প্রবন্ধ - শিবাংশু দে
Posted in প্রবন্ধবাবার অটোগ্র্যাফ খাতায় আচার্য সুনীতিকুমার লিখে দিয়েছিলেন তুলসীদাসের একটা দোঁহা|
‘‘যদ্যপি জগ দারুণ‚ দুখ নানা‚
সব তেঁ কঠিন জাতি অপমানা।।’’
প্রায় চুয়াত্তর বছর আগের কথা| লাটসাহেবের বাড়িতে তখনও ইউনিয়ন জ্যাক উড়তো| তাঁরা ভেবেছিলেন একদিন আমরা 'জাতি-অপমানা' জয় করবো| ব্যস‚ ইউনিয়ন জ্যাকটা নামিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা| জ্ঞান হবার সময় থেকে লেখাটি দেখেছি| জাতি-অপমানা যে কী ব্যাপার সেটা জানতে খুঁজেছি পুথিপত্র। হাত ধরেছি কবি’র| মানুষটির মননে জাতি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মাত্রার তোলপাড়। একটা ভিন্ন মাত্রা| তাঁর সিদ্ধির সব কিছুতে দেশি মানুষের উপরে জেগে থাকে আন্তর্জাতিক মানব| গান্ধিজির মতো মানুষও বুঝে উঠতে পারেননি কবির স্বভাবের এই দিকটি| 'Religion of Man' লিখে এদেশে ওদেশে সব মূঢ় জাতীয়তাবাদীর নিন্দার ভাগী হয়েছিলেন| 'জাতীয়তা'র শিকল ভেঙে ফেলেছিলেন তিনি। তবু 'জাতি অপমানা'র বেদনা তাঁকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে| জালিয়াঁওয়ালাবাগ ও তাঁর প্রতিক্রিয়া তো সবাই জানে|
অপ্রবাসী, অঋণী দ্বীপবাসীরা কবে থেকে যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলো। কবে থেকেই অলক্ষ্মীকে ভয় না পাওয়া প্রবাসীর লক্ষ্মীলাভ দস্তুর হয়ে দাঁড়ালো। সেটাই পুণ্য। 'স্বদেশ' মানে যদি নস্টালজিয়া, 'বিদেশ' কি একটা মূঢ় প্রত্যয়? প্রবাসী মেঘের জলে সোনার ধান। তবু কেন 'প্রবাসী' মানে অমর্যাদার কালো টিপ? 'প্রবাসী' হওয়া 'অপরাধ' নয়| এদেশে, ওদেশে, কোনও দেশেই। তার মর্যাদার কোনও লাইসেন্স লাগেনা চিরন্তন দেশে ও কালে। নিষ্প্রয়োজন| কোনটা যে 'দেশ', সেটাই তো সবসময় বুঝে ওঠা যায়না| চামড়ার রং নিয়ে পক্ষপাত তো এদেশেও রয়েছে পুরো মাত্রায়| রয়েছে জন্মগত জাতি নিয়ে কটাক্ষ| সে তো ব্যক্তি আমি পারিবারিক ভাবে দেখতে গেলে নিজের দেশেই 'প্রবাসী' চার পুরুষ| আমার যে বিপুল পরিমাণ আত্মীয়-বন্ধু ছড়িয়ে আছেন য়ুরোপ বা আমেরিকায়‚ তাঁদের সঙ্গে যখনই সাক্ষাৎ হয়‚ জানতে চাই 'জাতি অপমানা' কেমন লাগে? নবীন প্রজন্মের মানুষেরা হয়তো ততটা স্পর্শকাতর ন'ন| কিন্তু চল্লিশ পেরোনো আত্মীয়রা নিজেদের অস্বস্তি ঢাকেন না| একই স্তরের‚ হয়তো উচ্চ স্তরেরও যোগ্যতা‚ কুশলতা নিয়েও শুনেছি শাদা চামড়াদের থেকে অনেক অধস্তন থাকার বেদনা সইতে হয়| আমার এক ভাই‚ সে এম আই টি ও হার্ভার্ডে উচ্চ শিক্ষিত| দীর্ঘদিন বস্টনে থাকে| সেদিন বললো কোথাও লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল| হঠাৎ দু-চারজন শাদা চামড়া, যাদের লোকে রেডনেক বলে তাচ্ছিল্য করে, স্রেফ ধাক্কা দিয়ে তাকে লাইন থেকে বার করে নিজেরা দাঁড়িয়ে পড়লো সেখানে| বললো‚ পিছনে গিয়ে দাঁড়াও| আমি বলি‚ কী করলি তখন? সে বললো‚ কী আর করবো? পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম| বলি‚ কেউ কিছু বললো না? না দাদা‚ কেউ কিছু বলেনা| আজ আবার এক বন্ধুর সঙ্গে শাদা চামড়া একজন মানুষের অকারণ রূঢ় ব্যবহারের খবর পেলুম। তিনি দীর্ঘদিন মার্কিন দেশে আছেন। স্বাভাবিকভাবেই সেই দেশ তাঁকে দিয়েওছে বহুকিছু। কিন্তু মনেও করিয়ে দেয় তিনি তাঁদের লোক ন'ন। আমার এক ভায়রাভাই আরো লক্ষ মানুষের মতো 'মূলধন' জমিয়ে ফিরে আসতে চেয়েছিল| কারণ তখনও তার গায়ের চামড়াটা একটু মিহি থেকে গিয়েছিল| কিন্তু এখন সে আরো লক্ষ মানুষের মতো সব পেয়েছির দেশের অংশ হয়ে গিয়েছে| এগুলো হয়তো নিতান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা| অন্যরকম উদাহরণও হয়তো রয়েছে ভূরি ভূরি| উপার্জনের মাত্রা‚ যাপনের স্থিরতা‚ সাহেবি অনুশাসনের স্বাচ্ছন্দ্য‚ এককালের 'সচেতন' ভারতীয়দের জাতি-অপমানা ভুলিয়ে দেয়| নিজস্ব সান্ত্বনার স্পেস তৈরি করে নেয়। সেদেশে একটা সরকার পাল্টায়| কিছুদিন উদ্বেগে থাকে| আবার মানিয়ে নেয়| ভারতীয়দের মতো 'মানিয়ে' নেবার ক্ষমতা শুধু চিনদেশের মানুষদেরই থাকে| বিহারিরা মরে বম্বেতে, ঝাড়খণ্ডিরা মরে কর্ণাটকে, ছত্তিসগড়িরা মরে গুজরাতে। খেটে খাওয়া মানুষগুলো মরে যায় অবিচারে, অকৃতজ্ঞতায়। শুধু জেগে থাকে জাতি অপমানা। বাড়তে বাড়তে আকাশ ছোঁয়। পুরোনো সভ্যতার পুণ্য|
মানুষের রক্তে জাতিহিংসা রয়েছে| কেউ তাকে লালনপালন করে আনন্দ পায়| কেউ লুকিয়ে রাখে| কিন্তু বিষ থেকেই যায়| কী এদেশে‚ কী ওদেশে| আমাদের দেশেও তো রেডনেকের দল ক্রমশ বেড়ে উঠছে। দিন দুনি, রাত চৌগুণি। অবশ্যই আশা করিনি যে অচ্ছেদিন আসছে। 'বাঙালি জাগো' বলে যেকোনও সময় কল্কি অবতার ধুপ করে স্টেজে এসে নামবেন। তবে এই ক’দিনের মধ্যে অবস্থাটা যে এতটা খারাপ হবে, তাও ভাবিনি। লিস্ট মিলিয়ে লিখতে গেলে ফুরোবে না। উত্তরভারতের যে রুক্ষপ্রকৃতির 'হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান' জাতীয় মডেল আমরা বাল্যকাল থেকে দেখেছি নিজ বাসভূমে, তার বিষ যে এত দ্রুত সুবেহ বাংলাকেও গ্রাস করে নেবে, ভাবতে পারিনি। অথচ ঘটনাটি সেরকমই। গেল গেল রব তুলে অনশন ধর্নায় বসার উপক্রমকে অবশ্যই সমর্থন করিনা। কিন্তু বিষয়টি ভাবাচ্ছে। সতর্ক হওয়া জরুরি। বাঙালিরা এ জাতীয় অধমর্ণ অস্তিত্বের সংকট থেকে উদ্ধার হতে না পারলে ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নিয়ে বিশেষ সংশয়ের অবকাশ থাকেনা।
সারা বিশ্বে প্রতিটি মানুষগোষ্ঠীর দুরকম পরিচয় থাকে। একটি তার ঐতিহাসিক পরিচয়। কালখণ্ডের উদ্বর্তনের পথ ধরে, নথিবদ্ধ ধারাপাঠের পরিপ্রেক্ষিতে নিজস্ব অবস্থানকে চিনে নেওয়া। আর অন্যটি তার পরিচিত প্রতিবিম্বভিত্তিক কল্পনা। কোনটাই সর্বৈব সত্য বা মিথ্যা নয়। দুই ধরণের পরিচয়ের ভিতরই কিছু সারবস্তু থাকে। ঐতিহাসিক বস্তুস্থিতি ছাড়াও প্রতিটি জাতির একেকটা স্বীকৃত প্রতিবিম্ব থাকে। বাঙালিরও আছে। এই প্রতিবিম্ব সৃষ্টির পিছনে নানা ধারণা ও অভিজ্ঞতা কাজ করে। যে ভৌগোলিক অবস্থানে আজকের বাঙালিদের বাস, মহাভারতের যুগে তাদের অন্ত্যেবাসী মনে করা হতো। সেকালের অঙ্গদেশ, অর্থাৎ আজকের ভাগলপুর, তার পূর্বের অংশকে হস্তিনাপুরের মানুষ অসভ্য ও অনার্যদেশ মনে করতো। সেখানে আর্যদের নামে মাত্র বসবাস ছিলো। সে জন্যই পরম চতুর দুর্যোধন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় কর্ণকে অঙ্গদেশের রাজা হিসেবে ঘোষণা করলেন। বাংলায় যাকে বলে, উড়ো খই গোবিন্দায় নমো। কর্ণ কখনও ভুলেও তাঁর 'রাজ্য' দেখতে আসেননি। বাঙালির এই অবহেলিত অবস্থানটি তার ঐতিহাসিক 'ভাবমূর্তি'র অঙ্গ। বিকৃত, প্রতিবিম্বিত লোকশ্রুতির ফসল।। উত্তরাপথের আর্যজাতি 'বাঙালি'দের সম্বন্ধে পুরাণ যুগ থেকেই হীন ধারণা পোষণ করে এসেছে।
বলীরাজার পুত্রদের নিয়ে অঙ্গ, বঙ্গ বা কলিঙ্গের যে লোককথা, তা কিন্তু আর্যেতর মানুষদেরই উপাখ্যান। এই এলাকায় যে রাজ্যগুলো ছিলো, যেমন বঙ্গ, সুহ্ম থেকে প্রাগজ্যোতিষপুর, সেখানকার মানুষদের সম্বন্ধে আর্যাবর্তের দর্পিত অধিবাসীরা বেশ নিচু ধারণাই পোষণ করতো। তার রেশ আজও আছে। কারণ আর্য সভ্যতার সীমানা ছিলো মগধরাজ্যের সমৃদ্ধতম রাজপাট। যার সামনে কোসল থেকে গান্ধার, সবাই নিষ্প্রভ।
বাঙালির আদিতম জাতিগত অস্তিত্ত্ব গড়ে ওঠে তার সমুদ্রবাণিজ্যের সঙ্গে যোগাযোগকে কেন্দ্র করে। কাশ্মীরের রাজকবি কল্হনের লেখায় একটা উল্লেখ পাই, সমতটের মানুষদের। যাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে তারা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের মানুষ এবং দেবভাষা সংস্কৃত জানেনা। তার বদলে তারা পাখির ভাষায় কথা বলে। এ সময়ে ন্যায় ও তর্কশাস্ত্রের প্রতি বাঙালির আগ্রহ বেশ প্রচারিত ছিলো। যাঁরা প্রমথনাথ বিশীর 'নিকৃষ্ট গল্প' পাঠ করেছেন (জানিনা কজন এমন আছেন এখানে), তাঁদের মনে পড়বে কাশ্মীরের বা অবন্তীপুরের পটভূমিকায় 'ধনেপাতা' নামক সেই বিখ্যাত গল্পটি। মুঘল যুগে জাহাঙ্গির বাদশা বলেছিলেন, 'হুনরে চিন, হুজ্জতে বঙ্গাল'। অর্থাৎ চিন দেশের মানুষের স্কিল অনন্য আর বাঙালি অতুলনীয় হুজ্জত বাধাবার কলায়। সবাই স্বীকার করবেন জাহাঙ্গির যতই আনারকলি-নূরজাহান করুন না কেন, ক্রান্তদর্শী পুরুষ ছিলেন। একদিকে ন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্রের যুগান্তকারী চর্চা, আবার তার সঙ্গেই নিমাই পণ্ডিতের ভাসিয়ে দেওয়া প্রেমধর্ম। দিগ্বিজয়ী সমুদ্রযাত্রী বীরের দল, মঙ্গলকাব্যের লোকায়ত দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা, অপরপক্ষে ভীত সন্ত্রস্ত তৈলচিক্কন বাবু কালচারের প্রতিনিধিরা। আবার কী শরণ নিতে হবে সেই, 'মেলাবেন, তিনি মেলাবেন' মন্ত্রের।
পশ্চিমে পরাক্রান্ত মগধ, দক্ষিণে সমান পরাক্রান্ত ওড্র, উৎকল ও কলিঙ্গদেশ উত্তরে অরণ্যবিকীর্ণ অঙ্গদেশ ও পূর্বে পর্বতারণ্যানীর সমারোহে অগম্য উপজাতি সভ্যতা, এই নিয়ে বাঙালির যে সভ্যতা গড়ে ওঠে তার মধ্যে আর্য, দ্রাবিড়, মোঙ্গল ও অস্ট্রিক, সবারই কিছু কিছু রক্তবীজ এসে পড়ে। বাঙালি সে অর্থে ভারতবর্ষের প্রথম প্রকৃত pot boiled জাতি।
আমাদের এইসব স্ববিরোধী ঐতিহাসিক অবস্থান থেকেই দেশবিদেশে মানুষের মনে বাঙালির ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। এই গৌরচন্দ্রিকা একটু আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। 'বাঙালি'রা কীভাবে তাদের সন্তানসন্ততিদের আত্মপরিচয় সম্বন্ধে ওয়কিফহাল করবে। বাঙালিরা তাদের কোন পরিচয়ের সঙ্গে নিজেদের চিহ্নিত করে অথবা কেন করে, সেটাই বৃহৎ প্রশ্ন। যেমন বলা হয়, 'as much Bengali as rasogolla'। শ্লেষার্থে গড়ে ওঠা এ জাতীয় ধারণাবলী থেকে নিজেদের বার করে আনতে প্রচুর উদ্যম প্রয়োজন। অভিজ্ঞতা বলে, বাঙালিদের সে উদ্যম আছে বলে মনে হয়না। তাদের ভাবনার বাইনারি জগতে লাল-সবুজ দাদাদিদি, ইস্ট-মোহন, বাঙাল-ঘটি, চিংড়ি-ইলিশের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি যে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা হয়, সেই শ্রমের ভগ্নাংশও আত্মপরিচয় গড়ে তোলার কাজে ব্যয় করা হয়না। ১৯৪৭এর দেশভাগের পর বাঙালির জাতি পরিচয় এই মুহূর্তে আবার তুমুল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাঙালিকে গোবলয়ের অংশ করে তুলতে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেমেছে বণিক আর মাফিয়ার দল। পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণের মাধ্যমে তারা কাজটা অনেকটা এগিয়েও নিয়েছে। 'হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান' নামক উত্তর ভারতীয় জাতিসত্ত্বার বিকৃত, গলিত শবদেহটি বাঙালির স্কন্ধলগ্ন করে দেবার জন্য কোমর বেঁধে নেমে গেছে শাসক গোষ্ঠী। মনে হয় অচিরকালেই আমাদের উত্তরসূরিরা গোপনে নিজেদের মধ্যে 'হামরাও বঙ্গালি হচ্ছি' বলে পরিচয় বিনিময় করবে। বাহাত্তর বছর আগে করে যাওয়া সুনীতিকুমারের আশংকা, বাস্তব হবার পথে অনেকটা অগ্রসর হয়ে গেছে।
জর্জ ফ্লয়েড অথবা জেকব ব্লেক নামক অনন্ত পাশার চৌরসে পাওয়া যাচ্ছে রহু চণ্ডালের হাড়। জর্জের দেশটা না হয় ইতিহাসহীন। শুধু বর্তমানের জোরে চলে। চলে যায়। সত্য-মিথ্যার বিচার আলাদা আমাদের থেকে। পরিপ্রেক্ষিতগুলি একেবারে আলাদা। কিন্তু প্রথম তারা নিজের জমিতে অনুভব করছে রক্ত, কান্না, আগুনের প্রলয়ংকর বিপর্যয়। আইনের সমাজ ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে বেআইনি লুটপাট, অরাজকতায়। সর্বশক্তিমান রাজাকে ভূমিগত বাংকারের ব্যবস্থা দেখে আসতে হচ্ছে। যেমন অন্য একজনকে শেষ পর্যন্ত দেখা গিয়েছিলো বার্লিনের পাতালে। খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়। মানুষকে অস্বীকার করে, মানবিকতা থেকে ইস্তফা দিয়ে কোনও দিন কেউ টিকে থাকে না। কিন্তু এদেশে তো আড়াই-তিন হাজার বছরের নথিবদ্ধ ইতিহাস। ইতিহাসের শিক্ষা পৃথিবীতে আমাদের মতো আর কারো কাছে নেই। বার বার মুখ থুবড়ে পড়া। বার বার লাফিয়ে উঠে হাঁটতে থাকা। ঐ খেটে খাওয়া মানুষগুলির মতো। তাদের এই জীবনী শক্তি কোথা থেকে আস! তাদের সঙ্গে হিমালয়প্রমাণ অবিচার। কীটপতঙ্গের মতো মৃত্যু। তবু তারা কোথাও আগুন জ্বালিয়ে দেয়নি। অন্যের সম্পত্তি লুটপাট করেনি। মৃত্যু তাদের ধ্বংস করতে পারে না। তারা জানে শরীরের মৃত্যু হবেই। জন ল্যাংয়ের 'ওয়ান্ডারিংস ইন ইন্ডিয়া' বইয়ে সেই আফঘানিস্তান যুদ্ধ জিতে ফিরে আসা ছ-ফুট দু ইঞ্চি লম্বা অওধের দুর্ধর্ষ সিপাহি মৌন সিংয়ের গল্প দেখেছি আমরা। তার যখন মনে হলো, মারা যাবে, তখন পিছু ফিরে দেখা নয়। তার সেনাপতি লেফটেন্যান্ট সাহেব জন ল্যাংকে বলছেন, 'They always fancy they are going to die, if there is anything the matter with them.' মরতে রাজি, কিন্তু জাতি-অপমানা সইতে পারবে না। বাঙালির কি মনে থাকে তাদের জাতি পরিচয় কী? তার সম্মান আর অপমানের বোধ? গরিমা আর গৌরব? অস্তিত্ব রক্ষার ন্যূনতম সম্বল কিছু আদর্শ, কিছু প্রস্তুতি?
বাঙালিরা কি বুঝতে পারছে না, তাদের উত্তরসূরিরা মরে যাবে, পুড়ে যাবে, কাল সমুদ্রের তীর ধরে ধরে গাঁথা থাকবে তাদের সমাধি পাথর।
কখনও মনে হয় তুলসীদাস বা সুনীতিকুমার কোনও এক অলীক দেশের মানুষ, যাঁদের জন্য শুধু রাখা থাকে আমাদের ব্যর্থ নমস্কার|
উপলব্ধির সম্পদে ঋদ্ধ অনবদ্য বক্তব্য!
ReplyDeleteজন্মাবধি বহির্বঙ্গের বাসিন্দা হবার সুবাদে প্রচ্ছন্ন ও প্রকট নানারকম জাতি অপমানের শিকার হয়ে ও 'মানুষের অধিকারে' বারবার বঞ্চিত হয়ে আমরাও সেই উপলব্ধির অংশী। পশ্চিমবঙ্গ ও বহির্বঙ্গ মিলিয়ে চারপাশের বাঙালি পদবিধারীদের দেখে খুব একটা ভরসা পাইনা। এখন মাঝে মাঝে আমাদের মনে পড়ে যায়, "একদিন বাঙ্গালি ছিলাম রে!" কিন্তু আমাদের পরের প্রজন্মের সেটুকুও মনে পড়বে না, কারণ তারা যে কোনদিনই বাঙালি ছিল না। মানসিক ক্রীতদাসত্ব মনে হয় আমাদের আগের প্রজন্ম থেকেই শুরু হয়েছে। আমাদের হাতে এখন একটিই কাজ অবশিষ্ট আছে - বাঙালি জাতির জন্য একটি এপিটাফ লিখে রেখে যাওয়া।