গল্প - আনসার উদ্দিন
বিশুর সারা শরীর জুড়ে রোগব্যাধি । এত রোগ যে ডাক্তার বাবু শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অবশ্য ডাক্তারবাবুর ভিজিট ৪০০ টাকা । এত টাকা ভিজিট যখন সব রোগ তো খোলসা করে বলা দরকার । একবার বলতে শুরু করলে বিশুকে থামানো মুশকিল। পায়ের কুলাটি, হাটুতে যন্ত্রণা, কোমড়ে যন্ত্রণা, মাথায় যন্ত্রণা, উঠতে বসতে চোখ অন্ধকার হয়ে যায়, ঘাড়ে ব্যাথা, গায়ে দাদ, একটু গরম করলে ঘামাচি বেরোয়।
-আর কিছু?
এতো দেহের উপরের ভাগের কথা বললাম । এরপর রোগের খনিতে ঢুকবো। বিশু বলতে শুরু করে- বমি বমি ভাব হয় সকালে, বুকের মধ্যে যন্ত্রণা, ধড়ফড় করে। খাদ্যে অরুচি, পেটে গ্যাস । আমাশা, পায়খানা পরিষ্কার হয় না । পেচ্ছাবে যন্ত্রণা, তলপেটে টান ধরে । হলুদ পেচ্ছাপ । একবার করে দেখাতে পারলে ভালো হতো।
-নানা করে দেখাতে হবে না, মুখে যা বলেছেন তাতেই বুঝতে পেরেছি।
কি বুঝেছেন স্যার?
সারা শরীর তো রোগের বাসা। এতগুলো রোগের চিকিৎসা একসাথে সম্ভব নয়। বেশি সমস্যা কোনগুলো?
এত এত রোগের মধ্যে কোনগুলোকে জরুরি মনে হয় তা নিয়ে একটু ভাবল, তারপর বলল- গ্যাস আমাশা আর পেচ্ছাপের দোষ।
-রাতে ঘুম হয়?
বিশুর আফসোস হয় ঈশ এই কথাটা বলা হয়নি, ডাক্তারবাবু ঠিকই বুঝেছেন।
না স্যার হয়না। বউ জাগালে মোটেই হয় না। ওকেই আমার বেশি ভয় জানেন।
-বিড়ি সিগারেট খান?
সিগারেট কোথায় পাব আমরা চাষা ভুসো মানুষ? বিড়ি খাই।
-একদিনে কতগুলো লাগে?
দিন দু আঁটি লাগে।
দু আঁটি ? ডাক্তারবাবু আশ্চর্য হন।
ঠিকমতো খেলে তিন আঁটি লাগে। গরিব মানুষ তো তাই ওতেই কোন রকমে চালিয়ে নি।
-রাতে খান নাকি?
রাতে খেয়ে জুত পাই, শুয়ে শুয়ে খাই। লাইটার নিয়ে শুয়ে থাকি বুঝলেন।
বিশুর বিড়ি খাওয়ার খবর শুনে ডাক্তারবাবুর চোখ কপালে উঠে যায়। দু আঁটি বিড়ি মানে প্রায় 40 টা। এত বিড়ি যে রোগীতে খায় তাকে কি ওষুধ লিখবে ভেবে পাচ্ছেন না।
-আপনাকে বিড়ি ছাড়তে হবে।
কি বলছেন? এতদিন ধরে খেয়ে আসছি। বিড়ির উপর আমার মায়া পড়ে গিয়েছে।
-কবে থেকে খাচ্ছেন?
তেরো বছর বয়স থেকে। বাবা শিখিয়েছে। বলেছিল আমরা হলাম গিয়ে মুনিশ খাটিয়া । পরের জমিতে গতর খাটাতে হবে আজীবন। বিড়ি খেলে কাজের মধ্যে রেস পাবি । না হলে শুধু বসে থাকা যায় নাকি? না ক্ষেত মালিক বসতে দেবে? সেই থেকে খাওয়া । ডাক্তার বাবু বাড়িতে লোকজন কেউ আসলে তাদেরকেও দিই। খেয়ে তারা খুশি হয় । বিড়ি খেলে মন ভালো থাকে। বিড়ির ধোঁয়ায় দুশ্চিন্তা উড়ে যায়। মনটা খুব ঝরঝরে থাকে।
বিশুর বিড়ি খাওয়ার গল্প শুনতে শুনতে ডাক্তারবাবু কি ওষুধ লিখবেন তার খেই হারিয়ে ফেলছেন। এত বিড়ি মানুষ কখন খায়? কখন ঘুমায়? শুনুন বিড়ি না ছাড়লে আমি একটা ওষুধও লিখব না।
তাহলে আপনার ভিজিটের টাকাটা নিন।
টাকা দিতে হবে না ওই টাকায় আপনি বিড়ি কিনে খাবেন।
বিশু যেন কেমন আতান্তরে পড়ে যায় । পিছনে আরও রুগিতে গুঁতোগুতি করছে । বিশু নরম সুরে বলল ঠিক আছে। আপনি টাকাটা নিন আর ওষুধ লিখুন যদি বিড়ি খাওয়া ছাড়তে পারি তাহলে আবার আসবো না হলে এই পর্যন্ত।
ডাক্তারবাবুর নাম কে সি পাল বন্ধনীতে এমডি। পুরো নাম কৃষ্ণচরণ প… তবে কে সি পাল নামেই সর্বাধিক পরিচিত। বিশু জানে সংক্ষিপ্ত নাম। বাড়ি ফেরার পথে গণেশ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা। বলল- কোথা থেকে আসছিস বিশু?
ডাক্তারের বাড়ি থেকে।
-কোন ডাক্তার দেখালি?
-কে সি পাল।
-এত ডাক্তার থাকতে কোথাকার কোন ছাতার ডাক্তার দেখালি?
না না ভালো ডাক্তার। অনেক রোগী হয়। ছাতার ডাক্তার হবে কেন?
গণেশ বলল আরে উজবুক, বাজারে কে সি পালের ছাতা বিক্রি হয় জানিস না? ছাতা ভালো কিন্তু ডাক্তার কেমন কে জানে?
সাইকেলে আরো কিছুদূর এগুলো বিশু। গণেশের কথা শুনে হ্যান্ডেল কাঁপতে লাগলো । এত টাকা পয়সা খরচ করে শেষ পর্যন্ত কিনা ছাতার ডাক্তার। গোটা রাস্তা জুড়ে সাইকেল টাল খাচ্ছে। মনে হচ্ছিল হয় পড়ে যাবে নয়তো গাছে ধাক্কা খাবে। যে কারণে হেঁটে যাচ্ছে, সাইকেলটাকেও হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চোখ তুলতেই শেখ পাড়ার খালেককে আসতে দেখল। সাইকেলেই আসছে, মনে হয় কামারদহের বাজারে যাবে। খালেক কিছুটা লেখাপড়া জানে। তখনকার সময় গ্রামের স্কুল পাশ দিয়ে দুই বছর হাইস্কুলে পড়েছে। বিশুর ইচ্ছে হলো খালেককে একবার প্রেসক্রিপশনটা দেখায়। বেরিয়ে যাবার আগেই বিশু থামাল। বলল, দাদা দেখতো প্রেসক্রিপশনটা ডাক্তারটা কেমন?
খালেক বলল পড়ে থাকলে লোহার জিনিসেও জং ধরে, আমি পড়া ছেড়েছি চল্লিশ বছর আগে। সেসব কি মনে আছে?
বিশু বলল দেখোই না পড়ে।
খালেক কিছুক্ষণ প্রেসক্রিপশন সামনে করে মাথা কাপালো। মনে হল ভালই বুঝেছে। তখনকার লেখাপড়া তো।
- কিছু বুঝলে দাদা? অসহায় গলায় বলে উঠল বিশু।
বিশুর কথায় খালেক মাথা তুলল। বলল হাতের লেখা তো বুঝতে পারলাম না। কাগজের মাথায় ছাপা লেখা পড়ে মনে হল ডাক্তারবাবু মুসলমান।
অ্যাঁ ? বিশু যেন কেঁপে উঠলো। একটু আগে গণেশ বিশ্বাস বলল ছাতার ডাক্তার এখন মুসলমান।
কি করে বুঝলে দাদা যদি খোলসা করতে…
ঐতো ডাক্তারের নামের পাশে ব্রাকেটে লেখা আছে এমডি। এমডি মানে জানিস?
মাথা নাড়ে বিশু।
এমডি মানে হলো মোহাম্মদ। আমি যেমন লিখি এমডি খালেক শেখ। মোহাম্মদ হল মুসলমানদের পয়গম্বর।
সকাল থেকে খাওয়া নেই নাওয়া নেই। বিশু ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরছে। বাস রাস্তা থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিশাল মাঠ নেতিয়ে আছে। মাঠের অর্ধেক রাস্তাও পেরুতে পারেনি। এর মধ্যে গণেশ আর খালেক তার মাথা ঘুরিয়ে দিল। সাইকেলটা টানতে টানতে পথের ধারে আগুদি গাছের নিচে বসলো। গলা শুকিয়ে গিয়েছে মুখের থুতু আঠার থেকেও আঠালো হয়ে গিয়েছে। একটু আগে পথ চলতি মানুষ ডেকে কথা বলছিল এখন ভয় পাচ্ছে কেউ কিছু বলবে। বিশু গাছের ওপাশে সরে বসার চেষ্টা করেছিল। ওপাশে বসলে পথ চলতি মানুষকে কিছুটা আড়াল করা যায়। কিন্তু তার আগেই তাদের পাড়ার মোহিতোষ মন্ডলের ছেলে শিবু কথা বলে উঠল… কাকা কোথা থেকে আসছো?
কি যে বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। শিক্ষিত ছেলে ডাক্তার দেখানোর কথা বললে যদি প্রেসক্রিপশন দেখতে চায়?
-কানাদহের বাজার থেকে আসছি চাঁদ।
এই রোদে একেবারে খালি মাথায় বেরিয়েছো একটা ছাতা মাথায় দিয়ে বেরোলেই তো পারতে। আজকাল বাজারে কত ভালো ভালো ছাতা পাওয়া যায়। ভালো ছাতার কথা উঠতেই আবার গণেশ বিশ্বাসের কথা মনে পড়ল। ডাক্তার কে সি পাল ছাতার ডাক্তার হয়ে গেল। এখন এই ওষুধপত্তর আর এই প্রেসক্রিপশন নিয়ে কি করে বাড়ি যাবে? শেখ পাড়ার খালেক তো আবার ডাক্তারের জাত ধর্ম নিয়ে কথা শোনালো। মনে হল ডাক্তারবাবু বোধ হয় ওর মামাতো খালাতো ভাই।
লোকের কথা শুনে এমন একটা ডাক্তারের কাছে গেল যে তার হাড়ি নাড়ির খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এই ঝনঝনে রোদে আগুদি গাছের ছায়া টা বড় ঠান্ডা। এতটাই ঠান্ডা ও আরামদায়ক যে বিশুর মনে হচ্ছে সাত পাঁচ না ভেবে একটা গামছা পেলে বিছিয়ে শোয়া যেত। দক্ষিণ দিক থেকে তিরতির করে বাতাস ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করলেই ঘুম চলে আসবে। বিশু গাছের ওপাশ থেকে আবার এপাশে সরে বসলো।
এ পাস মানে পথমুখো সটান তাকালে গ্রামটাকে চোখে পড়ে। গ্রাম আড়ালে থাকে। তার আগে বাঁশ গাছ, আম গাছ, কাঁঠাল আরো সব গাছ গাছালি এসবই গ্রামের ইজ্জতকে বাঁচিয়ে রাখে। বিশুর মনে হল সে এবার সাইকেল চড়ে ঠিক যেতে পারবে। তেষ্টাটা আগের মত মনে হচ্ছে না। নিজেকে বুঝ দেয় সে- ছাতার ডাক্তার হোক আর মুসলমান ডাক্তার হোক মানুষ তো বটে।
এত এত লোক যখন সেই ভোর থেকে লাইন লাগিয়ে চিকিৎসার জন্য নাম লিখিয়েছে। বিশু গাছের গা থেকে সাইকেলটা নিয়ে পথে নামবে এমন সময় তাদের পাড়ার পচা মন্ডল এসে হাজির। বলল- বস বস আমাকে দেখে চলে যাচ্ছিস যে, বাড়ি কি তোর উঠে পালিয়ে যাচ্ছে নাকি?
বিশু সরল সাদা মানুষ। কিছু বলবে দাদা?
কি আর বলব। বসে দুটো গল্প গুজব করি … সুখ-দুঃখের কথা কই।
গায়ের মানুষের এই এক স্বভাব। বাড়ির বউ আর মাঠের গাছ পেলে চারপাশে ঘুরপাক খায়।
তুমি বস আমি এবার বাড়ি যাই, সকালে বেরিয়েছি বুঝলে। এখনো চান খাওয়া হয়নি।
তাহলে পাঁচ মিনিট বস আমিও খেত খামার দেখভাল করবো। তোকে যখন দাঁড় করালাম ভাবলাম দুজনে বসে একটু নেশা করি, বিড়ি খাই। আমার ছোট শালা আবার বিড়ির ফ্যাক্টরি খুলেছে। গতকাল উদ্বোধন হলো ঘটা করে। এলাকার যত পঞ্চায়েতের মেম্বার, প্রধান, এমএলএ সব উপস্থিত ছিল। আর সাধারণ মানুষ যা ছিল, অত মানুষ জনসভাতেও হয় না। এক এক জন আট দশটা করে বিড়ি ফুঁকেছে, বিড়ির ধোঁয়ায় তামাম গা এমন অন্ধকার হয়ে গিয়েছে যে ৮-১০ দিন মশা ঢুকতে পারবে না। তুই তো নেশাখোর মানুষ। খেয়ে দেখ দিকিনি। বিড়ির নাম সরস্বতী বিড়ি। মেয়ে মানুষের নামে নাম।
শুধু মেয়ে মানুষ? সরস্বতী ঠাকুর না। তুই ঠাকুরকে অপমান করলি? আসলে পেটে বিদ্যে নেই তো যা মনে আসে বলে দিবি। পচা মন্ডল একটু মনোক্ষুন্ন হলো ।
বলছিলাম মেয়ে মানুষ তো বিড়ি খায় না।
কে বলেছে খায় না? আদিবাসী সাঁওতাল মেয়েরা বিড়ি খায় না? বলতে পারিস আমাদের ওই গৈ-গেরামের মেয়েরা বিড়ি খায় না। কিন্তু বিড়ি বাঁধে। পুরুষরা খাবে বলে বাঁধে। ঠাকুর কি প্রসাদ খায় … না আমাদের খাওয়ায়? সে একটা খেয়ে দেখ। খেয়ে কেমন লাগল বলবি। প্রসাদ ভেবেই খাবি। মা সরস্বতী কৃপা পাবি। আমাকে হাজার পাঁচেক পাঠিয়েছে মানুষকে খাওয়ানোর জন্য। গাড়ি নিয়ে এদিকেও প্রচারে আসবে - বলে ফস করে নিজেই একটা বিড়ি ধরালো পচা মন্ডল। বিশুর দিকে অন্য একটা বাড়াতেই কুঁচ কুঁচ করতে লাগলো।
নে ধর অন্য সময় তো চেয়ে খেতিস, আজ আবার কি হলো?
দাদা অন্য দিন খেলে হতো না?
তোর আবার বিড়ি খাওয়ার বার দোষ আছে নাকি? পচা মন্ডল বুঝতে পারছে না বিশুর মতো নেশাখোর মানুষ কেন এমন করছে?
একটা অন্তত খা, খেয়ে বল।
বিশু আর সোজা থাকতে পারল না। দাদা ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছি, শরীরের নানা রোগব্যাধি এই দেখো ওষুধের পোটলা। বলেছে বিড়ি খাওয়া বন্ধ করতে হবে। না হলে ওষুধ লিখবে না। তুমি যদি আগের দিন দিতে তাহলে ওই জিনিস না খেয়ে থাকি?
আরে গাধা ডাক্তার ও কথা বলে। শাস্ত্রেও তো বলে মিথ্যা কথা বলবি না মিথ্যা কথা বলা মহাপাপ। পিতা-মাতার সেবা যত্ন করবে, মিথ্যা সাক্ষ্য দিবে না, মানুষ শুনছে একথা?
না
তাহলে বুঝ আমাদের রাজ্যে কত লক্ষ বিড়িশ্রমিক আছে জানিস? জানিস না। যদি আমার শালার ফ্যাক্টরি উদ্বোধনে থাকতিস তাহলে জানতে পারতিস। বিড়ি খাবি মন মেজাজ ভালো থাকবে। বাড়িতে কেউ আসলে ভাত দিতে না পারিস একটা বিড়ি দিবি, দেখবি মানুষ কতটা খুশি হয়।
এরপর মানুষকে বুঝি অন্যথা করা যায় না। পচা মন্ডল হুস হুস করে বিড়িতে টান দিয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকা একটা সুন্দর গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব সুরস হবে। পচা মন্ডল ইচ্ছে করে তার দিকে ধোঁয়াটা লেলিয়ে দিচ্ছে। আর তাতেই জেগে উঠছে নেশা। তাহলে দাদা দাও একখান। এত করে বলছো যখন…
পচা মন্ডলের হাত থেকে একখানা বিড়ি নিয়ে ধরালো বিশু। মানুষ মরার পর ঘনিষ্ঠ কেউ একজন মুখাগ্নি করে। কিন্তু নেশাখোর মানুষ সে অপেক্ষায় থাকে না। পকেটে বিড়ি লাইটার ছিল। খাবে না বলে মনস্থির করেছিল। এখন পচা মন্ডলের পাল্লায় পড়ে বরবাদ হয়ে গেল। ফুস ফুস করে কটা লম্বা টান দিল বিশু।
কেমন বুঝছিস?
খুব ভালো দাদা। আর একটা দাও মনে হচ্ছে ঠাকুরের প্রসাদ খাচ্ছি।
ও কথা তো আমি আগেই বললাম। সামনের দিন যখন গাড়ি নিয়ে প্রচার করতে আসবে, সেদিন তুই থাকবি পঞ্চায়েতের মাঠে। ভিডিও হবে। তোর বিড়ি খাওয়ার ছবি তোলা হবে বিড়ি কেমন তা নিয়ে দু’ কথা বলবি আর ওই কথাটা অবশ্যই মনে করে বলবি। কোন কথাটা দাদা? এই যে একটু আগে বললি- বলবি সরস্বতী বিড়ি খাচ্ছি না তো … ঠাকুরের প্রসাদ খাচ্ছি। তোর ছবি সমেত এই কথাটা টিভিতে রেডিওতে বিজ্ঞাপন বের হবে। কাগজে ছেপে পোস্টার সাঁটা হবে দেওয়ালে দেওয়ালে। আমার ছোট শালাকে বলে কিছু অর্থ কড়িও করিয়ে দেবো।
বাড়ি ফিরে মত পাল্টে ফেলল বিশু। ভেবেছিল পকেটে যে কটা বিড়ি আছে সে কটা খেয়ে আর খাবে না। পচা মন্ডলের কথায় পড়ে দু দুটো সরস্বতী বিড়ি খেয়ে ফেলেছে। আজকের দিন যা হল হল সকালে বিছানা থেকে উঠে অবশিষ্ট পাঁচটা বিড়ি সে গুঁড়িয়ে ফেলল। সেগুলো চাপ দিয়ে গুড়িয়ে ফেলতে মায়া হচ্ছিল খুব। মনে হচ্ছে শিশু হত্যা করছে। এই বিড়ির জন্য কত জনের কাছে হাত পেতেছে। পচা মন্ডলকে সাফ সাফ বলে দিয়েছে- ভিডিও করার জন্য অন্য লোক দেখে নাও আমি পারবো না। হঠাৎ উল্টো কথা কেন? তোর কটা বাপ?
বাপ কয়টা হয় মানুষের? তখন তো বললি ঠাকুরের পেসাদ খাচ্ছি, এখন বিষ?
তুমি অন্য লোক দেখে নাও।
ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না
হ্যাঁ, ওই কাকেদের কাছে যাও। আমি তোমার শালার কাক হতে পারবো না।
বিশুর কথাটায় খোঁচা ছিল। গায়ে ঝাল বাটা লাগলে যেমন চিড়বিড়িয়ে ওঠে পচা মন্ডল অনুচ্চারে গালমন্দ দিতে দিতে বেরিয়ে গেল।
বিশু এখন পাঁচ রকমের ওষুধ সারাদিনে পালা করে খায়। কোনোটা খাবার আগে কোনোটা পরে। রাতে শোয়ার সময় যেটা খায় সেটা বোধহয় ঘুমের ওষুধ। ঘোর ঘোর হয় বটে কিন্তু ঘুম হয়না। খাটের উপর বসে থাকে, কখনো পায়চারি করে। তার বউ বলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো, চোরের মত ঘুম চলে আসবে। অবশেষে একসময় ঘুম আসে। ঘুম যখন গাঢ় হয় তখন তার বউ ঝাঁকিয়ে দেয় - হ্যাঁগো ঘুমোলে?
অনেক সাধ্য সাধনা করে যে ঘুমটা এসেছে সেটাকে পন্ড করে দিল। ততক্ষণে ভালোমতো ঘুমিয়ে নিয়েছে সে। মেয়ে মানুষের এই এক দোষ। যখন তখন পুরুষ মানুষকে জাগিয়ে দেওয়া। কি দরকার সেটাও মুখ ফুটে বলবে না। বিশুর মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। ভগবান কোন মাগির পাল্লায় পড়লাম…
আমাকে মাগি বললে?
আমাকে জাগালে কেন?
তোমার সোনার অঙ্গে হাত পড়লে দোষ হয়, কাল থেকে আলাদা করে শুবো।
কথা বলতে ভালো লাগছে না বিশুর এখনো যদি তালি মেরে ঘুমটাকে জোড়া লাগাতে পারে। বিশু বললো হ্যাঁ তাই হবে। ভেবেচিন্তে কথা বলবা। আমাকে আর দরকার হবে না তো? পরে যেন হাত পা ধরতে এসোনা। আর সহ্য করতে না পেরে বউয়ের তলপেটে জোরসে লাথি চালিয়ে দিল। দেখতে পাচ্ছিস রোগী মানুষ দেহে আমার বল শক্তি নেই।
-বলছো বটে শক্তি নেই লাথিটা তো আস্তে মারোনি।
সকালবেলা বিশুর বউ বলল গ্যাস লাইটার টা একটু দাও তো দিকিনি দেশলাই কাঠি নেই।
কি হবে?
উনুন জ্বালাবো লাইটার কোথায় ফেললে?
বিশ্বাসদের পুকুরে ফেলে দিয়ে এসছি।
ফেললে কেন? বিড়ি খাবে না?
বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। আমার যা রোগ বিড়ি খেলে ভালো হবে না ডাক্তার বলেছে।
তা লাইটারটা আমাকে দিতে পারতে, সংসারে কাজে লাগতো । ফি দিন দেশলাই কেনা কত খরচ। ছেড়েছো ভালো কাজ করেছো।যখন বলতাম ছেড়ে দিতে দাওনি । আমার কথা কবেই বা নিয়েছো?
বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দিয়ে খুব সমস্যায় পড়ে গেল বিশু। বারবার পকেটে হাত চলে যায়। নাহ কিছুই নেই । পকেটটাকে মনে হয় অনর্থক একটা জিনিস। মনে হয় কোন একটি মূল্যবান বস্তুকে হারিয়ে ফেলেছে। পাড়ার লোকেরাও অনেকে বিড়ি টানতে টানতে আসে। বিশু তুই নাকি বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস ? কি করে ছাড়লি? আমি পারছি না।
বিশুর ইচ্ছে হয় একটা বিড়ি চেয়ে খায়, একটা খেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? হ্যাঁরে বউয়ের কথায় ছাড়লি না নিজে ছাড়লি?
উনি সেই মানুষ যে আমার কথা নেবে যখন ছাড়তে বলেছি তখন ছাড়েনি। এখন কোথাকার ছাতার ডাক্তারের কথা শুনে ছেড়ে দিয়েছে।
কথাটা শুনেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো বিশুর। তাহলে গনেশ বিশ্বাস কি বউকে বলে দিয়েছে?
-কারো কথা শুনে নয় নিজের বুদ্ধিতে ছেড়েছি। ১৩ বছর বয়স থেকে খাচ্ছি তো, আর কত খাব। আর কতদিন বিড়ি দেশলাই পকেটে গুঁজে ঘুরে বেড়াবো।
তুই যখন ছেড়েছিস তখন আমিও একবার চেষ্টা করে দেখব। কথাটা বলল ঘোষপাড়ার হারাধন।
ঘোষ বিশ্বাস শেখ মন্ডল সম্প্রদায় ভেদে জাতিভেদে মানুষ আলাদা হতে পারে কিন্তু বিড়ির নেশার কাছে সবাই কুপোকাত।
কেউ বলে- বিড়ি না খেয়ে তিন মাস ছিলাম। কেউ বলে- ছ মাস, কেউ বলে বিড়ি ছাড়ার জন্য পান ধরলাম। এখন পান বিড়ি দুটোই খাচ্ছি। শেখ পাড়ার বক্কর ঘরামী বলল বিশু, তুই সদ্য কদিন হলো বিড়ি ছেড়েছিস এখনো অনেক পরীক্ষা বাকি আছে। ঘরের বউ বাদ যাবে কিন্তু বিড়ি খাওয়া সহজে কেউ বাদ দিতে পারবে না।
বিশুর তাই মনে। হয় তবু সে কঠিন পণ করে আছে। বলল- না দাদা ৪০ বছর ধরে খাচ্ছিলাম। আর নয়।
বিশু আর বক্কর ঘরামীর কথা শুনে বউটা আতান্তরে পড়ে যায়। তাদের ২৫ বছরের দাম্পত্য জীবন। ঝোঁকাল মানুষ, এমন মানুষকে বিশ্বাস করা যায়! যে লোক ৪০ বছরের নেশা ছাড়তে পারে তার কাছে ২৫ বছরের সঙ্গী ছেড়ে দেওয়া কি এমন ব্যাপার হতে পারে। বক্কর ঘরামির কথাটা বড় ধাক্কা দেয় মনে। সেদিন হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল বিশুর বউ। বিড়ি খাওয়া একদম বাদ দিলে?
-হুম
একটা তো খেতে পারতে। খেলে মনে হয় বাড়িতে একটা পুরুষ মানুষ আছে। না খেলে নিজেকে তখন বিধবা মনে হয়। কথাটা বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
বিশু কি বলে সান্ত্বনা দেবে… বললে- তোমার যদি নিজেকে বিধবা মনে হয় তাহলে পচা মন্ডলের বাড়ি থেকে কাউকে দিয়ে এক আঁটি সরস্বতী বিড়ি আনো।
গুনে গুনে ২০ দিন পরে বিড়িতে টান দিচ্ছে বিশু। বিড়ির ধোঁয়া ছুঁড়ে দিচ্ছে বউয়ের দিকে। ডাক্তারবাবুর কথা অমান্য করে নতুন করে এই ধূমপান। আর কোনদিন রোগের জন্য সে ডাক্তার দেখাবে না। পাকা নেশাড়ুর মতো কলজে ভরে সরস্বতী বিড়িতে এমন ভাবে চুম্বন করছে সে নিজের বউয়ের মুখে এমন চুম্বন কখনো করেছে বলে মনে পড়ে না। যত ধোঁয়া গল গল করে ছাড়ছে বিশু সব ধোঁয়া বউয়ের শরীর ঘিরে পাক খাচ্ছে।
মনে হচ্ছে একটা সাদা থান ক্রমশঃ তার নরম শরীরকে পেঁচিয়ে যাচ্ছে।
0 comments: