2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






পর্ব ১

ইতিহাসের কাল ঠিক কবে শুরু হয়েছে তাই নিয়ে আমাদের পণ্ডিতি মাঝে মাঝেই তার সীমাবদ্ধতা জানান দিচ্ছে। এই পণ্ডিতরা ঘোষণা করলেন যে মাত্র পাঁচ হাজার বছর আগেও মানুষ কোনোরকমে বেঁচে থাকতে শিখল। আর তারপরেই কেউ নতুন কোনও প্রত্নখনন উপলক্ষে জানালেন, উঁহু, মানুষ অন্তত দশহাজার বছর আগেই সমাজবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানুষের সভ্যতার নিরিখে পৃথিবীদখলকারী জীব হিসেবে সে নিতান্তই অর্বাচীন। এভাবেই ক্রমউন্মোচন ঘটেই চলেছে।

যেমন, এখনও পর্যন্ত আমরা জানতাম আর্যসভ্যতা একটি বহিরাগত শক্তি। যা উত্তর পশ্চিম থেকে এসে আমাদের ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদ করেছিল। সিন্ধুবাসীরা বিজিত হয়েছিল এই সভ্যতা দ্বারা। হয়ত প্রচলিত শব্দ এই সভ্যতা। আসলে সভ্য বোঝাতে হয়ত একে ব্যবহার করেননা কোনও ইতিহাসবিদ। তারপর তো জানা গেলো, ভুল। সভ্য মানুষ এই ভূখণ্ডে বহুকাল ধরে বাসা বেঁধে আছে। আর্যরা কিছু বহিরাগত নয়। উত্তর পশ্চিম দিকের যাযাবর গোষ্ঠীগুলির ভাষা হিসেবে এদের এই নাম দেওয়া হয়। বহিরাগত নয় এইজন্য বলা, সেসময়ে কিন্তু ভারতবর্ষের সীমা এমন করে দেগে দেওয়া ছিলনা। এশিয়া মাইনরকেও নিজস্ব ভূমি বলা চলত।

সম্প্রতি আইয়াইটির গবেষণাগার থেকে একটি তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। দক্ষিণ উপকূলে সাগরের অগভীর অংশে নিমজ্জিত এক প্রাচীন নগর। জোয়ারের জল সরে গেলে যার স্থাপত্য জেগে ওঠে। মুগ্ধ করে উপকূলবাসী জেলেদের। জানা গেল, এই নগরের বয়স নাকি দশ হাজার বছর! তাহলে? মানুষের সভ্যতার সময় মাত্র দশ হাজার বছর নয় তো! দেখা গেলো, বৈদিক সভ্যতার যে গ্রামভিত্তিক গঠন ছিল, যে পুরোহিততন্ত্র তাকে পরিচালনা করত, তার চেয়েও অনেক বেশি উন্নত সভ্যতা ছিল দক্ষিণ উপকূলের এই সভ্যতা গুলো। সিন্ধু সভ্যতা তো তার উৎকর্ষের উচ্চতা প্রমাণ করে দিয়েছে অনেক আগেই। এখন দেখা যাচ্ছে যে এই সভ্যতাগুলো নগরভিত্তিক। বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে এগুলোর সমান বৈপরীত্য।

মাদ্রাজ শহর থেকে কিছু দূরে পূর্ব উপকূলে, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সাগর তটে এমন একটি নাগরিক সভ্যতার নিদর্শন মেলে। মহাবলীপুরম নামটা সকলেই শুনেছেন। সপ্তম শতাব্দীর চোল রাজাদের তৈরি স্থাপত্য। কিন্তু যা অনেকেই জানেন না, তা হল, এরও বহু আগে এই অঞ্চলে নাগরিক সভ্যতার উন্মেষ ঘটে গেছে। বহু খ্রিস্টপূর্বাব্দ আগেই। গত সুনামির সময়ে মহাদেশীয় তল খানিক সরে যাবার ফলে মাটির গভীরে প্রোথিত সেই অবশেষ খানিক বেরিয়ে পড়েছে। স্থানীয় মানুষ, যারা এ নিয়ে চর্চা করছেন, তাদের কাছ থেকে জানা গেলো, এই সাগর তট থেকে পুরাকালে বাণিজ্যবহর যাত্রা করত নানাদিকে। বড় বড় অর্ণবপোত তাদের সম্ভার নিয়ে যেত বহির্দেশে বানিজ্যে। এখন উদ্বৃত্ত সম্পদ এমন কি ছিল? যা দিয়ে রপ্তানি সম্ভব? ছিল কৃষিজ উদ্বৃত্ত। এ অঞ্চল ছিল কৃষিজ সম্পদে ভরপুর। সেই সম্পদ উৎপন্ন করতে প্রয়োজন একটি কুশলী ও শক্তিশালী জাতি। সেই শক্তিশালী দীর্ঘকায় পেশিবহুল মানুষকে, খর্বকায় শিথিলপেশি পুরোহিত মাতব্বরেরা নাম দিলো অসুর। অসুর একটি জাতি বিশেষ। এ নিয়ে পরের কোনও পর্বে লিখব। এই শক্তিশালী মানুষদের মধ্যে ছিল শক্তিশালী স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই। এরা সকলে মিলে সমৃদ্ধ নগর গড়ে তুলেছিল। এদের অস্তিত্ব ছিল গণে। রাজত্বে নয়। এমনই কোনও এক নগরের একটি উঁচু টিলায়, (কেননা দক্ষিণ উপকূলে, লাল পাথরের টিলা আছে) কোনও এক ভূয়োদর্শী পুরুষ ডেকে নিলেন বাকিদের। তিনি জানালেন, একার জমি নয়, সম্মিলিত জমিতে চাষ করলে মিলবে বেশি উদ্বৃত্ত। তা নিয়ে বানিজ্যে যাওয়া যাবে। সকলে সেই নিয়মে রাজী হলে সেই পুরুষটি নিজের বিবেকের কারণেই সম্মিলিত জনগণকে বিপদ আপদে রক্ষা করার ভার নিলেন। মহাবলী। এই নামেই হয়ত তাঁকে সকলে ডেকেছিল।

সমান ভাবে নিজের মাটিতে কাজ করলেও বিদেশে সাগর পাড়ি দিয়ে বানিজ্যে যেত পুরুষ। মেয়েরা তখন ঘরবাড়ি পরিবার শিশু বৃদ্ধ, কৃষি জমি, ইত্যাদি সামাল দিত। এই সময়ে কোনও এক রমণী অসীম ক্ষমতাবলে এই অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষদের দেখাশুনোর ভার নিলো। এর সাহায্যে এগিয়ে এলো কমবয়সী রমনীকুল। এদের প্রত্যেকেরই পরিশ্রমের ফলে সুগঠিত শরীর। এইসব রক্ষয়িত্রীদের কারো কারো মূর্তির অবশেষ দেখা যায়। আধুনিক কালের মতো এদের পেটে সিক্স প্যাকের অস্তিত্ব নজরে পড়ে। সুরক্ষার কারণে এরা পশুদের পোষ মানিয়ে তাদের বাহন করে দস্যুদের মোকাবিলা করত। অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত তীর ধনুক, খড়গ, তরবার। বন্যজন্তু পোষ মানানোর কথা অদ্ভুত লাগলেও সত্যি। আফ্রিকার আরণ্যক উপজাতিরা সিংহ পোষ মানায় এখনও। লায়ন হুইস্পারার এরা। সেসময়ে দক্ষিণের উপজাতিরাও বন্য জন্তু পোষ মানানো এবং তাদের সঙ্গে ভাষা বিনিময় জানত। পুরুষের অনুপস্থিতিতে এইসব নগরে এই বীরাঙ্গনা রমণীরা শক্তির উৎস ছিল। পাওয়া যায় কোটরাপ্পা বলে এক রমণীর নাম। যিনি এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁকে দেবী হিসেবে পুজো করতে শুরু করেছিল তার গণের মানুষজন। তিনি সিংহবাহিনী। অবশ্যই সিংহ তাঁর পোষা ছিল!

এই রমণী যেমন শৌর্যের প্রতীক ছিলেন তেমনই আরেক রমণী ছিলেন। তিনি মধ্যবয়স্কা। পৃথুলা। বৃহৎ উদরা। বৃহৎ উদরের তাৎপর্য হল, তিনি বহুজনের জননী। তিনি উর্বরা। তাঁর স্তনভারে অবনত শরীর বুঝিয়ে দেয় যে তিনি বহুজনের স্তন্যদায়িনীও বটে। এই রমণী জননী এবং উর্বরা শক্তির প্রতীক। অতএব জন্মদান পালঙ ও রক্ষণ, এই তিন প্রকার কর্মে নিযুক্ত রমণীরা গণের পুরুষদের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন সেই নগর সভ্যতার কালে।

পুরোহিততন্ত্র যখন দক্ষিণ উপকূল গ্রাস করতে এলো, তখন বুদ্ধিতে বলীয়ান কিন্তু শরীরে হীনবল একদল মানুষকে সেনা হিসেবে ব্যবহার করল। এদের বলা হল শিবগণ। মানে শিবের সৈন্য। অর্থাৎ, পুরুষ রাজার অধীনস্থ সেনা। অথচ হীনবীর্য। এখনও দক্ষিণের পর্বতগাত্রে খোদিত কোটরাপ্পা দেবীর সঙ্গে দেখা যায় বালকসুলভ খর্বকায় একদল সৈন্য। এরা শিবগণ। কিন্তু কি উপায়ে এরা কোটরাপ্পাকে নিজেদের পক্ষে এনেছিল? তবে কি সেই আদিকাল থেকেই নারীশরীর আর রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে জমির দখলকে একযোগে ব্যবহার করা হয়েছিল? নারীশরীরের মালিকানা, একগামিনী নারী ও বহুগামী পুরুষের সেই ঐতিহ্য কি ততটাই প্রাচীন? ধর্ষিতা, আহত নারী কি তখনই সংস্কারে আচ্ছন্ন হয়েছিল যে, যে পুরুষ তার ধর্ষক সেই আসলে তার স্বামী? তার ঔরসে জাত পুত্রই আসলে উত্তরাধিকারী? তখনও কি ভূসম্পত্তির মালিকানায় নারী ব্রাত্য ছিল? মনে হয়না কিন্তু। গণের পরিচালিকা নারী অবশ্যই নিজস্ব ভূসম্পত্তির মালিক ছিল। কারণ পরিবার পালনের দায়িত্বও তারই ছিল।

কিন্তু বৈদিক সভ্যতার আগে তেমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছেনা।

কোটরাপ্পা দেবীর সঙ্গে পরবর্তীতে, আর্য আগ্রাসনের পর, দক্ষিণী যে পুরুষের সংঘাত হয়, তিনি মহাবলী। তাঁর মুখাবয়বে মহিষের মুখ। তিনিই কি মহিষাসুর? এভাবেই তো অসুরদলনীকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে আবিষ্কৃত স্থাপত্যের মধ্যে বহু বৃষ বা মহিষের মূর্তি। কৃষিকাজের জন্য এদের ব্যপক প্রচলন ছিল নিশ্চয়! আবার শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে এরা কম ছিলনা। অতএব পাশবিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জমিকে উর্বরা করে তোলা, বীজ বপন করা, ইত্যাদি কর্মের মধ্যে দিয়ে নারীর পরিচালন শক্তি ও পুরুষের পেশিশক্তির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। তখনও নারীপুরুষ সভ্যতার দুটি পক্ষ। যার শক্তি সেকালে পুরোহিততন্ত্রকে আশঙ্কিত করেছিল। তাই বিচ্ছিন্নতাবাদের আশ্রয় তারাও নিয়েছিল। কি উপায়ে সেই বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হল, বিশদে না জেনেও বলা যায়, কূটকৌশলই তাদের অস্ত্র ছিল। মহাভারত রামায়ণের মহাকব্যিক বিস্তারেও আমরা সেই রাজনীতির খেলা দেখতে পাই। চতুরতার সঙ্গে শক্তিশালী শত্রুর মোকাবিলা।

দক্ষিণ উপকূলের এই সভ্যতার সূত্রটি রেখে গেলাম। শেষে মিলন ঘটবে বৃহত্তম ভারতের অবশিষ্ট আদি জনসভ্যতার সঙ্গে।



পর্ব ২

সিন্ধু জনগোষ্ঠী যে মাতৃকুলভিত্তিক ছিল তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় হরপ্পার সমাধিক্ষেত্র থেকে। সমাধিক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায় নারীদের মাতৃকুল অনুযায়ী সমাধিস্থ করা হয়েছিল। একই পরিবারের নারীদের সম্ভবত একই ক্ষেত্রে সমাধি দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি গৃহে মাতৃদেবীর কাদামাটির মূর্তি ছিল। একটি অনুমান এ থেকে করা সম্ভব যে নারীর অবস্থান থেকেই পরিবারের অবস্থান সুচিত হতো। কিন্তু তাই বলে নারী এখানে সম্মানজনক অবস্থানে থাকতনা। তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে হরপ্পার কঙ্কালগুলোর দন্তসংক্রান্ত গবেষণায়। দেখা গেছে নারীদের তুলনামূলক ভাবে অনেক কম যত্ন নেওয়া হতো। তাদের খাদ্যে মাংসের পরিমাণ অনেক কম ছিল। তাহলে মাতৃতান্ত্রিক বলব কেন? কারণ এসবই সিন্ধুর সম্পন্ন সময়ের কথা। যখন সভ্যতার উৎকর্ষ ভীষণ ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তখন সমাজে নারীর অবস্থান পুরুষের ক্ষমতার আওতায় এসে পড়েছে। এর আগে, গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে নারীই ছিল প্রধানা। কৃষিক্ষেত্রে, শিল্প উৎপাদনে তার ভূমিকা ছিল প্রধান। পুরুষ তখন উদ্বৃত্ত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে, জলধারার রক্ষণে ব্যস্ত। সভ্য নগর গড়ে ওঠার আগে গ্রামগুলির চারিদিকের বন্য এলাকার থেকে বাঁচতে পুরুষের পেশী শক্তি কাজে লেগেছিল। নারী তখনও সৃষ্টিশক্তি। কি কৃষিতে কি সন্তান প্রসবে। কিন্তু ধীরে ধীরে নগর গড়ে উঠল। উদ্বৃত্ত সম্পদের প্রাচুর্য বৈদেশিক বানিজ্যে প্রেরণা দিলো। পুরুষ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হল। কারণ বৈদেশিক বানিজ্যে নারীর ভূমিকা ছিল নগণ্য। তার প্রধান ভূমিকা ছিল নিজের ক্ষেত্রে। ফলে, বানিজ্যে উদ্ভুত সম্পদ গেলো পুরুষের হাতে। এলো বণিক সম্প্রদায়। তাদের সঙ্গে সঙ্গে এলো পুরোহিত সম্প্রদায়। তারা তখনও নারীকে মাতৃকা মূর্তিতে পূজা করে চলেছে। কারণ সৃষ্টিরহস্যে নারীর অবিসংবাদী ভূমিকা তারা অস্বীকার করতে পারছেনা। কিন্তু অন্যদিকে তারা নারী নির্যাতনের বিভিন্ন পন্থা খুঁজে বার করছে। এই বণিক সম্প্রদায় ও পুরোহিত সম্প্রদায় মিলেই যে একটি শক্তিশালী সিন্ধু রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল সে একদিন প্রমাণ হবে। আপাতত সিন্ধুতে নারীর অবস্থানের দুয়েকটি প্রমাণ দিই। নৌশেরা থেকে পাওয়া গিয়েছে একটি কাদামাটির প্লেট। তাইতে একজন নারী একটি চ্যাপ্টা পাথরের ওপর বেলন দিয়ে শস্যদানা চূর্ণ করছে। সিন্ধুর বাসভবনে পাওয়া অসংখ্য তকলি থেকে অনুমান করা যায় ঘরে ঘরে নারীরাই সুতো কাটত। ঘূর্ণমান হস্তচালিত জাঁতা এবং চরকার উদ্ভাবন তখনও হয়নি। সুতরাং উভয় প্রকার কাজই পরিশ্রমসাধ্য ছিল। পুরুষ এসব কাজে নিযুক্ত হয়েছে সে প্রমাণ কোনও চিত্রেও পাওয়া যায়নি।

একেবারে অন্য একটি দিক উত্থাপন করি। সিন্ধুর নানা ভাস্কর্যর মধ্যে একটি নৃত্যরতা নারীমূর্তির কথা সর্বজনবিদিত। নারীটি নগ্নিকা। দুই বাহু অলঙ্কারে ভূষিত। এমন নগ্নিকা মূর্তি যে দেবীমূর্তি নয় তা বলাই বাহুল্য। তবে এ কিসের মূর্তি? কোনও নগরনটীর কি? নারীর সেই আদিম ব্যবহার! কোনও মুগ্ধ সেবাক্রেতা অতঃপর ভাস্কর্যটি তৈরি করেছেন! মাতৃকৌলিক হোক বা মাতৃতান্ত্রিক হোক, কেন্দ্রীভুত ক্ষমতার মধ্যে রাষ্ট্রের উদ্ভবের মধ্যে নারীর মনুষ্যত্ব চিরকাল পদদলিত।

চোখ ফেরাই আরেকটু অর্বাচীন কালে। দেখে নিই একটি অন্য প্রেক্ষিত । দক্ষিণ ভারতে অনার্য যে মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, তার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে গীতি থাডানির দুটি বইতে। Sakiyani: Lesbian Desire in Ancient and Modern India এবং Mobius Trip বই দুটিতে তার গবেষণার কথা জানাচ্ছেন গীতি। গীতি স্বনামধন্য। তিনি একজন শিক্ষাবিদ। কারোর অস্তিত্বের সঙ্গে ‘সমকামী’ শব্দবন্ধ জুড়ে দেওয়ার যে রেওয়াজ থেকে আমরা এখনও মুক্ত হতে পারিনি, গীতির পরিচয় খুঁজলে তার উদাহরণ মিলবে। যাই হোক, তিনি তার বইতে লিখছেন, ভারতের, বিশেষত দক্ষিণ ভারতের উপকূল জুড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছিল যোগিনী মন্দির। যোগিনী বৌদ্ধ ধর্মে ব্যবহৃত ডাকিনী শব্দটির সঙ্গে প্রায় সমার্থক। এই মন্দিরগুলো আর্য মন্দিরের মতো নয়। এগুলি বৃত্তাকার। মাথায় কোনও ছাদ নেই। উন্মুক্ত। পরিধি জুড়ে যে প্রাচীর, তার কুলুঙ্গিতে থাকত দেবদেবীর মূর্তি। মাঝের বৃত্তাকার চত্বরে একটি বৃহৎ যোনিপ্রস্তর। গীতি জানাচ্ছেন, এইসব তথাকথিত যোগিনীরা, (যাদের আমরা একসময়ের শক্তিময়ী নারী ভাবতেই পারি) ছিলেন সর্বৈব স্বাধীন। তাদের মন্দির চত্বরে সম্ভবত কৌল চক্রের মতো চক্র বসত। সেখানে নারীই প্রধানা। সক্রিয়। পুরুষ খানিক নিষ্ক্রিয়। কিন্তু চক্রে স্ত্রী পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত চর্চার কথা তো সকলেই জানেন। আর্যরাই ধর্মাচরণকে সম্পূর্ণ স্ত্রীমুক্ত করে। তাদের তৈরি শাস্ত্রই বিশাল তালিকা তৈরি করেছে যুগে যুগে। নারীর কিসে কিসে অধিকার নেই, সেই তালিকা দাখিল করতে গেলে, মৈনাক পর্বত যদি কলম হয়, আর সাত সমুদ্র যদি কালি হয় , তাও বোধ হয় লিখে শেষ করা যাবেনা।

গীতির লেখার মধ্যে প্রকটরূপে বর্তমান, প্রাচীন ভারতে নারী সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল। তার অবস্থান পুরুষের মতোই সমান মর্যাদাপূর্ণ ছিল। অতএব সিন্ধুপরবর্তী সময়ে ধর্মের হাত ধরে নারী আবার স্বমহিমায় উপস্থিত।

এবার ফিরে দেখব, ভারতীয় পুরাণের দিকে। পুরাণ রামায়ন ও মহাভারতের কাল। একটি কাহিনী শোনাবো। এ কাহিনী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষ্যে লিখিত।

বৈবস্বত মনুর কন্যা ইলা। ইক্ষ্বাকুর ভগ্নী। যদিও বায়ুপুরাণ ও ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে ইলাকে মেয়েই বলেছে, বিষ্ণুপুরাণ কিন্তু জানাচ্ছে, ইলা প্রথমে পুরুষ হয়েই জন্মেছিলেন। পরে নারী হন। বা কিম্পুরুষ। যার নাম সুদ্যুম্ন। এই সুদ্যুম্ন চন্দ্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার প্রতিষ্ঠিত বংশ ঐল বংশ নামেও পরিচিত। রামায়ণে আছে, ইলা নাকি মৃগয়াতে গিয়ে ভুলবশত সহ্যাদ্রি পর্বতে অবস্থিত পার্বতীর শরবনকুঞ্জে ঢুকে পড়েছিলেন। সেখানে শিব ছাড়া অন্য পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তাই পার্বতীর অভিশাপে তিনি নারী হয়ে যান। ওই কুঞ্জে নাকি বৃক্ষলতা পর্যন্ত নারী। এই অভিশাপের ফলে ইলার সঙ্গের পারিষদেরাও নারী হয়ে যান। বা কিম্পুরুষ। ইলা বাধ্য হয়েই বনে রয়ে গেলেন। এখন নারী ইলাকে দেখে বনে তপস্যারত চন্দ্রপুত্র বুধ মোহিত হয়ে পড়েন। তিনি নাকি প্রগাঢ় তপস্বী। তবুও সংযমের বাঁধ ভাঙছে। তিনি ইলাকে প্রেম নিবেদন করলেন। সম্ভবত ইলারও এছাড়া কোনও উপায় ছিলনা সমাজে ফেরবার। তাই তিনি বিবাহ করলেন বুধকে। এরপর নাকি একমাস অন্তর অন্তর ইলার লিঙ্গ পরিবর্তিত হতে থাকে। যেসব মাসে তিনি নারী সেসব মাসে তিনি বুধের সঙ্গে দাম্পত্যে মেতে থাকতেন। আর যখন তিনি পুরুষ তখন তিনি ব্রহ্মচর্যে কাল কাটাতেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলনা। কিম্পুরুষ রূপে ইলার অস্তিত্ব সিদ্ধ হলনা। কারণ ন মাস পর তার একটি পুত্র হল। নাম পুরুরবা।

স্কন্দপুরাণ কিন্তু বলছে ইলা নাকি মেয়ে হতেই চেয়েছিল। স্বেচ্ছায় সে নারী হবার জন্যেই শরবনে প্রবেশ করে। ইলার পুত্রসন্তান হতে একটি প্রত্যক্ষ ফল এই, যে, ইলার পিতা তাকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। কারণ তিনি নারী। সম্পত্তি পান পুরুরবা। মানে কিম্পুরুষ ইলার সন্তান। কারণ তিনি পুরুষ।

এই কাহিনীটি অবশ্যই রূপকধর্মী। শিবপার্বতীর গোপন মিলনস্থলে ঢুকে পড়ে তিনি অপরাধ করেছিলেন। কেন? তন্ত্রের স্রষ্টা শিব ও তন্ত্রের প্রধান দেবী পার্বতীর মিলন তো স্বর্গীয়! তাহলে তা দেখা অপরাধ কেন? যৌনতার ওপরে বিধিনিয়ম? নাকি শিব ও পার্বতীর বৈদিক দেবতারূপে উত্তরণের ফল? এবং শাস্তি হিসেবে ইলা কিম্পুরুষে পরিবর্তিত হলেন। একই অঙ্গে নারী ও পুরুষের চিহ্ন ধারণ করলেন। মানে তার স্বাভাবিক চিহ্ন বিলোপ করা হলো। ভয়ংকর! প্রাচীন ধর্মীয় আচারকে গিলে ফেলে তাইতে বৈদিক শিলমোহর লাগানর কাজ শুরু হয়েছে তো আগেই। তাই শিব পার্বতী এখন আর লোকায়ত দেবতা নন। তারা এখন বৈদিক দেবদেবী। ইলার সঙ্গে সঙ্গে তার অনুচরবর্গও কিম্পুরুষে পরিবর্তিত হলো।

বুধ যে তাকে বিবাহ করলেন সেও বাহ্যিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে। হয়ত তিনি অনুধাবন করতে পারেননি যে ইলা কি নিদারুন শাস্তি পেয়েছেন।

এ পর্যন্ত সব ঠিক। কিন্তু এরপরে ইলা একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। পুরুরবা। কেমন যেন মনে পড়ল চিত্রাঙ্গদার কথা। তবে কি ইলা মেয়ে হয়েই জন্মেছিল? পিতা কন্যারূপ গোপন করে ইলাকে সুদ্যুম্ন সাজিয়ে জগতে পেশ করেছিলেন? যাতে কোনভাবেই সম্পত্তি অন্য বংশে না যায়? আর সুদ্যুম্নবেশী ইলা গভীর অরন্যে মিলিত হলেন বুধের সঙ্গে! ঠিক যেমন পুরুষবেশী চিত্রাঙ্গদা ব্রহ্মচারী অর্জুনের প্রেমে পড়েছিল। প্রেমের সঙ্গে কারই বা যুদ্ধ চলে! তিনি নিশ্চয় নিজের কথা খুলে বলেছিলেন বুধকে। অরন্যেই তারা ঘর বাঁধলেন। পিতার মিথ্যাকে সত্য প্রমাণিত করতে ইলা একমাস অন্তর নিজেকে পুরুষরূপে পেশ করতেন। তবু শেষরক্ষা হলনা। তিনি সন্তানের জন্ম দিলেন। আর পিতাও দৌহিত্রকেই সম্পত্তি প্রদান করলেন। ইলা বঞ্চিত হলেন সম্পত্তি থেকে। কারণ তিনি নারী। নারী হয়ে সম্পত্তির অংশ পেলে সে সম্পত্তি জামাতার হবে। ইলার এই মিথকে ভাঙলে এই তো চোখে পড়ে!



পর্ব ৩

সম্ভবত আর্য জাতিসত্ত্বা বলতে যে বহিরাগত তত্ত্বটিতে এতদিন ধরে ঐতিহাসিকদের নির্ভরতা ছিল সেটি এখন নিরসনের পথে । এই ভূখণ্ডের উত্তর পশ্চিমাংশ জুড়ে যে যাযাবর জাতি ক্রমান্বয়ে বাসস্থান পরিবর্তন করে করে শেষ পর্যন্ত সরস্বতী অববাহিকায় থিতু হয়েছিল তাদেরই আমরা আর্য বলি । ঊষর বন্য পরিবেশে থাকতে থাকতে এই যাযাবর গোষ্ঠীগুলির মানুষজন রুক্ষ্ম স্বভাবের হয়ে পড়েছিল । স্বভাবে নম্রতা ছিলোনা বললেই চলে । ক্রমাগত যুদ্ধবিবাদের ফলে তাদের স্বাভাবিক ক্রুরতা ভীষণ বেশি ছিল । বন্য পশুকে এরা ব্যবহার করতে শিখেছিল । বুনো ঘোড়াকে বশ মানিয়ে তাইতে সওয়ার হয়ে এরা ভূখণ্ডের মধ্য থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তের স্থিতিশীল সম্পন্ন জাতিগুলিকে আক্রমণ করত । শান্তিপ্রিয় ও সম্পন্ন সেসব মানুষ যুদ্ধবিমুখ ছিল । বহির্বানিজ্যে উন্নত মানুষজন পারস্পরিক সম্পর্কে ক্ষমতা বা প্রভুত্ব নয় , সৌহার্দ্য রক্ষা করতে জানত । কারণ তাইই ছিল তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল কারণ । ফলে ধারালো অস্ত্রের সামনে , দুরন্ত গতির অশ্বারোহীর সামনে তারা হার স্বীকার করল । নিহত হলো । লুণ্ঠিত হলো । আর এই যাযাবর নৃশংস গোষ্ঠীগুলিই প্রথম বিজিত পক্ষের নারীদের লুণ্ঠন ও ধর্ষণের দ্বারা প্রতিরোধ ব্যর্থ করতে শুরু করে । বস্তুত তেমন অকাট্য পাথুরে প্রমাণ হাতে না থাকলেও কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ করলে বোঝা সম্ভব । দাস বা শুদ্র বলে আর্যরা যাদের চিহ্নিত করত তারা ত বিজিত গোষ্ঠীর মানুষ ছিল । এই দাসেদের বা বন্দীদের কাজ ছিল সমাজের বাকি তিন বর্ণের সেবা । কেমন সেবা ? শুদ্র নারী যদি নিজের স্বাধীন অবস্থানে কোনও কুলের প্রধানাও হয়ে থাকেন , আর্য দলপতির দ্বারা বিজিত ও ধর্ষিত হয়ে তাঁর প্রধান কর্ম বা শাস্তি হয়ে দাঁড়ালো পুরুষের শয্যায় যাওয়া । সে পুরুষ গোষ্ঠীপতি স্বয়ং হতে পারে বা তার অতিথিও হতে পারে । বৈদিক সাহিত্যে এমন ভূরি ভূরি কাহিনী ছড়িয়ে আছে , যেখানে গৃহে আগত ঋষি , যিনি কিনা ব্রহ্মজ্ঞ বেদজ্ঞ ইত্যাদি ইত্যাদি , তাঁর সেবার জন্য এক বা একাধিক নারী কামনা করবেন । সুন্দরী , পীনবক্ষা, গুরুনিতম্বিনী নারী দর্শনে তাঁরা এমন কামার্ত হয়ে পরেন যে যেখানে সেখানে রেতঃপাত ঘটে যায় সেইসব উর্দ্ধরেতা ঋষির । নারী তাদের কাছে স্খলিত রেতর আধার মাত্র । কামনার উপশম মাত্র । মানুষ নয় ।

ফিরে আসি পূর্ব প্রসঙ্গে । যারা ভাবছেন আর্যরা ত সাংঘাতিক বিদগ্ধ , পণ্ডিত , ও ধর্মবেত্তা, তাঁরা এমন অসভ্য হীন কর্ম কেন করবেন ? তাদের বলি , মেধার উৎকর্ষ থাকলেই যে চারিত্রিক উৎকর্ষ থাকবে এমনটা নাই হতে পারে । বিশেষ করে আর্য ধারণায় নারীকে যখন অবমানব ভাবাটা চেতনায় গেঁথে গিয়েছে । সুতরাং পণ্ডিত ও ধার্মিক একই সঙ্গে ধর্ষক ও পীড়ক । এরকমই আরেকটি ঘটনাকালের সাক্ষী কি আমরা ইতিহাসে পাইনি ? যখন ইসলাম শাসকের দল উত্তর পশ্চিম প্রান্ত ধরে ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল । ইতিহাসের পাতা ভরে আছে অজস্র নারীর হত্যা ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে । কখনো কোনও সুলতান দয়াপরবশ হয়ে বেগম করেছেন পরধর্মের নারীকে । সে বিচ্ছিন্ন ঘটনা । আসলে এটি যুদ্ধনীতি । নারীকে পদদলিত করে অধিকার করতে পারলে দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় । একটি প্রজনন অপরটি সম্ভোগ । প্রজননের দ্বারা নিজ গোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ে । যুদ্ধে লড়বার লোক বাড়ে । আর সম্ভোগ ত ক্ষমতা প্রদর্শনের সেরা উপায় ! ফলত দেখা গেলো , এমন শত শত গোষ্ঠীর হয়ত কুলমাতৃকা ছিলেন যে নারী তিনিই পীড়িত হলেন । উপরন্তু তাঁর সম্পদ ও ভূমি গ্রাস করা হলো ।

ভারতের মাটিতে ঋক বেদের রচনা শুরু হয়েছিল আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীর আশেপাশে । আর সর্বাপেক্ষা অর্বাচীন সুক্তটি রচিত হয় খ্রীষ্টিয় পঞ্চম শতকে । অর্থাৎ বৈদিক যুগের ব্যপ্তি সতেরো থেকে আঠেরো শতক ।

এই গেলো প্রাচীন অধিবাসীদের পরাজয়ের অষ্পষ্ট ইতিহাস এবং মাতৃতন্ত্রের অবসানের প্রহর । পূর্ব ও দক্ষিণের দুর্গম (পর্বত ও দুরন্ত নদনদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ) অঞ্চলগুলি অবশ্য তখনও অগম্য ছিল । ফলত আর্য সভ্যতার প্রভাব এসব অঞ্চলে সমকালে প্রায় ছিলোনা বললেই চলে ।

একবার ঋক বেদ ঘাঁটি বরং । দেখতে পাচ্ছি একটি প্রাচীন রচনা । যেখানে ঊষাকে এক সুন্দরী ও সুসজ্জিতা রমণী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । হাস্যমুখী বধূ যেমন স্বামীর সামনে নিজের রূপ উন্মোচন করে তেমনি ঊষা তাঁর রূপ উন্মোচন করেন । তাঁকে বলা হয়েছে নির্লজ্জা । সমাজে নারীর বিচরণের ক্ষেত্রে কি তবে তখনই একরকম নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে গিয়েছিল ? লজ্জার ধারণাই বা এলো কিভাবে ? এবং কেন ? শরীর ঢাকতে মানুষ যে পোষাকের ব্যবহার শুরু করে সে ত শীত গ্রীষ্ম থেকে বাঁচতে ! প্রাকৃতিক কারণেই । তবে লজ্জা নিবারণের প্রশ্নটি কবে থেকে উঠল ? বিশেষত নারীর ক্ষেত্রে ? পুরুষ যদি যৌবনবতী নারীকে দেখে কামাতুর হয়ে পড়ে তবে সে দোষ নারীর । সেটিই তার লজ্জা । অতএব আচ্ছাদন দাও । লজ্জা নিবারণ করো । শুধু সেই পুরুষের সামনে নগ্ন হও যে তোমাকে অধিকার করেছে।


পর্ব ৪

মাতৃতন্ত্রে মাতৃআরাধনা এবং মাতৃত্বর গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সেই সময় পেরিয়ে আমরা এসে পড়েছি মাতৃতন্ত্রের কণ্ঠরুদ্ধ হচ্ছে যখন, সেই কালে। সৃষ্টির প্রকাশ যখন প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে নারীর মধ্যেই দেখা যেত তখন মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করেছে, সমীহ করেছে। নারীর ঋতুকালকে পবিত্র কাল ধরা হয়েছে। কারণ রজঃস্বলা নারী প্রাণদানের উপযোগী শরীর পেয়েছে। সে তাই ঈশ্বরী। আরাধনা করতে হয় তাকে। সেই ধারণা বদলে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি, ঋতুমতী নারী অশুদ্ধ। অশুচি। দেবতার স্থানে, পুজার স্থানে তার প্রবেশ নিষেধ। আশ্চর্য! কিন্তু এমনটা হলো কি করে? আরেকটু দেখা যাক। ঋক বেদের পুরুষসুক্ত। সেখানে পুরুষকে সহস্রচক্ষুর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। সে সর্বময়। সর্বাত্মক অস্তিত্বে সে বিশ্বে নিজেকে প্রকাশ করছে। কেমন করে? যেমন করে তার রেত নিম্নগামী হয়ে সৃষ্টি করছে প্রাণ। সেটিই সৃষ্টিবীজ। নারী ধারয়িত্রী। পুরুষ শুচি। সর্বকালে সে পবিত্র। কারণ তার শরীরে রেত সৃষ্টি হয়। নারী নির্বীজ। সে শুধুই ধারণ করে। যেমন করে এই পৃথিবী ধারণ করে বীজ। উদ্ভিদ তার ভুমিকে উদ্ভিন্ন করে জেগে ওঠে। তাই ঋতুকালে নারীস্পর্শ অনুচিত। রজঃস্বলা নারী স্নান শেষে পুরুষের সঙ্গে মিলনে যাবে। কিন্তু তাই কি? বিজ্ঞান কি বলছে? শুধুই শুক্র প্রাণের বীজ? গমনশীল বলে? নারীর ডিম্বাশয় থেকে যে ডিম্বাণু ঋতুচক্রের বিশেষ সময়ে শুক্র দ্বারা নিষিক্ত হয় সেটিই তো ভ্রূণ হয়ে ভবিষ্যতের আলো দেখার অপেক্ষা করে! ডিম্বাণু স্থিত। স্বাভাবিক! পুরুষ তো সদা সঞ্চরণশীল। নারী তো সেই কোন কাল থেকে আপন ঐশ্বর্যে স্থিত! কিন্তু কি অদ্ভুতভাবে ধীরে ধীরে নানা গভীর দর্শনের মধ্যে দিয়ে জানানো হলো, পরম পুরুষ ঈশ্বর। নারী শুধু মানবী নয়, অবমানবী। তার মধ্যে রেত জন্মায়না। সেই রেত উর্দ্ধমুখী হয়ে সে উর্দ্ধরেতা হতে পারেনা। আর যার রেত নিম্নভুমি থেকে ওপরে না গিয়েছে সে আর সেই ঈশ্বরীয় আলো দেখবে কি করে? প্রাণের আলো? কারণ শুক্রই তো প্রাণ, ব্রহ্ম! (ছান্দোগ্য উপনিষদ – ৮/১২) এ একরকম বুঝিয়ে দেওয়া গেলো যে ঈশ্বর অতএব পুরুষ। অথচ আলোর আবার লিঙ্গভেদ হয় বলে আমরা জানিইনা। এইভাবে নারীর সৃষ্টিশীলতাকে একেবারে শূন্য করে দেওয়া হলো। বীজ না পড়লে যেমন প্রাণ জন্মাবেনা তেমনই বন্ধ্যাভূমিতে বীজ পড়েও প্রাণের উন্মেষ ঘটবেনা। সুতরাং নারীর সৃষ্টিশীলতা প্রয়োজন বৈকি!

এরপর ঘটল অদ্ভুত সব সামাজিক পরিবর্তন। ঋকবেদের কাল ধরা হয় খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দী বরাবর। সূত্রগুলি সেইসময় লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়েছে। আমরা দেখতে পেলাম সেই বৈদিক সময়ে নারীকে কিভাবে অবমানবীর মর্যাদা দেওয়া শুরু হলো।

একটি অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিই। স্ত্রী গর্ভবতী হলে পুংসবন অনুষ্ঠান করতে হতো (অথর্ব বেদ)। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে শুধুমাত্র পুত্রসন্তানের জন্যই এই যজ্ঞ। সমস্ত প্রার্থনাগুলিও পুত্রের জন্য, কন্যাসন্তান জন্মানোয় বাধা দেয়। এরপরের অনুষ্ঠানটি ভয়াবহ। সীমন্তোন্নয়ন। এতে যে নারীর স্বামী পুত্র জীবিত, শুধু তারাই গর্ভিণীর সামনে বীনা বাজিয়ে নাচবে গাইবে। তারপর রান্না করা ভাতের একটি পিণ্ড তার সামনে ধরে জিজ্ঞেস করবে – কি দেখছ? সে উত্তর দেবে – সন্তান। তারা উত্তরে বলবে – বীরপ্রসবিনী হও। (গোবহিলা গৃহ্যসূত্র) এইভাবে অনুষ্ঠান চলাকালে যাবতীয় প্রার্থনা স্বামী ও সন্তানের দীর্ঘজীবনের কামনা করে করা হয়ে থাকে। কোথাও নারীটির দীর্ঘ জীবনের প্রার্থনা নেই। কারণ সন্তান জন্মের পর তার মৃত্যু হলে স্বামী স্ত্রীর সৎকারের পরদিনই বিবাহ করতে পারে।

পুত্র জন্মের পর মায়ের ভুমিকা কি ছিল? পটভূমিকায় মাতা হিসেবে তার নাম বহন করা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ পিতা তার হাত ধরে বাইরের পৃথিবীতে আনে। পাঁচ বছর বয়স হলেই সে গুরুগৃহে যায়। মাতার সংস্রব ত্যাগ করে। কি অপরূপ কৌশলে নারীকে তার ন্যায্য অধিকার, সন্তানসঙ্গের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

মাতৃতন্ত্রের লুপ্তির আরও কারণ থাকতে পারে। প্রবন্ধে শুধু কিছু তথ্যকে হাতে রেখে একটি আলোচনার অবতারণা করা হয়েছে।

[শব্দের মিছিলে ২০১৭/১৮ তে ধারাবাহিক প্রকাশ]

2 comments:

  1. দীর্ঘ লেখা। এবং দীর্ঘ পড়াশোনার ফসল। মাতৃশক্তিকে মিথ বানানোর কিছু সুবিধা আছে, এখানে সে নিয়েও খানিক আলোচনা হয়েছে। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত লেখা, লেখিকা এবং প্রকাশিকার কাছে আবদার রইল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ জানাই। ভবিষ্যতে ইচ্ছে আছে আরো পড়াশুনো করে লেখার।

      Delete