ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(১০)
নবাবহাট সংলগ্ন একটি ক্ষীণকায়া জলধারা দক্ষিণমুখে প্রবাহিত হতে হতে মূল নগরীতে এসে দামোদরের কোলে এসে মিশেছে।
যদিও এই জলপথটির কোন অংশে মূল নদীটির নাব্যতা নেই বললেই চলে তাও কুমোর পাড়ার দৈনন্দিন সামগ্রী ছোট ছোট কিস্তি নৌকো করে বড় গঞ্জের হাটগুলিতে বিক্রির জন্য অধিকাংশ সময় এই পথে প্রেরিত হয়ে থাকে।
নদীঘাটটির একাংশে কৈবর্ত্যদের একটি গ্রাম ও তারমধ্যে দু'তিনটি অগ্রদানী ব্রাহ্মণের চালাঘরও দেখতে পাওয়া যায়।
জলাশয়টির পূর্ব ও দক্ষিণদিকে বঙ্গভূমির প্রধান শস্য " ধান্যে"র অবারিত ভান্ডার। ধান পাকার সময়ে মৃদু হাওয়ায় 'ঝুনঝুন' শব্দে চতুর্দিক গুঞ্জরিত হলে মনে হয় যে স্বয়ং মা ধান্যলক্ষ্মী যেন দর্শনসুখের সাথে তাঁর অলক্তরঞ্জিত পদস্পর্শে শ্রুতিময় করেও তুলেছেন শস্যসম্পদের এই অনাবিল প্রাচূর্য্যটিকেও।
গোলকপতি আজ হাঁটতে বেরিয়ে উদাস নয়নে অনেকক্ষণ ধরে আমন ধানের প্রাচূর্য্যে মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়েছিল। ওর চটকা ভাঙ্গল একটা বিশেষ গোলমালে। সামনের মালো পাড়া এই চিৎকারের উৎস। সে বিষয়টি অনুধাবন করতে সেদিকের উদ্দেশ্যে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল।
......
বাগবাজারে গাঁজা-গুলি-চন্ডুর আড্ডায় এখন একটা কথাই ঘুরে ফিরে সব হট্টোগোলের মাঝে ফিরে ফিরে আসছে। সিপাই বিদ্রোহের পরে ইংরেজরা নাকি আবার এদেশের লোকাচারগুলিকেও এবার নাকি রদ করতে উঠে পড়ে লেগেছে! শোনা যাচ্ছে বড়লাট বেন্টিঙ্ক সাহেব নাকি হিন্দুদের সতীদাহের বিরুদ্ধে খুব চটেছেন আর তাঁর এই কুবুদ্ধিতে নানা রকম কেতাব খুলে খালি উস্কে দিচ্ছেন দেওয়ান রামকান্ত রায়ের ছোটছেলে 'রামমোহন'!
কিছুদিন আগে তাদের 'বেম্মজ্ঞানী'দের আড্ডাটা নিয়ে শহর কলকেতার মানুষজন তির্যক দৃষ্টিতে মেনে নিলেও তার এই লোকাচার নিয়ে বাড়াবাড়িটাকে কিন্তু কেউ ভাল চোখে দেখছে না।
পক্ষীদের দলের নেতা 'রূপচাঁদ ' কল্কে মুখে একরাশ গাঁজার ধোঁয়ায় চারিদিক ধুম্রাশ্রিত করে একবার বললেন, " আহ্! ভীষণ তো দেকচি ক্যাঁ..ক্যোঁ..কিচি...মি...চি! ওরে সব্বাই তো হাড়ে মাংসে পুড়চেই... তা কটা মেয়েছেলে যদিবা নাই পুড়ে ম'ল তো তাতে কার কি ক্ষেতি হে ? "
পক্ষীদের দলপতির মুখে এমন উল্টো কথা আগে কেউ তেমন শোনেনি। চার জন বশংবদ গাং শালিক বেশী ছোকরা চোখ বড় বড় করে তামাশা দেখতে লাগতেই একজন নধরকান্তি যুবা যার নাম 'রাজহাঁস' সে ধপ্ করে এসে একেবারে চাতালে বসে পড়ে মনে মাথা চাপড়ে বলল,
"...পুলিশের গুঁপো সান্ত্রীরা রাস্তায় লোকজনদের আর হেঁটে যেতে দিচ্চে না গো! ধরে ধরে সড়কীর গুঁতো মারতেচে আর ফেরৎ পাঠ্যে দিচ্চে। আমি কোনওমতে সটকে এসিচি। "
এসবের কারণটিও বোঝা গেল বড় চিন্তার।
আজ কলুটোলা দিয়ে যাবার সময় স্বয়ং লাটসাহেবের ফিটন গাড়ি লক্ষ্য করে কেউ বা কারা বেদম পাটকেল ছুঁড়ে মেরেছে আর তাতে গাড়ীর গারোয়ানের কপালে সেই ঢিল এসে লেগেছে ও তার কপালটিও সেই আঘাতে ভালমত ফেটে গেছে।
যদিও সাহেব তখন নিজে ওই গাড়িতে ছিলেন না। লাটভবন থেকে সায়েবের ফিটনে চেপে মির্জাপুর যাচ্ছিলেন স্বয়ং রামমোহন। বন্ধুকৃত্য করতে গিয়ে এবারে নিজেই বেশ বিপাকে পড়ে গেছেন স্বয়ং বড়লাট।
তাই শহর কলকেতার আনাচেকানাচে ওই ঢিল ছোঁড়নেওলাদের খোঁজে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে বলে পুলিশ সাধারণ লোকজনেদের গতিবিধিও বেশ নিয়ন্ত্রণ করে ফেলছে।
সান্ধ্য আড্ডার মাঝে এসব অনাচার বিষয়ক বাগবিতন্ডা থামানোর জন্যে কয়েকজন "হাফ পক্ষী" নামধারী ছোকরার দল চোখ বুজে ওদের জাতীয় সঙ্গীতটি বিকট গলায় গেয়ে উঠল,
" খগ-সম্পাতি, কশ্যপ নাতি / খগ লীলা, জাতিমাল, কুলজি, নবপুথি /সারস বাবুই জাতি ব্যবসায়ী মহাজন/ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পক্ষী শূদ্র, শুক শারি হীরামন /কুলীন কায়স্থ পরহাম্মা, নীলকণ্ঠ আদি খঞ্জন/অষ্ট ঘর সেন সিংহ কর, গৃহবাজ,
বাজবাউড়ি বাঁশপাতি | (দে দত্ত দাস,
হয়পাতিহাঁস, ভীমরাজ কপোত কপোতী)
গলা ফোলা, মুক্ষি গোলা, জবর জং,
পরপঙ সক্কর খুরে..."
পরক্ষণে সমবেত কন্ঠে স্বয়ং রূপচাঁদ তার বাকী খেউড়ের দলের সাথে সমস্বরে গেয়ে উঠল,
" ....ওরে পক্ষীর ওছা কাদাখোঁচা, কালোপেঁচা বাহাডুরে,পাখি আরগিন বঙ্গের কুলীন গুহ পদবী ধরে/ উত্তররাঢ়ী কায়স্থ, নুরি মস্ত বুলি বার করে/বারেন্দ্র ফরিয়াদী, বাদী পেলে ঘাল করে,
কোকিল বৈদ্য বুদ্ধি হদ্দ, ঠকায় কালো কাকেরে,
নবশাক চক্রবাক নবরঙ্গের নয় জাতি...."
......
গোলকপতি এক জায়গায় বেশ ভীড় দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল। একটা জনাপঁচিশেক নারী-পুরুষের দল অন্য একজন মৃতপ্রায় প্রৌঢ়কে ধরাধরি করে এনে এখানকার জলাশয়টির দক্ষিণমুখে একটি অস্থায়ী চালাঘরে এনে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ব্যাপারস্যাপার দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে লোকটির অন্তিম সময় প্রায় উপস্থিত।
অবশ্য তার সঙ্গের লোকজনের চেহারা প্রমাণ করে দিচ্ছে যে সে এই গ্রামের আদি বাসিন্দা বা কৈবর্ত কূলের কেউ নয়। তার সঙ্গের পুরুষদের অধিকাংশই স্বাস্থ্যবান ও যজ্ঞোপবীতধারী। কানাঘুষো যে খবরটি হাওয়ায় উড়ছে তা হল প্রৌঢ়টি হলেন বারেন্দ্র বংশীয় ব্রাহ্মণ, তবে এঁর পূর্বপুরুষের কেউ একজন অন্ত্যজ শ্রেণীর এক মহিলায় উপগত হওয়ায় ইনি আপাতত ভঙ্গকূলীন গোত্রের। তবে হাজার হোক বামুন বলে কথা! তাই অন্তিম সময়ে তাঁর দ্বিজত্ব রক্ষা করতে ও নানাবিধ পারলৌকিক সুবিচারের আশায় তাঁকে অন্তর্জলি যাত্রায় আনা হয়েছে।
বৃদ্ধটির পাশে এক বছর একুশের সধবা মেয়ে নতমস্তকে সমানে কেঁদেই যাচ্ছে। সম্ভবতঃ সে ওই বৃদ্ধের অনেকগুলি স্ত্রীদের মধ্যে নবতর। স্বামীর মৃত্যু ঘটলে তাকে নিশ্চয়ই অন্য কয়েকজন সপত্নীর সাথে নিয়ে গিয়ে সতীদাহ করা হবে।
মেয়েটির করুণ পরিণতির কথাটি মাথায় আসতেই গোলকপতির মধ্যে এক দুর্বিনীত ও বিদ্রোহী যুবক এসে হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
লোকাচারের নির্মম আঘাত সে নিজেও এ জীবনে যা পেয়েছে তার ফলেই তো সে শেষ অবধি দেশহারা হয়েছে, তার যন্ত্রণা কোনদিন কি সে আদৌ কখনও ভুলতে পারবে? যদিও এখনও পর্যন্ত তার জীবনে চলছে শ্বদন্ত প্রকাশী নির্মমতার সাথে স্নায়ু ও শরীরের এক সমবেত ও তুমুল দ্বন্দযুদ্ধ।
0 comments: