0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



৮ 

গত সপ্তাহে নীলিমাকে ভিলাইয়ে ওর বাড়িতে ছেড়ে এসেছি। কলিয়ারির হাসপাতালের প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবে ধরা পড়েছে যে আমাদের দুজনের সংসারে তৃতীয় জন আসছে। আমার একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল । মোটরবাইকটা ভাল করে দাঁড় করানো হয়নি। নীলিমা নামতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে যায় । বাইরে থেকে চোট লেগেছে কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু আমার ভয় হল। যদি কিছু হয়ে যায় । তাই ভিলাই গিয়ে স্টিল প্ল্যান্টের সেক্টর নাইনের বড় হাসপাতালে দেখালে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। ভাল খবরটা আমাদের বাড়িতেও দিতে হবে। আমি ঠিক করেছি এই ডেলিভারির সমস্ত খরচ আমিই দেব, নীলিমার বাড়ি থেকে নেব না । তবে নীলিমার ইচ্ছে – প্রথম সন্তান, ওর মায়ের কাছেই হোক । 

তিনদিনের ছুটি দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেল। হাসিঠাট্টা খাওয়া দাওয়া। ওদের বাড়ির তুতো শালীর দল আর আমাদের বাড়িতে বড়ীভাবি—চিমটি কাটতে কেউ কম যায় না। 

--কি হল দেবরজী, তর সইল না? এখন ন্যাপি বদলানো শিখে নাও। 

-- ভাবী, আপ তো হমারী মাতা সমান হ্যায়। 

-- এ এ, ফালতু বাত নহীঁ। ম্যায় তুমহারী বড়ীশালী ইয়ানে ছত্তিশগড়ি মেঁ দেড়শাস হুঁ। নিমকি হমারী বহন ভী লগতী হ্যায়; ভুল গয়ে কা? 

ফেরার আগের রাতে নীলিমা আবার নিমকি হয়ে গেল। 

--শোন ম্যানেজার । একটা কথা। আমি আর ওই গাঁয়ে ফিরছি না। 

--কেন ? কী হয়েছে? 

-- কিচ্ছু হয়নি। দু’বছর তো তোমার সঙ্গে গাঁয়ে রইলাম। আমার শখ মিটে গেছে। আমি চাইনা আমার ছেলেমেয়ে ওই কুলিধাওড়ায় মানুষ হয় । বাচ্চা হয়ে গেলে আমি বাপের বাড়ি ছেড়ে তোমাদের বাড়ি গিয়ে থাকব। শ্বশুর-ভাসুর আমাকে পছন্দ করেন। বড় জেঠানী তো আমার তুতো দিদি। শাশুড়ি একটু ত্যাড়া মতন, কিন্তু নাতিনাতনির মুখ দেখতে পেলে সব ভুলে যাবেন। তোমারও আগামী বছরে ট্রান্সফার হবে। দেখ, যদি বিলাসপুর বা রায়পুরে হয়। একটু তদ্বির কর। তাহলে আমরা শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকব। আমি একটা স্কুলে চাকরি নেব। নিজের বাচ্চাকে ওই স্কুলেই ভরতি করে দেব। গ্রাম-জঙ্গল-কয়লাখনি আর নয়। 

আর আমি চাই তুমি ওই এলাকা ছেড়ে দাও। যেদিন ছুরিগাঁয়ে নিয়ে গেছলে, ওই যে ভালুমার দ্রৌপদী না কে মেয়েটি এসেছিল। তুমি ওর সঙ্গে কথা বলছিলে আর আমি তোমাকে দেখছিলাম। তোমার চেহারায় চোখেমুখে যে ভাব ফুটে উঠেছিল তা আমার ভালো লাগেনি। 

তারপর নিমকি বা সরলা পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল-- সারারাত এককাতে। 

এটা কি একরকম মন্দের ভাল হল? আমিও কি ভেতরে ভেতরে হাঁফিয়ে উঠছিলাম? নীলিমার শরীরের মাদক গন্ধে আর জোড়া হাতের ফাঁসে কি দমবন্ধ হয়ে আসছিল? জানি না । আসলে আমি বোধহয় ঠিক ঘরসংসার করার জন্যে তৈরি হইনি। 

মুখের ভেতরে একটা বোদা স্বাদ নিয়ে ব্যাংকে ফিরলাম। গেওরা লোক্যাল ১৫ মিনিট লেট। ব্যাংকের দরজায় একটা জীপ দাঁড়িয়ে, নেমপ্লেটে গ্রামীণ ব্যাংকের নাম। 

কী ব্যাপার! হেড অফিস থেকে অডিট টিম? কোন কমপ্লেইনের এনকোয়ারি? শুনেছি নতুন চেয়ারম্যান কোন উড়ো চিঠি পেলেও এনকোয়ারি করতে বলেছেন। ভিতরে গিয়ে দেখি দু’জনের একটা দল বসে সিঙাড়া, কালাকাঁদ আর চা সাঁটাচ্ছে। ওদের মধ্যে একজনকে আমি চিনি— রামকুমার পান্ডে। তিন বছর আগে আমার ছুরি শাখার কাছে কাঠঘোরায় ম্যানেজার, আমাকে ওর বৌয়ের হাতের রান্না খাওয়াতে টিফিন ক্যারিয়ারে করে নিয়ে আসত। বর্তমানে হেড অফিসে স্ট্যাটিসটিকসের ডেস্কে।অন্যজনের পরনে জিনস , হালকা দাড়ি, একহারা চেহারা। চোখে একটা চাপা দুষ্টু হাসি। 

রামকুমার পরিচয় করিয়ে দিল—দেবাশীষ চ্যাটার্জি। তোর নতুন ও-এস-ডি। মানে অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি। এখন তিনমাসের জন্যে তোর ব্র্যাঞ্চে ডেপুটেশনে। 

আমার চোখে প্রশ্ন, ব্যাপারটা কী? 

আগন্তুক হাত বাড়িয়ে দেয়। বলে আমাকে চ্যাটার্জি বলেই ডাকবেন। ম্যানেজার আপনিই, আমি শুধু আপনার হেল্পিং হ্যান্ড। 

আমার মনের ধন্দ ঘোচে না । তখন পান্ডে ব্রিফকেস খুলে একটা বন্ধ খাম বাড়িয়ে দিয়ে বলে –এতে সব ডিটেইলস আছে। পরে দেখে নিস। আমি শর্টে বলে দিচ্ছি। 

আসলে এখানে যে আরেকটা কয়লা খাদান শুরু হচ্ছে তাতে কমপেনসন হিসেবে গাঁয়ের লোকের পকেটে আসবে বেশ কয়েক কোটি টাকা। এই মোচ্ছবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কোরবার সব ব্যাংক, বিশেষ করে স্টেট ব্যাংক ও সেন্ট্রাল ব্যাংক। আমাদের রিসোর্স নামমাত্র। তাই ডিপোজিট মবিলাইজেশনে অভিজ্ঞ অফিসার চ্যাটার্জিকে পাঠানো হয়েছে তোকে হেল্প করতে। এছাড়া কম্পেনসেশন পেমেন্টের দিন গাড়িভাড়া করতে পারবি। ক্লায়েন্টদের চা-জলখাবার খাওয়াতে খরচা করতে পারবি। বিলটিল সামলে রাখিস। মাসের শেষে ওগুলো জুড়ে স্টেটমেন্ট জমা করতে হবে। তাতে তোদের দুজনের সাইন লাগবে। চ্যাটার্জির থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা তোকেই করতে হবে, ব্যস। এবার আমি চললাম দোস্ত, ওকে তোর জিম্মায় ছেড়ে। 

ক্যাশ কাউন্টার বন্ধ হওয়ার পর লাঞ্চ সেরে আমরা চায়ে চুমুক দিতে শুরু করি। চ্যাটার্জি একটা কাগজ নিয়ে এই দুরপা কলিয়ারি প্রোজেক্টের ক্ষতিপূর্তি জমা অভিযানের রোডম্যাপ ছকে ফেলে। 

প্রথম, কলিয়ারির সাব-অফিসে গিয়ে রেভিনিউ অফিসার বা কোন পাটোয়ারির সঙ্গে ভাব করে যাদের জমি সরকার নিচ্ছে তাদের নাম-ঠিকানা আর কতটা জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে সেটার লিস্টি হাতানো, যাতে টাকার পরিমাণটা একটু আঁচ করা যায় । 

দ্বিতীয়, কোন মহল্লার পেমেন্ট কবে হবে তার খবরটা আগাম বের করা। 

তৃতীয়, ওই মহল্লার কোন কোন জাত আছে আর তাদের ওপিনিয়ন লিডার কারা –তাদের নামঠিকানা জোগাড় করা । 

চার, পোটেনশিয়াল গ্রাহকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং হটশট ক্যামেরায় ওদের পাসপোর্ট সাইজ ফটো তুলে নেয়া। 

পাঁচ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিজেদের ক্যাম্পেনের সেলিং পয়েন্ট ডিজাইন করা। অর্থাৎ, কেন কেউ স্টেটব্যাংকের মত বটগাছের নৌকো না বেঁধে আমাদের মত ভুঁইফোড় ব্যাংকে নাম লেখাবে, কী স্পেশ্যাল সুবিধে পাবে, সেটা গাঁয়ের লোকের কথা ভেবে ঠিক করা। এবং তাদের বোঝানো যে আমরা প্রাইভেট ব্যাংক নই, চিটফান্ড নই। আমরাও সরকারি ব্যাংক, স্টেটব্যাংকের মতই, তবে গাঁয়ের লোকজনের জন্যে । 

আমার মাথা ঘুরে যায়। 

তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমার কোয়ার্টার হবে অপারেশন ডিপোজিট এর কম্যান্ড পোস্ট। চ্যাটার্জি আমার সঙ্গে থাকবে। মনবোধি আমাদের জন্যে রান্না করবে—চা, জলখাবার এবং লাঞ্চ। রাত্তিরে নুর মুহম্মদের হোটেল। এই ব্যবস্থা চলবে তিনমাস, তারপর দেখা যাবে । 

শুরু হয়ে যায় আমাদের ক্যাম্পেন—চ্যাটার্জির তৈরি ছক মেনে। আমরা জোর দিই সাধারণ মানুষ, চাষাভুষোর সঙ্গে আত্মীয় ব্যবহার এবং দরকার মত বাড়ি গিয়ে স্পেশাল সার্ভিসের উপর। এটাও বলি যে কোরবা শহরের বড় ব্যাংকে বিজনেসম্যান ও লেখাপড়া জানা বাবুদের ভিড়। সেখানে ইংরেজিতে ফর্ম ভরতে হয় । গাঁয়ের মানুষ এক কাউন্টার থেকে আরেক কাউন্টারে ধাক্কা খেতে থাকবে। ওরা বড় ব্যাংক তো কি হয়েছে? তোমার জলতেষ্টা পেলে আহিরণ নদীতে গেলাস নিয়ে যাও? নাকি ঘরের কুয়োতে বালতি ডুবিয়ে টেনে তোল? 

পরপর তিনটে পেমেন্ট হয়ে গেল। বেশিরভাগ লোক চেক জমা করল স্টেট ব্যাংকে। আমাদের জুটল খুদকুঁড়ো। আমি হতাশ। কিন্তু চ্যাটার্জি হাসে। বলে এ তো খেলার শুরু।হাফটাইমও হয়নি। হেড অফিস থেকে খবর এল—হতাশ হবার কিছু নেই। স্টেটব্যাংক অনেক বড় , লোকবল ধনবল সব বিশাল। আমাদের মোট ক্ষতিপূরণের টাকার তিনভাগের একভাগ পেলেই চলবে। 

এসব সান্ত্বনা আমার পোষায় না। আমি জিততে চাই। চ্যাটার্জি বলে—প্রতিপক্ষের থেকে শেখা উচিত। ওরা প্রত্যেক গাঁয়ে নিজেদের ভলান্টিয়ার বানিয়েছে। তাদের খাওয়ায়- দাওয়ায়, টার্গেট পুরো করলে গিফট দেয় । 

আমরা ঠিক করি নিজেদের টিই বিল যা পাবো, সব ভলান্টিয়ারদের পেছনে খরচ করব। আমাদেরও টিম তৈরি হয়। 

আমরা গাঁয়ে যাই গোপনে, সন্ধ্যের পর রাত্তিরে। আমরা সম্পন্নদের ছেড়ে ছোট ছোট জমির মালিক গরীব এবং অন্ত্যজদের পাড়ায় যাই। জুটিয়ে নিই সেখানকার নানা বয়েসের কর্মহীন যুবকদের। তারা দলবেঁধে আমাদের সঙ্গে গিয়ে ঘরে ঘরে অ্যাকাউন্ট খোলায়। আমরা হ্যাজাক বা টেমির আলোয় পাসবুক বিলি করি। তারপর ওরা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে –এবার একটু ‘ঠান্ডা-চা’ খাব। 

আমি অন্যদিকে তাকাই। মনবোধি ওদের নিয়ে নুরের দোকানে যায়। 

পরের চারটে পেমেন্টে হাওয়া ঘুরতে শুরু করল। স্টেটব্যাংকের টিম অবাক, তারপর আমাদের সঙ্গে একটা বিচ্ছিরি ঝগড়া হল। না হলেই ভাল হত । আমাদের চেয়ারম্যান, জিএম –সবাই স্টেটব্যাংকের যে! 

পাঁচনম্বর গাঁয়ের পেমেন্টের দিকে সবাই তাকিয়ে। অনেক বড় গ্রাম। অনেক লোক, সাতটা পাড়া। অনেক টাকা। এর একটা নেশা আছে। আগের পেমেন্টে একজন আমাদের ব্যাংকে একটা চেক জমা করেছে, তাতে লেখা এক লক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার। এমন চেক আমাদের ব্র্যাঞ্চে এই প্রথম। অনেকক্ষণ হাত বোলালাম। তারপর উত্তেজনায় ভেসে গিয়ে রাত্তিরে নুরের হোটেলে আমরা দু’জন দুটো করে বিয়ার মেরে দিয়েছিলাম। 

কিন্তু সব আশায় জল ঢেলে সেদিন পেমেন্ট হল না। গাঁয়ের কিছু লোকজন মিছিল করে এসে পেমেন্ট অফিসের সামনে শ্লোগান দিল, কোলিয়ারির অফিসারদের ঘেরাও করার হুমকি দিল। কিছুই বুঝলাম না। পেমেন্টের দিন পিছিয়ে গেল এক সপ্তাহ। 

আজ ইতওয়ার বা রোববার। খেয়েদেয়ে খাটিয়ায় গড়িয়ে খানিকটা সময় কাটল। গরম বাড়ছে। 

মনবোধি শোনাল যে আবহাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাঁয়ের লোকজনের মেজাজও চড়ছে।
গাঁয়ে এখন নাকি দুটো দল। একটা পুরনো মোড়লের আর একটা নতুন চ্যাংড়াদের। নতুনের দল চাষের জমির ক্ষতিপূরণের জন্যে আরো উঁচু দর দাবি করছে।
কাল নাকি নগৈখারের দিকে লোকজন কয়লা কোম্পানির জমিকাটা ডোজার মেশিন আটকে দিয়েছে। পুলিশ এসে ফিরে গেছে। সোমবার সবাইকে নিয়ে সমঝোতা বৈঠক হবার কথা ছিল। কিন্তু কোথাও জমির ক্ষতিপূরনের ঝগড়ায় মারামারিতে টাঙি চলেছে। একজনের আঙুল কাটা পড়েছে। 

একটু উশখুশ করছি এমন সময় চ্যাটার্জির হুকুম-- মনবোধি ! বড়িয়া কড়ি মিঠঠি চায় বনাও, হম দোনো থোড়া গাঁও ঘুমনে জায়েঙ্গে।
তারপর আমার দিকে চোখ মেরে বলল--- চল না রে রূপেশ! আবার কবে এ গাঁয়ে আসা হবে কি না হবে? 
মাত্র এক কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথ। তারপর শিমূল গাছের পাশে একটা চায়-পান-বিড়ি-সিগ্রেট আর বিস্কুটের দোকান। কিছু চাল-ডাল-নুন-তেলও পাওয়া যায়।
এই সময়টা দোকানের সামনে চার গাঁয়ের লোকজন জড়ো হয়। গুলতানি কেনাকাটা গপশপ সবই চলে।
চ্যাটার্জির আশা এখানে ফোটানো দুধের চা খেতে খেতে গাঁয়ের আসলি খবর পাওয়া যাবে।
কিন্তু সে গুড়ে বালি!
মোড়ের মাথায় লোকের ভিড় নেই। হৈচৈ কেনাকাটা কিচ্ছু নেই।
দোকানের সামনে মাত্র জনাচারেক লোক বসে চা খাচ্ছে। আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন হল-- ক্যা চাহিয়ে?
আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলি-- দো কাপ কড়িমিঠি চায় অউর--।
আমাদের কথা কেটে দেয় দোকানদার -- নহী মিলেগা, দুধ নহী হ্যায়।
আমরা অবাক। নেই মানে কী? ওই তো কড়াইয়ে ফুটছে!
দোকানদার জবাব দেবার আগেই উপস্থিত চারজনের একজন বলে ওঠে-- ও দুধ আপনাদের জন্যে নয়।
আমরা এবার কোন কথা না বলে গাঁয়ের ভেতরে পা বাড়াই।
কি আশ্চর্য! গাঁয়ের ভেতরের ছোটখাটো দোকানগুলো আজ বন্ধ দেখছি যে! রাস্তাঘাটে জনমনিষ্যি নেই, শুধু ছোট বাচ্চারা খেলছে। পাতকুয়োর সামনে বালতি নাবিয়ে জল তুলতে থাকা বৌ-ঝিয়ের দল অন্যদিন চোখে চোখ পড়লে সলজ্জ হাসি হাসত বা কেউ কেউ সাহস করে 'রাম-রাম সাহাবমন!' বলত।
আজ আমাদের দেখে কলসী-দড়ি-বালতি সব ফেলে দুদ্দাড় করে ছুটে পালাল।
কিছু না বুঝে আমরা গাঁয়ের মোড়ল বা সরপঞ্চের বাড়ির দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম। 

সদর দরজা ভেজানো, সামনে দু-চারটে ন্যাংটোপুঁটো বাচ্চা খেলছে। আমরা গিয়ে দাঁড়াই, উস্‌খুশ্‌ করি।
চ্যাটার্জি হাঁক পাড়ে--- কৈসে গা গোটিয়া, ঘর মা হবে কা?
কি গো মোড়ল? ঘরে আছ নাকি?
কোন উত্তর নেই। বার দুয়েক হাঁক পেরে বিরক্ত হয়ে ওর দরজার কপাট থেকে ঝুলতে থাকা লোহার শেকল ধরে জোরে জোরে নাড়াই।
হটাৎ দরজা খুলে যায়। দরজার ফ্রেমের মাঝে আধো ছায়ায় হেটো ধুতি আর পিরান পরা সমারুরাম গৌটিয়ার শুকনো কড়া চেহারা আমাদের চমকে দেয়। আরো চমকে দেয় ওর রস-কষহীন রুক্ষ কেজো প্রশ্নঃ
--- কা বাত হ্যায়?
আমি কি বলব ভেবে পাই না। এতদিন ওর দরজায় এলে এই গৌটিয়া আমাদের হাসিমুখে – আও গা সাহাবমন! বৈঠো, বলে খাটিয়া টেনে এনে বসিয়েছে। কাঁসার বাটিতে কাঁসার ছোট গেলাস বসিয়ে চা দিয়েছে, তাতে এক চামচ ঘি! আর আজ?
চ্যাটার্জি তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলে-- কা বাত হ্যায় গৌটিয়া? আজ খড়ে খড়ে বিদা করবে কা? চুঙ্গি-উঙ্গি পিলাইকে মন নাহি হাবয়?
কী ব্যাপার মোড়ল? আজ দরজা থেকেই বিদেয় করবি নাকি ? বিড়ি- টিড়ি খাওয়াবি না?
সমারুরাম যেন ঘোরের থেকে জেগে ওঠে। একটু লজ্জা পায়। খাটিয়ার জন্যে বাড়ির ভেতর দিকে কাউকে হেঁকে বলে।
তারপর বলে-- না, না! বিড়ি দেব না কেন? আসলে কি জান সাহেবরা? এতসব গন্ডগোলে মাথার ঠিক নেই আমার। 

তারপর ধীরে ধীরে শোনায় ওর বিপদের কাহিনী। 

ওর এক ছেলে, এক মেয়ে। 

সরকার যে জমির টুকরো কয়লাখনির জন্যে নিচ্ছে তাতে দেবে একটা চাকরি। তা জামাই জিদ ধরেছে ওই চাকরি ছেলেকে নয়, ওকে দিতে হবে। নইলে ওর বৌকে সরকারি কাগজে দস্তখত করতে দেবে না।
এই নিয়ে শালা-ভাটোর মধ্যে কথা কাটাকাটি, বচসা; শেষে ছেলেটা রাগের মাথায় ভগ্নিপতির ওপর মারলো টাঙির কোপ! মেয়েটা বেওয়া হতে হতে বেঁচে গেল। কিন্তু জামাইয়ের বাঁ-হাতের তিনটে আঙুল চলে গেছে। তো ঘরের একজন হাসপাতালে, আর একজন হাজতে। গৌটিয়া বুড়ো দৌড়ুচ্ছে গাঁ থেকে শহর, শহর থেকে গাঁ।
জামিন হয় নি। আগামী সোমবার কেস আদালতে তুলবে; উকিলবাবু দু'হাজার নিয়েছে। সেদিন বেশ কয়টা নম্বরি নোট নিয়ে যেতে হবে।
এবার ও ঘটি থেকে ঢক্ঢক করে জল খায়।
আমরা মিনিট খানেক চুপ করে থাকি।
অস্বস্তি এড়াতে চ্যাটার্জি মুখ খোলে।
---- বহোত বুরি বাত। কিন্তু আমাদের কী দোষ? আমরা কী করেছি?
ফুঁসে ওঠে গৌটিয়া সমারুরাম।
--- কী বললে? তোমাদের কোন দোষ নেই? তবে কার দোষ? কে করেছে এসব?
--- আমি? কী করলাম?
--- তুমি নিজে না, তোমরা! 

আমরা জানতাম জমি হল মায়ের মতন; ও আমাদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। জমি বেচতে নেই। তোমরা দেখালে লোভ,-- জমি দে, টাকা নে, চাকরি নে।
আমরা ক্ষেতে চাকর রাখি, কামিয়া রাখি। নিজেরা গোমাতার সেবা করি, বাঢ়রাজা-বাররাণী-ঠাকুরদেব এর থানে মাথা ঠেকাই।
আমরা কারো চাকর নই। এখন আমাদের ছেলেপুলেরা সরকারি অফিসে চৌকিদার হবে, পিয়ন হবে, চাপরাশি হবে!
আমরা জানতাম সবাই মিলে একটা পরিবার। তোমরা শেখালে আপন আপন বাঁচ গে যাও। আমাদের হিসেবে বড় বা সিয়ান বা কর্তার কথাই শেষ কথা। তোমাদের প্রশ্রয়ে সেদিনের ছোঁড়াগুলো চোখ তুলে কথা বলে!
আমার জামাই ও ছেলে! কত ভাব-ভালবাসা! দুই ভাইয়ের মত। এখন সেই ছেলে জামাইয়ের ওপর টাঙি চালিয়ে দিল--- এর জন্যে তোমরা শহুরে বাবুরা দায়ী নও?
শোন গো! আজকের চা তোলা রইল। আকাশের মতিগতি ভাল নয়। আঁধি আসছে মনে হয়। অব তুমন জলদি রেঙ্গ। উঠ, রেঙ্গ। নহী তো ফঁস জাও গে।
এবার তোমরা গা তোল, পা চালাও। নইলে এখানেই আট্কা পড়ে যাবে। 

আমরা চুপচাপ বেরিয়ে আসি। চ্যাটার্জি সিগ্রেট ধরায়, তারপর একদলা থুতু ফেলে বলে-- না এলেই ভাল হত।
আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে--দূর্‌! মেঘ কোথায়? ওই যে এককোণে একটা ছোট্টমত? ওতে কিস্যু হবে না। মন খারাপ করিস নে রূপেশ! চল্‌, তোকে ওদের দেবতার থান দেখিয়ে নিয়ে যাই। ওখান থেকে আমাদের লেবার কলোনি ফেরার একটা শর্টকাট রাস্তা আছে।
আমি কোন কথা না বলে ওর পেছন পেছন চলতে থাকি।
গাঁয়ের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে একটা বাঁশঝাড় এড়িয়ে খানিকটা সাফসুতরো জায়গা। বিশাল বটগাছ, বয়সের গাছপাথর নেই, অসংখ্য ঝুরি নেমেছে, উইয়ের ঢিবি।
এইখানে বটের ছায়ায় গোবরলেপা একটু বেদি মতন, তাতে তিনখন্ড এবড়ো খেবড়ো পাথর-- একটা খানিকটা বাড়ির মশলা পেষা শিলনোড়ার মত। ওটার গায়ে সিঁদূর লেপা। আর সামনে কিছু হলুদ চাল, লংকা ও আদার টুকরো মত ছড়িয়ে রয়েছে।
কিন্তু ওদের ভগবান কই?
চ্যাটার্জি আমার অজ্ঞতায় হাসে। আঙুল তুলে দেখায় যে শিলনোড়ার মত দেখতে পাথরটাই বাঢ়রাণী, বাকি দুটো বাঢ়রাজা ও ঠাকুরদেব। 

আমরা খেয়াল করিনি-- ঈশানকোণে একটু আগে দেখা ছোট্ট কালির ফোঁটা কখন যেন আকাশের সাদা টেবিল ক্লথে ছড়িয়ে গেছে। দূর থেকে একটা গোঁ-গোঁ-সোঁ-সোঁ আওয়াজ। পাক খেয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে শুকনো পাতা ও লাল ধূলো।
---- সেরেছে! বড় করে আঁধি আসছে। মনবোধি, দৌড়ো।
আমরা দৌড়োতে থাকি। একটু পরেই চারদিক অন্ধকার করে সেই ধূলোর ঝড় আমাদের গায়ে মাথায় আছড়ে পড়ে। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি নে। চোখে মুখে বালি কিচকিচ করছে।
ভাবছি কোথাও দাঁড়ালে হয়; তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। চ্যাটার্জি খিঁচিয়ে ওঠে-- থামিস না, সামনের দিকে দৌড়ো। আঁধি আমাদের পেছনে চলে যাবে। কিন্তু বৃষ্টি আসছে, তার আগে কলোনি পৌঁছতে হবে। 
আমরা অন্ধের মত সামনে দৌড়ে চলি।
হ্যাঁ, ওই আঁধি বা ধূলোর ঘুর্ণি আমাদের টপকে গাঁয়ের দিকে চলে গেছে। এখন সামনে দেখতে পাচ্ছি। ওই তো আমাদের কলোনি! আর পঞ্চাশ গজ।
ওয়েল্ডিং এর তীব্র ফুলকির মত এক আলোর রেখা ইস্পাতনীল আকাশটাকে ওপর থেকে নীচ অবদি ফালাফালা করে দিল। আর কড় কড় শব্দে বাজ।
শেষ ল্যাপে চ্যাটার্জিকে হারিয়ে সোজা কোয়ার্টারের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে দম নিলাম। ততক্ষনে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। 

হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা মুছে চায়ে চুমুক দিয়েছি কি বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বেশিক্ষণ থাকতে হল না, মনবোধি নিপুণ হাতে হ্যাজাক জ্বেলে দিয়েছে।
বাইরে শুরু হয়েছে তান্ডব। কালো মেঘের চাঁদোয়ার নীচে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মত জলভরা সাদা মেঘ। মাটি ডাকছে আকাশকে। আকাশ সাড়া দিয়েছে সে ডাকে। বিজলির জিভ দিয়ে চেটে দিচ্ছে ধরতীর শরীর, লালায় ভরিয়ে দিচ্ছে। আর ধরতী মুঠো করে খামচে ধরছে গাছপালা, নুইয়ে দিচ্ছে মাথা।
কোয়ার্টারের জানলায় ছাদে পায়খানার টিনের চালে বৃষ্টির চড়বড় চড়বড় যেন মাদলের বোল। এর ওপর শুরু হয়েছে 'ওলে' বা শিলাবৃষ্টি। আস্তে আস্তে ছাদ আর দেওয়াল ঠান্ডা হয়ে এল। বাইরে ঝড়ের দাপট কমেছে, কিন্তু বৃষ্টির জোর সেই একরকম। 
জানলা বন্ধ করতেই হল, নানারকম পোকামাকড় ঢুকছে। কানে আসছে অসংখ্য সোনাব্যাঙ ও ঝিঁঝির ঐকতান।
কিছু করার নেই। এই আবহাওয়ায় টিভি চলার প্রশ্ন নেই, ট্রানজিস্টারেও শুধু খড়খড়ানি।
খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। আর দুটো দিন। আর একটা রাত্তির। তারপর কমপেন্সনের পেমেন্ট শুরু হবে। দেবতা কি গ্রামীণ ব্যাংকের উপর প্রসন্ন হবেন?
শীত শীত করছে। গায়ে চাদর টেনে এক ইঁটের পাতলা ছাদের ওপর বৃষ্টিধারার তবলা লহরা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি। (চলবে)

0 comments: