প্রবন্ধ - সোমব্রত সরকার
Posted in প্রবন্ধদুই
প্রথম কৈবর্ত শব্দটির প্রয়োগ দেখি আমরা তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে। কৈবর্ত শব্দটির প্রাচীনতম রূপ হল কেবর্ত। এর ধাতুগত অর্থ হল, কে(জেলে) বর্ততে ইতি কেবর্ত। মৎস্যজীবী সম্প্রদায়কে আবার ধীবরও বলা হয়। ধীবর সংস্কৃত শব্দ। বাংলায় জেলে বা জালিয়া। পুরাণ সহ বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে ধীবর শব্দের অর্থ মৎস্যঘাতী। রাঢ় অঞ্চলে মৎস্যজীবীরা সব ধীবর বলেই পরিচিত। বৈদিক যুগে আবার জলকে অবলম্বন করে যাদের জীবিকা তাদের বলা হত কেবট্। এই কেবটরা নয়টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল তখন। সকলেই মাছের ব্যবসা করত। এরা সব ধৈবর, দাস, বৈন্দ, শৌসকলা, কৈবর্ত ও পর্ণক জাতি ক্ষত্রিয়দের সমকক্ষ ছিল। বিষ্ণুপুরাণে কৈবর্তদের অব্রাহ্মণ বলা হয়েছে। মনুস্মৃতিতে নিষাদ পিতার ঔরসে অয়োগব মাতার গর্ভজাত সন্তানের নামকরণ করেছে মার্গব বা দাস হিসেবে। আবার কৈবর্তও বলা হয়েছে। জীবিকা বলা হয়েছে নৌকা চালনা। বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, এই কৈবর্তরা আর্যপূর্ব কৌম্ বা গোষ্ঠী। মনুও এই মত পোষণ করেছেন। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে ধীবর ও কৈবর্তদের দেখানো রয়েছে অসংশূদ্র হিসেবে। এরা সকলেই মৎস্যজীবী। আবার বৃহদ্ধর্মপুরাণে ধীবররা মধ্যম সংকর পর্যায়ের বলে গোষ্ঠীভুক্ত রয়েছে। তবে এটা ধর নেওয়া যেতে পারে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ভেতর ধীবর-কৈবর্তদের উদ্ভব নিয়ে যে ব্যাখ্যা রয়েছে, সেই ব্যাখ্যাকে মান্য করেই কৈবর্ত ও মাহিষ্যদের আসন এক এবং অভিন্ন হয়ে ওঠে। পূর্ববঙ্গের হালিক দাস এবং পরাশর দাশ, হুগলি-বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের চাষি-কৈবর্তরা এখন নিজেদের মাহিষ্য বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। আবার ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট, ময়মনসিংহ, ঢাকার মৎস্যজীবীরা কৈবর্ত হিসেবে পরিচিত। এই সব উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট, কালক্রমে কৈবর্তদের মধ্যে দু’টি বিভাজন হয়। মৎস্যজীবীরা কৈবর্ত আর কৃষিজীবীরা মাহিষ্য। বৌদ্ধ জাতকের গল্পেও কৈবর্তরা হল মৎস্যজীবী। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে রয়েছে, তাম্রলিপ্তের রাজা ময়ূরধ্বজ ও শিরধ্বজ ছিলেন কৈবর্ত রাজা। এবং এঁরা জালিক কৈবর্ত। আবার রাজা শান্তনুও জালিয়া সর্দারের কন্যা সত্যবতীকে (মৎস্যগন্ধা) বিবাহ করেছিলেন। হরিবংশে দেখি শ্রীকৃষ্ণের আত্মীয়া শ্রুতদেবীর সঙ্গে কৈবর্ত রাজার বিবাহ হয়।
কৈবর্তদের প্রথম ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায় পাল রাজাদের সময়। দিব্য, রুদোক ও ভীম — এই তিন কৈবর্ত রাজা বরেন্দ্রভূমিতে রাজত্ব করার ফলে রাজ্যে ও সমাজে যে কৈবর্ত জাতির প্রতিপত্তি বাড়ে সে কথা বল্লালচরিতে রয়েছে। একাদশ-দ্বাদশ শতকে কৈবর্তরা বাংলাদেশে কেবট্ট নামে পরিচিত ছিল। তাঁরা সে সময় কেউ কেউ পণ্ডিতও ছিলেন। তার প্রমাণ হিসেবে ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ কাব্যগ্রন্থে কেবট্ট কবির পদ রয়েছে। পপীপ রচিত গঙ্গাসাগরের পদটি মধুর এবং যথেষ্ট সুন্দরও বটে। বল্লালচরিতে বলা রয়েছে, বল্লাল সেন কৈবর্তদের শ্রেণি বিভাজন করে তাদের মালাকার, কুম্ভকার ও কর্মকারে উন্নীত করে গেছেন। আর কৈবর্তদের মধ্যে সেই বৃত্তি পরিবর্তনকারী হালিক সম্প্রদায়ই মাহিষ্যতে উত্তীর্ণ হয়েছে সে সময়ই। বাংলার পদাতিক সৈন্যদের পাইক বলা হত। এই পাইক বাহিনীতেও কৈবর্তরা ছিল। মহাভারতের শান্তিপর্বেও দেখি সৈন্যদলে প্রান্তবাসী ভীল, বাগদী, কৈবর্তদের অংশগ্রহণ।
বর্তমানে কলকাতার জেলিয়া কৈবর্তদের পূর্বেকার বাসভূমি ছিল হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার খানাকুল-কৃষ্ণনগর, খানাকুল বন্দর, মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার মেদিনীপুর শহর এবং বাঁকুড়া। ১৯৩৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী ‘খানাকুল-কৃষ্ণনগর’ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে। তিনি বলেছিলেন:
একসময় বর্তমান খানাকুলের কৃষ্ণনগর গ্রাম নদীগর্ভে ছিল। উক্ত নদী রামগড় থেকে উৎপন্ন হয়ে রূপনারায়ণে মিশেছিল। এই নদীর তীরে ঘণ্টেশ্বর শিব। নদীটি কোনও কোনও স্থানে রত্নাকর আর শাখারঙা নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে নদীটি মজে গিয়ে কানা নামে টিঁকে আছে।
0 comments: