পথে প্রান্তরে - রোশনি ঘোষ
Posted in পথে প্রান্তরে
পথে প্রান্তরে
নীল-সায়র আর ফুলপরীদের দেশে
রোশনি ঘোষ
জানুয়ারি মাসের রবিবারের বিকেল। বাইরে তুমুল বরফ ঝড় হচ্ছে। আমি আমাদের নিউ ইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টের জানালায় বসে কম্বল মুড়ি দিয়ে গল্পের বই পড়ছি আর ভাবছি উঠে এক কাপ চা বানালে হয়, ঠিক এইরকম সময়ে অ্যাশ ফোন করলো। অ্যাশ মানে ঐশ্বরিয়া আমার পিএইচডি বেলার বন্ধু। আমরা পাশাপাশি ল্যাবে রিসার্চ করতাম আর অবসরে প্রানভরে যে যার অ্যাডভাইসরকে গালাগালি দিতাম। রিসার্চ আর গালাগালির চক্করে আমাদের বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছিলো। আপাতত বছর দেড়েক হলো ও চাকরি নিয়ে বোস্টন চলে গেছে। ও চলে যাওয়ায় আমাদের ডেইলি আড্ডাটা মুখোমুখি থেকে সাপ্তাহিক ফোনাফুনিতে ঠেকেছে।
ফোনটা তুলতেই অ্যাশ হৈহৈ করে বলে উঠলো "রোশ, চল কোথাও একটা বেড়াতে যাই। আমি এই বিয়ের চক্করে টায়ার্ড হয়ে গেছি। আর আমি পারছি না। এবার ব্রেক চাই।" এখানে বলে রাখা ভাল অ্যাশ খাঁটি আইয়ার ব্রাহ্মণ। ওর বিয়ের জন্য মা বাবা রাশি, নক্ষত্র, লগ্ন মিলিয়ে প্রায় দেড় পাতা লম্বা একটা লিস্ট পাঠিয়েছে আর তার সাথে অ্যাশের নিজের চাহিদা মানে এক শহরে থাকলে ভালো, ট্রেকিং করতে ভালোবাসে এই সব অ্যাড হয়ে গিয়ে একটা ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়িয়েছে। লিস্টটা দেখে আমারই দুদিন মাথাটা তাজঝিম মাজঝিম করছিলো তা ওই লিস্টি মিলিয়ে বর খুঁজতে অ্যাশের যে মাথা চক্কর দেবে তাতে আর সন্দেহ কি?
তা বললাম "যাবিটা কই, শুনি? এক্ষুনি ক্রিস্টমাসের ছুটিতে দেশ থেকে ঘুরে এলাম, এবার লম্বা ছুটি নিলে অফিস থেকে তাড়িয়ে দেবে।" "না, না শোননা, হিসেব করে দেখলাম, এপ্রিলে একটা শুক্রবার ছুটি আছে, তার সাথে একদিন অ্যাড করে নিলেই ক্রেটার লেক আর টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল দেখা হয়ে যাবে।" "ক্রেটার লেকটা আবার কোথায়? আর টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল তো নেদারল্যান্ডে হয়, আমেরিকায় কোথায় পেলি?" "ধুর, তুই কিছু জানিস না, ক্রেটার লেক ওরেগনে আর সিয়াটলে এই সময় টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল হয়।" এবার আমার একটু একটু উৎসাহ হলো, বাইরের বরফ গুলো দেখতে দেখতে এমনিই ঠান্ডা লাগছিল তারপরে টিউলিপের রং গুলো মনে পড়লো, বছর দুয়েক আগে নেদারল্যান্ডের টিউলিপ ফেস্টিভ্যালে দেখেছিলাম। ইতিমধ্যে অ্যাশ নেট ঘেঁটে ঘেঁটে ক্রেটার লেকের বেশ কিছু ছবি পাঠিয়েছে। আর ভাবার দরকার নেই সোৎসাহে হ্যাঁ বলে দিলাম। ফোনের ওদিক থেকে একটা কিন্তু কিন্তু গলার স্বর ভেসে এলো "রোশ, এই ট্রিপটা খালি তুই আর আমি যাবি? আমাদের গার্লস ট্রিপ? মানে চ্যাটকে যেতে বলতাম, কিন্তু আমার না এখন বন্ধু ছাড়া কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।" "ঠিক হ্যায়, নো চাপ,শুধু তুই আর আমিই যাবো।" ওদিক থেকে গলার স্বরের স্বস্তিটা স্পষ্ট শুনতে পেলাম কানে "থ্যাংকস রে, সমঝনেকে লিয়ে।"
চ্যাটে একটু সেন্টু (আহারে, বন্ধুর এরকম মানসিক অবস্থায় সঙ্গ দেওয়া আমার কর্তব্য) আর একটু ঘুষ (এখানে থেকে ফিরেই ভার্জিন আইল্যান্ড বেড়াতে যাবো) এই সব বলে রাজি করিয়ে ফেললাম। এমনিতে আমরা দুজনেই দারুণ ঘুরতে ভালোবাসি, কাজেই এরকম ভালো দেখতে একটা জায়গা ওকে বাদ দিয়ে দেখতে চলে যাবো, তাই একটু দুঃখ পাচ্ছিলো বেচারা। তবে অ্যাশের কারেন্ট নাকানিচোবানি দশাটা চ্যাটও মোটামুটি জানে, তাই ও আর ঝামেলা না করে ভার্জিন আইল্যান্ডের প্ল্যান করতে বসে গেলো। অফিসে গিয়ে বললাম, আমি ল স্কুলের এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত তাই বেড়াতে যাবো, অফিসও দেড় সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করে দিলো। প্ল্যানটা হলো এরকম বৃহস্পতিবার রাতে অফিস করে আমি প্লেন ধরে অ্যাশের সাথে বেড়াতে যাবো, সেখান থেকে সোমবার ফেরার ফ্লাইট, তারপর মঙ্গলবার চ্যাটের সাথে ভার্জিন আইল্যান্ড গিয়ে পরের মঙ্গলবার ব্যাক। বুধবার ফেরত অফিস।
বাড়ি, অফিস যখন মোটামুটি সামলে গেছে এবারে বেড়াতে যাবার প্ল্যান বানাতে শুরু করলাম। ভার্জিন আইল্যান্ডের প্ল্যানের দায়িত্ব চ্যাটের কাজেই আমি নিশ্চিন্তে গাৰ্লসট্রিপের প্ল্যান করতে বসলাম অ্যাশের সাথে। সে কি যে সে প্ল্যান, ম্যারাথন প্ল্যান একেবারে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই একটা ফোন, ওয়েদারটা দেখিস, সেই মতন জামাকাপড় নিতে হবে, দুপুরে টেক্সট, নীল একটা সোয়েটার নিস কিন্তু, ক্রেটার লেক দেখতে যাওয়ার দিন পরবি, রাতে আবার স্কাইপিতে কনফারেন্স ওষুধপত্তর কি কি সাথে নিতে হবে। রকম সকম দেখে চ্যাট বলেই ফেললো তোদের দেখে মনে হচ্ছে তিনদিনের জন্য ওয়েস্ট কোস্টে না, তোরা মঙ্গলগ্রহে যাচ্ছিস এক বছরের জন্য। এসব তুচ্ছ কথায় কান দেওয়ার পাত্রী আমি না, কাজেই নির্বিকারে প্ল্যান চালিয়ে গেলাম।
আমাদের প্ল্যানের সব থেকে বড় প্রব্লেম হলো ড্রাইভিং। আমার লাইসেন্স নেই আর অ্যাশের ড্রাইভিংয়ের দৌড় বাড়ি থেকে অফিস অবধি। এদিকে ক্রেটার লেকের ধারে কাছে কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। তা খুঁজে পেতে একটা গাইডেড টুর পাওয়া গেলো যারা আমাদের নিয়ে ঘুরিয়ে আনবে ক্রেটার লেক থেকে। তারপর বাকি প্ল্যান অনেক হিসেবে নিকেশ, ছুটি ম্যাক্সিমাইজ করে দাঁড়ালো এরকম যে অ্যাশ বোস্টন আর আমি নিউ ইয়র্ক থেকে ফ্লাই করে পোর্টল্যান্ডে মিট করবো। সেদিন রাত্তিরে পোর্টল্যান্ড থেকে পরের সকালে পোর্টল্যান্ড ঘুরবো। তারপর দুপুরবেলা অ্যামট্রাক ট্রেনে চড়ে ক্লামাথ লেক। সেখানে রাত্তিরে থাকা। পরের দিন সকালে গাইড নিয়ে ক্রেটার লেক দর্শন, সেখান থেকে অ্যাশল্যান্ড এসে শেষরাত্তিরে বাস ধরে আবার পোর্টল্যান্ড। পোর্টল্যান্ডের বাকি ঘোরা গুলো সেরে, বিকেলে আমট্রাক ধরে সিয়াটল। সিয়াটলে এক বন্ধুর বাড়িতে থেকে পরের দিন টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল দেখা, তারপর গভীর রাতের প্লেন ধরে সক্কাল সক্কাল যে যার জায়গায় ফেরত।
পোর্টল্যান্ড যাওয়া অবধি কিছু গণ্ডগোল পাকাইনি, শুধু অন্যমনস্ক হয়ে আমার পাশে বসা লোকটার কোল্ড ড্রিংক্সটায় দুটো চুমুক দিয়ে ফেলেছিলাম খালি। তা তাতে লোকটা এমন কটমট করে তাকালো আর কি বলবো। বললাম এয়ারহোস্টেসের থেকে আরেকটা চেয়ে দিচ্ছি, তাতে নো থ্যাংকস বলে গোমড়া মুখে বিজনেস টাইমস পড়তে লাগলো। মরুকগে যা, আমার কি. বেড়াতে যাচ্ছি এখন এসব সাত পাঁচ ভাবতে আমার বয়েই গেছে। পোর্টল্যান্ডে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই দেখি অ্যাশের ফোন। "কি রে কদ্দুর? আমি তোর টার্মিনালে দাঁড়িয়ে আছি।" বেরিয়ে অ্যাশকে খুঁজে একটা ট্যাক্সি নিয়ে দুজনে চললাম পোর্টল্যান্ডের এয়ারবিনবি এর দিকে। এখানে আমরা থাকবো এক আর্টিস্টের বাড়ি। ভদ্রমহিলা থ্রি ডি পেইন্টিং আর স্কাল্পচার তৈরি করেন। সারা বাড়িতেই ওনার কাজের বিভিন্ন নমুনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমার যে খাট টায় শোবো সেটাও ওনার তৈরি। একটা পুরোনো দিনের নৌকোর মতন দেখতে খাট। পাশে একটা ডানা মেলা রাজহাঁস দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের দেওয়ালগুলো গাঢ় নীল। ভারী সুন্দর লাগলো দেখে। অ্যাশ তো বলেই ফেললো দেখ মনে হচ্ছে নদীতে থাকবো আমরা। সেদিন তখন বেশ রাত হয়েছে। একটু জামাকাপড় পাল্টে, ফ্রেশ হয়েই দুজনে বেরোলাম, রাতের ডিনার খুঁজতে। বেরোতে বেরোতেই বাড়িওয়ালির সাথে দেখা। খানিকক্ষন গল্প করলাম, পোর্টল্যান্ডের হিস্ট্রি নিয়ে, আশপাশের কটা রেস্টুরেন্টেরও খোঁজ দিলেন উনি। যখন বেরোচ্ছি তখন বললেন, শোনো মোটামুটি গরম পরে গেছে বলে তোমাদের বিছানায় কম্বল দিই নি, রাতে ঠান্ডা লাগলে ড্রেসার থেকে বের করে নিও। আমি আর অ্যাশ বাধ্য মেয়ের মতন ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেশ রাত হয়ে গেছে। সব রেস্তোরাঁই মোটামুটি ঝাঁপ গোটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউই আর নতুন খদ্দের নিতে রাজি নয়। এদিকে পেটে ছুঁচোরা শুধু হা ডুডু কেন, ফুটবল, বাস্কেটবল, সাইক্লিং মায় সুমো রেসলিং অবধি লাগিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ দেখি সামনের রেস্টুরেন্টের নাম তাজ মহল। দুজনের চোখে চোখে কথা হয়ে গেলো সাথে সাথেই। একসাথে দরজা খুলে ঢুকে পড়লাম দুজনেই। ভেতরে তখন সব কর্মচারীরা খেতে বসেছে। ম্যানেজার হাঁ হাঁ করে উঠছিলো। অ্যাশ খুব করুন মুখে বলে উঠলো, "হাম দোনো কো বহোত ভুখ লাগি হ্যায়, কুছ ভি খানেকো মিলেগা? অউর কোই রেস্টুরেন্ট খুল্লি নেহি হ্যায় আভি" ভদ্রলোক খুব থতিয়ে গিয়ে দেখি বলছেন "হামলোগ আপনে লিয়ে লেমন রাইস অউর চিকেন বানায়া হ্যায়, আপ দোনো চাহ তো হামারে সাথ বৈঠ সাকতে হো।" আর আমাদের পায় কে? হৈ হৈ করে দুজনে দুটো চেয়ার টেনে বসে পড়লাম ওদের সাথে। ওদেরই একজন কিচেনে গিয়ে দুটো আরো থালা নিয়ে এলো। খেতে, খেতে আলাপ হলো সবার সাথে। কয়েকজন পাকিস্তানের লোক, দুজন বাংলাদেশের আর দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছেন বাকি কজন. একজন হাসতে হাসতে কুকের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন "এ ব্যাটা, চেন্নাই থেকে এসেছে কিনা, তাই ফাঁক পেলেই আমাদের ধরে লেমন রাইস খাওয়ায়।" হাজার বলাতেও কিছুতেই টাকা নিতে চাইছিলেন না ওঁরা। নিজের জন্য রেঁধে সেটাই অতিথিদের সাথে ভাগ করে খেয়েছেন। তার আবার টাকা কিসের?
খেয়েদেয়ে ওদেরকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ফেরত এলাম আমরা দুজনে। বেশ রাত হয়ে গেছে, পরের দিন ঠাসা প্ল্যান। সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করে আমরা যাবো পোর্টল্যান্ডের জাপানিজ গার্ডেনে। জাপানের বাইরে এটাই নাকি সব থেকে অথেন্টিক জাপানিজ গার্ডেন। ১৮৭১ এ জমি কেনা হলেও বাগানটা সর্বসাধারণের জন্য খোলা হয় ১৯৬৩ তে। জাপান-আমেরিকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী মৈত্রীর সাক্ষী হিসেবে জাপান থেকে বেশ কিছু মালি এসে থেকে গেছিলেন বাগানের রক্ষনাবেক্ষন করতে। ৫.৫ একরের এই বাগান দেখে ফিরতে ফিরতেই আমাদের ট্রেনের সময় হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি হাতপা ধুয়ে আমরা বিছানায় ঢুকলাম। একটু আধটু গল্প করতে করতেই ঘুমে চোখ একেবারে জড়িয়ে এলো।
মাঝরাত্তিরে হঠাৎ করে ঘুম ভাঙলো। কি ভয়ংকর শীত করছে রে বাবা। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে দেখি অ্যাশ আমার আগেই উঠে সারা ঘরে খোঁজাখুঁজি করছে। "ড্রেসারটা কি ঘরের বাইরে? তোর কি মনে হয়? ঘরের তো কোথাও ড্রেসারের চিহ্নমাত্র নেই। বাইরের প্যাসেজটাও দেখে এলাম। ড্রেসারের কোনো নামও নিশান নেই।" রাত দুটো বাড়িওয়ালীকে বিরক্ত করাও বাড়াবাড়ি। অগত্যা, ব্যাগ খুলে যে কটা সোয়েটার এনেছিলাম সব কটা গায়ে চাপিয়ে শুয়ে পড়লাম সে রাত্তিরের মতন। উফফ, তাতেও কি আর শীত কাটে, সারা রাত্তির ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতেই কেটে গেলো। সকালবেলা ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে বাড়িওয়ালীকে বললাম তোমার ড্রেসার কোথায় খুঁজেই পেলাম না। সারারাত্তির শীতে কেঁপেছি। ভদ্রমহিলা চোখ গোলগোল করে বললেন সেকি? ড্রেসার তো ঘরেই ছিল, তোমরা দেখোনি? অ্যাশ সাধারণত চুপচাপ থাকে, এবারে ও মুখ খুললো "কোথায় ড্রেসার? খাট আর তোমার স্কাল্পচার ছাড়া তো ঘরে আর কিছু দেখিনি। এবারে ভদ্রমহিলার অবাক হবার পালা। সেকি ঘরে তো কোনো স্কাল্পচার নেই। চলো তো দেখি। ভদ্রমহিলার সাথে গিয়ে অ্যাশ রাজহাঁসটা দেখালো। ভদ্রমহিলা গিয়ে রাজহাঁসের ডানা দুটো ধরে টান মারতেই ড্রেসারটা খুলে গেলো, ভেতরে এক্সট্রা কম্বল, বালিশ সব রাখা। আমাদের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন সত্যি আমারি ভুল হয়েছে এতো রিয়েলিস্টিকালি ডিজাইন করা উচিত হয়নি। আমার তখনও ঘোর কাটেনি। সত্যি কি অপূর্ব বানিয়েছেন ভদ্রমহিলা ড্রেসারটাকে। কালকে সারারাত দেখেও আমরা বুঝতে পারিনি যে ওর পেটে এত কিছু লুকিয়ে আছে।
এবার ওখানে মালপত্র রেখে আমরা বেরোলাম পোর্টল্যান্ড শহর আর জাপানিজ গার্ডেন দেখতে। পোর্টল্যান্ড শহরটা ওরেগনের সব থেকে বড় শহর। ভারী মিষ্টি এই শহরটা পাহাড়ের কোলে বসে আছে. শহরের নানান রাস্তা থেকে মাউন্ট রেইনিয়ার উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে আমাদেরকে। একটা বাস ধরে আমরা এসে পৌঁছলাম জাপানিজ গার্ডেনে। আজকে দুপুর অবধি এখানেই ঘুরবো আমরা। পর পর পাঁচটা বাগান মিলিয়ে তৈরি বিশাল বড় বাগান।
একটা জায়গায় জলপ্রপাত ঝর্ণা মিলিয়ে জাপানি চা বাগান তৈরি করা হয়েছে। একটা জলপ্রপাত এসে একটা পুকুরে পড়ছে, পাশেই একটা সুন্দর দেখতে ব্রিজ। এক মহিলা ঘুরছিলেন পাশেই। তাকে ডেকে বললাম আমার আর অ্যাশের একটা ছবি তুলে দিতে ব্রিজের ধারে। মহিলা ( পরে নাম জেনেছি এডিথ) আমাদের ছবিটা তুলে দিলেন, শুধু একটা নয়, বিভিন্ন পোজে বেশ কয়েকটা। তারপরে আমাদেরকে জিগেস করলেন আচ্ছা তোমরা কি ইন্ডিয়া থেকে এসেছো? আমরা হ্যাঁ বলতেই পরবর্তী প্রশ্ন আচ্ছা তোমরা দার্জিলিং গেছো? জায়গাটা দার্জিলিঙের মতন দেখতে না? আমি বললাম আপনি কি দার্জিলিঙে ঘুরতে গেছিলেন আগে? এবারে এডিথের এতোক্ষনের হাসিমুখটা একটু ম্লান দেখালো, "আমি ওখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি। ভারতবর্র্ষ আমারও দেশ।" গল্পের গন্ধ পেয়ে একটু নড়েচড়ে বসেছিলাম দুজনে। অ্যাশ বললো "কিন্তু, আপনাকে দেখে তো অভারতীয় মনে হচ্ছে।" "আমার গায়ের রং দেখে বলছো? শুধু কি বাদামি চামড়াই ভারতীয়দের পরিচয়? আমার ঠাকুরদাদা আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে এসেছিলেন ভাগ্যসন্ধানে। নানা কাজ করে টাকা জমিয়ে, দার্জিলিঙে একটা চা বাগান কিনে থিতু হয়ে বসেন তিনি। প্রথমে হয়তো দেশে ফিরবে ভেবেছিলেন কিন্তু ধীরে ধীরে দেশটার প্রেমে পরে যান উনি আর ঠাকুমা দুজনেই। আমার মাও জন্মসূত্রে ব্রিটিশ, বাবার সাথে ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করতেন। বাবার সাথে ভারতে বেড়াতে এসে আর ফেরত যাননি। কতটা ভারতের প্রেমে পড়ে আর কতটা বাবার সেটা আমি আজও জানিনা। ঠাকুরদা-ঠাকুমার পরে বাবা মা মিলেই চালাতো বাগানটা। কথা ছিল ওদের পরে আমি দায়িত্ব নেবো।" এবার উসখুস করে প্রশ্নটা করেই ফেললাম "ভারতে আপনাদের চা বাগানটা এখনো আছে?" আবার ক্ষনিকের উদাস দৃষ্টি "ঠিক জানিনা, আছে হয়তো। ৭০ এর দশক, আমি তখন পড়াশুনো করছি এখানে। একদিন খবর পেলাম নকশালেরা পুঁজিবাদী জোতদার ভেবে বাবা মা দুজনকেই মেরে ফেলেছে। আর আমি ফিরে যাইনি কখনো। কার কাছে যাবো? কাকে বিশ্বাস করবো? শুনেছি আমাদের বাগানের লোকেরাই বাবা কে কুপিয়ে মেরে ফেলেছিলো, বাধা দিতে এলে মাকেও। এদের কাছেই তো ছোটবেলা থেকে মানুষ হয়েছিলাম।" এডিথের সুন্দর মুখটা কথা বলতে বলতে ভেঙে চুরে যাচ্ছিলো। ওনার পাশের লোকটি এতক্ষন চুপ করে বসেছিলেন, এবারে ধীরে ধীরে এডিথকে জড়িয়ে ধরলেন পরম স্নেহে। এডিথ একটু সামলে নিয়ে বললেন "সরি তোমাদের এত কথা বলে ফেললাম। আসলে দার্জিলিঙের কথা উঠলেই একটু সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাই। আর এই চা বাগানটায় বসলে বড্ড পুরোনো কথা মনে পড়ে।" চারপাশের পরিবেশটা ভারী হয়ে গেছিলো। একটু সামলে নিয়ে এডিথকে বললাম "একবার পারলে ভারতে ঘুরে যাবেন, হয়তো সবাই আপনার বাবা মায়ের সাথে যেটা হয়েছে সেটা সাপোর্ট করেননি। হয়তো ওখানে ছোটবেলার কারোকে দেখতে পাবেন। একবার যাবেন পারলে।"
মনটা ভারী হয়ে গেছিলো খুব। ওঁদের থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আস্তে আস্তে বাকি বাগানটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। চা বাগানের পরে গোলাপ বাগান, পাথরের বাগান আর মাঝে মাঝে মাউন্ট রেইনিয়ারের লুকোচুরি খেলা। সেটা দেখতে দেখতে কখন নিজের অজান্তেই মন ভালো হয়ে গেছিলো। হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর পড়তে দেখি প্রায় ১:৩০ টা বাজে। অ্যাশ আগেই বলেছিলো আমাদের দুটো পঞ্চাশে ট্রেন। আগে ওই বাড়িতে গিয়ে মালপত্র নিয়ে তারপর ট্রেন ধরতে হবে, তাই আর একটু ঘোরার ইচ্ছে থাকলেও এবার ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম জাপানিজ গার্ডেন থেকে।
উবারে বসে অ্যাশকে বললাম এবার ট্রেনের টিকিটটা একবার দেখতো। রিসার্ভ সিট্ কিনা চেক করেনি। টিকিট বের করে দেখতে গিয়ে দুজনেরই চক্ষু চড়কগাছ। টিকিটটা আজকেরই তবে সময়টা দুটো পঞ্চাশের জায়গায় দুটো কুড়ি। কোনোমতে উবার থেকে নেমে তাকেই বললাম একটু দাঁড়াতে, মালপত্র নিয়ে আবার ওই উবারেই চড়ে বললাম প্লিজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিন, আমাদের দুটো কুড়িতে ট্রেন। যখন হাঁপাতে হাঁপাতে স্টেশনে পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে বাজে দুটো আঠেরো। মালপত্র নিয়ে ট্রেনে উঠতে যাবো, টিকেট কন্ডাক্টর আটকে দিলেন। ট্রেন ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগেই নাকি ট্রেনে ওঠা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কাকুতি মিনতি করেও লাভ হলো না. আমাদের চোখের সামনে ট্রেনটা টাটা করতে করতে চলে গেলো।
ভীষণ মন খারাপ লাগছিলো, ক্লামাথ ফলসে যাওয়ার ট্রেন দিনে মাত্র একটা। পরের দিনের ট্রেন ধরতে গেলে আমাদের পুরো বেড়ানোর রুটিনটাই বিগড়ে যাবে। ক্রেটার লেকটা মনে হয় এযাত্রায় হলো না। মন দিয়ে তাও ফোনে চেক করছিলাম যদি অন্য কোন উপায় থাকে। এর ফাঁকে অ্যাশ কখন পাশ থেকে সরে পড়েছে খেয়ালই করিনি। হঠাৎ দেখি অ্যাশ ফোন করছে। ফোন তুলতেই প্রচন্ড উত্তেজিত গলায় বললো "এক্ষুনি স্টেশনের বাইরে আয়, একটা রাস্তা পাওয়া গেছে।" তাড়াতাড়ি করে বাইরে এসে দেখি অ্যাশ এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে কথা বলছে। "শোন, আমরা ট্যাক্সি নিয়ে পরের স্টেশনটায় চলে যাই। ট্যাক্সিতে যেতে আধঘন্টা লাগে, ট্রেনে ৪৫ মিনিট। ওখান থেকে ট্রেন ধরে নেবো।" "তুই শিওর এটা পসিবল? ট্রেন আবার মিস হলে কি হবে? ট্যাক্সিরও তো অনেক ভাড়া হবে।" ট্যাক্সি ড্রাইভার এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার সে আসরে নামলো "ম্যাডামজি, আপনি জব উই মেট দেখেছেন? আমি ওই শাহিদ কাপুরের থেকেও ভালো গাড়ি চালাই। তবে ট্রেন ধরতে গেলে আর সময় নেই. এক্ষুনি গাড়িতে উঠুন। আর ভাড়া নিয়ে ভাববেন না। আপনারা আমার দেশের লোক। ৫০ ডলার দেবেন তাতেই হবে।" ভাড়াটা বেশ রিজনেবল, কাজেই দুজনে ঝটপট গাড়িতে উঠে পড়লাম।
এরপরে শুরু হলো ট্রেনের সাথে গাড়ির প্রতিযোগিতা। আড়চোখে দেখলাম আমাদের শাহিদ কাপুর স্পিড লিমিটের থেকে প্রায় ৩০-৪০ মাইল বেশি স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছেন। খুব ভয়ে ভয়ে বললাম শাহিদজি, একটু স্পিড লিমিটে গাড়ি চালালে হয়না? পুলিশ ধরলে ঝামেলায় পরব তো। শাহিদ মানে আমাদের ড্রাইভার জয়সিং একগাল হেসে বলল কিছু চিন্তা করবেন না, একটা অ্যাপ ইউজ করছি, কোথায়, কখন পুলিশ আছে সব বলে দিচ্ছে, আর আপনাদের ট্রেনটা ধরাতে হবে তো। আমার ইজ্জতকা সওয়াল। এরপরে আর কথা হয়না। আমি আর অ্যাশ দুজন দুজনের হাতটা শক্ত করে বসে রইলাম। অ্যাশ ভগবানের নাম জপছিলো কিনা জানিনা, তবে আমি কিন্তু একটু চুপি চুপি ঠাকুরকে ডেকে নিয়েছিলাম দেখো এ যাত্রায় প্রাণটা যেন বাঁচে। পাশ দিয়ে অন্য গাড়িগুলোকে বিপদজনকভাবে কাটিয়ে কোন সব শর্টকাট ধরে গাড়িটা চলছিল। খানিক পরে আর টেনশন না নিতে পেরে গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে বসে ছিলাম আমি। এভাবে কতক্ষন কেটেছিল জানিনা, হঠাৎ চমক ভাঙলো জয়সিংয়ের ডাকে "ম্যাডামজি, আপনাদের স্টেশন এসে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ট্রেন আসতে তখন পুরো ২০ মিনিট বাকি। মানে ওই আধ ঘন্টার রাস্তাটা জয়সিং ১৫ মিনিটে এসেছে। ওকে টাকা আর ধন্যবাদ দিয়েই ছুটছিলাম ট্রেনস্টেশনের দিকে। জয়সিং আবার ডাকলো "ম্যাডামজি, খোঁজ নিয়ে দেখুন ট্রেন ছেড়ে গেছে কিনা, তাহলে আপনাদের পরের স্টেশনে দিয়ে এসব, টাকা দিতে হবে না, আমার ইজ্জতকা সওয়াল। " এবার আমি আর অ্যাশ একসাথেই বলে উঠলাম, "না না, ট্রেন নিশ্চিন্তে পেয়ে যাবো, তুমি কিচ্ছু চিন্তা করো না।" বলেই স্টেশানের দিকে দৌড়। যেতে যেতেই অ্যাশ বলে উঠলো "ক্রেটার লেক দেখা হোক বা না হোক, ওই ট্যাক্সিতে আর চড়ছিনা। ওই ১৫ মিনিট আমি শুধু ঠাকুরকে ডেকেছি যে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট না হয়।" এরপর আর কি? নিদারুন অ্যান্টিক্লাইমেক্সের মতন পুরো উত্তেজনাবিহীন ভাবে ট্রেনটা এসে পড়লো, আমরাও টুকটুক করে ট্রেনটায় চড়ে পড়লাম।
ট্রেনটা দেখতে বেশ সুন্দর, বড়, বড় কাঁচের জানালা, তার পাশে গদি মোড়া আরামদায়ক সিট, অনেকটা আমাদের রাজধানীর চেয়ার কারের মতন। সিটে বসতে না বসতেই কন্ডাক্টর চলে এলেন টিকেট দেখতে। আমাদের দেখে একগাল হেসে বললেন ট্রেন পেলে তাহলে? ভয়ংকর রাগ হচ্ছিল লোকটার ওপরে, তারপরে কালকে ক্রেটার লেক দেখতে পাবো ভেবে মনে মনে ক্ষমা করে দিলাম। মনটা আরেকটু ভালো হয়ে গেলো যখন ভদ্রলোক বললেন ডাইনিং কারের ঠিক আগেই ভিউইং কার আছে, সেটার মাথা আর দেওয়ালগুলো পুরো কাঁচের। খানিক বাদেই ট্রেনটা দুটো পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে একটা সরু ট্রেনলাইন ধরে যাবে, সে দৃশ্য নাকি একবার দেখলে আর জীবনে ভোলা সম্ভব নয়। সাথে সাথে আমরা তল্পিতল্পা সমেত ভিউইং কারে গিয়ে ঘাঁটি গাড়লাম।
রাস্তার দুধারটা সত্যি সুন্দর। দুপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, গায়ে হালকা সাদা মেঘ কুয়াশার মতন জড়িয়ে। মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলোটা তেরছা হয়ে পড়ছে পাহাড়ের মাথায় দেখে মনে হচ্ছে যেন আকাশ জুড়ে সোনা রুপোর কাজ। আমাদের ট্রেনটা খাদের মধ্যে দিয়ে একটা সরু রেললাইন ধরে চলেছে। ভিউইং কারের থেকে নিচের দিকে তাকালে বহু নিচে গাছপালা আর তার ফাঁকে ফাঁকে একটা নদীর অভ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। বেশিক্ষণ সেদিকে দেখলে মাথা ঘোরে। আমরা দুজনে হাঁ করে দেখতে লাগলাম বাইরের দিকে। ইতিমধ্যে অ্যাশ আমরা আজকে যে বাড়িতে থাকবো সেই ভদ্রলোককে টেক্সট করেছে, স্টেশন থেকে তার বাড়িতে কিভাবে যাবো জানার জন্য। সাথে, সাথে উত্তর এলো, উনিই স্টেশন থেকে আমাদের নিয়ে যাবেন ওনার বাড়ি। সে চিন্তা শেষ তাই আমরা আবার ক্যামেরাবন্দি করতে লাগলাম আশেপাশের রূপ. ধীরে, ধীরে অন্ধকার নেমে এলো আমাদের উপত্যকায়, আমরাও গুটি গুটি পা বাড়িয়ে ডাইনিং কারে বসে লাঞ্চ সেরে ফেললাম। খাওয়া সেরে একটা ছোট্ট ঘুম দিতে দিতে ক্লামাথ লেক এসে গেলো।
বেশ ছোট একটা স্টেশন, প্লাটফর্ম বলেও কিছু নেই। ট্রেন থেকেই সোজা মাটিতে নেমে পড়ার ব্যবস্থা। স্টেশনটায় ট্রেনটা মোটে এক মিনিট দাঁড়ায় কাজেই আগে থেকেই বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে রেডি ছিলাম আমরা। ঝুপঝাপ নেমে পড়লাম। স্টেশনে একটা টিমটিম করে আলো জ্বলছে, খুব বেশিদূর যাচ্ছে না। আলোর বৃত্তের ঠিক বাইরে একেবারে জমাট অন্ধকার। অ্যাশ কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো, "হ্যাঁরে হলিউড মুভিগুলোতে সিরিয়াল কিলারের এন্ট্রিগুলো ঠিক এরকম টাইপের সিনেই হয় না?" আমার আবার মনে হল ভুতুড়ে গল্পই বরং এই পরিবেশে ভালো জমবে। বুঝতেই পারছেন যখন এইরকম সব উচ্চাঙ্গের আলোচনা চলছে তখন কানের কাছে রোশনি? অ্যাশ? নাম দুটো শুনে দুজনেই একটু চমকে উঠেছিলাম। তাকিয়ে দেখলাম অন্ধকারের মধ্যে থেকে এক ভদ্রলোক হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছেন "আমি জিম, আমার বাড়িতেই তোমরা থাকবে আজকে রাত্তিরে। সরি একটু দেরি হলো আসতে। স্টেশনের বাইরে গাড়ি রেখে এসেছি।" আমাদের সুটকেসগুলো জিম কিছুতেই বইতে দিলেন না। নিজেই দুহাতে দুটো হেঁইও হেঁই করে টানতে টানতে গাড়ির পেছনে তুলে ফেললেন। তাকিয়ে দেখলাম ঠিক গাড়ি নয়, জিম যেটা এনেছেন সেটা আমাদের দেশের ম্যাটাডোরের একটা বড় সংস্করণ।
অ্যাশ মহা খুশি। ওর নাকি ছোটবেলা থেকেই লরিতে করার একটা সুপ্ত বাসনা ছিল। ব্যাপারটা যে আমারও ছিল না তা নয়, কিন্তু বছর কয়েক আগে মুভিং এর সময় ম্যাটাডোর চড়ে শখ মিটে গেছে। গাড়িগুলো বড্ডো উঁচু। উঠতে নামতে রীতিমতন কসরত লাগে। সে যাহোক হাঁচোড় পাঁচর করে উঠে পড়লাম কোনোরকমে। জিম এবার রওনা হলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে শুনলাম ভদ্রলোক নাকি ওরেগনের সব থেকে বড় কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সিইও। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগলো। ওনার কথা যদি সত্যি হয় তবে ভদ্রলোক মাল্টিমিলিওনেয়ার। তাহলে উনি বাড়ি ভাড়া দেন কেন? কিন্তু কিন্তু করে করেই ফেললাম প্রশ্নটা। জিম হেসে ফেলে বললেন, "ছেলে মেয়ে দুজনেই কলেজে পড়তে চলে গেছে, বাড়িতে খালি আমি আর জেন। অতবড় বাড়িতে দুজনে করব কি? তোমাদের মতন লোকজন এলে নতুন লোকের সাথে আলাপও হয়, বাড়িটাও একটু ভর্তি, ভর্তি লাগে।" জিমের কোম্পানির নানান গল্প শুনতে শুনতেই পৌঁছে গেলাম ওনার বাড়ি। অবিশ্যি বাড়ি না বলে ওটাকে বোধহয় প্যালেস বলাই বেটার হবে। বিশাল বড় বাড়িটা একেবারে ক্লামাথ লেকের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। লেকের গা ঘেঁষে বাড়ির দেওয়ালে বড় বড় দেওয়াল জোড়া কাঁচের জানালা। এক নজরে দেখলে মনে হয় লেকটা যেন বাড়ির ভেতরে ঢুকে এসেছে। একতলায় ওই দেওয়াল জোড়া জানালার ঠিক পাশেই ফায়ারপ্লেস। জিম অফার করলেন আমরা চাইলে জানালার ধারে কম্বলমুড়ি দিয়ে বসে তারা দেখতে পারি। জানালার ধারে টেলিস্কোপও রাখা আছে। বাড়িটার আশেপাশে কোনো আলো নেই. তাই জায়গাটা তারা দেখার জন্য একেবারে আদর্শ। চোখে টেলিস্কোপ লাগিয়ে একটু বাইরেটা দেখতে দেখতেই জেন এসে গেলেন। জেন একটি স্থানীয় হসপিটালের এডমিনিস্ট্রেটর। বেশ হাসিখুশি মহিলা। আমাদের হৈহৈ করে স্বাগত জানালেন। তারপরে বললেন চলো তোমাদের ঘরে নিয়ে যাই, এতটা জার্নি করে এসেছো, নিশ্চয়ই ভীষণ ক্লান্ত। একটু ফ্রেশ হয়ে চাইলে আবার নিচে চলে এসো। আমি আর অ্যাশ ততক্ষনে সত্যিই বেশ ক্লান্ত, একে তো সকালবেলা পোর্টল্যান্ডের বাগানে ঘণ্টাপাঁচেক হেঁটেছি, তার ওপরে ওই ট্যাক্সি রেসের উত্তেজনা। হঠাৎ করে মনে হল ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। দম্পতিকে সেরাত্তিরের মতন বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম। আমাদের ঘরটার একদিকের দেওয়াল পুরো কাঁচের। ভারী পর্দা দিয়ে আড়াল করা. বিছানার পাশে দুটো কার্ডে লেখা ওয়েলকাম রোশনি, ওয়েলকাম অ্যাশ। সাথে দুজনের জন্য দুটো বাড়িতে বানানো ব্রাউনি। মুখে পুরতেই মিষ্টিটা যেন জিভের মধ্যে মিলিয়ে গেলো। মনে মনে বুঝলাম, কালকের ব্রেকফাস্টটা জমবে ভালো। ফ্রেশ হয়ে, আলো নিভিয়ে আবার একটু বাইরের দিকে তাকালাম। অন্ধকারে লেকটা আর দেখা যাচ্ছে না. শুধু কানে আসছে ঢেউয়ের পাড়ে ভাঙার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। আকাশটা পরিষ্কার। ওপরের দিকে তাকালে ছায়াপথটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে ঢেউয়ের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম দুজনে।
সকালে ঘুম ভাঙলো অ্যাশের ধাক্কায়। অ্যাই উঠে পর, ৭ টা বাজে, ৯টায় আমাদের গাইড আসবে। তাড়াতাড়ি করে চান করে নিচে নামতে নামতেই জেন ধরিয়ে দিলেন সদ্য ঘরে বানানো ড্যানিশ (এক রকমের পিঠে), মাশরুম, শাকসবজি আর কিমা দিয়ে বানানো ওমলেট, ঘরে বানানো পাঁউরুটির সাথে লোকাল ফার্ম থেকে আসা মাখন আর জ্যাম, আর সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা কফি। ব্যবস্থা দেখে মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেলো এতো রাজবাড়ীর আদর দেখছি। খেতে খেতে গল্প করছিলাম জিমের সাথে। বোস্টনের একটা কুখ্যাত পাড়ায় জন্মেছিলেন জিম। সে পাড়া ড্রাগ, অপরাধ আর খুনোখুনির জন্য বিখ্যাত। ৮-১০ বছর বয়েসেই ছেলে মেয়েরা মাফিয়াতে জয়েন করে, ৩০-৩২ এর ওপর বাঁচেও না বেশিরভাগই। জিমকে যেটুকু দেখেছি, তার সাথে ওর ছোটবেলাটা মেলাতে পারছিলাম না। আমাদের অবাক চাউনি দেখে জিম বললেন "অবাক লাগছে? সবারই লাগে, কিন্তু আজ যে জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছি, আমার মা না থাকলে এর কোনোটাই সম্ভব হতো না। আমার মা ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক আর বাবা মাফিয়া দলের সর্দার। চিরকালই খুনোখুনিতে আপত্তি ছিল মায়ের আর আমার বাবা মারা যাওয়ার পর মা আমাদের ভাইবোনদের আগলে ধরে ওই রাস্তায় পা বাড়াতে দেয়নি। আমি সবার বড়, তাই স্কুলে যাওয়ার আগে বাড়ি, বাড়ি কাগজ দিতাম আর আমার ভাই পাড়ার সবার বাড়ির ঘাস ছাঁটত। বোন তখনো মায়ের কোলে। মা তিন চারটা বাড়িতে বাড়ি পরিষ্কার করত। এভাবেই পুরো পড়াশুনা চালিয়েছি। আমরা ভাইবোনেরা পড়াশুনায় ভালো ছিলাম বলে কারোরই পড়তে টাকা লাগেনি। আজকে আমার বোন হসপিটালের নার্স, ভাই ডাক্তার আর আমি এখানে।" জিজ্ঞাসা করলাম "তোমার মা?" "উনি এখনো বোস্টনে, আগের পাড়াতেই আছেন। আমাদের পাড়ায় যে যে বাচ্চারা পড়াশুনা করতে চায়, আমাদের থেকে টাকা নিয়ে তাদের পড়ার খরচ চালান। রিটায়ারমেন্টের পর এটাই মায়ের কাজ।" জেন চুপচাপ শুনছিলেন, এতক্ষনে মুখ খুললেন "শুধু কি তাই? রেগুলারলি খোঁজ নেন ওই টাকা কিভাবে খরচ হচ্ছে, কেউ পড়াশুনা না করে বাজে খরচ করলে সাথে সাথে টাকা বন্ধ। আর আমরা ছুটিছাটাতে গেলেই আমাদের ধরে শেল্টারে নিয়ে যান, বাচ্ছাগুলোকে দেখাতে। মনটা খুব ভাল লাগছিলো জিমের গল্প শুনতে, শুনতে। আমাদের বললেন, "জোর করছিনা, তবে যদি পারো এদেশের শেল্টারে থাকা বাচ্চাগুলোকে কখনো সাহায্য করো। তবে একটা উপদেশ দেব, কখনো অপাত্রে দান করবে না। সাহায্য শুধু দিতে নয়, নিতেও জানতে হয়।"
গল্প করতে করতেই আমাদের গাইড এসে গেছিলেন। আমাদের দেখে এক মুখ হেসে বললেন "তোমরা নিশ্চয়ই রোশনি আর অ্যাশ? আমি জিমি, তোমাদের আজকের গাইড।" অ্যাশ পাশ থেকে বলে উঠলো "জিম থেকে জিমির পাল্লায়।" জেন ততক্ষনে জিগেস করছেন আমাদের পোর্টল্যান্ডে ফেরার প্ল্যান কি? আমাদের অ্যাশল্যান্ডে বিকেল থেকে শেষ রাত্তির অবধি থাকার কথা শুনে জিম আর জেন দুজনেরই মুখ একেবারে গম্ভীর হয়ে গেলো। জেন সাথে সাথেই অফার দিলেন আমাদের ক্রেটার লেক ঘোরা শেষ হলে উনি অ্যাশল্যান্ডে গিয়ে আমাদের নিয়ে আসবেন আবার রাত্রিবেলা বাসস্টপে ছেড়ে দিয়ে আসবেন। জিমও সাথে সাথে সমর্থন করলেন আইডিয়াটা। ক্লামাথ ফলস থেকে অ্যাশল্যান্ড ড্রাইভ করে যেতে লাগে প্রায় এক ঘন্টা। কাজেই স্বভাবতই না, না করে উঠলাম দুজনে। জেন কি আর তাতেও মানার পাত্রী? অগত্যা ওনাকে নিশ্চিন্ত করলাম যে রাত্তিরে আমরা কোনো হোটেলে বসে অপেক্ষা করবো বাস আসার জন্য। জেন জবরদস্তি ওনার নম্বরটা একটা কাগজে লিখে তুলে দিলেন আমাদের হাতে। বারবার বলে দিলেন এতটুকু অসুবিধে হলেই যেন ফোন করি ওনাকে। বেরিয়ে আসার সময় আমাদের দুজনেরই মন খারাপ। মনে হচ্ছিলো বহুদিনের পরিচিত কোন বন্ধুর বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি। প্রসঙ্গত: জিম আর জেনের বাড়ি আর না যাওয়া হলেও এখনো ফেসবুকে নিয়মিত কথা হয় ওদের সাথে। হ্যাঁ, ওই এক রাত্তিরের পরিচয়েই আজও যোগাযোগ রয়ে গেছে ওনাদের সাথে।
বারবার করে সাবধানে যাতায়াতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন জেনের থেকে ছাড়া পেলাম তখন ঘড়িতে বাজে সোয়া নটা। আমাদের গাইড জিমি বেশ মজার মানুষ। সারাজীবন আলাস্কাতে অয়েল রিগে চাকরি করেছেন। এখন বুড়ো বয়েসে এসে গুছিয়ে বসেছেন নিজের ছোটবেলাকার গ্রামে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যে যার মতন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়িতে শুধু উনি আর ওনার বৌ। আশেপাশের এলাকা নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা ভদ্রলোকের আর ক্রেটার লেক জায়গাটা প্রায় হাতের তালুর মতন চেনা। গাড়ি চালাতে চালাতেই দুতিনবার জানালার কাঁচ নামিয়ে হাওয়া পরীক্ষা করে বললেন তোমাদের কপাল আজ খুব ভালো। এমন দিনে এসেছে বেলা ১২ টা অবধি হাওয়া নেই। আজকে তোমরা লেকের অপূর্ব সুন্দর ছবি পাবে, জীবনে ভুলতে পারবে না সে দৃশ্য। তারপরে উনি আমাদের বলতে শুরু করলেন ক্রেটার লেক তৈরির ইতিহাস।
অনেক, অনেক বছর আগে, তা ধরুন প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে মাউন্ট মাজামা নামে একটা আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছিল। তখন একদিকে সাহারা মরুভূমি সবে তৈরি হয়ে উঠছে, সিসিলিতে মাউন্ট এটনা লাভা ছড়াচ্ছে, মানুষ সদয় ব্রোঞ্জ যুগে ঢুকছে আর ভারতের মানুষ সবে বন্য পশুকে পোষ মানাতে শিখছে। তা এ হলো সেই আমলের কথা। তা অগ্ন্যুৎপাত হয়ে আশেপাশের যে খুব কিছু ক্ষতি হল তা না, মাঝখান থেকে লাভের লাভ মাউন্ট মাজামার মাথাটা গেল উড়ে. ১২০০০ ফুটের পাহাড়টা ঝপ করে হয়ে গেলো ৮০০০ ফুটের আর মাথার মধ্যে তৈরি হল বিরাট বড় খোঁদল। আর তারপর ধীরে ধীরে তিনহাজার বছর ধরে বৃষ্টির জল জমে তৈরি হলো ক্রেটার লেক। স্থানীয় আদিবাসী ক্লামাথ ইন্ডিয়ানদের এনিয়ে একটা ভারী সুন্দর গল্প আছে. ওদের গল্পে পাতালদেবতা লাওয়ের বাড়ি ছিল মাউন্ট মাজামার ভেতরে। আর পাহাড়ের কোলে বাড়ি ছিল আকাশ দেবতা স্কেলের। লাও মাঝে মাঝে পাহাড়ের মাঝের গর্ত থেকে মুখ বাড়িয়ে ওপরের দিকে উঠতেন, তার মাথাটা উঠতে উঠতে গিয়ে ছুঁতো আকাশের তারাদের। লোকে দূর থেকে ভয়ে, ভক্তিতে প্রণাম করত. আর স্কেল থাকতেন লোকের মাঝে, তাদের একজন হয়ে। লোকে তাকে ভালোবাসতো। একদিন লাও বেড়াতে বেরিয়ে দেখলেন এক পরমাসুন্দরী মেয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে শিকার করছে। লাও দেখেই ঠিক করলেন একেই তিনি বিয়ে করবেন। মেয়েটি ছিল স্থানীয় রাজার মেয়ে, লোহা। লোহা কিন্তু লাওকে একদম বিয়ে করতে চায়নি। মাটির নিচে থাকার কথা ভাবলেই তার দম বন্ধ হয়ে আসে। সব আদিবাসীরা মিলে গেলো স্কেলের কাছে লোহাকে বাঁচাতে। স্কেল তখন করলেন কি লোহাকে লুকিয়ে রাখলেন মজমা পাহাড়ের ধারে। লোহাকে না পেয়ে রেগে মেগে লাও তখন বড়, বড় আগুনের গোলা ছুঁড়তে থাকেন পাহাড়ের মাথার থেকে। ভাবলেন সমস্ত আদিবাসীদের জ্বালিয়ে দেবেন তিনি অবাধ্যতার শাস্তি হিসেবে। বহু লোক মারা গেল আগুনের গোলায়। বাকিরা তাড়াতাড়ি করে গিয়ে স্কেলকে ডেকে আনলো তাদের বাঁচাবার জন্য। দুস্টু লাওয়ের ব্যবহারে স্কেল গেলেন রেগে। তিনিও তখন অন্য দেবতাদের ডেকে লড়াই শুরু করলেন লাওয়ের বিরুদ্ধে। অনেক দিন যুদ্ধের পর শেষ মেশ লাও এক ঘুসি মেরে লাওকে পাতালে পাঠিয়ে দিলেন। ঘুষির চোটে পাহাড়ের মাথায় ইয়াব্বড় গর্ত হয়ে গেলো। স্কেল তখন সব আদিবাসীদের ডেকে বললেন গর্তটা তাদের চোখের জলে ভর্তি করে দিতে। যাতে দুষ্টু লাও কখনো ওপরে ওঠার চেষ্টা করলেই আবার লোকের শোকের জলে ডুবে যায়। স্কেল এরপর আশীর্বাদ করলেন ওই লেকের তলা অবধি সবসময় স্বচ্ছ থাকবে, যাতে যদি লাও কখনো বেরিয়ে আসতে চায়, লোকে আগেভাগেই সাবধান হতে পারে। সায়েন্স বলে লেকের জলে গন্ধক বেশি হবার জন্য এই লেকে জীবন্ত কিছু বাঁচতে পারে না। আর সেজন্যই লেকের জল এত স্বচ্ছ। কিন্তু সায়েন্সকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে কখনো কখনো ভাবতে ভালো লাগে, একটি মেয়ের ইচ্ছার সম্মান দেওয়ার জন্য, পুরো একটা জাতি, একজন দেবতা লড়তে নেমেছিল আরেকজন সর্বশক্তিমান দেবতার বিরুদ্ধে।
গল্প করতে করতেই ক্রেটার লেকে পৌঁছে গেছিলাম আমরা। মাঝে এক জায়গায় থেকে ছোট্ট একটা ফোটোশুটও করে ফেলেছিলাম। পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে দারুন হয়ে ছিল ফটোগুলো। জিমি একজন শখের ফটোগ্রাফারও বটে। আমার ক্যামেরাটা দেখে ভারী খুশি হয়ে অনেকগুলো সেটিংস সংক্রান্ত খুঁটিনাটি জিনিস শিখিয়ে দিলেন আমায়। ক্রেটার লেকে পৌঁছে জিমি বললেন লেকের মাঝে যাওয়ার যে ট্যুরটা সেটা শীতকালের জন্য বন্ধ আছে কিন্তু আমরা পাহাড়ের ধার থেকে লেকটা দেখতে পাবো। আর তারপরে অবসেরভেটরিতে গিয়ে ক্রেটার লেক কিভাবে তৈরি হলো সেটার ওপর ডকুমেন্টারি দেখতে পারি। জিমি আমাদের থেকে অনেক বেশি জানেন ক্রেটার লেকের ব্যাপারে। তাই তাঁর পরামর্শই মেনে নিলাম এব্যাপারে। বাইরে বেশ ঠান্ডা। পাহাড়ের নিচে হালকা সোয়েটারেই কাজ চলে যাচ্ছিলো কিন্তু এখানে এখনো বরফ জমে আছে। বেশ ঠান্ডা চারদিকটা। আশপাশে আমরা ছাড়া আর একটাও লোক নেই। জিমি বললেন ছুটির দিন তাই লোকে একটু বেলা করে ঘুরতে আসবে। আমাদেরই ভালো। প্রকৃতির এ সৌন্দর্য ভিড়ের মাঝে উপভোগ করা যায়না। শেষ মোড়টা ঘুরতেই চোখের সামনে ভেসে এলো এক দিগন্তজোড়া নীল। প্রথম দর্শনে মনে হয়েছিল আকাশটা বুঝে নেমে এসে মিশে গেছে পাহাড়ের কোলে। পরে ভালো করে তাকিয়ে দেখি আকাশ নয়, আমাদের চোখের সামনে ক্রেটার লেক। জলটা এত ঘন নীল যে প্রথম দেখায় আকাশ আর জল আলাদা করা যায়না। জিমি ঠিকই বলেছিলেন। এতটুকু হাওয়া দিচ্ছে না। পাহাড়ের ছায়া পরেছে জলের বুকে। মনে হচ্ছে যেন পরপর দুসারি পাহাড় রয়েছে পাশাপাশি। লেকের মাঝখানে ছোট্ট একটা পাহাড় মাথা জাগিয়ে রয়েছে। জিমি বললেন স্কেল নাকি ওই পাহাড়টা দিয়ে লাউয়ের বাড়ির দরজাটা চাপা দিয়ে রেখেছেন। যাতে লাও চাইলেও কোনোদিন না বেরোতে পারেন, পাতালেই আটকে থাকেন চিরকাল। কতক্ষন যে হাঁ করে ক্রেটার লেকের দিকে তাকিয়েছিলাম জানিনা, চমক ফিরলো জিমির কথায় "ছবি তুলবে না? এখন হাওয়া নেই, চটপট ছবি তোলো, খুব ভালো উঠবে।"
চারপাশের জমি বরফ পরে সাদা। আর আকাশের ঘন নীলটা প্রতিফলিত হচ্ছে লেকের বুকে। সব মিলিয়ে এক অপার্থিব দৃশ্য। একটা ছবি তুলেই মনে হয় অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে আরো ভালো ছবি আসছে। ছবির পর ছবি তুলেও আশ মেটেনা যেন। অগত্যা ক্যামেরাটা চুপচাপ কাঁধে ঝুলিয়ে মনের ক্যামেরায় সামনের দৃশ্য বন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দেখতে, দেখতে ১২ টা বেজে গেল। এবার গুটি গুটি পা বাড়ালাম সংলগ্ন অবসারভেটরিতে। লেক দেখতে দেখতে চটপট জিমের আনা স্যান্ডউইচ আর কফি খেয়ে ফেললাম আমরা। তারপরে গেলাম ক্রেটার লেকের ওপরে তৈরি মুভি দেখতে। বেশ ভালো ছিল মুভিটা কিন্তু জিমের গল্প বলার ধরণ অনেক ভালো। মুভি শেষ হলে এবার শেষ বারের মতন ক্রেটার লেক দেখে অ্যাশল্যান্ডের দিকে পা বাড়াবো। বেলা বেড়েছে, লেকের চরিত্র বদল হয়েছে। হালকা হাওয়ায় লেকের বুকে ছোট, ছোট ঢেউ উঠেছে। ছবিগুলো ভেঙে চুরে যাচ্ছে। কতগুলো পরিবার বেড়াতে এসেছে। তাদের বাচ্ছারা ছুটোছুটি চিৎকার করে বেড়াচ্ছে আর নুড়িপাথর তুলে কে লেকের বুকে কদ্দুর ছুঁড়তে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে। আর পেছনে কার ট্রান্সিস্টরে গান চলছে। তাড়াতাড়ি পা বাড়িয়ে ওখান থেকে চলে গেলাম। এ পরিবেশে ওই গান, চিৎকার মানায়না। কেন যে লোকে বোঝে না সেটা।
ফেরার পথে দেখি জিম বলছেন, চলো তোমাদের আরেকটা জায়গা দেখিয়ে আনি। উইনেমা ন্যাশনাল ফরেস্ট আর তার সাথে স্যামন ফার্ম। খুব অবাক হয়ে বললাম কিন্তু এগুলো তো আমাদের প্ল্যানে ছিল না। জিমি বললেন ধরে নাও এইটা তোমাদের ভালো টুরিস্ট হবার জন্য পুরস্কার। ভারী সুন্দর দেখতে উইনেমা ন্যাশনাল ফরেস্ট। বহু, বহু বছরের প্রাচীন গাছগুলো একে ওপরের গায়ে লেগে, লেগে বড় হয়ে উঠেছে। মাঝখান দিয়ে কুলকুল করে একটা ছোট্ট ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে আমরা ছাড়া আর কোনো লোক নেই। জিমি এঁকেবেঁকে জঙ্গলের মধ্যে পথ ধরে আমাদের একদম নদীর সামনে নিয়ে গেলেন। একটা গাছের গুঁড়িকে কেটে বসার বেঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। ওখানে বসিয়ে জিমি বললেন "এটা আমার ভারী প্রিয় জায়গা। সাধারণত এখানে আমি টুরিস্টদের আনিনা কিন্তু তোমাদের দেখে মনে হলো তোমাদেরও এজায়গাটা খুব ভালো লাগবে।" সত্যি অপূর্ব জায়গাটা। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু জলের কুলুকুলু আওয়াজটা কানে আসছে। খানিকক্ষণ বসলে মনটা নিজের থেকেই শান্ত হয়ে যায়। প্রাচীনকালে মুনিঋষিরা এজন্যই বোধয় জঙ্গলে গিয়ে ধ্যান করতেন। এখানে কিছুক্ষণ বসে থাকলে আপনা থেকেই সব রাগ, হিংসে, দুঃখ মন থেকে চলে গিয়ে মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। খানিক ওখানে বসে আমরা গেলাম স্যামন ফার্ম দেখতে। এটা ওরেগনের সব থেকে বড় স্যামন ফার্ম। সারা আমেরিকায় মাছ চালান যায় এখান থেকে। জিমি আমাদের ঘুরিয়ে, ঘুরিয়ে দেখালেন কিভাবে ছোটো থেকে মাছগুলোকে বড় করা হয়। ক্লাস নাইনে মাঝে, মাঝে বন্ধুদের পিসিকালচার বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখতাম। বহুকাল বাদে সেই বইগুলোর কথা মনে পরে গেলো। এবার আমাদের ফেরার পালা। গাড়িতে চড়ে রওনা হলাম অ্যাশল্যান্ডের দিকে।
জিমি জিগেস করলেন "কোথায় ছাড়বো তোমাদের? আজকে কি হোটেল এ থাকবে?" আমি বললাম "নাহ, আমাদেরকে বাসস্টপে যেতে হবে। রাত তিনটায় বাস।" জিমি দারুন অবাক হয়ে বললেন "সেকি? এখন তবে বিকেল তিনটে। অ্যাশল্যান্ড পৌছাবো ধরো অ্যারাউন্ড ৪:৩০। তখন থেকে রাত ৩টে অবধি করবেটা কি তোমরা?" অ্যাশ তখন বললো যে গুগলে দেখেছি থ্রি ডটার বলে একটা বার আছে অ্যাশল্যান্ডে যেটা সারারাত খোলা থাকে। ভাবছি সেখানে বসেই বাসের অপেক্ষা করবো। জিমি কিছু বললেন না, কিন্তু মুখটা দেখি গম্ভীর হয়ে গেছে।
অ্যাশল্যান্ড পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৪:৩০ তে বেজে গেলো। জিমি আমাদের নিয়ে চললেন থ্রি ডটার বারের দিকে। ওখানে নামতেই দেখি জিমি ও গাড়ি পার্ক করে পেছন পেছন আসছেন। আমাদের টাকাপয়সা ওনাকে মেটানো হয়ে গেছিলো, তাই একটু অবাক হয়েই জিগেস করলাম "কি হলো জিমি? কিছু ফেলে এসেছি নাকি গাড়িতে?" "না, তা ঠিক নয়। তোমরা দুটো একলা মেয়ে, একটা অচেনা জায়গায় এতো রাত অবধি থাকবে তাই একটু খোঁজ নিয়ে যাবো সব ঠিকঠাক আছে কিনা।" বলেই আমাদের দুজনকে প্রায় বগলদাবা করে হাজির হলেন বারটার ম্যানেজারের কাছে। দুঃসংবাদ, বারটা রাত ১ টায় বন্ধ হয়ে যাবে। এদিকে ছোট জায়গা, ওই বারটা ছাড়া আর কোনো কিছুই অত রাত অবধি খোলা থাকেনা। অ্যাশের তো শুনেই মুখ শুকিয়ে গেছে। আমার একটু একটু ভয় করছে। তাও জোর করে মুখে হাসি টেনে বললাম, "চল, গ্রেহাউন্ডের ওয়েটিং রুমে যাই, ওখানে নিশ্চই অপেক্ষা করতে দেবে।"
গ্রেহাউন্ডের ওয়েটিং রুমে গিয়ে দেখি একজন কর্মচারী সেখানে তালা লাগাচ্ছেন। জিগেস করে বললেন কিছু হোমলেস আর ড্রাগ ইউসার রেগুলারলি ওয়েটিং রুমে ঢুকে বসে থাকে, তাই নতুন পলিসি অনুযায়ী বাস আসার মাত্র আধ ঘন্টা আগে ওয়েটিং রুম খোলা হয়. মানে রাত ২:৩০ টের আগে এদিকেও কোনো আশা নেই। এবারে সত্যি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। রাত ১টা থেকে ২:৩০ টে কোথায় যাবো আমরা?
জিমি দেখি ইতিমধ্যে একটু দূরে চলে গিয়ে কাকে ফোন করছেন। ফোন শেষ হতেই হাসি মুখে এগিয়ে এসে বললেন "কোন চিন্তা নেই, চল গাড়িতে ওঠো, আমার বাড়িতে নিয়ে যাই তোমাদের। ২:৩০ টা নাগাদ আবার এসে তোমাদের ছেড়ে দেব।" আমি তো শুনেই প্রবল আপত্তি শুরু করলাম, "না না সে হয় না। তোমার বৌয়ের ওপর খুব চাপ পড়বে। চেনে না শোনে না, এখন আমরা দুজন গেলে তোমাদের অনেক অসুবিধে হবে। আর তার ওপরে তোমার কালকেও টুর আছে, রাত ২:৩০ টায় আমাদেরকে পৌঁছে, তারপর বাড়ি গেলে তুমি কখন শোবে আর কখন ঘুমোবে? তোমার ওপর এতো অত্যাচার করতে পারব না।" জিমি দু মিনিট হাসিমুখে আমাদের বক্তব্য শুনলেন। তারপর খুব ফার্মলি বললেন " এতক্ষন বৌয়ের সাথেই কথা বলছিলাম। ওই সাজেস্ট করলো তোমাদেরকে বাড়ি নিয়ে আসতে। ইনফ্যাক্ট, বরং তোমাদেরকে বাড়ি না নিয়ে গেলেই আমার কপালে দুঃখ আছে।" অ্যাশ এতক্ষন চুপচাপ শুনছিলো, এবার এগিয়ে এসে বললো "জিম, আমার একটা সাজেশন আছে, আমরা বরং এখন থেকে ডিনার করে একটা ক্যাব নিয়ে তোমার বাড়ি যাই, আর তারপর ওই ক্যাবটাই আবার আমাদের ২:৩০ তে নাগাদ পিক আপ করে এখানে পৌঁছে দেবে। দেখো, এখন অলরেডি ৫:০০ টা মতন বাজে, এখন হঠাৎ করে ডিনারে দুজন বাড়তি লোক হাজির হলে অসুবিধা হবে। তুমি বরং তোমার বৌকে এখানে চলে আসতে বলো, আমরা একসাথে ডিনার করবো।" জিমির আবার এব্যবস্থায় প্রবল আপত্তি। শেষ কালে রফা হলো, জিমিরা বাড়িতে ডিনার করবে আর আমরা এখানে আর তারপর আমরা দুজন ক্যাব নিয়ে ওর বাড়িতে যাবো।
জিমি দেখি এরপর গিয়ে এক ক্যাব ড্রাইভারকে ধরেছেন "এই যে দুটো মেয়েকে দেখছো, ওরা এখন থ্রি ডটারে ডিনার করবে, তুমি তারপর ওদের তুলে নিয়ে আমার বাড়িতে পৌঁছে দেবে, আবার রাত ২:১৫ নাগাদ ওদের তুলে এখানে পৌঁছে দেবে, যাতে ওরা রাতের বাসটা ধরতে পারে। আর শোনো, ওরা বাসে না ওঠা অবধি অপেক্ষা করবে কিন্তু। এই আমার নাম-ঠিকানা আর ফোন নম্বর রইলো। ওরা দুজন কিন্তু এখানে কিছু চেনেনা। কোন অসুবিধা হলেই আমাকে ফোন করবে। ক্যাব ড্রাইভার ও দেখি খুব ঘাড় নেড়ে নেড়ে জিমির কথা শুনছে। অ্যাশ ফিসফিস করে বললো "বুঝলি এক গার্জেন আরেক গার্জেনকে ডিউটি হ্যান্ডওভার করছে।"
কথাটথা শেষ হলে, আমাদেরকে রেস্টুরেন্টে ঢুকিয়ে আমাদের মালপত্র নিয়ে জিমি চলে গেলেন। ইতিমধ্যে জেনকে ফোন জিমির বাড়ি যাচ্ছি বলে আশ্বস্ত করেছি। অ্যাশ আর আমি বলাবলি করছি এ তো পুরো বাড়ির কারফিউ মনে হচ্ছে। কে বলে রে আমেরিকানরা অন্যের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয় না? এবারে আমরা দুই মূর্তি ঢুকলাম ডিনারে। খেয়েদেয়ে, একটু ডেসার্ট আর ওয়াইন কিনে দুজনে চললাম জিমির বাড়ি। জিমের বাড়িটা একদম সাবার্বের মধ্যে, ছোটোখাটো বাড়ি, দেখলেই বোঝা যায় বেশ মধ্যবিত্ত পাড়া। আমরা দুজনে বেল টিপতে, জিমি দরজা খুলেই হৈহৈ করে উঠলেন, "হেলেন, আমাদের গেস্টরা এসে গেছে।" জিমির বৌ, হেলেনও ততক্ষনে দরজায় হাজির। জিমির মতনই বয়েস, একটু মোটাসোটা ভারিক্কি গোছের মহিলা, মুখের মধ্যে একটা স্নেহময়ী মা, মা ভাব। এসেই জিমিকে একটা ধমক, "আহ জিমি, ওদেরকে ঢুকতে দেবে তো? এস, এস, আমি হেলেন। তোমরা তো নিশ্চই সারাদিন ঘুরে টায়ার্ড হয়ে গেছো। রেস্টরুমটা ওদিকে, ঝটপট করে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও, ভালো লাগবে। আমি বরং তোমাদের জন্য একটু কফি বানাই। আচ্ছা, তোমরা কফি খাও তো? ইন্ডিয়ানরা তো শুনেছি খালি চা খায়। আমার কাছে ভালো চাও আছে। আমরা আসলে আগে কখনো কোনো ইন্ডিয়ানকে মিট করিনি। তাই ঠিক সিওর না, তোমাদের কি ভালো লাগবে।" ভালো আর লাগবে কি? কন্টিনুয়াস কথার তোড়ে আমরা তখন হতভম্ব। হেলেন একটু থামতেই বলে উঠলাম, "না না, আমাদের নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না। আমরা চা, কফি সব খাই। ইনফ্যাক্ট আমরা ডেজার্ট আর ওয়াইন এনেছি। আমরা ফ্রেশ হয়ে এলে ওগুলোও খাওয়া যেতে পারে।"
ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতেই হেলেন দুজনকে দুটো চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলেন। চা খেতে খেতে ওদের সাথে গল্প করছিলাম। হেলেন স্থানীয় একটি স্কুলের স্পেশাল এডুকেশন টিচার। একটিই ছেলে, সে এখন আলাস্কাতে চাকরি করে। আর মেয়ে থাকে সান ফ্রানসিস্কোতে। এবছর ওনাদের বিয়ের ৪৫ বছর হবে। জিমি ততক্ষনে পাশ থেকে ফুট কাটছেন "ওদেরকে আমাদের বিয়ের গল্পটা বলো। কত কষ্ট করে তুলেছিলাম তোমাকে।" হেলেনের মুখে তখন নবকিশোরীর লজ্জা, "তোমার ওই গল্পটা যে আসে, তাকেই বলতে লাগে, তাই না?" জিমিও নাছোড় "আরে, ওটা আমার জীবনের বেস্ট অ্যাচিভমেন্ট, লোককে না বললে চলে? বুঝলে হে ছুকরিরা, আজকে যে এই মহিলাকে দেখছো, যিনি এককালে মিস আলাস্কা ছিলেন। তা ওনার ক্রাউনিং এর পর একদিন আমাদের অয়েল রিগ দেখতে এসেছিলেন। তখন ওনার আশেপাশে, আগে পিছে রোমিওদের ভিড়. আমি আর চান্স পাইনা।"
"তা তখন কি করলেন?" "আমিও বাবা চালু ছেলে, খোঁজ নিয়ে দেখলাম, হেলেনের কুকুরটা ওর বড্ডো প্রিয়। তাই আমি হেলেনকে ছেড়ে ওর কুকুরকে পটাতে শুরু করলাম। তারপর সে এমন হলো কুকুর আর আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। হেলেন আবার কুকুরকে ছেড়ে থাকতে পারেনা। কাজেই আমি ঝোপ বুঝে কোপ মারলাম যে দেখো আমাকে বিয়ে করলেই প্রব্লেম সল্ভড। ব্যাস বিয়ে হয়ে গেলো।" হেলেন এতক্ষণে লজ্জারুণ মুখে প্রতিবাদ করলেন "যাহ, আমি মোটেই টমির জন্য তোমাকে বিয়ে করিনি। তোমাকে ভালো লাগতো, তাই বিয়ে করেছি।" জিম খুশির চোটে চেয়ার ছেড়ে একদম লাফিয়ে উঠে পড়লেন "সত্যি? প্লিজ প্লিজ আরেকবার বলো।" "আর বলবো না, তুমি ওটা শোনার জন্যই বারবার ওই অ্যাবসার্ড গল্পটা সবাইকে বলো।" জিমির মিচকি হাসি সমেত কমেন্ট, "আহা, বলি বলেই না তুমি সবার সামনে বারবার আমাকে আই লাভ ইউ বলো।"
দম্পতির এই খুনসুটি দেখতে বড্ডো ভালো লাগছিলো। মনে মনে ভাবছিলাম, আমরাও যেন বিয়ের ৪৫ বছর পর এরকমই থাকতে পারি। এরপর শুরু হলো ওয়াইন আর ডেসার্ট সমেত আড্ডা। কি নেই তাতে? হেলেন আর জিমির প্রচুর পড়াশুনা আর ইন্ডিয়া নিয়ে প্রবল আগ্রহ। কাজেই গল্পের টপিকের অভাব নেই। গল্প করতে করতে কখন ১০:৩০ টা বেজে গেছে বুঝতেই পারিনি। হেলেন হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ ফেলেই জিমিকে আরেক ধমক "তোমার আর কোনোদিন আক্কেল হবেনা। মেয়েগুলোর মাঝরাতে উঠতে হবে, তুমি এখনো ওদের বসিয়ে রেখে গল্প করছো।" জিমি মিনমিন করে বলতে চেষ্টা করলেন "ডার্লিং, তুমিও তো..." "আমি যা করি, করি, তা বলে তুমিও করবে?" এপ্রশ্নের উত্তর হয়না, তাই বোধহয় জিমি চুপ করে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করলেন।
হেলেন এরপরে নিয়ে গেলেন একটা বেডরুমে। "তোমরা আসবে শুনেই বিছানা পেতে রেখেছি। চটপট এখানে শুয়ে ঘন্টা তিনেক ঘুম লাগাও। ১:৪৫ এর অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি। আর কফিমেকারে জল ও ভরা আছে. সকালে উঠে, ওখান থেকে চা বা কফি খেয়ে বেরিয়ো। আর শোনো, বেরোবার সময় সদর দরজাটা টেনে দিয়ো, অটোলক আছে, বন্ধ হয়ে যাবে।" আমরা কিন্তু কিন্তু করে বললাম "কিন্তু তুমি তো আমাদের চেনোও না, আমাদের ভরসায় বাড়ি খোলা রেখে ঘুমোতে যাবে?" হেলেন এতক্ষন ভালোভাবে কথা বলছিলেন হঠাৎ আমাদেরকেও জিমির মতোই ধমকে উঠলেন, "ননসেন্স, চিনিনা মানে? এতক্ষন তাহলে কি করলাম? কোন আপত্তি করবে না, ঝটপট শুতে যাও। কাল-পরশু তো আবার টইটই করে ঘোরা আছে, আর ফিরে গিয়েই অফিস। একটু না ঘুমোলে চলবে কেন?" বলেই আমাদের দুজনকে এক এক করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন "গড, ব্লেস ইউ মাই চাইল্ডস। তোমাদের সাথে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো। দুজন বুড়োবুড়ি একা থাকি, তোমরা এলে, সন্ধ্যেটা খুব ভালো কাটলো।" আমরাও ততক্ষনে জড়িয়ে ধরেছি ওনাকে। গায়ে কি সুন্দর মা-মা গন্ধ। জিমি ইতিমধ্যে ঘরে ঢুকে বললেন "আমি তোমাদের বাড়িতে আনলাম, আর তোমরাও ওর দলে হয়ে গেলে?" অ্যাশ বললো "কেন? হয়েছেটা কি?" জিম একদম অভিমানী বাচ্ছাদের মতন ঠোঁট ফুলিয়ে বললেন "আমার হাগ্ কই? আমি কফি খাওয়াইনি বলে, হাগ্ও পাবনা?" জিমিকেও জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিলাম দুটো। এরপর আমাদেরকে গুড নাইট বলে দম্পতি শুতে চলে গেলেন। আমরাও ঝটপট শুয়ে পড়লাম ঘন্টা দুই ঘুমোতে।
অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙলে, আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে গিয়ে রেডি হলাম। তারপর কিচেনে গিয়ে দেখি, শুধু কফি নয়, তার পাশে দুটো ক্রয়স্যাঁ আর দুটো আপেল রাখা। পাশে ছোট চিরকুট, "পোর্টল্যান্ড পৌঁছাতে সকাল নটা বেজে যাবে। এগুলো সকালে খেয়ে নিয়ো, নয়তো খিদে পাবে।" অ্যাশের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখে জল, আমারও চোখটা জ্বালা করছে তখন। একটা কাগজে দুজনে থ্যাংক ইউ নোট লিখে যখন বেরোলাম, তখন ঘড়িতে ২:১৫।
বেরিয়ে দেখি আমাদের ক্যাব ড্রাইভার হাজির। খুশি খুশি মুখে বললাম "বাহ্, তুমি তো একেবারে অন টাইম" সে বললো "টাইমে না এলে চলবে? তোমরা আমাদের শহরের অতিথি না?" যেতে যেতে তার সাথেও একটু গল্প হলো, যে ক্যাবটায় যাচ্ছি ভদ্রলোক সেই ক্যাব কোম্পানিটার মালিক। পাশের শহরে থাকেন। আজকে এসেছিলেন এদিকে, রুটিন দেখাশুনো করতে। জিমি সে সুযোগে ওনাকে পাকড়েছে। অ্যাশ জিজ্ঞাসা করলো "তাহলে তুমি এলে এতো রাতে? তোমার কোনো এমপ্লয়ীকে পাঠালেই তো পারতে। তুমি এতো ঝামেলা নিলে কেন?" ডিলান খুব গম্ভীর হয়ে বললেন "আমার একটা দায়িত্ব নেই? জিমি আমার ভরসায় তোমাদেরকে পাঠিয়েছে। আমি সেই রেস্পন্সিবিলিটি অন্যের ঘাড়ে কি করে ট্রান্সফার করবো? বিসাইডস, আমি নিজেকে যতটা ট্রাস্ট করি, সেটা তো বাকিদের করিনা। তাই সে প্রশ্নই ওঠে না।" এ কথার পর আর কথা ওঠে না। তাই আমরাও চুপ করে গেলাম।
যখন বাসস্টেশনে পৌছালাম ঘড়িতে তখন ২:৪০। ডিলান আমাদের নামিয়ে বললেন "আমার ফোন নম্বরটা লিখে নাও। এখানে গাড়ি পার্ক করার জায়গা নেই আশেপাশে, তাই আমি গাড়িটা নিয়ে চারপাশেই চক্কর দিচ্ছি। কোন অসুবিধা হলেই ফোন করবে।" আমরা বলবার চেষ্টা করলাম বাস স্টেশনে যখন পৌঁছে গেছি, আমরা ঠিক বাসে উঠে যেতে পারবো। কিন্তু কে কার কথা শোনে। ডিলানের এক গোঁ, আমাদের বাসে না উঠিয়ে উনি যাবেন না। তা আমরা অগত্যা মাল পত্র নিয়ে বসে রইলাম বাস স্টেশনে। দশ মিনিট পর পর ডিলানের টেক্সট আসছে, "সব ঠিক আছে তো?" প্রায় ৩:০৫ নাগাদ টেক্সট এলো "তোমাদের বাসটা আসছে।" বাস এলো, আমরাও উঠে পড়লাম। জানলার ধারে আমার সিট্। ডান দিকে চোখ পড়তেই দেখি ডিলান হাসি মুখে টাটা করছেন। এক ঘুমে বাকি রাত কাবার। সকালে উঠতে উঠতেই দেখি জেন, জিম আর ডিলানের টেক্সট, ঠিকঠাক পৌঁছেছি কিনা আমরা। সবাইকে একে, একে টেক্সট করে আশস্ত করলাম আস্তসুস্থ পৌঁছেছি বলে। তারপর লাগেজ রুমে মালপত্র জমা রেখে ফ্রেশ হয়ে বেরোলাম পোর্টল্যান্ডের বাকিটা ঘুরতে। আজকে আমাদের গন্তব্য চাইনিজ গার্ডেন আর তারপরে পাওয়েল বুকস্টোর। শুনেছি সেটা নাকি আমেরিকার সব থেকে বড় বইয়ের দোকান। তারপরে পোর্টল্যান্ডের ফেমাস কার্ট ফুড খেয়ে আর ভুডু ডোনাট কিনে বিকেল ৪ টে নাগাদ এখন থেকেই ট্রেন ধরে সিয়াটল যাবো। এবারে যেতে যেতেই বারবার করে দেখে নিলাম ট্রেনটা ঠিক কটায়। একবার ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছি, আবার ওই শাহিদ কাপুরের পাল্লায় পড়লে আস্ত ফিরে আসবো কিনা সেব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
চাইনিজ গার্ডেনটা জাপানিজ গার্ডেনের থেকে বয়েসে ও আকারে দুদিকেই ছোট। কিন্তু ছোট হলেও তার রূপের কমতি নেই। ইউ এস গভর্নমেন্টের কড়াকড়ির জন্য চীন থেকে গাছপালা আসতে পারেনি বটে কিন্তু স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় আর নার্সারিগুলি মিলে হুবহু একটুকরো চীন তুলে এনেছেন পোর্টল্যান্ডের বুকে। পোর্টল্যান্ডের গর্বের জায়গা যদি জাপানিজ গার্ডেন হয়, চাইনিজ গার্ডেন তবে আদরের। শনি-রবিবার গুলোতে পোর্টল্যান্ডের লোকজন সব এখানে জড় হন, বিভিন্ন ক্লাস হয় সেগুলো করে, চাইনিজ টি হাউসে ব্রেকফাস্ট করে বাড়ি যান। আমরা গুগল ম্যাপ দেখে দেখে চাইনিজ গার্ডেনের দিকে হাঁটা লাগিয়েছি। ম্যাপে দেখাচ্ছে প্রায় মিনিট পনেরোর হাঁটা রাস্তা। একটা জায়গায় এসে একটু কনফিউসড হয়ে গেলাম। সোজা না ডানদিকে? অ্যাশের মতে সোজা আর আমার ভোট ডানদিকে। বেশি তর্কে না গিয়ে সামনে একটি মেয়ে যাচ্ছিল তাকেই ডেকে জিগেস করলাম। মেয়েটি একটু হেসে জানালো সেও চাইনিজ গার্ডেনের দিকেই যাচ্ছে, চাইলে আমরা ওর সাথেই যেতে পারি। জুটে গেলাম ওর সঙ্গে। মেয়েটির নাম পোর্শিয়া, স্থানীয় কলেজে মাস্টার্স করছে আর তার থেকেও বড় কথা মেয়েটি অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটের পোর্টল্যান্ড ব্রাঞ্চের এক বড়সড় লিডার। ওর থেকে গল্প শুনছিলাম কিভাবে কেন ও অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্টে জড়িয়ে পড়লো। ডাকোটা এক্সেস পাইপলাইনের গল্পও আমি প্রথম ওর মুখ থেকেই শুনি। এই পাইপলাইনের গল্পটা হয়তো আপনারা অনেকেই জানেন এখন। ২০১৫ তে সত্যি বলছি এব্যাপারে বিন্দু বিসর্গও জানা ছিল না আমাদের দুজনের। আমাদের উৎসাহ দেখে পোর্শিয়া গল্প বলছিল ডাকোটা পাইপলাইনের বা কিভাবে নেটিভ আমেরিকানরা বঞ্চিত হয়েছে দিনের পর দিন তার। পোর্শিয়া নিজেও নেটিভ আমেরিকান। ওর ইচ্ছে সোশ্যাল সায়েন্স পি এইচ ডি করে নেটিভ আমেরিকানদের সমস্যাগুলো লোকের সামনে তুলে ধরবে একটু একটু করে। ওর সাথে হেঁটে হেঁটে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম চাইনিজ গার্ডেনে। পোর্শিয়া এখন যাবে অকুপাই পোর্টল্যান্ডের মিটিঙে, ওর থেকে বিদায় নিয়ে দুজনে ঢুকে পড়লাম চাইনিজ গার্ডেনে। খানিক বাদেই দেখি ফেবুতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে পোর্শিয়া।
আমেরিকাতে একটা বেশ মজার কাস্টম আছে। সব শহরেরই বিদেশে একটা করে "সিস্টার সিটি" আছে। পোর্টল্যান্ডের সিস্টার সিটি চীনের সুঝোউ। পোর্টল্যান্ডের চাইনিজ গার্ডেন যখন তৈরি হয় সুঝোউ থেকে গাছ পাঠাতে চেয়েছিলো বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে। কাস্টমসের পাল্লায় পরে সেটা সম্ভব না হয়নি বলে সুঝোউ থেকে কাঠ আর পাথর পাঠানো হয় যাতে চাইনিজ গার্ডেনে চীনের কিছু অবদান থাকে। বাগানের মাঝখানের টিহাউসটা পুরোপুরি সেই মালমশলা দিয়েই তৈরি। ইনফ্যাক্ট ওটাতে যে চা গুলো পাওয়া যায় সেটাও সুঝোউ থেকেই আসে।
বাগানে ঘুরতে ঘুরতে টিহাউসের সামনে এসে দেখি তাই চি ক্লাস হচ্ছে। তাই চি একধরণের চাইনিজ মার্শাল আর্ট কিন্তু অনেকে তাই চি মেডিটেশনের জন্যও করেন। দুজনে দেখতে দেখতে কখন নিজের অজান্তেই একেবারে সামনে চলে এসেছি খেয়াল নেই। হঠাৎ দেখি ইন্সট্রাক্টর ডাকছেন আমাদেরকে। "তোমরা জয়েন করবে ক্লাসটাতে? এক্ষুনি একটা নতুন সেশন শুরু হবে।" ইতস্তত করে বললাম কিন্তু আমরা তো তোমার স্টুডেন্ট নই। উত্তর এলো এটা ফ্রি ক্লাস। আমি প্রতি উইকেন্ডে এখানে ক্লাস করাই, যার ইচ্ছে জয়েন করে। চাইনিজ গার্ডেনে, চাইনিজ মার্শাল আর্ট। বেশ ইউনিক অভিজ্ঞতা। সাথে, সাথে ব্যাগপত্র রেখে ক্লাসে জয়েন করলাম দুজনে। ব্যাপারটা অনেকটা নাচের মতন কিন্তু শরীরের যে অংশটা নাড়াচ্ছি সেটার দিকে তখন মনোযোগ দিতে হবে। করতে করতে কিরকম একটা ট্রান্সএ চলে যাচ্ছিলাম। মনটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছিল। ক্লাস শেষ হলে টিহাউসে গিয়ে চাইনিজ চা আর কেক খেলাম। এবার গন্তব্য পাওয়েল বইয়ের দোকান।
বিশাল বড় বইয়ের দোকান। ৬৮,০০০ স্কয়ার ফুটের ওপর তৈরি এই দোকানে প্রায় ৪০ লক্ষের ওপর বই আছে। দোকানটায় ঢুকে মনে হয়েছিল স্বর্গরাজ্যে চলে এসেছি। ওখান থেকে বেরোতেই ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু উপায় নেই। ট্রেনের তাড়া আছে। অগত্যা ঘন্টাখানেক থেকেই বেরিয়ে পড়তে হলো ওখান থেকে। এবার দুপুরের খাবার পালা। আমাদের দেশে যেমন অফিসপাড়ায় অস্থায়ী খাবারের দোকান বসে এদেশে সেরকম দোকানকে ফুড কাৰ্ট বলে। পোর্টল্যান্ডে প্রায় ৫০০ এর ওপরে ফুড কাৰ্ট আছে। ডাউনটাউনে একটা বিশাল বড় জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ফুড কাৰ্ট গুলো। কতরকমের দোকান, বিভিন্ন দেশের খাবার বিক্রি হচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর প্রায় সব কুইসিনই বোধহয় পাওয়া যাবে এখানে। ভেবেচিন্তে আমি চুজ করলাম নাইজেরিয়ান একটা ফুড কাৰ্ট। আর অ্যাশ গেলো বেলজিয়ামের খাবারের দিকে। খেয়েদেয়ে এবারে ফেরত চললাম স্টেশনের দিকে। এবারের মতন পোর্টল্যান্ড দর্শনের এখানেই সমাপ্তি। এখন আমরা যাবো সিয়াটলে।
পোর্টল্যান্ড থেকে সিয়াটলে যাবার রাস্তাটা আগের ট্রেনযাত্রার মতন অতখানি সুন্দর নয়। তাই এই রাস্তাটা মূলতঃ গল্প করেই কেটে গেলো। আজকে আমরা থাকবো অ্যাশের এক বন্ধুর বাড়ি। সিয়াটলে নেমে লোকাল ট্রেন ধরে পৌছালাম অ্যাশের বন্ধু নিশির বাড়ি। বেচারি তার দেড় বছরের যমজ বাচ্চাদের নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে প্রায়। ভারী মিষ্টি দুটি বাচ্চাই। নতুন মানুষ দেখে তারা প্রথমে একটু কেঁদেছিল বটে কিন্তু খানিকক্ষণের মধ্যেই তারা এমন ঘাড়ে মাথায় চড়তে লাগলো যেন তাদের সঙ্গে জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। সেদিন সন্ধ্যেয় আর কোথাও বেরোনো নেই। শুরু হলো চা মুড়ি নিয়ে আড্ডা। পরের দিন আমরা স্কাগিট ভ্যালি টিউলিপ ফেস্টিভ্যালে যাবো। নিশি দের বাড়ি থেকে ট্রেন ধরে একটা ট্রেন ধরে যাবো মাউন্ট ভারনন। তারপরে ট্যাক্সি ধরে মিনিট পনেরো লাগবে ফেস্টিভ্যালে পৌঁছাতে। নিশির প্রতি বছরই যায় ফেস্টিভ্যালে কিন্তু এবছর ওদের একটা কাজ পরে গেছে তাই আর যেতে পারবে না। আমাদের ভালো করে ম্যাপ ট্যাপ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলো কিভাবে যেতে হবে।
পরের দিন সকালে ট্রেন ধরে দুই মূর্তি চললাম স্কাগিট ভ্যালি। প্রশান্ত মহাসাগর এখানে ছোট ছোট খাঁড়ির মধ্যে ঢুকে এসেছে। আমাদের ট্রেনটা এরকমই এক খাঁড়ির ধার ঘেঁষে চলছে। মাঝে মধ্যে জাহাজ দেখতে পাচ্ছি, ইয়টও চোখে পড়ছে কয়েকটা। নিশির দেওয়া ব্রেকফাস্ট খেতে খেতেই ট্রেন জার্নি শেষ হয়ে গেলো। স্কাগিট ভ্যালি টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়েছে ১৯৮৪ তে মাত্র এক একর জমি নিয়ে। আজ একত্রিশ বছর পরে আকারে কলেবরে সে বেড়েছে কয়েকগুন। সারা আমেরিকা থেকে লোকে দেখতে আসে মাইলের পর মাইল বেছানো রং বেরঙের টিউলিপ। দূর থেকে দেখলে মনে মাটিতে কে যেন ফুলের চাদর বিছিয়ে রেখেছে। স্টেশনে নেমেই আমাদের চক্ষু চড়কগাছ, একটাও ট্যাক্সি পড়ে নেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। উবার সার্ভিস এখানে অ্যাভেলেবল নয়। কাজেই টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল দেখতে হলে ৬ মাইল হাঁটা ছাড়া উপায় নেই।
অ্যাশ তাতেও অদম্য। আমার যদিবা একটু আধটু আতঙ্ক হচ্ছিলো ৬ মাইল হাঁটার কথা শুনে অ্যাশের উৎসাহ দেখে পা বাড়ালাম ফেস্টিভ্যালের দিকে। অনেকটা রাস্তা, হেঁটে যেতে ঘন্টা দেড়েক লাগবে। প্রথম দিকে অসুবিধে হচ্ছিল না হাঁটতে। প্রতি ১৫ মিনিটে মিনিট পাঁচেক জিরিয়ে নিচ্ছিলাম আমরা। প্রায় ঘন্টা খানেক হেঁটে একটা গ্যাস স্টেশনে পৌঁছলাম। একটু কফি নিয়ে দুজনে রাস্তার ধারে জিরোচ্ছি এমন সময় একটা গাড়ি এসে পাশে থামলো। দেখি একটি মেয়ে তার মাকে নিয়ে টিউলিপ ফেস্টিভ্যালে যাচ্ছে। ওর ফোনের চার্জ শেষ তাই আমাদের থেকে ডাইরেকশন নেবার জন্য থেমেছিল। আমরাও ফেস্টিভ্যালে যাচ্ছি শুনে ওর গাড়িতেই রাইড নেবার অফার দিলো। আমরা দুজনে একটু চোখাচুখি করে ভাবলাম এ ট্রিপে তো অচেনা লোকের ওপরে ভরসা করেই কেটে গেলো, অচেনা লোকের বাড়ি মাঝরাত্তিরে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারলাম আর এতো সামান্য দিনের বেলা ৫ মিনিটের গাড়ি চড়া। পুরো ভাবনাটা ভাবতে লেগেছিলো বোধহয় দু সেকেন্ড। একসাথেই দেখলাম আমি আর অ্যাশ বলছি থ্যাংক ইউ।
পুরো রাস্তাটার দুই তৃতীয়াংশ হেঁটেই ফেলেছিলাম তাই গাড়িতে আসতে লাগলো মাত্র পাঁচ মিনিট। নেমে মা মেয়েকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে পা বাড়ালাম ফেস্টিভ্যালের দিকে। প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ লোক এই ফেস্টিভ্যালে আসে। মূলতঃ আসে পাশের টিউলিপ চাষিরাই এখানে তাদের বাগানের টিউলিপ শোকেস করে। এক বছর ধরে প্ল্যান চলে বাগানের ডিজাইন কি হবে। আমাদের কপাল ভালো, আমরা মোটামুটি মিড্ ব্লুমে এসে পৌঁছেছি কাজেই সব কটা ফিল্ডের টিউলিপই দেখতে পাবো। এক পাশ থেকে শুরু করলাম দেখা। প্রকৃতির এ আরেক রূপ। সকাল মোটামুটি শেষ, সূর্য মাথার ওপরে চড়ে এসেছে। সেই শেষ সকালের রোদে টিউলিপগুলো যেন আগুনের মতন জ্বলছে। কত রকমের টিউলিপ, প্রকৃতির প্রায় সব রং খুঁজে রং পাচ্ছি টিউলিপ গুলোর মধ্যে। ফটোর পর ফটো তুলে যাচ্ছি, কখনো অ্যাশকে মডেল করে, আবার কখনো বা শুধুই টিউলিপের। ঘন্টা তিন চারেক যে কোথা দিয়ে কেটে গেলো খেয়ালই নেই।
এবার আমাদের ফেরার পালা। এবারে একটা ট্যাক্সি নিয়ে স্টেশন তারপরে ট্রেন ধরে নিশির বাড়ি থেকে মালপত্তর নিয়ে ফ্লাইট ধরা। যেতে, যেতে দুজনে ছবিগুলো দেখছিলাম। প্রথম দিকের ছবিগুলোতে সবুজ আর নীলের ছড়াছড়ি আর শেষের দিকে রঙের মেলা। অ্যাশ হঠাৎ একটু ধরা গলায় বলে উঠলো "দেখ এসেছিলাম প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে কিন্তু এখানে এসে এত লোকের সাথে আলাপ হলো যে সেগুলোকেই এখন আসল মনে হচ্ছে।" আমার মনের কথাও সেটাই তাই চুপ করেই রইলাম। এসেছিলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে, দুই বন্ধু মিলে কটা দিন হৈহৈ করতে, ফেরত যাচ্ছি এই ট্রিপে আলাপ হওয়া অনেক জন মানুষের ভালোবাসা, তাদের সাথে কাটানো সুন্দর সময়ের স্মৃতি নিয়ে। মনে, মনে ভাবলাম যদিও ফেরত যাচ্ছি কিন্তু খালি হাতে নয়, বুকের ভেতরে একটুকরো ক্রেটার লেক আর অনেকখানি ভালোবাসা ভরে নিয়ে, মনের মণিকৌটো উপচে পড়া স্মৃতি নিয়ে।
1 পোর্টল্যান্ড জাপানিজ গার্ডেন
1 পোর্টল্যান্ড জাপানিজ গার্ডেন
3 ক্লামাথ লেকের পথে, অ্যামট্রাক থেকে তোলা
4 ক্লামাথ লেকে দুই মূর্তি
4 ক্লামাথ লেকে দুই মূর্তি
5 ক্রেটার লেক
6 পোর্টল্যান্ড চাইনিজ গার্ডেন
8 টিউলিপ
9 ফুলের মাঝে ফুল
10 ফুলের চাদর
প্রথমেই বলি, খুউউউব ভাল লিখেছো গো। ক্রেটার লেকের প্যারাটুকু খুব গুছিয়ে লেখা হয়েছে বলে ঠিকভাবে ভিস্যুয়ালাইজ করতে পেরেছি। তবে তার তুলনায় উইনেমা ন্যাশনাল ফরেস্ট আর স্যামন ফার্মের ডিটেলিং বেশ ছোট, হয়তো ইচ্ছাকৃত। কিন্তু আমার মতো হাভাতেদের ওইটুকুতে কি আর পেট ভরে? এরপর পেয়েছি চিনা বাগান, কিন্তু ওখানকার গাছপালাগুলো কেমন দেখতে ছিল জানা হল না। আমি তো ঘুরতে গেলে সবকিছু চোখ দিয়ে গিলে খাই। ক’টা গাছ আছে, ফুলের কী রং, বেশি পাতা না কম পাতা, পাতাগুলো কেমন দেখতে সঅঅবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। টিউলিপ ফেস্টিভ্যালের অংশটাও ভেবেছিলাম অনেকটা বড় হবে, অনেককিছু ডিটেলিং থাকবে, পাইনি। ছবি পেয়েছি কিছু, তবে চাইনিজ গার্ডেনের ভেতরের ছবি নেই, হয়তো ওখানে ছবি তুলতে দেওয়া হয় না। তাই যেখানে ছবি তোলা যায় না, সেখানে যে ভরসা তোমার মুখের কথাই। একমাত্র ক্রেটার লেক ছাড়া সবকিছু বড্ড কম কম করে বলেছো। তোমার লেখাটা খুব সুন্দর, শুধু পরেরবার আমার মতো পেটুকদের জন্য আরো একটু বেশি বেশি করে লিখে দিও, যেন পড়তে পড়তে পুরোটা চোখের সামনে দেখতে পাই।
ReplyDeleteচমৎকার লেখা, রোশনি। রোমহর্ষক এবং তথ্যবহুল। তোমাদের অভিজ্ঞতাগুলো সত্যি লিখে রাখার মতোই। এরকম আরও লেখার অপেক্ষায় রইলাম
ReplyDeleteহেবি হইসে।
ReplyDeleteদারুন গো দিদি, না গিয়েও পুরোটা ঘুরে ফেললাম, সব কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম এত সুন্দর বর্ণনা, খুব ভালো।
ReplyDelete