পুবের জানালা - রুখসানা কাজল
Posted in পুবের জানালাআমাদের ক্যালেন্ডারগুলোতে ইংরেজি মাসের সাথে কেন যে বাংলা মাসগুলো দেওয়া থাকে না কে জানে! এবারের আশ্বিন মাসের প্রথম দিনের ভোরটি আমার ভীষণ দরকার। তাই ১৬ আগস্ট, ভাদ্র মাস শুরু হতেই নড়েচড়ে বসি। তারিখটাকে সার্কেল করে প্রমিস করি, আশ্বিনের প্রথম দিনের ভোর আমাকে ধরতেই হবে। কিছুতেই মিস করা চলবে না।
মাখনের মত নরম কোমল আলো লেগে থাকা কিছু অনুভব নেমে আসে আমার মনে। এবার আমি গাস্যি করব। মায়ের ভেজা চুলের মত মখমল ঠাণ্ডা ভোরে অলকানন্দা, গুটি করবী, কণকলতা আর গন্ধরাজ গাছের সাথে হবে আমার গাস্যি। গাছগুলোতে কিছুতেই ফুল আসছে না।
রোজ সার পানি দিয়ে গান শুনাই। গায়ে মাথায় পাতায় ডালে হাত বুলিয়ে আদর করি। তবু ফুল ফোটায় না। তাই ত মনে পড়ে গেল আশ্বিনের প্রথম ভোরে আমাদের ছোট্ট শহরের গাস্যি উৎসবের কথা। সে কী হইহই ব্যাপার ছিল! বয়সে বড় কেউ দা নিয়ে অফুলবতী বা অফলবান গাছকে ভয় দেখানোর নাটক করে বলত, হ্যারে গাছ তুই কবে ফল দিবি, কবে ফুল ফোটাবি? এরমভাবে আর কতদিন থাকবি তুই! নাহ্ আর ত সহ্যি হচ্ছি না। ইবার তোকে রাখব না। কাটি ফেলাবো। ফেলাবোই---
দা উঁচিয়ে কোপানোর ভান করতেই আমরা কুচোকাচারা গাছটাকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠতাম, কেটো না কেটো না প্লিজ। দেখো সামনে বার সিওর ফলফুল ফোটাবেনে। ও কাকু এবা্রের মত ছাড়ি দাও। কেটো না গো কাকু।
কাকু তখন রক্তরাঙ্গা চোখ করে গাছের গায়ে আলতো করে দা ঠেকিয়ে বলত, ওকে ওকে। আচ্ছা তোরা বললি বলে এবারের মত ছাড়ি দিচ্ছি। তয় আসছি বছর ফলফুল না দিলি সত্যি সত্যি কাটি ফেলাবানি কিন্তুক। কারও কথা শুনবোনানে।
নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, ভয় পেয়ে এবার ফলফুল দিবে গাছ। অনেক সময় বাস্তবে এমন ঘটেও যেত।
আমরা কেউ কখনও জানতে চাইনি, গাস্যি কাদের আচার অনুষ্ঠান। হিন্দু্র নাকি মোছলমানের। শুধু জানতাম এ যে আনন্দের এক মহা উৎসব।
অথচ বড় হতে হতে শুনলাম, এগুলো হিন্দুদের আচার। মোছলমানের করা পাপ। কেউ কেউ যদিও প্রতিবাদ করে বলেছিল, গাছের আবার হিন্দু আর মোছলমান। যত্তসব ধর্ম ফাজিলদের কান্ডকারখানা।
আমাদের অনেকেরই মুখ শুকিয়ে গেছিল। গাস্যি ত বাহানা। আসলে সেদিন গাছওয়ালা হিন্দু মোছলমানদের বাড়িতে কাঁসার থালা ভর্তি নারকুলে সন্দেশ, তালের পিঠা আর তালের ফোঁপা সাজানো থাকত। দেদারসে খেতাম। এমনকি চালাকি করে ডান হাতেরটা বাঁ হাতে রেখে আবার ডানহাত পেতে দিতাম আমরা।
করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে কি করে যেন পেরিয়ে গেল আশ্বিনের ভোর। যখন বুঝলাম তখন দুপুর হয়ে গেছে! গাছগুলো ছায়া ফেলে মায়াঘর বানিয়ে খেলছে বারান্দায়।
সকালে ভেজা কাপড় নেড়ে দিয়ে কিচেন ঝেড়ে মুছে চুলোয় আগুন জ্বালাচ্ছি, ছেলে এসে দাঁড়ালো, মাম দাঁত ব্যথা করছে। শক্ত ছেলে, সহজে কিছু বলে না। নুনজল করে দিয়ে জানাই ব্যাথাটা মেনে নিতে হবে বাবা। তোমার থার্ড মোলার টিথ উঠছে যে! চলে যেতে যেতে ফিরে আসে ছেলে। মূহূর্তের জন্যে ওর চিবুক ছুঁয়ে যায় আমার চুল। আমি বুঝি সে স্পর্শের ভাষা, লাভ ইউ মাম। হ্যাপি ডটার্স ডে।
ডটার! মানে কন্যা, আমি আমরা! সুখে আছি কি?
পাহাড়ের মৌন শান্তশ্রীকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাগড়াছড়িতে আদিবাসী এক প্রতিবন্ধী কন্যাকে ধর্ষণ করেছে নয় জন সমতলের বাঙ্গালী পুরুষ। সিলেটে ধর্ষিত হয়েছে এক নববধূ। নোয়াখালীতে নারীদেহ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। ফেসবুক, টিভির বদৌলতে জানা যাচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও ভাল নেই নারীরা। ধর্ষণের ধরণ পাল্টেছে। এখন একজন নয়। দলবদ্ধভাবে এমনকি কোথাও কোথাও হিন্দু মোছলমান মিলেঝুলেও ধর্ষণ করছে। শিশ্নের কাছে ধর্মও পরাজিত।
লবঙ্গ এলাচ, দারচিনির সাথে লেবু চায়ের উপর দুটি পুদিনাপাতা ভাসিয়ে অন্যমনে ভাবি, পুরুষত্ব কি কেবল শিশ্নে বাঁধা এক পাশবিক তমসুক! কেবলি শিকার, খুন, হত্যা, নির্যাতন, দখল ধর্ষণ আত্মসাৎ এর পশ্বাচার? পুরুষ পুরুষ তোমার কী মন নেই পুরুষ?
বাংলাদেশে সম্ভবত কভিড১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ তরঙ্গিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত এটি হতেই থাকবে। ভয়কে তুচ্ছ করে বীর বাঙ্গালীরা বেরিয়ে পড়েছে। অধিকাংশের মাস্ক নেই। কারও আছে। কেউবা গলায় মালা করে রেখেছে আবার কেউ কেউ জোরালোভাবে শুধু মহামূল্যবান চিবুকখানি ঢেকে রেখেছে সযত্নে। ফলে করোনা তার রক্তিম আঙ্গুল তুলে বলে দিয়েছে, রেডি সেডি গোওও —রি স্টার্ট অ্যাকশন ধুমসেএএ। ! মৃত্যু বাড়ছে। গ্রাফ উর্ধ্বমুখীন।
জিম এখও বন্ধ। তাই হাঁটতে বেরিয়েছিলাম লেকের আশপাশে। দেখি ব্রজে গোপাল খেলছে। রাধা রাঙিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। জনম জনম ভরের খেলা। হ্যাপি শারদীয়া আন্টি! আমি হেসে ফেলি। ধানমন্ডি বত্রিশের কালো পিচের রাস্তায় ঝাঁপিয়ে ঝরেছে রাতের শেফালি। মর্নিং ওয়াকের নাম করে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে এসেছে আমাদের ফ্ল্যাটের সাততলার মেয়েটি। প্রেমিকের কাস্ট আলাদা। তাই নিয়ে নিত্য ঝগড়াঝাঁটি। লিফটে দেখা হলেই মেয়েটি হাসে, এসব কেউ মানে এখন!
গেল মার্চে হোলির সকালে চারুকলায় যাওয়ার আগে দেখা করে গেছে, আন্টি হ্যাপি হোলি। আপনার গিফট। সঞ্জয় দিয়েছে।
ফাটাফাটি সুন্দর দুটি শোলার পাখি। রঙে রঙিন। এক ডালে মুখোমুখি দুজন। গল্পবাজ ভঙ্গী। আমি খুশিতে উইশ করি, তোমাদের হোলি, আমাদের দোল।
আমাদের?
ছিটকে উঠে আসে ধাঁ ধাঁ এক দুপুর, এই তোরা হিন্দু হইছিস তাই না?
কালো দাড়ি, ফর্সা বাচ্চুকাকার পাশে কুচুটে ঠান্ডু কাজি। অন্ধ রাগে কান মলে দেয় ভাইয়া আর আমার। রঙপচা স্যাঁতসেঁতে এক বোটকাগন্ধে মন খারাপ হয়ে যায় আমাদের। রঙ খেলা ফেলে ফিরে আসি ঘরে। দুপুরে ফার্মেসি থেকে বাপি ফিরলে বুঝিয়ে দেয়, ধর্ম যার যার উৎসব সবার।
ফোঁস করে উঠে মা, ওদের সাহস হয় কি করে শুনি! আমার ছেলেমেয়েদের কান কি সস্তা? ওরা কারা?
আল্লামা শফি সাহেব মেয়েদের তেঁতুলের সাথে তুলনা করে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবীনামা পেশ করেছিলেন। দাবী নামাগুলো পরে এক সময় আলোচনা করা যাবে। এবার একটি সত্যি কথা বলি, তেঁতুল কি কেবল পুরুষদের লোভ জাগায়? আমরা নারীরা কি ক্রাশ খাইনা কোন কোন পুরুষের সিক্স প্যাক বডি, ভয়েস, চোখ, কথা বলার আর্ট, মেধা, সততা দেখে। তো পুরুষরাও ত ভোগ্য। তারা কেন নিজেদের ঢেকে রাখে না?
যদিও কয়েক শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মজাক হলো, নারীদের ঢাকনা দিয়ে রাখার নিয়ম।
ঢেকে রাখলেই কি ধর্ষণসহ নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে! কুমিল্লার তানিয়া, চট্টগ্রামের পোশাককন্যা, নোয়াখালীর রোজীসহ ধর্ষিতাদের অধিকাংশ বোরখা হিজাবের ঢাকনাতে ঢাকা ছিল। ওরা পেরেছে ধর্ষণ এড়াতে?
মিরপুর রোডের জ্যামে আটকে আছি। কে বলবে করোনাকাল! গাড়ী, মানুষে মিলেমিশে এক বিপুল জনসমুদ্র। জীবন যেন হো হো করে হোপাক নাচছে। ওদিকে বেঙ্গলে অপেক্ষায় রয়েছে একজন। হঠাৎ চোখে পড়ে আমার রিক্সা বাহকের দিকে। হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ক্লান্ত জীর্ণ চেহারা। দুপায়ে রবারের গোলা। ধানমন্ডির ছায়ামাখা রাস্তায় যেতে যেতে জানতে চাই, বাড়ি কই গো মামু? সিরাজগঞ্জ। ওহো, নদীভাঙ্গা দেশের মানুষ আপনি। তা কেমন আছে যমুনা?
জানিনা গো মা। যমুনা ছাড়ি অনেকদূর চলি আসিছি। আগে পাতাম নদীর গন্ধ। এখন খালি ধুলো পলিথিন আর বিষ্ঠার গন্ধ পাই।
লকলকিয়ে ওঠে আমার পাপী জিভ, মামু কোনো দিন ভরপেট ভাত খাইছেন? থালা থালা গরম ভাত!
প্যাডেল স্লো করে এবার ফিরে দেখে আমাকে। মেডিকেল মাস্কে বাঁধা মুখ, উথাল পাথাল এক বোঝা খাটো চুল আর পিউনিফুলের মত ছোট চোখের আমাকে দেখে কি ভাবল কে জানে!
খাইছিলাম একবার। আমাগের ইউনুস মেম্বারের মা মরি গেলি জেয়াফত হইছিল। অড়হড়ের ডালের সাথি আলুকচু আর মুরগির গিলাপরান পা চামড়ার লটপটি। ঝাঁকা ঝাঁকা ভাত। কী যে সোয়াদ –
মিনমিন হয়ে আসে আমার সুর, মাংস দেয়নি?
কী যে কন মা। মাংস পোলাউ খাইছেলো বড়লোকরা। চেয়ারমেনের জন্যি শুনেছি আস্তো খাসি হইছেলো। তারা ছেলো তাম্বুর ভিত্রে। আমরা খাইছিলাম তাম্বুর পিছনে ইশকুলির মাঠে বসি। মনে কয় তিন চার থাল ---
সিটের উপর কিছু বেশি টাকা রেখে নিজের শয়তান মনটাকে অভিশাপ দিতে দিতে নেমে আসি। নেমে আসি নাকি পালিয়ে আসি কে জানে!
কোয়ান্টাম ক্লাশে মডারেটর যখন দুমিনিটের জন্যে চোখ বুঁজতে বলে, আমার অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। মনে হয় কেয়ামত হয়ে যাবে এই দুমিনিটে। কিছুই দেখতে পাবো না। একবার বাঁ চোখ অন্য বার ডান চোখ বন্ধ করে ডান বামের নড়াচড়া, বন্ধ মুখের অভিব্যক্তি দেখে হাসি পেয়ে যায়। স্তব্ধতায় ভেসে আসে মডারেটরের কথামালা, এবার নিজেকে সমর্পণ করুন, মৃত অথবা বিচ্ছিন্ন বন্ধু প্রিয়জনের জন্যে কাঁদুন, হালকা করে নিন দুঃখের অপরাহত আঘাতকে।
একটুখানি চোখ বন্ধ করেই তাকিয়ে ফেলি, আমি তো এমনিতেই নদী। সামান্য টাল খেলেই দুকূল ভাসিয়ে কেঁদে ফেলি। তাই বলে এমন অর্ডারি কান্না! নাহ্ আর আসব না এখানে।
আমি বরং মনছবিতে হেঁটে চলে যাই নদী ধরে। বড় নদীর ভেজা বুকের অতল থেকে গুমগুম ডাক শোনা যাচ্ছে। ঢেউ ভাঙ্গছে ফেনা তুলে। দেখি এক কোষা এক নাও দুলিয়ে দিচ্ছে শূন্য রঙের এক ফেরেশতা, কী খোঁজো জলকপালি মেয়ে?
তরঙ্গিত জলের ফণা পেরিয়ে দ্রুত নেমে আসি, আদমকে খুঁজছি গো! আবার গন্ধম খাবো! চলে যাবো কোনো অগম অতল সুনীল পাতালে। আবার গড়ে নেবো কোনো ঈশ্বর। নীতিবাগীশের ধুতি টুপি আয়াত শ্লোকের ভার ছেড়ে সে ঈশ্বর সমান ভাগে খেতে দেবে মানুষকে, সমান ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে সবাইকে।
ফেরেশতা জল ছিটোয় চকিত ঠারে, আদম কি রাজি হবে মেয়ে?
0 comments: