0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






- ওমা তুমি এসে গেছ? এই দেখো আমি এখনো সেই খাতাখানা খুঁজেই চলেছি।

আমার বান্ধবী সোনা তার প্রিয় অধ্যাপিকা এবং লেখিকা শ্রীমতী নবনীতা দেব সেনের সঙ্গে আমার একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অনেকদিন ধরেই খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ও সেটা পুরন করেছে। তবে আমি যেহেতু সাহিত্যের ছাত্রী নই তাই কী নিয়ে কথা বলব সেবিষয়ে মনে বেশ ধন্দ ছিল। সোনাই সাহায্য করল। বলল, কেন রে, তুই ওঁর রামায়ণের ওপরে অসামান্য কাজ আছে, তাই নিয়ে কথা বলিস। উনি নিজেই কত কিছু বলবেন দেখিস। ভারি ভালোবাসেন কথা বলতে। আর এত আদর করতে পারেন যে তোর মন খারাপ সব ভালো হয়ে যাবে দেখিস। আমি অবশ্য মনে মনে ভেবে নিয়েছি। চুপ করেই থাকব বেশি। উনি নিজে যা বলবেন তাইই তো হীরে কুঁচি!

আমার আপাত অন্যমনস্কতা কাটিয়ে উনি ঘরে এসে বসলেন। আলুথালু খোলা চুলে চওড়া লাল পাড়ের গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি আর খুব বড়ো তৃতীয় নয়নের মতো টিপ নিয়ে তিনি একেবারে উজ্জ্বল। একমুখ হাসি। কিন্তু হাসিতে একটু কুণ্ঠা। কী যেন হারিয়ে গিয়েছে উনি তার হদিশ রাখেননি। শুধুই কি খাতা? আমি ততক্ষণে বসে পড়েছি। খাতা তো পাওয়া যাবেই। ওই কতগুলো ব্যাগের মধ্যে হয়তো গুছিয়ে রেখেছেন। হাতড়ে ঠিক বেরিয়ে পড়বে। এর মধ্যেই ঘরের মধ্যে থেকে আর একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। “কোনোদিন জায়গায় জিনিস রেখে মনে করতে পারো? শুধু খুঁজে পাচ্ছিনা আর খুঁজে পাচ্ছিনা”। আবার হাসিমুখে একটা ছায়া খেলে গেল । বললেন – ও মায়ের গলা । খুকু তো আর বড়ো হলোনা! খুকুর কন্যেরা সব বড়ো হয়ে গেল । কিন্তু মা বকাবকি না করলে খুকু ঠিক করে কিছুই করতে পারেনা । আমি অবশ্য রোমাঞ্চিত হচ্ছি। রাধারানী দেবীর গলা!

আবার উনি ঝর্ণার মতো হাসলেন। তারপর বললেন – আচ্ছা বলো তো তুমি আমার কাছে কী চেয়েছিলে? আমি এবার বুঝেছি । নবনীতাদি, মানে নবনীতা দেব সেন ভুলেই গিয়েছেন আমার কী চাওয়ার আছে ওঁর কাছে। আমিও এবার হেসে ফেলি। আমার প্রিয়বান্ধবী ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে। সে বলেছিল, দিদি কিন্তু বেমালুম ভুলে যান। ওটাই দিদির রোগ। তাই একটু সময় নিয়ে বললাম -দিদি, আপনার পোস্ট ডক্টরাল কাজ তো বাল্মীকি রামায়ণের স্ট্রাকচারাল অ্যানালিসিস নিয়ে। আমি সেটা নিয়েই খুব আগ্রহী।

একজন মানুষ যে কতটা হাসতে পারেন সে সম্পর্কে আমার আগের ধারণা সব ভেঙে চুরমার । এ হাসি থামছে না। বললেন – মা গো! ও তো সেই খাতায় নেই! ও যে ওদের দেশের সম্পত্তি! তা চিন্তা নেই। তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারো। আমি বলব। তা হ্যাঁ গো তুমি কি এর ওপরে কিছু করতে চাইছ নাকি? এবার আমি কুণ্ঠিত – না। সেরকম কিছু নয় যদিও ।

ভেতর থেকে আবার গলা ভেসে এলো, খাতাখানা খুঁজে পেলে? উনি আমায় ইশারা করলেন। একটু বসো। ঘুরে আসি। পাশের ঘরে শুনতে পেলাম চিরকালীন খুকুর কথা।

-মা তোমার শরীর খারাপ। একটু চুপ করে শুয়ে থাকো। একটু কি হরলিক্স খাবে?

– না, ও তোমার বেড়ালকে খাইও । আমার চাই না । শুয়ে তো তোমারও থাকার কথা। ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে যায়নি তোমায়?

এমন অমূল্য কথোপকথন শুনতে আমার একাডেমিক কাজের কথা ভুল হয়ে যাচ্ছে। উনি আবার এলেন । গুছিয়ে বসলেন । এবার আমি লক্ষ করলাম কথা বলার সময়ে ওঁর শ্বাসের স্বর শোনা যাচ্ছে। এতটা অসুস্থ? ইনজেকশন নিয়ে শুয়ে থাকার কথা! আমি উঠে পড়লাম। দিদি পরে আসবো। অন্য দিন। আপনার শরীর এত খারাপ। আপনি বিশ্রাম নিন ।

উনি চোখ বড়ো করে তাকালেন। ছদ্ম গাম্ভীর্যঁ। -বসো চুপ কর। আনমনে বলে উঠলেন, বিছানা আঁকড়ে সারাদিন শুয়ে থাকা? বলো তুমি কি বলছিলে। আমি ততক্ষণে স্থির করে ফেলেছি। আজ একটিও একাডেমিক আলোচনা নয়। ওসবের আমি ছাই কী বুঝি? আজ বরং ওঁর মুখ থেকে গল্প শুনি। হালকা হাসির গল্প। মনটা তো বিশ্রাম পাক। বললাম – দিদি যা জানতে এসেছি তার জন্য নয় আবার আসবো । আজ বরং আপনার থেকে কিছু মজার স্মৃতি শুনি । “মজার স্মৃতি? মজার স্মৃতি তো ভুলে যাই গো! মনে থাকে শুধু দুঃখের স্মৃতি। তবে আমার স্বভাবে দুঃখবিলাস নেই কিনা, তাই সেসবও মজার লাগে। তুমিই বরং বলো কিরকম গল্প শুনতে চাও। তবে তোমার মূল প্রশ্নটা আমার খেয়াল আছে। সীতাকে নিয়ে আমাদের আবেগ তো কম নয়! দেখো, রামকে যতই মর্যাদাপুরুষোত্তম বলে মুনি কবিরা সম্মান টম্মান দিয়ে থাকুন না কেন আদতে তো সে একটি ভীতু পুরুষমানুষ! শুধু ভীতুই নয়, সন্দেহবাতিকও বটে। ও নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কত যে জানলুম কী বলব! বেশির ভাগ মেয়েদের লেখা বা গাথা রামায়ণের নানা ভার্সন পেলুম। অবাক আমি! নিজেদের রোজকার সুখ দুঃখ বঞ্চনা দিয়ে তারা সীতার ছবি এঁকেছে! আর তাতে এতটুকু মিথ্যে নেই! আমি চুপ করে শুনছি। হঠাৎ বলে উঠলেন – ও মেয়ে, তোমার বিয়ে হয়েছে তো দেখি! তা একটু বলো না, নিজের জীবন দিয়ে মহাকাব্য কেমন বুঝছ? খুব দুর্বল জায়গা। আমি চুপ করেই থাকি। দিদি আবার বললেন – এই ধরো তুমি আমার বাড়ি থেকে ফিরবে যখন তখন তো বেশ রাত হয়ে যাবে। কীভাবে যাবে তা নিয়ে আমার তো চিন্তা থাকবেই, এমনকি আমার মা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করবেন, সে মেয়ে পৌঁছেছে তো? তারপর তোমার আবার বাড়ি গিয়ে সব কাজ সারতে হবে। সেসবে দেরি হলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিরক্ত হয় না কি? কিংবা ধরো তোমার সহকর্মী পুরুষটির সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব আছে। এই নিয়ে কোনো রাগারাগি হয়না নিশ্চয়? আমি ঘামতে শুরু করি। উনি কী করে এত কিছু টের পেলেন? নবনীতাদি হাসছেন- কী? ঠিক বলেছি তো? আরে বাবা, এ আর না জানার কি আছে? এরকম সাত সতেরো ঝামেলা নিয়েই তো মেয়েদের জীবন। মহাকাব্যের নায়িকা এ থেকে রক্ষা পাবেন কি করে? আমি সাহস সঞ্চয় করলাম –দিদি, সাধারণ ঘরের মেয়েদের এমন করেই কাটে বটে, তবে বিদুষী স্বক্ষেত্রে উজ্জ্বল মানবী নিশ্চয় এই ছকে বাঁধা পড়েন না? খানিক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে ঘরে। যেন এমন প্রশ্নের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। তারপর বলে উঠলেন –স্বক্ষেত্রে উজ্জ্বল হতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয় জানো? কত বিষাদ নদী পেরিয়ে জীবনের হাত ধরতে হয়? জানো কি, বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে কি পরিমাণ যুদ্ধ নিজের সঙ্গে করতে হয়? সেসবও তো সীতার জীবনকাহিনী! তাই না? আমি অজান্তে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। মুখ নীচু করে বসে আছি। উনি নিজেই প্রসঙ্গ পালটালেন।

- দেখো আমাদের শহরটা কেমন বদলে গেছে। এখন মেয়েরা আর তেমন সংকোচে ম্রিয়মাণ নয়, বলো? আমার কিন্তু বেশ লাগে। স্বাধীন সব মেয়ে। নিজের ইচ্ছে মতন বাঁচে। কত কত কাজ করছে সব! আমারই কত ছাত্রী আছে চারিদিকে দেশেবিদেশে ছড়িয়ে। এত আনন্দ হয়! অনেকে বলেন বটে, মেয়েরা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। সাজপোশাকে জীবনধারণে কেমন যেন উদ্দাম। আমি ভাবি বেশ তো। এতকালের পাথর চাপা মন যদি খুলে যায় আর আলো দ্যাখে তবে হোক না একটু উদ্দাম?

আমি মনে মনে ওঁর সব কথাগুলো ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিচ্ছি। এ সুযোগ আর আসবেনা। মনের রেকর্ডারে অনর্গল রেকর্ড করে চলেছি। বাইরে সন্ধ্যে নামছে। ওঁর ঘরের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দায় কটা গাছের মাথায় অন্ধকার নামছে। সময় হাতে কম। আমি একবার বলে উঠলাম –দিদি, আপনি জন্ম থেকেই ভাগ্যবতী। কত কত মহৎ মানুষের স্নেহ পেয়েছেন, সংস্পর্শ পেয়েছেন। নিজের বাবা মা তো বটেই, এছাড়াও কত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ! উনি মাথা নাড়লেন –সে বলতে পারো। আমার বাবা তো বট গাছের মতোই বিশাল ছিলেন। আর মায়ের আশ্রয় তো এ জীবনে ঘুচবে না। আমার জীবনে সাহিত্যযোগ অবশ্য বুদ্ধদেব বসুর হাত ধরে, জানো তো? উনি গুরু হয়ে হাত না ধরলে এতটা হতো না। এ ঠিক। আমি একটু অনুযোগের সুরে বললাম – আপনি যে কেন আরও আরও প্রবন্ধ লেখেননি! রম্যরচনা পড়ে আনন্দ পেয়েছি ঠিক কিন্তু আপনার প্রবন্ধগুলো অমূল্য। -না না, তা কেন? আমার বহু একাডেমিক লেখা আছে বইকি! রম্যরচনা যা বলছ ও আমার স্মৃতির ভাঁড়ার। লিখতে খুব ভালোবাসি। এইটুকু জীবনে আনন্দ যদি না দিতে পারলাম তবে আর আসা কেন? ওঁর কণ্ঠস্বর কি ভারী হয়ে উঠছে? ভেতর ঘর থেকে আবার সেই গলা ভেসে আসছে।

-খুকু একটু বিশ্রাম করো এবার। সারাটা দিন কেবল কথা বলা আর ছুটে বেড়ানো। উনি উঠে পড়লেন। আমি নিস্তব্ধ হয়ে দেখছি, আঁচল কাঁধ থেকে ছড়িয়ে লুটিয়ে যাচ্ছে মেঝেয়। খোলা চুল উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছেন যেন। ঘরের দেওয়াল সরে সরে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশ বারান্দা গাছ আর সময়। দ্রুত দিন আসছে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে, বিকেল গড়িয়ে রাত। জীবন যেন ফাস্ট ট্র্যাকে দৌড়চ্ছে। কিশোরী হাসিখুশি মেয়েটি যেন দ্রুত ছুটে চলেছে অনিবার্য পরিণতির দিকে। চারপাশে তার কত না ভক্ত! কত স্তাবক! কিন্তু শেষপর্যন্ত ভালো বাসা বাড়ির সেই বাসিন্দা ভালোবাসা নিয়ে পথ হাঁটছেন। গন্তব্য সেই কণ্ঠস্বর, খুকু এবার একটু বিশ্রাম নাও।

[শহরতলির ডায়েরি শারদীয়া ২০২০]

0 comments: