গল্প - অচিন্ত্য দাস
Posted in গল্পগাইড ছেলেটা বেশ কথা বলতে পারে। সামনের শ্বেত-পাথরের তিনতলা রাজবাড়িটা দেখিয়ে বলছিল – রাজস্থান-গুজরাটে ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ অনেকদিন থেকেই আছে। রাজারাণী, রাজকুমার-রাজকুমারী সবাই ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াতো। আর এই রাস্তার ধারে ছোটছোট দোকানগুলো দেখছেন..এগুলো আজকের নয়, বহুদিনের। অন্য রাজবাড়ির মেয়ে যখন বৌ হয়ে আসত তখন তার সঙ্গে তার বাপের বাড়ির কিছু দোকানপাট এমনকি লোকজনকেও এখানে নিয়ে আসা হতো যাতে নতুন জায়গা বৌএর অচেনা না লাগে। সেই থেকে এরা অনেকে এখানেই থেকে গেছে। এখানকার রাণীমা এসেছিল জুনাগড় থেকে…
তা গাইড ছেলেটা ঠিকই বলছে। এই তো সামনের ছোট মনিহারী দোকানটায় কতগুলো ঘুড়ি-লাটাই ঝুলছে।
হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা করছিল, একটা বেঞ্চিতে বসে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। যেন অনেকদিন পিছিয়ে গেছি। সাজ্জুর তখন পনেরো হবে। জুনাগড়ে তার বাবার পানের দোকান কিন্তু ওরা ঘুড়ি সূতো লাটাই এসবও রাখতো। সাজ্জু খুব ভালো ঘুড়ি তৈরি করতে পারতো, ওড়াতেও ওর জুড়ি ছিল না। রোজ বিকেলে এক কচ ঘুড়ি, সূতো সব নিয়ে রাজবাড়ির ছাদে আসতো। ভারি লাজুক ছেলেটি, চুপ করে বসে ঘুড়ি এগিয়ে দিতো রাজকুমার-কুমারীদের। রাজকুমারীর নাম রীম, সাজ্জুর সমানই হবে। ওদের ভাষায় রীম মানে সাদা হরিণ। হরিণই বটে - উচ্ছল, সব সময় ছুটে বেড়াচ্ছে। সাজ্জু শুধু দেখতো তাকে। ছাদের মাঝখানের শ্বেত-পাথরের চবুতরায় বসে রীম একদিন সাজ্জুর হাত ধরে বলল – “ এই সাজ্জু তুই আমাকে রীম বলিস না কেন রে? আজ থেকে বলবি। আর তুই তুই করে বলবি, আমরা তো বন্ধু, তাই না?
সাজ্জু অবশ্য সাহস করে বলতে পারেনি তবে একা বসে ঘুড়ি বানাতে বানাতে সে রীমের সঙ্গে মনে মনে ওরকম করে কথা বলত। কেন তা সে জানত না। রীমও বোঝেনি সাজ্জু না এলে এত ঘুড়ি উড়লেও গোটা আকাশটা কেন খালি খালি লাগতো তার।
দিন যায়। রীমের বিয়ে হলো এখানে। প্রথা মেনে কিছু দোকান-পাটও এলো। সাজ্জুর বাবা সাজ্জুকে পাঠালো। রাজাই দোকান বানিয়ে দেবে, সাজ্জুটা যদি দাঁড়িয়ে যায়। যা লাজুক ছেলে! মার্বেলের তিনতলা বিরাট ইমারতের হাত দশেক দূরেই সাজ্জুর দোকান। প্রথম প্রথম ঘুড়ি নিয়ে ছাদে যেত সাজ্জু, রাণীমা মানে রীমও আসতো। আস্তে আস্তে তা কমে গেলো। তবে রাণীমা রোজ পান আনাতো। সাজ্জু নিয়ে যেতো। রীম একদিন বলেছিলো – “সাজ্জু তুই কেন এখনো আমাকে মনে রেখছিস রে ?” চোখ নিচু করে সাজ্জু বলেছিলো “ তুমিও কি আমাকে মনে রেখেছো ?”
দিন যায়। সাজ্জুর পৃথিবী ওই প্রাসাদের দেয়াল অবধি। সে আর সংসার করেনি। বিকেলের দিকটায় দোকানের বাইরে ঘাসে বসে ঘুড়ির কাগজ কাটতো নয় পানের মশলা বানাতো। রাণীমা ছাদে উঠে নিচে দেখতো তাকে.. সাজ্জু কী করে যেন টের পেয়ে ওপরে তাকাতো।
বয়স তেমন হয়নি, রাজা মারা গেলেন। রাণীমার মাথায় অনেক দায়িত্ব এসে পড়ল। রাজকাজ, সরিকের ঝমেলা, রাজবাড়ির গোপন চক্রান্ত সব সামলাতে হতো।
সাজ্জুরও বয়স হয়েছে। চুলে পাক ধরছে, চোখে বোধহয় ছানি পড়ছে..দূরের জিনিস ঝাপসা দেখে। ভালই হয়েছে হয়তো.. ছাদের আলসেতে শুভ্র-বসনা রীমকে দেখে ওর মনে হয় এই তো সেই পনেরো বছরের কিশোরী মেয়েটি। সাদা হরিণ।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রাণীমার পায়ে ব্যথা, সিড়ি ভাঙ্গতে কষ্ট হয়। তবু বিকেলে একবার করে ছাদে ওঠাটা বন্ধ হয়নি। ব্যথা বাড়লে দু-একদিন বাদ পড়ে অবশ্য।
****
বেশ একটা ভালোবাসার গল্প বুনছিলাম এমন সময় ঘটাং ঘটাং আওয়াজে গল্পের সূতোটা ছিঁড়ে গেলো। গাইড ছেলেটি সবাইকে নিয়ে প্রাসাদের কোণে একটা ছোটমতো লোহার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমিও উঠে পেছন পেছন গেলাম।
-“ এই দরজাটার ভেতরে দেখুন, সেই অতদিন আগে এখানে ‘লিফ্ট’ লাগানো হয়েছিল ছাদ অবধি ওঠার জন্য। অনেক টাকা খরচ হয়েছিলো…শোনা যায় রাণীমা সব খরচা দিয়ে বিলেত থেকে ইঞ্জিনীয়র আনিয়ে এটা বসিয়েছিলেন। বলতেন – “খোলা ছাদটাই আমার জীবন, রোজ না উঠলে আমি যে আর বাঁচব না রে…”
আমি মনে মনে চমকে উঠলাম। আমার গল্পের ছেঁড়া সূতোটা কি জুড়ে গেল? প্রাসাদের শ্বেতপাথরের দেয়ালে অপরাহ্ণের হলদে আলো পড়েছে। সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো এইসব ইমারতের আনাচে-কানাচে গল্প আর সত্যি জট পাকিয়ে রয়ে যায়। পাথরের বাড়ি তো কথা বলে না, মনে মনে বুঝে নিতে হয়…
0 comments: