0

প্রবন্ধ - রিমি মুৎসুদ্দি

Posted in


-না, আমি একটু ঘুরে আসি। আশেপাশের হোটেলগুলোও একটু দেখে আসি।

সাংবাদিক যুবকটি হোটেল থেকে বেরোতে উদ্যত হলে হোটেলের ম্যানেজার বলে ওঠেন -আরে স্যার, অন্যকোথাও যাবেন কেন? এই হোটেলের থেকে কম রেটে আপনি পুরো বস্তারে কোথাও পাবেন না। লছমী, পানি পিলাও স্যারকো।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আদিবাসী মেয়েটা ম্যানেজারের ঘরের এককোণে রাখা মাটির কুঁজো থেকে গড়িয়ে একগ্লাস জল সাংবাদিকটির সামনে এগিয়ে দেয়।

হোটেলের বিল অফিস মিটিয়ে দিলেও ঘরের নোনাধরা দেওয়াল আর বাথরুমে জিরো পাওয়ারের থেকেও কম আলোর হলুদ বাল্বটা চোখের সামনে ভেসে ওঠায় সাংবাদিক ছেলেটি এই হোটেলে থাকতে চাইছে না। জলটুকু খেয়েই সে বেরিয়ে যেতে গেলে ম্যানেজার আবার বলে ওঠে -স্যার, এই রুমের সাথে আপনি ওই লছমীকে ফ্রি পাবেন। আপনি যখন বলবেন, যতক্ষণ বলবেন আপনাকে সার্ভিস দিয়ে যাবে।

কথাটা শুনে চমকে উঠলেও সাংবাদিক অভিজ্ঞতায় এইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি সে আগেও হয়েছে। লছমী নামে আদিবাসী যুবতীটির কালো চোখে কী ভীষণ কাঠিন্য, নির্লিপ্তি! তবু এখনও যেন বনভূমির সরলতা লেগে রয়েছে ওই মুখে। বস্তারের জঙ্গলে বসবাসকারী বেশিরভাগ আদিবাসী যুবতী, কিশোরীর গল্পটা খানিকটা একইরকম। সালওয়া জুড়ুম বন্ধ হলেও যখন তখন হয় পুলিশ, নয় মাওবাদীদের অত্যাচারে ওদের অনেকেরই ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। অনেকের পরিবারের পুরুষ সদস্য মারা গেছে। টাটা কোম্পানি বক্সাইটের জন্য যে যে অংশগুলো লিজ নিয়েছে, জঙ্গলের সেই অংশগুলোয় ওরা ঢুকতে পারে না। তাই ওদের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যে বনভূমির ওপর এতদিন ধরে ওরা নির্ভর করত, তা এখন রাষ্ট্র ও বহুজাতিকের মালিকানা হওয়াতে ওরা ঘরছাড়া, ভূমিহীন, অরণ্যহীন।

Feminisation of Poverty- সারা পৃথিবীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্রের ভার (Burden of Poverty) নারীদের ওপরই বর্তায়। UNIFEM-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘the burden of poverty is borne by women, especially in developing countries.’ এর কারণ হিসাবে জেণ্ডার বায়াসকেই দায়ী করেছে WHO থেকে UNESCO। ইউনাইটেড নেশন ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম (UNDP)-এর জেণ্ডার রিলেটেড হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইন্ডেক্স ও হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইন্ডেক্স- এই দুই উন্নয়ন সূচক অনুসারে সারা বিশ্বে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের লাইফ এক্সপেক্ট্যান্সি ও মরটালিটি রেট অনেক কম।

মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক, অধ্যাপক ডায়না পিয়ার্স সারা বিশ্বের ৩৭টি উন্নয়নশীল দেশের ওপর গবেষণা করে দেখেছেন, দারিদ্র্যের দায়ভার ও বোঝা বেশিরভাগ দেশে ও সামাজিক পরিকাঠামোতে মহিলারাই ভোগ করেন।

অপুষ্টি ও স্বাস্থ্য-পরিষেবার অভাব, নূন্যতম জীবনধারণের অধিকার থেকে বঞ্চিতের পরিসংখ্যানে আমাদের দেশে মহিলাদের সংখ্যা অনেক বেশী- অর্থনীতিবিদ উমা কাপিলা তাঁর বই India’s Economic Development Since 1947-এ পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝিয়েছেন। উমা কাপিলার গবেষণা অনুযায়ী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মহিলাদের সমস্যা সেই অঞ্চলের ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক কারণগুলোর উপর নির্ভরশীল। এবং অবশ্যই জেন্ডার বায়াসের যে মানসিকতা শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের হাড়ে মজ্জায় ঢুকে রয়েছে, সেগুলোও অন্যতম কারণ।

ভারতবর্ষের আরো একটা গ্রামের চিত্র দিই। রাজস্থানের প্রত্যন্ত কয়েকটা গ্রাম। যেখানে নিম্নবর্ণ উচ্চবর্ণের ভেদাভেদ একেবারে দিনের আলোর মতোই দৃশ্যমান। মেয়েরা জলের খোঁজে দূরদূরান্তে যায়। তবু কাছাকাছি, উচ্চবর্ণের জলাশয়ের ধারেকাছেও যেতে পারে না। বেশিরভাগ দিনই শূন্য কলসি হাতে ফিরে আসে। দূরের একটামাত্র কুয়োতে অর্ধেক সময় জল থাকে না। আবার বাড়িতে জলের অভাব হলে বাড়ির পুরুষদের কাছেও মারধোর খায়। এটা সম্প্রতি ন্যাশনাল উইমেন কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখিত ঘটনা।

হরিয়ানা, পাঞ্জাবের বেশ কয়েকটা অঞ্চলে কন্যা ভ্রুণ হত্যা এমন পর্যায় উঠেছে যে ছেলেরা বিয়ে করা বা বংশরক্ষার জন্য মেয়ে পাচ্ছে না। তাই বাংলা, বিহার, ওড়িশা থেকে খুব গরীব ঘরের মেয়েরা এইসব অঞ্চলে পাচার হয়ে যায়। রীতিমতো পয়সা দিয়ে কিনে বিয়ে করে নেয় পাত্রটি। এরপর বয়স্ক থেকে কনিষ্ঠ পরিবারের সব পুরুষ সদস্যদেরই সেবাদাসী ও যৌনদাসীতে রূপান্তরিত হয় সেই মেয়েটি। আদিবাসী মেয়েদের অবস্থা আরো করুণ।

যাই হোক, দারিদ্র্যের সংজ্ঞা বা তথ্যের কপচানি না দিয়ে সাধারণ জীবনের আশেপাশে তাকালেই বোঝা যায়, মেয়েরা কীভাবে পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে নিজেদের সবটুকু নিংড়ে দিচ্ছেন। গৃহস্থ বাড়িতে কাজ করতে আসা অথবা কারখানায় দৈনন্দিন আয়ের ভিত্তিতে কাজ করা মহিলারা তাঁদের আয়ের সবটুকু পরিবারের জন্য তুলে দেন। নিজেদের শরীর, স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা ও কিছুটা পরিবার ও সমাজের উদাসীনতায় সেইসব মহিলারাই সঠিক পুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে বিভিন্ন রোগের শিকার।

এইসব আলোচনা করতে করতে রূপকথার গল্পের শেষটা মনে আসে, প্রশ্ন জাগে। রাজপুত্র এসে কেন উদ্ধার করবে বন্দিনী রাজকন্যাকে? সোনার কাঠি রূপোর কাঠি ছোঁয়ালেও জেগে যে তাকে থাকতেই হবে। নিজের বিরুদ্ধে হওয়া অত্যাচারের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে আরো অনেক বন্দীমুক্তি তাকেই ঘটাতে হবে। তবেই তো সে রাজকন্যা। কুঁচবরণ কন্যা তার মেঘবরণ চুল - রাজকন্যার এই প্রোটোটাইপটাও কিন্তু চাপিয়ে দেওয়া।

যেদিন জাতধর্ম, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে সব নারীদের বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে, কাগজে কলমে নয়, বাস্তব কর্মসূচীতে রূপায়িত হবে উন্নয়নের পরিকল্পনা, সেদিনই বোধহয় উওম্যানহুড অথবা ‘বিশ্বমানবতা দিবস’ পালন সার্থক হবে।

0 comments: