হাসির গল্প - অরিজিৎ চক্রবর্তী
Posted in হাসির গল্প
হাসির গল্প
পহলে আপ
অরিজিৎ চক্রবর্তী
আজ প্রায় বছরখানেক বাদে ট্রেনে চাপলেন হরিবাবু। বর্ধমান-পুরুলিয়া প্যাসেঞ্জার। এমনিতে লোকাল ট্রেনের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা নেই-দোরগোড়াতেই প্রাইমারি ইসকুলের সদ্য রিটায়ার্ড হেডপণ্ডিত বলেই বোধহয়। তাই বাদুড়ঝোলা হয়ে গোমড়ামুখে কোনওদিন অফিস যেতে হয়নি। দিব্যি তেলেভাজা মুড়ি প্রাতরাশ সেরে হাঁটা দিতেন সে'পথে। টিফিনে বাড়ি এসে মধ্যাহ্নভোজন সারতেন। তারপর বাকি সময়টা ঢেঁকুর তুলে, চেয়ারে গা এলিয়ে ঠিক কেটে যেত।
কামরায় উঠেই জানলার পাশের সিটটা ঠিক কেমন করে পেলেন, মনে মনে সেই রহস্য ঠিক উন্মোচন করে উঠতে পারলেন না। নিজেকে কেমন ছোট ছোটও মনে হলো-বাল্যবেলার তিনিই যেমন। স্মৃতির ঝুলি থেকে ট্রেনে চড়ার কয়েকখানি ঘটনা তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। হরিবাবুর মনকে নাড়া দেয় বেশ।
তাদের কিছুটা চেপেচুপে বসালেন তিনি-নিজেকেও কিঞ্চিৎ। ট্রেনের জানলার দিকে তাকিয়ে ছোটবেলার মতো গাছপালা, ঘরবাড়ির পেছনে দৌড়ানোও অনুভব করেন-স্পেশাল রিলেটিভিটি পড়া থেকেও। সামনের সীটের বিচ্ছু বালকটার সাথে ভারী ভাব জমাতে মন হয়। ট্রেনের ঝুলন্ত কড়াগুলো দুহাতে ধরে দোল খেতেও প্রাণ চায়। আজ আবার দরজার হ্যান্ডেল ধরে হাওয়া খেতে খেতে যাওয়ার কথা ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠল। জানলায় হাত দিয়ে বাইরে ঝুঁকতেই মনে হলো গোলগোল চোখে তাঁর মা বলে উঠছেন-'ওখানে হাত দিসনা বাবু, নোংরা আছে। লোকে থুতু ফেলে'।
চটপট হাত সরিয়ে নেন তিনি। তবে আশেপাশে বক্তাকে খুঁজে পাননা। মা আজ অনেক বছর হলো গত হয়েছেন। ট্রেনের মধ্যেই ভেঙে পড়েন হরিবাবু। আবার ছেলেমানুষিটাও লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়-বাঁধনমুক্ত হতে চায় সেও। দুইয়ে মিলে সে এক কিম্ভূত অবস্থা! এই দুইয়ের যাঁতাকলে মনেমনে পিষ্ট হতে থাকেন হরিবাবু।
'এইইই নারিয়েল...'-হকারের আওয়াজে ঘোর ভাঙে। এ ট্রেন অনিয়মিত হলেও হকার এখানে নিয়মিত। বিক্রিবাটাও ব্যাতিক্রম নয়। তাই দেদার নারকেল বিক্রি চলতে থাকে। মাঝারি সাইজের ঢেকচির উপর চারিদিকে গোল করে থরে থরে সাজানো নারকেল। মাথার উপর তাদের চাপিয়ে চলে ফেরি। শ্বেতশুভ্র সেই নারকেলের থালায় তখন মুক্তোর ছড়াছড়ি। পয়সা ছড়িয়ে কে কত কিনতে পারে...কে কত যোগাতে পারে তার রত্নভাণ্ডারে, মনের মণিকোঠায় থাকা সেই গোপন সিন্দুকে।
এবয়সে পকেটে মোটামুটি ভালো টাকাকড়ি থেকেও কারো কাছে এনিয়ে আবদার জুড়তে মন চায় হরিবাবুর। প্রত্যাখ্যাত হয়ে ট্রেনের মেঝেতে লটাগুড়ি দিতে চান পর্যন্ত। ক্রমে ফেরিওয়ালার ডাক ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়। বিক্রির উদ্দেশ্যে অন্য কামরায় চলে যান তিনি। কিছুক্ষণ বাদই ডাক ছাড়তে ছাড়তে আবার ফিরে আসেন। ইচ্ছা থাকলেও কিনে খেতে পারেননা হরিবাবু। এবয়সে হ্যাংলার মতো ট্রেনে বসে নারকেল খাওয়াকে সমাজ অন্য চোখে দেখে। সনাতনী আদবকায়দা, নিয়মকানুনে আটকা পড়ে যান। সে রীতিরেওয়াজ গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো বুকের পাটাও তাঁর নেই। বার্দ্ধক্য আরো খানিক জাঁকিয়ে বসলে অবশ্য এ বাঁধন থেকে খানিক রেহাই পাওয়া যায়। মুক্তির আগে খানিক আনন্দ যেরূপ। মুক্তির পরের রূপ তো জানার জো নেইকো। তাই ছাড়পত্র পাওয়ার আগে বেদম ছাড় একরকম। তবে এ ভীষণ কঠোর সময় হরিবাবুর। হ্যাংলামো ত্যাগ করে যতটা পরিমাণ সবজান্তা ভাব প্রকাশ্যে আনা যায় ততই মঙ্গল।
ট্রেন পুরুলিয়া স্টেশন ঢুকতে মিনিট পাঁচেক বাকি। নারকেলের জন্য উশখুশ করতে থাকেন হরিবাবু। কামরাটাও ফাঁকা হয়েছে এখন। স্রেফ সামনের সীটে বিচ্চু ও তার মা-বাপ বসে। এমন সময় ফেরিওয়ালা ফের হাঁক দেয়। ব্যাস, সময় ও সুযোগের সদ্বব্যবহার করতে পিছপা হননা হরিবাবু।
'এইক নারিয়েল দিজিয়েগা...'-বলতে যাবেনই, বিচ্ছুবালক ঝোঁক ধরে তার বাবার কাছে-'ওবাবা, নারকেল খাবো'।
বিচ্ছুর ঝোঁককে গ্রাহ্য করেননা হরিবাবু। তড়িঘড়ি হাত বাড়ান। কিন্তু ফেরিওয়ালা তার নোলাকে চুরমার করে বলে উঠেন-'একঠো নারিয়েল হ্যা দাদাজী। বচ্চে কো দে দেতে হ্যায়'। তাই সেদিকে নজর দিতেই হয়। নজরানা হিসেবে নারকেল তুলে দিতে হয় বিচ্ছু বালকের হাতের মুঠোয়। হরিবাবু প্রতিবাদ করতে পারেন না, আজ পর্যন্ত কোনোদিন পারেননি। এই বয়সেও সীমা অতিক্রম করে থাকেন কদাচিৎ। তবে হ্যাংলামোরও একটা সীমা থাকে। বালক, তাতে সে যতই নচ্ছার হোক কেন, যত বিচ্ছুই না হোক, এব্যাপারে তাদের অগ্রাধিকার। ট্রেনে বাসে অনেক সময় অগ্রাধিকার পেয়েছেন হরিবাবু। অনেক ছেলে ছোকরাই সীট ছেড়ে বাসে -ট্রেনের দুলুনি সয়েছে তাঁর জন্য। তবে অধিকারের এমন পারপ্যাঁচে যে তাকেও পচতে হবে একথা কভু ভাবেননি। অগ্রাধিকারকে মনেমনেই ধীক্কার জানিয়ে ট্রেন থেকে নামার জন্য উঠে দাঁড়ান তিনি। প্ল্যাটফর্মে ঢোকে ট্রেন হেলেদুলে। দরজার ফাঁক থেকে আবার থালাভর্তি অনেক নারকেলওয়ালাকেই দেখতে পান। তবে সেদিকে তাঁর আর আসক্তি নেই কোনো। ছোট-লোকামিটা যেন ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে।
হাসি পায়নি আমার! দুঃখে আছি তাই!
ReplyDelete