ার পর থেকেই অদ্ভুত চুপ করে গেলেন। ডাক্তারের বারণ সত্বেও বেরিয়ে মোড়ের সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনে খেতেন। কতবার দীপ্তি বলেছেন, নাই খেলে আর। কতই তো খেলে সারাজীবন ধরে। প্রীতিময় চলে যাবার পর ওই ঘর ভাড়াটুকুই সম্বল হয়েছে। সঙ্গে কস্তুরী যা মাইনে দেয় বর্ষাকে। মেয়েটা তো হায়ার সেকেন্ডারির পর আর পড়তে পারলনা। সাতপাঁচ চিন্তা করেন দীপ্তি। দিনের বেশির ভাগ সময় একা থাকতে থাকতে তাঁর এমন অতীতচারিতার অভ্যেস হয়েছে। প্রীতিময়ের চলে যাওয়াটা তাঁর জন্য বড্ড বেশি শূন্যতা এনেছে। কিন্তু কল্লোল চলে যাওয়ার শূন্যতা অতলস্পর্শী। কেন যে ছেলেটাকে বারবার মনে পড়ছে! ছেলেটা কেন এমন স্বার্থপর? দীপ্তির মনে বিদ্যুতের ঝলকের মতো প্রীতিময়ের মুখ ভেসে উঠল। প্রীতিময়ও কি এরকমই স্বার্থপর ছিলেননা? নাহলে সংসারের কথা ভেবে একটা নিশ্চিত আয়ের চেষ্টা করলেননা কোনোদিন? এজন্য কল্লোল যেন তাঁকেই বেশি দায়ী করেছিল। তিনি স্ত্রী হয়েও স্বামীকে তাঁর কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেননি কখনও। এরকম দুর্বলতা থাকার ফলেই ছেলেমেয়ে দুটোর ভবিষ্যৎ তৈরি হলোনা। দীপ্তির মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। 

প্রীতিময় চলে যেতে বর্ষা এক একবার বলেছে, মা দাদাকে বাবার চলে যাবার খবরটা কি দেবে? দীপ্তি দুঃখ পেয়েছেন। ও জানেনা ভাবছিস? ওর কলেজের কোনও বন্ধু বলেনি ওকে? প্রীতিময় গাঙ্গুলি তো আর যে সে নাম নয়! বর্ষাও বলতে পারেনি। এখনকার ছেলেমেয়েরা বই পড়েনা। প্রীতিময় কোনও আধুনিক লেখক নন। প্রবীণরা যদিও বা মনে রাখেন এই প্রজন্ম সম্ভবত প্রীতিময়ের নামই শোনেনি। লোকটা পনেরো বছর আগেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। গুটিকয় প্রকাশক ছাড়া কেউ মনে রাখেনি তাঁকে। 

আজ মেয়েটা এত দেরি করছে কেন যে! ছেলেটা কবেই চোখের বাইরে। কিন্তু আজ সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তায় দীপ্তি বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পান একটা ছোটখাট ক্লান্ত শরীর টেনে টেনে পা ফেলছে। আসছে মেয়েটা। 


৬ 

রোশনি বুকে ফাইলটা চেপে বসে আছে শ্রীবাস্তবের দপ্তরে। এই একটা কাজ সে নিজেই বেছেছে। কাজের ক্ষতি হয়। বম্বে বড় নিষ্ঠুর জায়গা। কাজ করতে না পারলে ঠেলে স্রোতের বাইরে ফেলে দেবে। ওই আরব সাগরের ঢেউয়ের মতো। অপ্রয়োজনীয় বস্তুকে এক ধাক্কায় তীরে আছড়ে ফেলে। উকিলবাবুর বয়স বেশি নয়। কিন্তু ফি অত্যন্ত বেশি। তবুও এই উকিলের কাছেই রোশনি আসে। ইন্দ্রর এই কেসের মামলাটা যার তার কাছে ছাড়া যেত না। জুনিয়রদের সরিয়ে দিয়ে, প্রায় দু’ঘণ্টার অপেক্ষার শেষে শ্রীবাস্তব ডাকলেন রোশনিকে। কেসটা লোয়ার কোর্টে হেরেছিল ইন্দ্র। হাই কোর্টে এপিলের পর ইনিই দেখেছেন। তার মধ্যে ইন্দ্রর চলে যাওয়া। এখন রোশনি মামলা করেছে। মিথ্যে অপবাদে ফাঁসানো হয়েছে ইন্দ্রকে। সে এরকম ছিলইনা।

শ্রীবাস্তব টেবিলে রাখা ফাইল থেকে বড় একটা চোখ তোলেন না। ক্লায়েন্টের মুখের দিকে না তাকিয়ে কাজ করার অভ্যেস আছে তাঁর। আজ কেন যেন তিনি রোশনির দিকে তাকালেন। “আচ্ছা, মিস সিং, আপনি কেন ইন্দ্রজিৎ সানিয়েলকে বেকসুর মনে করছেন? ডু ইউ রিয়েলি হ্যাভ এনি ভ্যালিড রিজন?” রোশনি ভাবছিল...। উত্তর দেওয়াটা খুব সোজা নয়। একটা মানুষকে ভেতর থেকে কতটা বিশ্বাস করলে তাকে এমন নির্দোষ নিষ্কলঙ্ক ভাবা যায়?

সেইদিনটা মনে পড়ে রোশনির। সে অনেক বছর হলো। ইন্দ্র তখন সবে এফটিআইআই থেকে বেরিয়ে শর্ট ডকু ফিচার বানাচ্ছে। প্রায় প্রতিটা ফিল্মেই নতুন নতুন মুখ। নতুন অভিনেতা। ইন্দ্রর একটা ভয়ঙ্কর ইগো কাজ করত। তার ছবি মানেই ডাইয়েরেক্টর’স ফিল্ম। পরিচালকের ছবি। অজানা অচেনা মুখগুলো যেখানে চরিত্র হয়ে উঠবে সহজেই। এক্সট্রা কোনও খ্যাতির ব্যাগেজ যাদের থাকবেনা। সেই সময় রোশনির সঙ্গে আলাপ ইন্দ্রর। কলকাতার মেয়ে। একটা প্রোডাকশন হাউজে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ শিখতে চায়। প্রথম দেখায় ইন্দ্র বলেছিল। এই শর্ট কাট কেন? একটু থিওরি পড়তে কিসের কষ্ট? ছবি না বুঝলে বানাতে কি হেল্প করবে তুমি? রোশনি সারেন্ডার করে দিয়েছিল। “তুমিই শেখাও। যা পড়তে বলবে, দেখতে বলবে, তাই করব”। ইন্দ্র হেসেছিল। এরকম বাধ্য ছাত্রী পেতে কার না ভালো লাগে? সেই যে শুরু হলো, তারপর থেকে রোশনি ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে ইন্দ্রর প্রতিটি কথা, প্রতিটি নির্দেশ। 

মাঝে মাঝে ইন্দ্রর অফিসে দেখা যেত নতুন নতুন মুখের মেয়েদের। বয়স্কদের নিয়ে অসুবিধে ছিলনা। কিন্তু এরা সবাই যে কাজের ব্যাপারে খুব সৎ তা মনে হতোনা। কেউ কেউ একটু অন্যভাবে ইম্প্রেস কোর্টে চাইত। সেই সব দিন কী যে অবস্থা হতো রোশনির! ইন্দ্র রেগেমেগে যা তা বলে দূর করত মেয়েদের। অবস্থা সামাল দিতে রোশনিকে বলতে হতো, সানিয়েলের মাথাটা ঠিক নেই। কাজ নিয়ে খুব চাপে। এখন মনে হয় দরকার হবেনা। পরে দেখা করবেন। আগে এসে আমার সঙ্গে কথা বলে নেবেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। 

এরকমই এসেছিল সুচিত্রা আগরকার। শ্যামলা মারাঠি মেয়েটির চেহারাটা কি ইনোসেন্ট! কোয়াইট ডিসিভিং! প্রথম প্রথম এসে অত্যন্ত ভদ্রভাবে কথা বলত। লম্বা সালওয়ারে আদ্যন্ত ঢেকে আসত অফিসে। ইন্দ্র বলেছিল রোশনিকে। ওকে তোমার এসিস্টেন্ট করে নাও। লেট হার লার্ন দ্যাট পার্ট অফ দ্য প্রোডাকশন। সুচিত্রা খুব বাধ্যভাবে রোশনির সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল। বয়সে ছোট মেয়েটাকে রোশনিই কি কম ভালবাসত? সেই মেয়ে কিনা ‘মি টু’ হ্যাশ ট্যাগ দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখে দিলো- ইন্দ্রজিৎ সানিয়েল হ্যাজ এবিউসড মি সেক্সুয়ালি...লঙ এগো। মিডিয়া কভার করল। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল সুচিত্রা আগরকারের স্টেটমেন্ট। রোশনি ইন্দ্রকে বলেছিল- লড়তে হবে। আই ডোন্ট বিলিভ এন ইঞ্চ অফ দ্য স্টোরি। বাট উই হ্যাভ টু ফাইট এন্ড প্রুভ শি ইজ ডিফেমিং আস। ওর মুখে ‘আস’ শুনে ইন্দ্র কষ্টের মধ্যেও হেসেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল- আমাকে ফাঁসিয়ে কি লাভ বলো তো? আমি তো সেভাবে কিছুই করতে পারলাম না। ইন্দ্র রোশনির প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়েছিল কি? ওর সেই ঋজু ভাবটা কেমন নেতিয়ে গিয়েছিল সেই থেকে। 

সেই থেকে কেস। ইন্দ্র একদম ভেঙে পড়েছিল। হায়ার কোর্টে জিতে বেরিয়ে এলেও লোকটা ভীষণ ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রির বহু লোক ওর পাশে এসে দাঁড়ালেও কেমন হয়ে গিয়েছিল। আর তার থেকেই চরম পরিণতি বেছেছিল। সেদিনের কথা ভাবলে রোশনির বুক কাঁপে।

অন্ধকার ফ্ল্যাটের চাবি ঘুরিয়ে রাত্রে যখন এসেছিল ও, মনে করেছিল ইন্দ্র হয়ত ফ্ল্যাটে নেই। কাজে গিয়েছে কোথাও। এরকমই সিঙ্কে ফ্রোজেন চিকেনের প্যাকেট নামাতে নামাতে কি মনে করে বেড রুমে ঢুকে এসেছে। অন্ধকার ঘরে খাটের ওপরে শুয়ে আছে ইন্দ্র। রোশনি ভেবেছে ঘুমিয়ে পড়েছে হয়ত। ছোট আলোটা জ্বালিয়ে ওকে ডাকতে গিয়ে চমকে ওঠে রোশনি। কই? ইন্দ্র তো বরফ মাখেনি গায়ে? 

ঘুমিয়ে পরবার আগে চোখ থেকে চশমাটাও খুলে রাখেনি। শ্যামলা ছোট্ট কপালে কোঁকড়া চুলের গুছি এসে পড়েছে। ভারী চোখের পাতা বন্ধ। কাঁচা পাকা চুলে ভরা মাথা একপাশে হেলে আছে। পা দুটো পেটের কাছে ভাঁজ হয়ে বুকের মধ্যে ঢুকে এসেছে। ঢোলা পাজামার থেকে শীর্ণ দুটো পায়ের পাতা বেরিয়ে আছে। পাঞ্জাবীর একটা হাত গোটানো। অন্য হাতটা ছড়িয়ে আছে খাটের ওপরে। অনভ্যস্ত হাতে সিরিঞ্জ ঢুকিয়েছে নিজে। রোশনি এতটাই ধাক্কা পেয়েছে যে সেই যে ধপ করে বসে পড়েছে উঠতেই পারেনি কতক্ষণ। খানিক পর কাঁপা হাতে তুলেছে ইন্দ্রর মোবাইল। গাল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই। মোবাইলটা অন করল রোশনি। তারপর ফোন করল আসলামকে। 

একটা দীর্ঘ চিঠি রেখে গিয়েছিল ইন্দ্র। সে চিঠি পড়ে রোশনি শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বারবার মনে হয়েছে, ইন্দ্র কি তাকে একটুও কাছের ভাবেনি? ইদানীং বুঝতে পারত ইন্দ্র একটা ডিপ্রেসানে আছে। সেটা ও সঙ্গতভাবেই কাজের ক্ষেত্রে তেমন খ্যাতি ও টাকা না হওয়ার কষ্ট বলে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইন্দ্র কি এতটাই ভেঙে পরেছিল? লিভ ইন পার্টনার কি লাইফ পার্টনার হয়না? কেন শেয়ার করতে পারলনা? কখনও ঠাট্টা করতে গিয়ে রোশনি যদিও বলেছে, ইন্দ্রর চেহারা, তার কাজের জগত, এসবে মেয়েরা নিজে থেকেই আকৃষ্ট হয় অনেক সময়। যদি সেরকম আকর্ষণ ইন্দ্র উপেক্ষা করতে না পারে তবে রোশনির কিছু বলার থাকবেনা। ও ইন্দ্রকে দোষ দেবেনা। ইন্দ্র অবশ্য এরকম ওপেন রিলেসানে একদম বিশ্বাসী নয়। তাই রোশনি ঠাট্টা করছে জেনেও রাগ করে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। রোশনি নিজে কখনও যে এরকম অবস্থার সম্মুখীন হয়নি সেটা নয়। এ লাইনই এমন যে কেউ না কেউ ঠিক এরকম একটা প্রস্তাব দেবে। কেউ নাছোড় কেউ বা একটু পরে হাল ছেড়ে দেবে। তবে প্রত্যেকেই কাজটা দেবেনা। এমন ওপেন সিক্রেট এটা যে সবাই জেনেও মুখ খোলেনা। তবে ইন্দ্রর সঙ্গে থাকার দরুন রোশনি কিছুটা হলেও একটু সিকিওরড থেকেছে। 

চিঠিটা কি রোশনি আজ আর একবার পড়বে? শ্রীবাস্তব কেন বললেন, একটা মানুষকে আপনি কতটা অন্তরঙ্গ ভাবে চেনেন যে সে এই ব্যাপারে নির্দোষ বলে দাবী করতে পারেন? মিস সিং, এইটুকু জানবেন এসব ক্ষেত্রে কোনও পুরুষ একেবারে নির্দোষ হয়না। অন্তত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। রোশনি বিরক্ত হয়েছিল- তাই যদি হবে তবে এই মিস আগরকার এতকাল কি করছিল? দশ বছর আগে ইন্দ্র ওকে এবিউজ করেছিল সেই কথা এতকাল পরে কেন বলছে? তখন বলেনি কেন? ওর মতলবটা কি? শ্রীবাস্তব টেবিলের ওপরে ঝুঁকে পরেছেন। “আপনি যা বলছেন মিস সিং তা সাধারনত একজন মূর্খ অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল ভারতীয় মহিলার কথা। তারা এইভাবে প্রটেক্ট করে। আপনার মুখে একথা শোভা পায়না। মিস আগরকার হয়ত তখন বলতে পারেননি। টেন্ডার এজে অনেক মেয়েই বলতে পারেনা। এই রিভলিউসানটা অনেককেই সেই সাহস দিয়েছে।” রোশনি সংযত হয়েছে। উত্তেজনার বশে এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। তাই ঠাণ্ডা মাথায় স্থির স্বরে বলেছে- তাই যদি সত্যি ধরিও, তাহলেও এত বছর পরে ও যা বলছে তার সব যে ঘটেছিল তারই বা প্রমাণ কি? প্রমাণ ছাড়া কাউকে এভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়া যায়? এত পর্যন্ত বলে রোশনি মাথা নামিয়ে নিয়েছে। শ্রীবাস্তব এতদূর সংশয় প্রকাশ করলেন কিভাবে? শ্রীবাস্তব অবশ্য বলেছেন। তাই জন্যেই মেয়েটা কেসে হেরেছে। প্রমাণ নেই বলে। 

ইন্দ্র যে এই একটা ঘটনায় এতটা ভেঙে যাবে সেটা রোশনি বোঝেনি। লোকটা কেমন গুটিয়ে গিয়েছিল। কারো সঙ্গে কথা বলতনা। ঘর ছেড়ে বেরোতেও অস্বস্তি। রোশনি জোর করেনি। ভেবেছে ধীরে ধীরে নিজেকে শক্ত করবে। কিন্তু তার মধ্যেই এভাবে ইন্দ্র চলে গেলো। তখনও কেসের কিনারা হয়নি। কাগজের হেডলাইনে ইন্দ্রর আত্মহত্যার খবরটা ফলাও করে ছাপিয়ে ছিল। কী অদ্ভুত! যে লোকটার হাজারটা ভালো কাজ, কিছু অসামান্য কাজের কথা মিডিয়া কোনোদিন কভার করলনা, বাঙালির পি আর ভালো না বলে যে লোকটা বেঁচে থাকতে প্রথম পাতায় এলনা, সে মরে যেতেই কি উৎসাহ! শুধু তো উৎসাহ নয়! সঙ্গে কুৎসা। তাহলে সত্যিই এমন কিছু ঘটেছিল যার জন্য লজ্জায় আত্মহত্যা করতে হলো! রোশনি তখনও হারেনি। ছটা বছর চলে গিয়েছে। কেসে ইন্দ্র বেকসুর প্রমাণ হয়েছে। ইন্দ্রর যাবতীয় ফাইল এখন শ্রীবাস্তবের কাছে। 

আজ আর একবার চিঠিটা খুলেছে রোশনি। এত কিছুর মধ্যেও ইন্দ্রর প্রতি অভিমান যায়না কিছুতে। বারবার পড়ে রোশনি চিঠিটা। চোখের সামনে অক্ষরগুলো নাচছে। ইন্দ্রর সেই কলমের আঁচড় ভাসছে। রোশনি তাকাল কাগজটার দিকে। 

“তুমি যখন চিঠিটা পাবে তখন আমি অনেক দূরে। এতটাই দূরে যে তোমার সঙ্গে আর কথা বলা হবেনা কখনও। সেটা ভেবে কষ্ট হচ্ছে আমার। কষ্ট হচ্ছে ভেবে যে, কেসটা জিতে গিয়েও আমি ভালো থাকবনা। থাকা সম্ভব নয়। একটা কেসের ভারডিক্ট দিয়ে আমার প্রতি মানুষের হারিয়ে ফেলা বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যাবেনা। দুনিয়ায় দুটো মানুষ আমায় বিশ্বাস করেছে। বাবা আর তুমি। মা ভাবত আমি ইচ্ছে করে একটা কাজের কাজ খুঁজিনা। এই বোহেমিয়ান জীবন, এই আলস্য আমার ভালো লাগে। কথাটা সত্যি। বাবা কিন্তু সারাটা জীবন বড় চাকরি করেও আমার এই বাউন্ডুলেপনা মেনে নিয়েছিল। কেন যে বাবার মনে হতো আমি খুব ট্যালেন্টেড! দ্যাখো, ইন্ডাস্ট্রির কেউ কিন্তু অতটা ভাবেনা। এতদিনেও আমি একটা ডিসেন্ট লিভিং আর্ন করতে পারলাম না। বাবা সুচিত্রার ব্যাপারটা হাল্কা মনে নিয়েছিল। যেন কিছুই হয়নি। মা কেবল বলেছিল- পুরুষ মানুষ কখন যে পড়ে যায় কেউ বলতে পারেনা। তোমার ছেলে এমন কি মুনি ঋষি? তুমি তো নিজের জোরেই জানো, সুচিত্রা কি করতে চাইছে। তবু একটা জবাবদিহি করি। 

আমার চলে যাওয়াটা তোমার সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। এটা সবসময় আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। কিন্তু আমিও আর পারছিনা। যা রইল সব তোমার। শ্রীবাস্তব জানেন। তেমন কিছু তো নেইও যে লোকে বলবে তুমি গেইনার। সুচিত্রার কথা বলি।

তখন তোমার আউট ডোরে কাজ চলছে। তুমি আর আমি প্রায় সমবয়সী। এমন কি আর বয়স। দুজনেই তিরিশ একত্রিশ হবো। নতুন অফিসটা তখন নেওয়া হয়েছিল। তোমার মনে আছে? আসলাম টাকা দিয়েছিল কিছু। এখনও সেই খাতে ও কিছু পায়, জেনে নিও। সেই সময় সুচিত্রা এলে ওকে দেখে আমি একটু দুর্বল হয়েছিলাম স্বীকার করে নিই আগে। আর তাই জন্যেই নিজের কাছে না রেখে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিই। দেখতে থাকি ও কেমন দিনের পর দিন তোমার খুব বাধ্য হয়ে উঠছে। তখন তোমার চেহারায় একটা কালি পরেছে। তুমি কেমন অনুজ্জ্বল, বয়সের চেয়ে বেশি বুড়ি হয়ে পড়ছ। রাগ কোরোনা। আমি লিখে রেখে যাচ্ছি। একবার সত্যি কথাটা বলেই ফেলি। 

সুচিত্রা দিনের পর দিন তোমার চেম্বারে একা কাজ করত। ওর নাকি সাইনাসের ব্যাথা হচ্ছে। ও রোদ্দুরে কাজ করতে পারছেনা। তখন আমাদের সেই এড ফিল্মের শ্যুট চলছিল। তুমি বম্বের ব্যাস্ত রাস্তায় নতুন অভিনেতাদের নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছিলে। সিগন্যালে থেমে থাকা গাড়ির সামনে মাইক নিয়ে গিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে হবে- আপনি হ্যান্ড্রেড পারসেন্ট সেফ? আপনার যদি কিছু হয় আপনার পরিবার ভেসে যাবেনা তো? ইন্সিওরেন্সের ফিল্ম ছিল। সেই সময় এক সন্ধ্যেয় আমি যখন একমনে কাজ করছি, সুচিত্রা পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি নিজেই ওর চোখের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচতাম। নিজের দুর্বলতা বুঝতে পারতাম বলে। কিন্তু ও তো একটা নিষ্পাপ মুখ নিয়ে বসে থাকত! আমি চমকে এক ঝটকায় ওকে সরিয়ে দিই। একটু বেশিই কি কঠিন হয়ে পরেছিলাম? জানিনা। ওও অবাক হয়ে গিয়েছিল। খুব নিচু গলায় বলেছিল- স্যরি। আমি ভেবেছিলাম আপনিও...। ও কথা শেষ করতে পারেনি। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম। একটা মেয়ের সহজাত ক্ষমতা থেকেই ও আমার দুর্বলতা টের পেয়েছিল। 

রোশনি আমি জানি, তুমি বলবে মনের মধ্যে যাই হোক না কেন, আমি তো ওকে এবিউজ করিনি। না করিনি। এবিউজ কেন, সেদিন যদি ওর ডাকে সাড়া দিতাম তাহলে ও হয়ত এই ঘটনা ঘটাত না। এতদিন পরেও রিজেক্টেড হওয়ার অপমান ওকে এরকম করিয়ে নিয়েছে বলেই মনে হয়। কিন্তু দ্যাখো! আমাকে ও কোথায় দাঁড় করালো? 

তুমিই বরং পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো। তোমার ওপরে আমি খুব বেশি নির্ভর করেছি। জীবনটা গুছিয়ে দিয়েছিলে আমার। আমাদের সম্পর্কে কোনও মিথ্যে ছিলনা। শুধু এই স্বীকারোক্তিটুকু বাকি ছিল। এ চিঠি তোমার জন্য। চাইলে কাউকে পড়াতে পারো, নইলে নয়। ভালো থাকার চেষ্টা কোরো। আফটার অল, লাইফ ইজ নট ইটারনাল।” 

রোশনি চিঠিটা খামে ঢোকায়। চোখ দুটো জ্বালা করে তার। প্রত্যেকবার সে চিঠিটা পড়ে আর আরও বেশি প্রতিশোধের ইচ্ছেটা জাগে। সুচিত্রাকে ছাড়বেনা সে। ইন্দ্র দুর্বল হয়ে পড়েছিল? অসহ্য জ্বালায় রোশনি আবার সিঙ্কের কাছে যায়। ঠাণ্ডা জল ছেটাতে থাকে চোখে মুখে মাথায় ঘাড়ে। শ্রীবাস্তব যেন চিঠিটা কক্ষনো দেখতে না পায়।



গাড়িটা এখানেই ছিল। কিন্তু আর নেই। তন্বী পুলিশকে তখনই জানিয়েছে। কল্লোল ওই ঝরনাটার পাষে বোশে ঐ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলছিল। তন্বী একটু বিরক্ত হচ্ছিল। কথা ছিল দুজনে নির্জনে উইকএন্ড কাটাবে, তা নয়, কল্লোল হঠাৎ এই রাশিয়ান মেয়েটাকে নিয়ে পড়ল কেন? একবার কথার ফাঁকে শুধু বলেছিল, তন্বী সামথিং ইরি ইউ নো? দিস গার্ল রিসেম্বলস আ লট উইদ বর্ষা। ইভন হার নেম ইজ ভারসা। তন্বী শ্রাগ করেছিল। এতে কি? ওরকম হতেই পারে। তা হঠাৎ কল্লোলের কি হোম সিক লাগছে নাকি? ঠাট্টাটা ভালো লাগেনি কল্লোলের। মুখে কিছু না বলে আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ভারসাকে ডেকে পাশে বসিয়ে গল্প শুরু করেছিল। বিরক্ত তন্বী উঠে গিয়ে ঝর্ণার অন্য দিকটা দেখতে গিয়েছিল। একটু পাথুরে। একটু টিলা পেরিয়ে যেতে হয়। ওদিকের ঝর্ণার বিউটিটা অসাম। তন্বী আবার ফিরে আসতে সময় নিয়েছিল। কিন্তু ফিরে এসে তো কাউকে দেখা গেলনা? ভয় পেয়েছিল তন্বী। চিৎকার করে কল্লোলকে ডেকেছিল। কোনও সাড়া আসেনি। প্রথমে মনে হয়েছিল জায়গাটা ভুল করেনি তো? কিন্তু তারপর গুগল ম্যাপে নির্দিষ্ট জায়গাটা দেখে বুঝতে পারল এখানেই তারা এসে বসেছিল। অদ্ভুত! গেল কোথায় কল্লোল! গাড়ি শুদ্ধু মেয়েটা শুদ্ধু হাওয়া? এরকম ফালতু ছেলে মনে হয়নি তো ওকে? রাগে ভয়ে বিরক্তিতে মুখ কালো করে তন্বী কল করেছিল পুলিশকে। পুলিশ এসে ওকে উদ্ধার করে বলা যায়। ওর কথামত ওই জায়গাটার ওপরে হেলিকপ্টার হোভার করেছে, কিন্তু কল্লোল আর ভারসা তো দুরের কথা, অত বড় গাড়িটা পর্যন্ত পাওয়া গেলনা। পুলিশ কিরকম অবিশ্বাস করেছে তন্বীর কথা। ওকে পৌঁছে দিয়েছে বাড়িতে। তবে কথা দিয়েছে খোঁজ জারি রাখবে। তন্বী স্পষ্ট লক্ষ করেছে ওরা নিজেদের মধ্যে হেসেছে। দুটো এডাল্ট লোক যদি কোথাও চলেই যায় তাহলে পুলিশের কি করার আছে? তার ওপরে তন্বীর লিভ ইন পার্টনার। 

দূরে সেই জঙ্গলের মধ্যে ঝর্ণাটার ধারে কল্লোল আর ভারসা গল্প করে চলেছে। সামনেই দাঁড়িয়ে গাড়িটা। ভারসা একবার এদিক অদিক তাকিয়ে দেখল। তোমার সঙ্গিনী কোথায়? ওই ধারের ঝর্ণা দেখতে গিয়ে কোথায় গেলো? কল্লোল হাত উল্টে দিলো। শি ইজ আ বিট উইয়ারড। হাত উল্টে সময় দেখল, মাত্র পাঁচ মিনিট হয়েছে। সে ভারসাকে শান্ত করতে নিজের ঘড়িটা দেখাল। অনলি ফাইভ মিনিটস সিন্স শি ওয়েন্ট দেয়ার। নো নিড টু ওয়ারি। দুজনের গল্পের মধ্যে কল্লোল যেন ছেলেবেলার দিনের গন্ধ ফিরে পাচ্ছে। 

আর ওদিকে কেটে যাচ্ছে একটা একটা বছর। কি এক দুর্বোধ্য কারণে তন্বীর চুল সাদা হতে শুরু করেছে। সব আশা ছেড়ে দিয়েছে সে। এরই মাঝে একদিন তন্বীর বর্তমান পার্টনার, হেনরি ওকে নিয়ে সারপ্রাইজ ডেটে নিয়ে যাবে বলে ভেবেছে। 

দুজনে যখন সেই চেনা অরণ্য চেনা মোটেল পেরিয়ে যাচ্ছে তখনই তন্বীর মনে হলো, কল্লোল কাছেই আছে। এখানেই। এখানেই কোথাও। এখানে এলে ওই অরণ্যঘেরা ঝর্ণাটাতে যেতেই হয়। হেনরি আর তন্বী যখন ঝর্ণার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, তখন কলকলানির সঙ্গে তন্বী যেন দুটো কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো। লুক, ক্যান ইউ হিয়ার সামথিং? –হোয়াট আর ইউ টকিং আবাউট? হেনরি ক্লুলেস। তন্বী ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে। চিৎকার করে ডেকে চলেছে কল্লোলের নাম। কিন্তু হেনরি ওকে ধরে বসিয়ে দিলো। শান্ত স্বরে জানতে চাইল, এরকম পাগলামির মানে কি? কোথাও তো কেউ নেই! কার গলা শুনতে পাচ্ছ? 

অসুস্থ তন্বীকে যখন ঝর্ণা আর জঙ্গলের ভেতর থেকে হেনরি বের করে আনছে ঠিক তখনই তন্বী দেখতে পেলো, আরে! ওর গাড়িটা। রঙ চটে বিবর্ণ গাড়িটার জানলা দরজা মরচে লেগে ভেঙে পরছে। জঙ্গলের মধ্যে যেন লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িটা। হেনরিকে অকাট্য প্রমাণ দেখান গিয়েছে। যদিও হেনরি মানেনি যে এটা তন্বীরই গাড়ি তবু তন্বী আবার পুলিশে ফোন করল। এত বছর পর গাড়িটা পাওয়া গিয়েছে। কল্লোলের খোঁজও সময়ের অপেক্ষা শুধু। পুলিশ অফিসার হেনরিকে নির্জনে বলেছেন অবশ্য। গাড়িটা পরে এসে রেখে গেছে কেউ। কল্লোলকে পাওয়া যায়নি। কে বলতে পারে যে সে খুন হয়নি? তবে এটা নিঃসন্দেহে তাদের বড় হার। এখনও এটার কিনারা হয়নি। কোনও অপরাধ ছাড়া একটা লোকের পিছু ধাওয়া করা যায়না। 

ঝর্ণার ধারে বসে বসে একবার কল্লোলের মনে হলো কে যেন অনেক দূর থেকে তার নাম ধরে ডাকছে। সে একবার ভারসাকে বলল- ক্যুড ইউ হিয়ার সামবডি? ভারসা মাথা নাড়ল, নাহ। কেউ না। 

ভারসা ততক্ষণে জেনে গিয়েছে। কল্লোল নিজের পরিবারকে ছেড়ে এখানে এসেছে। আর ফিরে যাবেনা। তার খুব অভিমান আছে বাবা মায়ের ওপর। তবে একটা ছোট বোন আছে যার কথা ভেবে ওর খারাপ লাগে। ভারসা হেসেছে। সে ভালোই আছে। কল্লোল এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল- তুমি জানলে কি করে? ইউ আর বর্ষা, এন্ড আয়াম সিওর আবাউট দ্যাট। নানাভাবে ভারসাকে ও নিজের কথার জালে ফেলতে চাইল। কিন্তু ভারসা যেন সত্যিই বর্ষা নয়!

কথার ফাঁকে কল্লোল একবার ঝর্ণার কাছে গেলো। একটু জল ছোঁবে। এখানটায় জল জমে একটু স্থির। তলায় সবুজ শৈবাল। সেই স্থির জলে হাত দিতে গিয়ে চমকে উঠল কল্লোল। জলে তার ছায়া পরেছে। সে ছায়ায় তার গাল তোবড়ানো, চুলে সাদা রঙ। চোখ নিষ্প্রভ। এ আবার কি? ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো। পাথরের ওপরে বসে ভারসা হাসছে। কাম, হ্যাভ সাম স্যান্ডউইচ। 

কিন্তু আর না। এবার তন্বীকে ডাকতেই হবে। কল্লোল তাড়াতাড়ি গাড়িটার কাছে গেলো। কিন্তু গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় গাড়িটা গেলো গড়িয়ে। তার বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি গড়িয়ে টিলা থেকে নীচে গিয়েছে। ওঃ কি ঝামেলা। জঙ্গলে আটকানো গাড়িটা আবার উদ্ধার করতে পুলিশ ডাকতে হবে। তার দুশ্চিন্তার মাঝেই ভারসা এসে ওর হাত ধরে। কাম, আয়াম ফিলিং হাংরি। 

এখন দুজনে খেতে খেতে আবার গল্প জুড়েছে। এই জঙ্গলে টাওয়ার নেই। মোটেলে ফিরলে তবেই পুলিশে খবর দেওয়া যাবে। ততক্ষণ অনন্তকালের মতো গল্প চলুক। বর্ষাকে দেখে এত ভালো লাগছে! 

কাউন্সেলিং এর সময় তন্বী বলেছে কল্লোলের হারিয়ে যাওয়ার কথা। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কল্লোলের সঙ্গে তার আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুব ভালো ছিল। হঠাৎ সে বলা নেই কওয়া নেই কোথায় চলে যাবে? আর কেনই বা যাবে? মাত্র পাঁচটা বছরে তন্বী যেন বুড়ি হয়ে গেছে। কোথাও থিতু হতে পারছেনা। কল্লোলের কলিগরা বলাবলি করে সে শুনেছে- দ্যাখ মেয়েটা মেরে টেরে দিয়েছে কিনা। সৈকত এর মধ্যে একদিন এসেছিল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করছিল- তোমরা এমন কোথায় গিয়েছিলে যে হারিয়েই গেল কল্লোল? ছেলেটা অদ্ভুত! বাপ মায়ের খবর নিলো না কোনোদিন। স্বার্থপর হতে গিয়ে নিজেকেই খুইয়ে দিলো। সৈকতের কথার মধ্যে এমন আফসোস ছিল যে তন্বীর সমানে মনে হচ্ছিল সৈকত তার দিকেই আঙুল তুলছে। তন্বীও তো কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনা। ভালবাসেনা মানুষজন। কি করা যাবে? ভাঙা পরিবারের সন্তান হলে সৈকত বুঝত। সেই ছোটবেলায় একটা লোকের সঙ্গে মা চলে গিয়েছে। দামী দামী উপহার পাঠানো ছাড়া আর কোনও ভুমিকা পালন করেনি। তন্বী এদেশে এসে মায়ের সঙ্গে ওইটুকু যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। বাবা চিরটা কাল ভাগ্যকে দোষ দিয়ে গেলো আর তন্বীকে দেখলেই ঘেন্নায় মুখ কুঁচকে রেখে গেলো। ওই মায়ের মেয়ে। না জানি কিরকম হবে। যেদিন বিদেশে আসা ঠিক হলো, বাবা যে কি শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল! আঃ, তন্বীকে আর চোখের সামনে দেখতে হবেনা। এই অবস্থায় কল্লোলের স্বভাবটা যে ওর খুব পছন্দ হবে সে তো সময়ের অপেক্ষা কেবল। দুজনে বেশ কাটিয়েছে। টু ইজ রিয়েলি কম্প্যানি। ওর চেয়ে বেশি ওরা কাউকে প্রশ্রয় দেয়নি। সৈকত ওঠার আগে আরেকবার বলেছিল- এদেশের পুলিশ নাছোড়বান্দা টাইপের হয়। তুমি বরং চেষ্টা করে সেদিনের যে যে কথা তখন মনে পরেনি, এখন পরছে, সেগুলো বলে দিও। তোমার পেছনে খামোখা পড়ে থাকবেনা এরা। তন্বী কিছু বলতে পারেনি। মাথাটা দুহাত দিয়ে ধরে চুপ করে বসেছিল। তার মানে এরা সবাই মনে করছে কল্লোলের গুম হয়ে যাওয়ার পেছনে ওর হাত আছে? এমন গভীর অবসাদ এলো যে বলার নয়। সেই থেকে তন্বী নজরদারির আওতায় এবং কাউন্সেলারের আওতায়।

আজ কি মনে করে বহুদিন পর ও টিভি খুলেছে। খবরের চ্যানেল। দেখাই যাক কোথায় কি হচ্ছে। খবর চলছে। সামনে ইলেকশান। তাই নিয়ে গরম গরম আলোচনা। একটি স্কুলে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী চল্লিশটি বাচ্চাকে খুন করেছে। তার হাতে ছিল স্বয়ংক্রিয় বন্দুক। আততায়ীর বয়স আঠেরো। জনৈক অভিনেত্রী সিরিয়াল থেকে সটান রাজপ্রাসাদে। তার গ্ল্যামারে মোড়া চেহারা ফ্ল্যাশ বাল্বের ঝলকানিতে জ্বলজ্বল করছে। আর তার মাঝেই নীচে স্ক্রল হতে থাকা একটা ছোট্ট খবর। বিজ্ঞানসংস্থার বিজ্ঞানীরা মনে করছেন একটি অরণ্যঅধ্যুষিত জনবিরল এলাকা এখন বিপজ্জনক ঘোষণা করা হোক। এক বিজ্ঞানীর ছোট্ট মুখ বলে চলেছে- ওই বিশেষ এরিয়াতে বেশ কিছু গাড়ি হারিয়ে গিয়েছে গত পাঁচ ছ বছরে। গাড়িগুলো পরে ভাঙাচোরা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে বটে, কিন্তু আরোহীদের পাওয়া যায়নি। প্রথম প্রথম পুলিশ এগুলোকে অপহরণ ও খুনের ঘটনা বলে তদন্ত চালালেও, বিজ্ঞানীরা মনে করছেন ওখানে একটি বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সির জন্য টাইম ট্র্যাপ তৈরি হয়েছে। ওই বাবল এ যা ঢুকছে তা যদি গাড়ির মতো নিষ্প্রাণ হয় তবে ফিরে আসছে। কিন্তু বয়স বেড়ে গিয়ে ওগুলো আর আগের মতো থাকছেনা। আর মানুষের মতো সপ্রান কিছু হলে তাদের একটি সমান্তরাল জগত তৈরি হচ্ছে। তাই তারা আর ফিরছেনা বা বলা ভালো ট্র্যাপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেনা। একটা নির্দিষ্ট টাইম স্ফিয়ারে আটকে আছে। একটি হাস্যময় মুখ বিজ্ঞানীর এই দাবিকে অবাস্তব বলে কৌতুক করছেন। বিজ্ঞানী হাত উল্টে নিজের অক্ষমতা জানিয়ে বলছেন- আপাতত বিশ্বাস ছাড়া আমাদের হাতে এই মুহূর্তে কোনও প্রমাণ নেই। যা আছে তা জটিল অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যা। দুজনেই দর্শকদের বিদায় জানাচ্ছেন এই আশা করে যে একদিন এই রহস্যের সমাধান হবে। খবরের হেডিং- এনাদার বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। 



স্নেহময় আজ একটু অসুস্থ। জ্বর জ্বর ভাব। বিকাশকে সকালে বলেছিলেন, উঠতে না পারলে মুশকিল। বিকাশ যেন চাবি নিয়ে যায়। চাবি ঘুরিয়ে ঢুকে আসবে। ছেলেটা একটু দরদী। বুড়ো মানুষটা যে একদম একা হয়ে গেছে সেটা বোঝে। ইন্দ্রজিৎদা চলে গিয়ে মানুষটা একদম নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কোথাও যায়না। মাসিমা মারা গিয়েছেন। কিন্তু মেয়ে তো আছে! কেমন যেন মেয়েটা। খুব নাকি পড়াশুনো করেছে। বিদেশে থাকে। আসেনা একেবারেই। সব খোঁজ ফোনে ফোনে। বাবাকে কেবল নির্দেশ। মিলিটারির মতো। একদিন বিকাশ শুনেছিল। ফোনে মেয়ে বলছে- সব যত্ন তো ভাইয়ের জন্য তোলা ছিল। এখন কেমন? একটা উশৃঙ্খল জীবন কাটিয়ে সবার মুখে চুনকালি দিয়ে চলে গিয়েছে, অথচ তোমাদের আর শোক যায়না। মা তো চলেই গেলো, আর তুমি আধমরা বেঁচে আছো। সে শুধু আমাকে জ্বালাবে বলে। স্নেহময় মাথা নাড়ছিলেন, না না ছেলেটা তো অসৎ বা দুশ্চরিত্র ছিলোনা। হ্যাঁ, স্বপ্ন তাড়া করতে গিয়ে জীবনে খুব দাঁড়ায়নি। সে তো হয়। কিন্তু ওই মেয়েটা ওকে ফাঁসিয়ে ছিল। ছেলেটা এত চাপা, কিছুই বললনা। হ্যাঁ, তিনি জানেন এইটুকু, যে, ছেলেটা একটি পাঞ্জাবী মেয়েকে ভালবাসত। একসঙ্গে দুজনে থাকত, কাজ করত। ইন্দ্র চলে যাবার পর ওই মেয়েই তো সব করেছে। এখনও ইন্দ্রর জন্য লড়ে যাচ্ছে। বিকাশ আর বাকি কথা শোনেনি। সন্তান যখন এমন করে আঘাত করে তখন যে কী কষ্টই হয়! 

দোকানে আজ ভিড় কম। রোদ্দুরটা বড্ড চড়া হয়ে উঠেছে। সকালের কাজ মিটে যেতে বিকাশ বাসনপত্র গুছিয়ে সব সাফসুতরো করে ফেলল। আজ একবার দোকান বন্ধ করে স্নেহময়কে দেখতে যাবে। কে জানে দুপুরে যদি জ্বর বাড়ে? আপনমনে গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিকাশের মনে হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে। বারবার পেছন ফিরে দেখেও কাউকে দেখতে পেলনা। কিন্তু কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। কে হতে পারে? দুপুরে ফাঁকা শুনশান গলি। ভয় করতে লাগল বিকাশের। একটু এদিক ওদিক দেখে সে খুব জোরে হাঁটতে শুরু করল। প্রায় দৌড়নোর সামিল। কেউ নেই অথচ একটা পায়ের আওয়াজ যেন কোথা থেকে আসছে। ভয়ে ঘামতে ঘামতে বিকাশ ছুটতে শুরু করল। 

আজ আবার সেই অটোটা পাওয়া গিয়েছে। ওরকম ফাঁকা। বর্ষা নিজেকে আটকাতে পারলনা। বলেই ফেলল, আমাকে ঠাকুর দাস লেন বলে যেখানে নামিয়েছিলেন সেখানে একটু নামিয়ে দেবেন তো। অটোওলা বিরক্ত মুখে একবার দেখে নিলো ওকে। মুখে কিছু বললনা। বর্ষা একটু আনমনে ভাবছিল। কস্তুরীদি ওকে নিয়ে ছত্তিসগড় যাবে বলেছে। ট্রাইবাল উইভ যে কি রিচ! ওদের কালার প্যাটার্ন, ওদের ন্যাচারাল ডাই, সব দেখাবে। বর্ষা খুশি, কিন্তু মায়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে। মা একা কি করে যে থাকবে! মামন থাকলে চিন্তা ছিলোনা। ওর চিন্তার মাঝে অটোওলা ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। নামুন। বর্ষা টাকাটা গুঁজে দিয়ে ঢুকে পড়ল গলিটায়। বাপ রে! কি রোদ্দুর! কেউ কোথাও নেই। ফাঁকা গলি। বর্ষা একটু তাড়াতাড়ি চলতে শুরু করল। মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। হঠাৎ বর্ষার মনে হলো, কেউ কি ওর সামনে হেঁটে চলেছে? নাহ কেউ নেই। গরমে যে কতরকম হয়! একসময় হেঁটে সেই বাড়িটার সামনে চলে এসেছে ও। দরজাটা আজ হাত দিতেই খুলে গেলো। বর্ষা ভেতরে ঢুকে এসেছে। অন্ধকার করিডর শেষ হতেই ডানদিকে একটা ঘর। উল্টোদিকে গ্রিলে ঘেরা বারান্দা আর তারপর উঠোন। ঘরের মধ্যে খাটে শুয়ে আছে ওই যে মানুষটা। ও ঢুকে এলো ঘরে। এখন আর কোনও ভয় কাজ করছেনা। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে ও ডাকল- মামন? মামন! তুমি এখানে কি করছ? কি করে এলে? স্নেহময়ের চোখ বন্ধ। জ্বরের তাড়সে ঠোঁট ও গাল দুটো ফুলে লাল হয়ে রয়েছে। বর্ষা শুনতে পেলো উনি বলছেন- আর আমার থাকা। ছেলেটা চলে গিয়ে অব্দি আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। বর্ষা চমকে উঠেছে। মামন! দাদার জন্য মন খারাপ? হতে পারে। সব কি আর বাইরে থেকে বোঝা যায়? ততক্ষণে ওর গাল বেয়ে জল নামছে- মামন, বাড়ি চলো। এখানে একা একা কেন আছো? বাড়ি চলো। স্নেহময়ের জড়ানো গলা। তিনি বললেন- যাবো যাবো। যেতেই হবে এখান থেকে। বাইরে কি কারোর পায়ের আওয়াজ? কেমন যেন টলমলে পা। বর্ষা আর দাঁড়ালো না। বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এসেই ছুটতে শুরু করে দিলো। ঝাপসা চোখে গলির মুখে আসতে আসতে ও দেখতে পেলো, উল্টোদিকে অটোটা দাঁড়িয়ে। আজ আর কিছু বলতে হলনা। অটোওলা ওকে নিয়ে নিঃশব্দে গাড়ি চালিয়ে দিলো। একটা অদ্ভুত অনুভূতি বর্ষাকে যেন অবশ করে ফেলল। মামন কি করে বেঁচে আছে! ওরা তো শরীরটাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল! দাদা না থাকায় ওই তো অস্থি নিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়েছিল। মামন তো আর নেই! তবে এখানে এলো কি করে? ওর কথাতেও তো সায় দিলো! বলল- ছেলেটার জন্য মন খারাপ লাগে। অথচ মা আর ও কত ভেবেছে যে, মামন দাদাকে মন থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ভুল ভুল। বর্ষা চোখ মুছতে মুছতে টের পেলো অটো ব্রেক কষেছে। টলমল করে হাঁটতে হাঁটতে ও ঢুকে এলো বুটিকে। কস্তুরী উঠে এসে ওকে না ধরলে হয়ত ওখানেই পড়ে যেত ও। 

বিকাশ খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে আসতে আসতে আসতে ভয়ে শুকিয়ে গেলো। কে এসেছিল? দরজা এমন করে খোলা? স্নেহময় কার সঙ্গে কথা বলছেন? ঘরে ঢুকে সে দেখতে পেলো, একা একা কথা বলছেন স্নেহময়। কাছে এসে কপালে হাত রাখতেই টের পেলো, জ্বর, অনেক জ্বর। জ্বরের ঘোরে ভুল বকছেন স্নেহময়? বিকাশের চোখ ফেটে জল এলো। এমন করে বয়স্ক মানুষটাকে একা ফেলে রাখে? ও দ্রুত ডাক্তারকে ফোন করল। নিজের ওপরেও খুব বিরক্ত হলো। কে আসবে আর? এখন পাড়ার ডাক্তার ফোন ধরলেন। বিকাশকে নির্দেশ দিলেন ওষুধের দোকানে গিয়ে ওঁকে ফোন করতে। দরকারি ওষুধ দিয়ে দেবেন। রাতে গিয়ে স্নেহময়কে দেখে আসবেন। বিকাশ ফোন নামিয়ে একটা গামলা করে ঠাণ্ডা জল আনল। তাইতে তোয়ালে ভিজিয়ে স্নেহময়ের জ্বরতপ্ত গায়ে বুলিয়ে দিতে থাকল। স্নেহময়ের লালচে মুখে ঠোঁট দুটো হঠাৎ ঠাণ্ডা পেয়ে থিরথির করে কাঁপছে। সেই অবস্থায় তিনি হাত দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলেন। বিকাশের শির ওঠা কেজো হাতে হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন- দূরে দূরে যাস না। বম্বে কি এখানে রে? বিকাশ বুঝতে পেরেছে। স্নেহময় ওকে ইন্দ্রদা ভাবছেন। জ্বরের ঘোরে ভুল বকছেন, ভুল ভাবছেন। সে একমনে ওই মিথ্যে স্নেহটুকু নিয়েই স্নেহময়ের শরীরের তাপ মুছে নিতে থাকল। আর ভাবতে থাকল, আজ শান্তি এলে বলে দেবে, ওর মেয়েটাকে বিকাশ বিয়ে করতে পারবেনা। না না। এতে ওই মেয়েটার কোনও দোষ নেই। মাত্র চোদ্দ বছরের কিশোরী কি বোঝে? কিন্তু বিকাশ তো বোঝে। তার তো বয়স কবেই তিরিশ ছাড়িয়েছে। এত বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করবে কেন? আর করেই বা কি হবে? এই যে স্নেহময় তাকে থাকতে দিয়েছেন, কেন? নিজের ছেলেমেয়েরা কোথায় তাঁর? কেউ কারোর নয়। কেউ কারোর জন্য দাঁড়ায়না। ইন্দ্রদা কি চলে যাবার আগে ভেবেছিল বাবা মায়ের কথা? কৃত্তিকাদি কি ভাবে একা পড়ে থাকা বাবার কথা? নাহ, বিয়ের দরকার নেই। একটুও নেই। এইসব ভাবতে ভাবতে বিকাশ দেখল স্নেহময়ের গা টা একটু ঠাণ্ডা হয়েছে। সে ডাকল- কাকু? স্নেহময় অতি কষ্টে চোখ খুললেন। মুখে কিছু বললেন না। শুধু একটু হাসলেন। যাক নিশ্চিন্ত। বিকাশ বলে উঠল- কাকু, আমি একটু ওষুধের দোকানে যাচ্ছি। তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি এসেই তোমাকে বাথরুমে নিয়ে যাবো। একা একা উঠবেনা একদম, কেমন? স্নেহময় মাথা হেলালেন। 

দীপ্তি যখন মেয়েটাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন তখনও মেয়েটা কিসব বকে চলেছে। “মা, মামন বেঁচে আছে। মামন মারা যায়নি। আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। মামনের অনেক জ্বর। আমি বলে এসেছি, এখানে নিয়ে আসব। জানো, মামনের দাদার জন্য মন খারাপ করে।” দীপ্তি আর শুনতে পারলেন না। ওঃ! মেয়েটার কি চিন্তায় শোকে মাথা খারাপ হলো? তিনি তাড়াতাড়ি কস্তুরীকে ফোন করলেন। এছাড়া আর ভরসা কে আছে? 

স্নেহময় এখন একটু সুস্থ। বিকাশ প্রচণ্ড বকাবকি করেছে। কেন দরজা ওরকম করে খুলে রাখা? কেউ এসে যদি কিছু করত? কি করতে পারতেন স্নেহময়? তিনি বলতে পারলেন না, কেউ এসেছিল সত্যি। একটা ছেলেমানুষ মেয়ে। তাকে ‘মামন’ বলে ডাকছিল। তাকে দেখে কেমন কাঁদছিল। কাঁদছিল কেন? বলছিল- আমার সঙ্গে ফিরে চলো। কে মেয়েটি? তিনি চেনেন না। অথচ মেয়েটি যেন তাকে কতই ভালোবাসে। বাবার মতোই ভালোবাসে। স্নেহময়ের চোখের কোলেও জল জমছে। বিকাশ ঘরের টেবিলটা গুছোতে গুছোতে দেখতে পেয়েছে। একটু কি বেশি বকে ফেলেছে? তাড়াতাড়ি এসে ও স্নেহময়ের হাত ধরেছে- রাগ করেছ? আমার যে ভয় করেছে খুব! তোমার এত জ্বর, দরজা খোলা, ভয়ে বুক শুকিয়ে গিয়েছিল। রাগ করবেনা কিন্তু। স্নেহময় বিষণ্ণ হাসেন। কে জানে স্বপ্নের মধ্যে কে এসে ওঁকে ডেকে গেছে। যাবার দিন এলো হয়ত। উনি বিকাশের হাতের ওপরে হাত বুলতে বুলতে বললেন- না রে বাবা। তুই ছাড়া আমার আর কে আছে? রাগ করতে পারি? কথার মধ্যেই ওঁর মনের মধ্যে ভেসে উঠল শীর্ণ এক তরুণীর মুখ। অদ্ভুত বাৎসল্য টের পেলেন। 



তাঁর লেখাগুলো স্নেহময় কোথাও পাঠাননা। এ শুধু ছেলেখেলা। তাঁর নিজের যে ভীষণ রকমের ইচ্ছে ছিল লেখক হবার, এ শুধুই সেই ইচ্ছেপুরনের খেলা। কোনও প্রতিপক্ষ নেই, কোনও হারজিত নেই। শুধু খেলার আনন্দ। কিন্তু মেয়ের জন্য এ খেলাতেও কি তাঁকে এবার ইতি টানতে হবে? ফোনেই কি ভীষণ চিৎকার! কেন এরকম করে পাগলামি করা! স্নেহময় বুঝতেই পারেন না মেয়েটা কেন ওরকম করে! এত কঠিন কেন ও! আজ আরেকবার লেখার ডেস্কটা টেনে কোলের কাছে নিতে নিতে তিনি ভাবলেন, এবার ফোন এলে স্পষ্ট বলে দেবেন, তাঁর ইচ্ছে তাই তিনি লেখেন। ও এর মধ্যে নাক না গলালেই ভালো। তাইতে যা হবার হবে। স্নেহময় আরও ভেবেছেন। টাকাপয়সা যা আছে সবখানেই কৃত্তিকা নমিনি। কিছু করার নেই। কিন্তু বাড়িটা এখনও উনি ওকে দেননি। তিনি মনঃস্থির করেই ফেলেছেন। এ বাড়ি বিকাশের। আজ ইন্দ্র থাকলে তো বাড়ি ওরই থাকত। শুধু তাই নয়, কয়েকটা যে ডিপোজিট উনি ইন্দ্রর জন্য রেখেছিলেন, সেটাও ওই মেয়েটিকে দিয়ে যাবেন। কি যেন নাম? রোশনি। মেয়েটাকে চোখে দেখা হয়নি। দরকার নেই। এই ভালো। কাছাকাছি থাকলে, মনে আরেকটু সাহস দিলে হয়ত ইন্দ্র এভাবে চলে যেতনা। আজ যখন ছেলেটাই নেই তখন রোশনির মুখোমুখি হবার লজ্জাটুকু এড়ানোই ভালো। বরং কাগজপত্রগুলো ইন্দ্রর থিকানায় পাঠিয়ে দেবেন। বিকাশ এইটুকু করে দেবে। ছেলের কাজ ওই করে তো। 

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে স্নেহময় উঠে দাঁড়ান। গালে হাত বুলিয়ে সাতদিনের পুরনো দাড়ি টের পান। একেবারে পরিষ্কার হয়ে স্নান সেরেই নয় লিখতে বসবেন। শান্তি এসে পড়েছে। তিনি নিশ্চিন্তে বাথরুমে যেতে পারবেন। বাথরুমে এসে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গালে হাত দিয়ে নিজের মুখটা একবার আয়নায় দেখলেন স্নেহময়। কিন্তু এ কে? দেখতে তো অবিকল তিনি! অথচ ঠিক তিনি নয়। স্নেহময় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন- কে তুমি? তুমি তো স্নেহময় নও! আয়নার ওপাশের মুখটা কি হাসি ফিরিয়ে দিলো? ফিসফিস গলায় সেও বলল- আমি প্রীতিময়। ও কি হচ্ছে? হ্যাঁ? লেখা না ছেলেখেলা? স্নেহময় যেন একটা স্বপ্নের মধ্যে প্রবেশ করছেন। বলছেন- অবসর কাটাই কি করে? বলো? স্ত্রী নেই, ছেলেটা অকালে চলে গেলো। আয়নার ওপাশ থেকে প্রীতিময়ের মুখটা বিষণ্ণ হয়ে আসছে। হঠাৎ শান্তির ডাকে স্নেহময় আয়না থেকে সরে এলেন। কাকাবাবু কি করছেন এতক্ষণ? বিকাশ খুব বকবে আমায়। হয়েছে সব? স্নেহময় এমন দুর্বল বোধ করছেন যে উত্তর দিতেও কষ্ট হচ্ছে। শান্তি যেন বুঝেছে। যত্ন করে ডাইনিং এর একদিকে এনে বসিয়েছে। তারপর অপটু হাতে স্নেহময়ের গালের দাড়ি কামিয়ে দিতে দিতে বকবক করেছে- কাকাবাবু, এই বিকাশটা যেন কেমন ধারা। এখন বলছে, শান্তি তোর মেয়ে বড় ছোট। ওকে লেকাপড়া করা। এখুনি বিয়ে থা দিস না। স্নেহময় খুব দুর্বল বোধ করছেন। কথার উত্তর দেবার ইচ্ছে হচ্ছেনা। মনে মনে বিকাশকে আরও ভালো বাসছেন। কি ভালো ছেলে! চায়ের দোকানের রোজগার। শান্তি বিয়েতে বেশ কিছু দেবে থোবে। তবু লোভ জাগলনা। শান্তি আবার টেবিলে এনে বসিয়েছে। উঠোনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বড় আমগাছটার ছায়ায় স্নেহময় যেন কাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। কে ও? প্রীতিময়? সঙ্গে ও কে? ইন্দ্র? 

এখন বর্ষা অনেকটা সুস্থ। কস্তুরী ওকে নিয়ে বাইরে যাবে। সব ঠিক। দীপ্তির সঙ্গে থাকার জন্য কস্তুরী বুটিকের একটি মেয়েকে বলে রেখেছে। কয়েকটা তো দিন। আর মনোবিদের পরামর্শ মতো বর্ষার একটু পরিবেশ বদল দরকার। 

আজ বুটিকে বসে বসে বর্ষা ভাবছিল। কেউ বিশ্বাস করলনা। কিন্তু বর্ষা নিজেকে অবিশ্বাস করবে কি করে? সে তো জানে যে ওই অটোওলা ওই গলি ওই বাড়ি, আর ওই বাড়ির বাসিন্দা সত্যি! কিন্তু কাউকে দেখাবে বলে গিয়ে কিছুতেই খুঁজে পেলনা! এটাই হয়ত ওর রোগ। এই ভুলে যাওয়া। রাস্তাঘাট বাড়িঘর ভুলে গেলে কি করে দেখাবে আর? ডাক্তারবাবু অবশ্য পুরোপুরি মিথ্যে ভাবেননি। বলেছেন, মনে পড়লে উনিও ওর সঙ্গে যাবেন। গিয়ে দেখে আসবেন সেই বাড়িটা। দেখে আসবেন প্রীতিময় এখন কোথায় থাকেন। অন্য একটা পৃথিবী তিনি নিজের মতো করে বানিয়ে নিয়েছেন এটা দারুন ঘটনা। বর্ষা সেটা শুনে আনন্দ পেয়েছে। মামন ভালো আছে। থাকুক। 

জীবন বয়ে চলেছে কাছে দূরে, এরকমই কতগুলো তৈরি করা ভুবনে। বাসিন্দারা কেবল কখনও কখনও গুলিয়ে ফ্যালে, কোনটা সত্যি তাদের বাসা আর কোনটা নয়।

0 comments: