0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


ভাগীরথী ও কপিল মুনি
অনিন্দিতা মণ্ডল


হাজার হাজার বছর আগে বললেই হয়ত মানাত, তবু পণ্ডিতেরা যখন পুরাণের কিছু নির্দিষ্ট তারিখ নির্দেশ করেছেন, সেসব অনুসরণ করলে এবং ভুতত্বের ইতিহাস অনুসরণ করলে এ ঘটনার সূত্রপাত মোটামুটি ভাবে চার থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের বলে ধরে নেওয়া যায়। সেসময়ে বাংলায় এক অতি সমৃদ্ধ জাতির বসবাস ছিল। বানিজ্যে কৃষিতে সংস্কৃতিতে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় এরা বাকি ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। এর ফলে আর্যাবর্তর যুদ্ধপরায়ণ রাজারা হিংসেয় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। তখন অযোধ্যার রাজা ছিলেন সগর। মহাভারতের সেই আদিযুগের কথা। সগর রাজার নাকি ষাট হাজার পুত্র ছিল। না, ঠিক তা নয়। সগর রাজার ছয়টি পুত্র ছিল বলে মনে করা যায়। স্নেহে ওরকম বহুবচন চলত তখন । সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়াতে সগর রাজা করলেন কি, এক অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। এভাবেই তিনি রাজ্যজয় করতে পারবেন, এই আশা করে ঐ ছয়পুত্রকে দিয়ে তিনি যজ্ঞের অশ্বটিকে সাজিয়ে গুজিয়ে রওনা করে দিলেন। পথে তেমন গোলমাল হলনা ঠিক। ক্রমে সেই ছয়পুত্র অশ্বের সাথে এসে পৌঁছল সাগর সংলগ্ন সমতট ভূমিতে। বাংলার উত্তর অংশে তখনও সে অশ্ব বাধা পায়নি। কিন্তু সমতটের সাগর সংলগ্ন অঞ্চলে তখন আশ্রম ছিল এক মহাপুরুষের। তিনি মহামুনি কপিল। যাঁর সাংখ্য দর্শনের খ্যাতি উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম, চতুর্দিকে। এই কপিল মুনির আশ্রম ছিল এক মহা প্লাবনময়ী নদী আর সাগরের মোহনায়। সে কোনও নির্দিষ্ট স্থান নয়। কারণ মোহনা অঞ্চল সদাই প্লাবনের ধারায় ধুয়ে মুছে যেত। ফলে মহামুনি তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ সহ সরে যেতেন অন্যখানে। সগর রাজার রাজ্যেও এই নদী বয়ে এসেছে। কিন্তু সমস্যা হল, সে কোনও বাঁধা ধরা খাতে বইতেই চায়না ! এখন সগর রাজার পুত্ররা যখন সেই মহা নদীর মোহনা অঞ্চলে পৌঁছল তখন তাদের অশ্বটি মহামুনি কপিলের আশ্রমে এসে পা ঠুকল। হ্রেষাধ্বনি শুনে মুনির ধ্যানভঙ্গ হয়ে গেলো। কপিল এক বিশেষজ্ঞ নদীবিজ্ঞানী ছিলেন। এই প্লাবন উপত্যকায় মানুষের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে সৌভাগ্যও যে কতটা জড়িয়ে ছিল তাই নিয়ে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আদতে যে নতুন পলির প্রলেপে প্রকৃতি শস্যশ্যামলা হয়ে উঠছেন, এবং মানুষের খাদ্য ও আশ্রয়ের পুনর্নির্মাণ ঘটছে, এই কথাটি তিনি ভালোই উপলব্ধি করেছিলেন। কপিলের মতে প্রকৃতিই সবলা। তাঁর ইচ্ছাতেই মানুষ এগিয়ে চলে। তাই প্রকৃতিকে ক্ষুব্ধ করা তাঁর নীতিবিরুদ্ধ। সেসময় গঙ্গা কোনও একটি স্রোত ছিলনা। সমস্ত বদ্বীপ জুড়ে তার অসংখ্য স্রোত ছিল। কোনটি যে শাখা আর কোনটি যে উপনদী, কোনটি যে প্রধানা আর কোনটি যে মাত্রই সখীসম, সে আলাদা করে চিহ্নিত করা হতনা। ফলে সে এক বিশাল উপস্থিতি।

এমত সময়ে কপিল ব্যাস্ত ছিলেন জলবিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণায়। বিদ্যুৎকে কাজে লাগিয়ে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা তিনি ভাবেননি। এ তাঁর চিন্তার বাইরে ছিল। তিনি শুধু আরও এক প্রচণ্ড প্রাকৃতিক শক্তির কথা চিন্তা করেছেন। এ শক্তি আগুনের জন্ম দিতে পারে। শুধু চকমকি ঠুকে কাঠে কাঠে ঘর্ষণে জাত অগ্নি নয়। এ এক সর্বগ্রাসী আগুন। ঠিক যেমন চরাচর ভাসিয়ে দেওয়া জল। সে জলকে প্রতিরোধ করার শক্তি মানুষের থাকেনা। শুধু সেই স্রোতের সঙ্গে চলা ছাড়া। সেইরকম আগুন। দেখা যাক প্রকৃতি ঠাকুরানী এই শক্তির উন্মেষে কিভাবে সাড়া দেন। এই রকম এক মগ্ন মুহূর্তে সগরেরষাট পুত্র তাদের অশ্বটিকে ছেড়ে দিয়ে দেখছেন মোহনার মনোমোহন শোভা। সামনে মাঝে মাঝে বালুর চর। তার চারিপাশ দিয়ে ধীর গতি জলের ধারা। কিছু দূরে সেইসব ধারা গিয়ে মিলেছে অকূল জলধিতে। আকৃষ্ট করার মতই শোভা। এমনটি তাদের দর্শনে মেলেনা। ওদিকে মহামুনি এই অসময়ে ধ্যানভঙ্গ হওয়ায় যারপরনাই বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি কিনা সভ্য নাগরিক মানুষ! তাই তিনি নিজেকে সংযত করে সগর রাজার পুত্রদের আহ্বান জানালেন আশ্রমে। পুত্ররা তো ততক্ষণে মহামুনির শরণ চেয়েই ফেলেছেন। এ স্থান ত্যাগ করার প্রশ্নই ওঠেনা। তবে এমন শক্তিশালী যাদুকরের মতো বিজ্ঞানীর সঙ্গে যুদ্ধে পারা তো অসম্ভব! অতএব সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত। মহামুনি চরণে স্থান দিন বরং। 

কিছুকাল বাসের পর সগর রাজার সৈন্যরা অশ্বসহ ফিরে গেলেন অযোধ্যায়। রাজা খবর পেলেন সাগরের মোহনায় মহামুনি কী এক অসীম প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা করছেন যার প্রকাশে দিগন্তব্যাপী আগুন জ্বলে উঠবে। রাতারাতি চারিদিকে গুজব রটে গেলো মহামুনি কপিল সগরপুত্রদের বন্দী করেছেন পাতালে। মানে মোহনাসংলগ্ন কপিলাশ্রমে। আর সেই অগ্নিসম প্রাকৃতিক শক্তি তাদের ভস্মীভূত করেছে। অর্থাৎ তারা সেই শক্তির মহিমায় আকৃষ্ট হয়েছেন। 

গবেষণার নানা স্তর পেরিয়ে এসে যখন আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তিও খানিক হাতে এলো, তখন বহুকাল পেরিয়ে গিয়েছে। বৃদ্ধ মহামুনির অস্থিও সাগরে বিসর্জন করা শেষ। সগরপুত্রদের বংশধারা এখন এই প্রাচ্যভূমিতে স্থিতিলাভ করেছে। এই সময়ে আবির্ভাব ঘটল আর এক নদীবিজ্ঞানীর। তিনি সগর রাজার বংশেই জাত। তিনি ভগীরথ। ঠাকুরদাদের বংশধারা খুঁজতে বেরিয়ে তিনি এসে হাজির হলেন মোহনায়। তখন এক অন্য কপিল সেখানে অধিষ্ঠান করছেন। মহামুনির শিষ্য পরম্পরায় তিনিই এখন কপিল। ভগীরথ এসে তাঁকে জানালেন নিজের কথা। কি করে এই অজস্র স্রোতকে একটি প্রধান ধারায় বহমান করা যায়। যদি যায় তবে এই বিধ্বংসী প্লাবনের থেকে সমস্ত প্রাণীই রক্ষা পায়। প্লাবনভূমির ওপরে বসবাস বা কর্ষণক্ষেত্র গড়ে তোলা আর অপরাধ হবেনা তবে। 

সগর রাজার সেই ষাট পুত্রর বংশধরেরা প্রথমে অনুমতি দেননি। কিন্তু পরে ভেবেচিন্তে দেখা হল ভগীরথ ভুল বলেননি। কারণ মানুষসহ সমস্ত জীবই প্রকৃতির অংশ বৈ তো নয়! সুতরাং এদেরও রক্ষা করা কর্তব্য।

এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হল ভগীরথের নেতৃত্বে। প্রধান ধারাটিকে অক্ষুণ্ণ রেখে আশে পাশে আরও নয়টি ধারার খাত কাটার কাজ শুরু হলো। কত সময় যে লেগেছিল সে কে বলতে পারে? তবে নিশ্চয় সে অনেক অনেক বছর লেগেছিল। আর অনেক বছর পরে গঙ্গাকে ভাগীরথী নাম দিয়ে ভগীরথ তার সেই আগ্রাসী প্লাবনকে রুখে দিয়েছিলেন। খনা কি আর সাধে বলেছিলেন – ভগার খাত!

0 comments: