0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in




















বছর খানেক আগে দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে এক শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা কি? না, এবার থেকে হিপোক্রেটিক ওথ-এর পরিবর্তে না কি চালু হতে পারে বা হতে চলেছে চরক শপথ। বলাবাহুল্য, চিকিৎসাক্ষেত্রে এটি একটি বড়সড় বদলের ইঙ্গিত। কেননা, চিকিৎসকেরা তাঁদের চিকিৎসা ডিগ্রির শেষে হিপোক্রেটিক ওথ বা হিপোক্রেটিক শপথ নিয়েই চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বা চিকিৎসা পেশায় আসার অধিকার পান। গোটা বিশ্ব জুড়ে এই ব্যাপারটা চলছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী। ঠিক এই বিতর্কের সময়েই বা প্রসঙ্গে আমাদের মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে আর আসাটাই বরং স্বাভাবিক– কে এই হিপোক্রেটাস, যাঁর নামে হিপোক্রেটিক ওথ সেই প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আমরা এই প্রবন্ধে আলোচনা করব। আসলে, আমাদের এই প্রবন্ধে আলোচ্য ব্যক্তিটি হলেন প্রাচীন গ্রীক  চিকিৎসক ও দার্শনিক হিপোক্রেটাস (অনেকের মতে– হিপোক্রেটিস) (Hippocrates)।

হিপোক্রেটাস-কে বলা হয় চিকিৎসাবিদ্যার জনক। তাঁর জীবন সম্পর্কে বিশেষভাবে কিছুই জানা যায়নি। তিনি মোটামুটি ৪৬০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে গ্রীসের ঈজিয়ান বা এজিয়ান সাগরের বুকে অবস্থিত কস নামক দ্বীপে জন্মেছিলেন। তাঁর পিতাও ছিলেন একজন চিকিৎসক। পিতার চিকিৎসক হিসেবে কাজকর্ম দেখে পুত্রেরও ছোটবেলা থেকেই চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। ছোটবেলা থেকেই হিপোক্রেটাস ছিলেন লেখাপড়ায় বেশ আগ্রহী। আর তাঁর এই অসীম

আগ্রহ ও অসধারণ মেধা দেখে তাঁর পিতা সেকালের সেরা জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের কাছে তাঁর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেন। এমনই একজন মহাজ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন এথেন্সের ডেমোক্রিটাস (যিনি পরমাণুবাদেরও অন্যতম জনক) (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ - খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০)(অনেকে উচ্চারণ করেন– দেমোক্রিতোস, ইংরেজিতে Democritus)। ইনি প্রায় গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করে প্রকৃতিবিজ্ঞান, গণিত, দর্শন ও চারুশিল্পে বিশাল ও সুগভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এই মহান পণ্ডিতের কাছেই উচ্চশিক্ষা শুরু হয় হিপোক্রেটাসের। গুরু ডেমোক্রিটাসের মতো তিনিও সারা বিশ্বের সেই প্রাচীনকালের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোয় যান। প্রাচীন গ্রীসের এথেন্স নগরীতে বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি চিকিৎসাবিদ্যা চর্চা ও অধ্যাপনা করেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি এথেন্সবাসীকে প্লেগ মহামারী থেকে রক্ষা করে এথেন্সবাসীর কাছে সম্মানীয় হয়ে ওঠেন। তিনি যখন চিকিৎসক হিসেবে তাঁর গুরু ডেমোক্রিটাসের চিকিৎসা করেছিলেন তখন তিনি কোনও অর্থ নেননি। ডেমোক্রিটাস ছাড়াও আরও কয়েকজন মহাজ্ঞানী পণ্ডিতদের কাছে হিপোক্রেটাস শিক্ষালাভ করেছিলেন।চিকিৎসকের পুত্র হিপোক্রেটাস গভীর জ্ঞান ও তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও যুক্তি দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অবৈজ্ঞানিক দিকগুলো উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি চারিত্রিক দৃঢ়তার সাথে ও অসাধারণ প্রতিভায় সফলভাবে অল্পদিনের মধ্যেই বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেছিলেন। এথেন্সে আগত নানান জ্ঞানীগুণীদের সাহচর্যেও তিনি জ্ঞানার্জন করেছিলেন। তিনি এইভাবেই সেই যুগের অন্ধ কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস জর্জরিত চিকিৎসাব্যবস্থাকে একটি পরিপূর্ণ ধারণা তৈরি করে ত্রুটিমুক্ত ও কুসংস্কারমুক্ত করে প্রকৃত চিকিৎসাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। বহুদূর থেকে রোগীরা আসত নবীন চিকিৎসক ও নতুন মতবাদে বিশ্বাসী হিপোক্রেটসের নবীন চিকিৎসক ও নতুন মতবাদে বিশ্বাসী হিপোক্রেটসের কাছে। এর ফলে এথেন্সের প্রবীণ চিকিৎসকরা এই নবীন চিকিৎসকের সাফল্যে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। আসলে, হিপোক্রেটাস চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শীতার পাশাপাশি একজন সুচিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসাবিদ্যাকে যেসব চিকিৎসক তথা পুরোহিতেরা ভণ্ডামি ও শঠতার

পর্যায়ে নিয়ে গেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদে গর্জে উঠে বিরোধিতা করেছিলেন। এজন্যে, পুরোহিত সম্প্রদায়ও রেগে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে লাগল। নিরাপত্তাহীনতার ফলে হিপোক্রেটাস এথেন্স পরিত্যাগ করলেন আর এর কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যক্ষ জ্ঞান, যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি গড়ে তুললেন। জানা যায় যে,ওই সময়ে গ্রীস দেশে শব-ব্যবচ্ছেদ করা ছিল নিষিদ্ধ। আর এই ব্যাপারটাই চিকিৎসাবিদ্যা ভালোভাবে অধ্যায়ন ও চর্চা করার ক্ষেত্রে ছিল প্রধান বাধা। আর ঠিক এই শব-ব্যবচ্ছেদ না করার জন্যই সেকালের গ্রীক চিকিৎসকেরা শরীরবিদ্যা ও রোগ নিরূপণ বিদ্যায় তেমন পারদর্শী হতে পারতেন না। হিপোক্রেটসের জন্মের সময় গ্রীসের চিকিৎসাবিজ্ঞান কুসংস্কার ও তন্ত্রমন্ত্রের অন্ধকারে আবৃত ছিল। প্রাচীন গ্রীকদের চিকিৎসার দেবতা একজন ছিল যাঁর নাম ‘অ্যাপোলো’। সেই দেবতার হাতে হার্মিসের দণ্ডটিকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতীক হিসাবে মনে করা হত। প্রাচীন গ্রীসের বিভিন্ন জায়গায় ছিল অ্যাপোলোর মন্দির। তখনকার দিনে লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়লে আরোগ্য কামনায় তারা মন্দিরে পুজো দিত। শুধু পুজো নয় সাথে পশু উৎসর্গও করত। কেননা তখনকার লোকেরা মনে করত যে অ্যাপোলো দেবতার ক্রোধের জন্যই তারা অসুস্থ হয়েছে আর মন্দিরের পুরোহিতরা হল দেবতার প্রতিনিধি আর তাদের ইচ্ছাতেই রোগীর রোগমুক্তি ঘটবে তাই তাদের তুষ্ট করতে পারলেই তারা সেরে উঠবে। আর এই সাধারণ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চিকিৎসক পুরোহিতরা তাদের ইচ্ছামতো রোগীদের চিকিৎসার বিধান দিত। এইভাবেই এই এক শ্রেণির পুরোহিতেরা চিকিৎসাবিদ্যাকে নিজেদের জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। এই পুরোহিতারা নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিকিৎসা করলেও তাদের এই চিকিৎসার জ্ঞানকে দেবতা অ্যাপোলোর দান বলে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের চিকিৎসাবিদ্যাটি গোপন করে রাখত। আর এভাবেই সেকালের চিকিৎসাবিদ্যা হয়ে  উঠেছিল এক ‘গুপ্তবিদ্যা’ যার অধিকারী থাকত কেবলমাত্র চিকিৎসক পুরোহিত পিতা ও তাদের সন্তানরা। এইরকমই এক চিকিৎসক, অ্যাপোলো মন্দিরের প্রধান

পুরোহিত হেরাক্লিদেস (Heraclides)-এর পুত্র ছিলেন হিপোক্রেটাস। তাই সমাজে তাঁদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি খুবই বেশি ছিল। যার ফলে, হিপোক্রেটাস সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে লালিত পালিত হয়েছিলেন। হিপোক্রেটাস তাঁর পিতার কাছ থেকে চিকিৎসাবিদ্যার গুপ্তবিদ্যা লাভ করেছিলেন। বলা যায়, চিকিৎসায় তাঁর পিতাই ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু। তাই তাঁর অস্থি-সংযোজক ঝিল্লী সম্পর্কে, মাংসপেশীর গঠন ও কার্য সম্পর্কে, ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো কিংবা সরে যাওয়া হাড়কে পুনরায় সঠিক জায়গায় বসানোর ব্যাপারে এবং আরও ইত্যাদি চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্র সম্পর্কে তাঁর ছিল অগাধ পান্ডিত্য। আর এইসবের পরিচয় পাই তাঁর লেখা চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলো পড়লে। তিনি এও জানিয়ে গেছেন যে ভাঙা হাড়কে জুড়বার জন্য পাতলা কাঠ কোথায় ও কিভাবে বসাতে হবে এবং তার ওপর কিভাবে পটি বা পট্টি বাঁধতে হবে সে সম্পর্কেও বিস্তারিত কথা। মজার বিষয়, এইসব পদ্ধতি বর্তমান আধুনিক পদ্ধতিরই অনেকটাই কাছাকাছি। অর্থাৎ, হিপোক্রেটাস হলেন প্রথম অস্থিচ্যুতি ও অস্থিভঙ্গের চিকিৎসাসহ শল্য-চিকিৎসার প্রচলনকারী। তৎকালীন যুগে গ্রীসে শরীরচর্চা বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হত আর এই গুরুত্বটা এতটাই মারাত্বক ছিল যে স্পার্টায় অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ  শিশুদের হত্যা করা হত কেননা গ্রীকদের মতে সুস্থ ও সবল নাগরিকদের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। এর ফলে তখনকার গ্রীসে শরীরচর্চার জন্য খেলাধুলা ও ব্যায়ামচর্চার জন্য ব্যায়ামাগার গড়ে উঠেছিল। যখন এই সকল ব্যায়ামগারে কোনও দুর্ঘটনা ঘটত তখন হিপোক্রেটাস যেতেন চিকিৎসা করার জন্য। দুর্ঘটনায় অস্থিসংক্রান্ত অসুবিধার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞান দ্বারা চিকিৎসা করতেন বা চিকিৎসার বিধান দিতেন। আর এইভাবেই তিনি শল্য চিকিৎসার সূত্রপাত ঘটান। ক্ষতস্থানে চিকিৎসার ব্যাপারেও তিনি অনেক নির্দেশ দিয়ে গেছেন যা প্রকৃতপক্ষে কার্যকরী ও বাস্তবধর্মী। এমনকি, তিনি জানিয়ে গেছেন অস্ত্রোপচারের ঘর কেমন হবে বা হওয়া উচিত, অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি কেমনভাবে থাকবে বা তার প্রস্তুতি কিভাবে নেওয়া উচিত, অস্ত্রোপচারের পর ক্ষতস্থানের যত্ন কেমনভাবে নেওয়া উচিত ইত্যাদি মূল্যবান বিষয়। রোগীর পথ্য, পরিচর্যা সহ নানান ব্যাপারে তাঁর অনেক মূল্যবান উপদেশ রয়েছে। বলাবাহুল্য, তাঁর পিতার থেকে চিকিৎসাবিদ্যার গুপ্তকথাগুলো জেনেছিলেন কোনও শব-ব্যবচ্ছেদ করার সুযোগ না পেয়েই। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে হিপোক্রেটাস চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞানলাভ করেছিলেন। হিপোক্রিটাসের মতে, একজন চিকিৎসকের শুধুমাত্র রোগের উপসর্গ থেকে বিধান দেওয়া উচিত নয় বরং রোগীর পারিবারিক ইতিহাস, পেশা, দৈনন্দিন কাজকর্ম তিনি যা করে থাকেন, তাঁর চারপাশের পরিবেশ, বংশানুক্রমিক রোগের ইতিহাস, তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে জানা ও বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এগুলো জানলে ও বুঝলে তিনি রোগীর রোগ সহজভাবেই নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে পারবেন। মানবদেহের তাপের হ্রাস-বৃদ্ধি যে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা প্রথম লক্ষ্য করেছিলেন হিপোক্রেটাস। হিউমোরাল মানবদেহ থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন ধরনের রস সংক্রান্ত চিকিৎসা ব্যবস্থারও তিনি প্রচলন করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, মানুষের দেহ, মানসিকতা, আচার  ব্যবহার এমনকি মৃত্যুরও প্রধান কারণ হল এই দেহ থেকে নির্গত রস। এই রস কখনো ঠান্ডা, কখনো গরম বা আবার কখনো শুকনোও হতে পারে। এই রসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেহেরও স্বাভাবিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী গ্যালেন (Galen) (আনুমানিক ১২৯ - ২১৬ খ্রিস্টাব্দ) হিপোক্রেটাসের এই হিউমোরাল মতবাদকে সমর্থন ও গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।

তখনকার দিনে সন্ন্যাসরোগ বা মৃগীরোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের তো বটেই এমনকি চিকিৎসকদের মধ্যেও হরেক রকম কুসংস্কার ছিল। সাধারণ এমনকি চিকিৎসকেরাও ভাবতেন যে, ঈশ্বর রেগে গেলে কিংবা ভূতে ভর হলে মানুষের মৃগীরোগ হয়। অতএব, এই রোগ অত্যন্ত মারাত্মক আর এর চিকিৎসা হয় না। অর্থাৎ, এই রোগে আক্রান্ত হলে কেউ সেরে ওঠে না। চিকিৎসক হিপোক্রেটাস এ ধারণা ভ্রান্ত বলে আখ্যা দিলেন আর শুধু তাই নয় বরং উক্ত ভ্রান্ত ধারণাটির নিরসন ঘটালেন।সেই যুগে হিপোক্রেটস তাঁর ‘অন দি স্যাক্রেড ডিসিস' গ্রন্থে লিখেছেন মৃগীরোগ আর দশটি রোগের মতোই একটি রোগ। তিনি বললেন, যতই ভয়ঙ্কর ও মারাত্মক রোগ হোক না কেন, তার নিশ্চয়ই কোনো না কোনো প্রাকৃতিক কারণ থাকবেই। তাই রোগের চিকিৎসার জন্যেও কোনওরকম ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করা অনুচিত বরং প্রকৃতিই হচ্ছে আমাদের চিকিৎসক। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, It is thus with regard to the disease called Sacred: it appears to me to be nowise more divine nor more sacred than other diseases, but has a natural cause from the originates like other affections. Men regard its nature and cause as divine from ignorance and wonder....। অর্থাৎ, ভূতে ভর করার ঘটনা বা ঈশ্বরের ক্রোধের মতো ঘটনার ফলে যে রোগটি হয় তা তিনি নাকচ করলেন। তার পরিবর্তে রোগ সম্পর্কে চিকিৎসকদের মধ্যে এক বৈজ্ঞানিক মনোভাব তিনি গড়ে তুললেন। যার অভাব তখনকার দিনে তো ছিলই এমনকি এখনকার দিনেও কিছুটা হলেও আছে। মানবদেহে সংগঠিত বিভিন্ন ধরনের ঘা, ফোঁড়া, কাটা, পচনের কারণ ও তার প্রতিকার করার উপায় ছিল তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। তিনি এইসব বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, এইসব রোগ অপরিচ্ছন্ন থাকার জন্য ও দূষিত দ্রব্য ব্যবহার করার ফলে হয় এবং বৃদ্ধিলাভ করে। চিকিৎসার জন্যে তাই তিনি উপযুক্ত খাবার, নির্মল বাতাস, পরিস্কার দ্রব্যাদি, আবহাওয়া পরিবর্তন, অভ্যাস ও সুস্থ জীবনযাপন প্রণালী ইত্যাদি দিকগুলোর ওপর গুরুত্ব দিতেন। আবার, উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রোগীকে ঔষধ দিতেন না। আসলে তিনি অপ্রয়োজনীয় ও অনির্দিষ্ট ওষুধ রোগীকে দেওয়ার ব্যাপারটা অবৈজ্ঞানিক মনে করতেন। তিনি বলেছেন, If you want to learn about the health of a population, look at the air they  breathe, the water they drink, and the places where they live.। তিনি  আরও বলেছিলেন যে, কোনও রোগ নিয়ে অনুসন্ধান বা গবেষণার ফলে সেই রোগের সঠিক কারণ জানতে হবে তারপর সেই অনুযায়ী রোগের উপযুক্ত ওষুধ প্রয়োগ করে সেই রোগের চিকিৎসা করতে হবে। তাঁর মতে, একজন চিকিৎসকের একমাত্র উদ্দেশ্য হল রোগীর সেবা এবং রোগ নিরাময়ের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তোলা। হিপোক্রেটাস মনে করতেন যে, চিকিৎসাবিদ্যা অন্যান্য সকল বিদ্যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিদ্যা। তাঁর মতে অন্যান্য শিল্পকলার মতো চিকিৎসাবিদ্যাও এক সুন্দর শিল্পকলা। কি অসাধারণ কথা! কিন্তু, দুঃখের বিষয় যে এই শিল্পকলাটি অন্যান্য শিল্পকলার চেয়ে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে কিছু চিকিৎসকদের অজ্ঞতার জন্যই। তিনি বলেছেন, এই চিকিৎসাবিদ্যার পুনরুজ্জীবনের জন্যে নবীন চিকিৎসকদেরই ভার নিতে হবে। চিকিৎসাবিদ্যার অধ্যাপক হিপোক্রেটাস তাঁর ছাত্রদের জন্য এক সুন্দর ও অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। চিকিৎসাবিদ্যা সমাপ্ত করার পর যখন তাঁরা চিকিৎসক হিসেবে জীবন শুরু করতে যাবেন তখন সেই নবীন চিকিৎসকদের দাঁড় করিয়ে তিনি এক শপথবাক্য পাঠ করাতেন। আসলে, চিকিৎসকরা তাঁদের চিকিৎসাবিদ্যা অর্জনের পর যাতে তাঁদের সেবা ও মহানতার সুমহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হন সেজন্যেই তিনি নব্য চিকিৎসকদের শপথ করাতেন। সেই শপথবাক্যটি হলঃ- সারাজীবন ধরে আমি নিষ্ঠাভরে আমার কর্তব্য সম্পাদন করে যাব এবং আমার পেশার পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখব। সেই শপথ বাক্যে এও বলা হয়ে থাকে চিকিৎসকদের শিক্ষাগুরু অর্থাৎ যাঁরা তাঁদের চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষাদান করেছেন বা করতে সাহায্য করেছেন তাঁরা তাদের মাতৃপিতৃতুল্য। তাঁদের সন্তানরা তাদের ভাতৃ ও ভগ্নীসম এবং তারা যদি এই বিদ্যালাভের ইচ্ছুক হয় তাহলে বিনা পারিশ্রমিকে তাদের বিদ্যাদান করা হবে। যে পথ্যাপথ্যের নির্দেশ চিকিৎসকরা দেবেন সেটি তাঁর যোগ্যতা, বিচার ও বিবেচনা অনুসারে রোগীর উপাকারে লাগবে। কোনও ব্যক্তি যদি চিকিৎসকের কাছে কোনও মারাত্মক ও ক্ষতিকারক ওষুধ চায় তাহলে সেই চিকিৎসক কখনোই সেই ওষুধগ্রহণ করার পরামর্শ দেবেন না। রোগী ও পরিবারের সকল তথ্য যা চিকিৎসক জানবেন চিকিৎসার জন্যে তা সেই চিকিৎসক অন্য কোনও কাউকে জানাবেন না অর্থাৎ গোপন রাখবেন। চিকিৎসকদের কর্তব্য যে তাঁরা যেন সবসময় চিকিৎসাশাস্ত্রকে পবিত্র রাখার চেষ্টা করেন। চিকিৎসকরা যেন এই শপথবাক্যকে যথাযথভাবে পালন করে সকল মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়ে তাদের জীবন ও বিদ্যাকে সমভাবে সম্মানিত করে তোলেন। আর এটাই হল সেই বিখ্যাত হিপোক্রেটিক ওথ (Hippocratic Oath) (বাংলায় যা ;হিপোক্রেটিসের শপথ বা হিপোক্রেটীয় শপথ নামে পরিচিত) যা ওই নবীন চিকিৎসকদেরকে বলতে হত আর এখনও বলতে হয়। তবে জানা নেই যে, ভারতীয় আয়ুর্বেদাচার্য চরক কোনও ওইরকম শপথবাক্য পাঠ করাতে কিনা। হয়তো আগাম গবেষণা তার হদিস দেবে। তবে, হিপোক্রেটাসের শপথ বিশ্বজুড়ে বেশি বিস্তারলাভ করেছে। আমাদের কাছে যদিও দুজনেই আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধেয়, নমস্য ও প্রণম্য প্রাচীনকালের চিকিৎসক। হিপোক্রেটাস ছিলেন একজন সুচিকিৎসক এবং চিকিৎসাবিদ্যার স্বনামধন্য অধ্যাপক। চিকিৎসকদের হিপোক্রেটাসই প্রথম শিখিয়েছিলেন কোনও রোগের ইতিহাস ও লক্ষণ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করে তুলনামূলক মূল্যায়নের পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা করতে। বলা যায় যে, তিনিই প্রথম যিনি চিকিৎসাবিদ্যাকে বৈজ্ঞানিক যুক্তি, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও নীতির ওপর দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য ও তত্ত্বগুলো ‘করপাস হিপোক্রেটিকাম (Corpus Hippocraticum বা Hippocratic Corpus) নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। এই গ্রন্থে চিকিৎসাবিষয়ক প্রায় ৬০ কি তার বেশি চিকিৎসা সম্পর্কিত কাজ বা নিবন্ধ ও গবেষণাপত্র রয়েছে। হিপোক্রেটাস ৩৭০ (মতান্তরে ৩৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নব্বই (কি তার বেশি বয়সে) আমাদের ছেড়ে চলে যান।আসলে, হিপোক্রেটিসের জন্ম ও মৃত্যুসাল যে ঠিক কত সালে সে সম্পর্কে একেবারে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি চলে গিয়ে রেখে গেছেন সারাজীবন ধরে লিখে যাওয়া চিকিৎসাবিদ্যার বহু প্রবন্ধ যা তাঁর ছাত্ররা সংগ্রহ করে যত্ন  সহকারে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন খৃষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর বিখ্যাত লাইব্রেরিতে। অনেকের মতে তা এক-দু খণ্ড নয়, বরং মোট সাতাশি খণ্ডের সেই বৃহৎ হিপোক্রেটাসের রচনাবলী ছিল রচনার পরবর্তী পাঁচশো বছর ধরে চিকিৎসকদের কাছে এক অমূল্য গ্রন্থের মতো। এক একটি খণ্ডে চিকিৎসার এক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর রচনায় উল্লেখিত চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে ও চিকিৎসকদের চিকিৎসা সম্পর্কে তাঁর সকল নির্দেশাবলী সর্বকালের জন্য প্রাসঙ্গিক।বলা যায়, সেই রচনাবলী ছিল চিকিৎসাবিদ্যার বাইবেল। তিনি সর্বদা চাইতেন যে, সমস্ত অজ্ঞতা, অন্ধকার ও কুসংস্কার দূর করে চিকিৎসাবিদ্যাকে যুক্তিনিষ্ঠ তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে। আর এই কাজের জন্যে ও চিকিৎসাবিদ্যায় বিপুল অবদানের জন্যে গ্রীসের মহান দার্শনিক প্লেটো (Plato) (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭ - খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪৮)-র কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন চিকিৎসাবিদ্যার মহাগুরু ও আদর্শ শিক্ষক। আর সর্বযুগের চিকিৎসক তো বটেই এমনকি সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে আছেন এক প্রণম্য ও শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক আর চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক।




তথ্যসূত্রঃ-

দেশ বিদেশের বিজ্ঞানী – অমরনাথ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।
নির্বাচিত বিজ্ঞানীদের জীবনী – পৃথ্বীরাজ সেন, আদ্রিশ পাবলিকেশন, কলকাতা।
ছোটদের বিজ্ঞানকোষ (দ্বিতীয় খণ্ড), বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ঢাকা, বাংলাদেশ।
উইকিপিডিয়া সহ নানান ওয়েবসাইট।

0 comments: