প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
বাংলার গান বাঙালির গান
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
সংগীতের উৎসের পৌরাণিক ব্যাখ্যায় গান বিনোদনের সামগ্রী রূপেই বর্ণিত। বলা হয়েছে যে বেদমন্ত্র গীতযোগ্য তাইই ‘সামবেদ’। কিছু গানকে বলা হতো ‘অরণ্যগেয়’ কিছু গানকে ‘গ্রামগেয়’। সঙ্গীত শাস্ত্রীরা বলেন এই ‘গ্রামগেয়’ গানগুলিই উত্তর কালের ভারতীয় সঙ্গীত। তাহলে ‘অরণ্যগেয়’ গানগুলি কি? সম্ভবত অ-সংস্কৃত ও বৈদিক ব্রাহ্মণদের অ-গেয়, অনার্যদের কর্মকালীন গানগুলিই ছিল ‘অরণ্যগেয়’ গান। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে সামবেদকেই গানের উৎস বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বলা হয়েছে যেহেতু নারীর বেদ চর্চার অধিকার ছিলনা। তাই তাদের শিক্ষা ও তৃপ্তির জন্য ব্রহ্মা সৃষ্টি করলেন পঞ্চম বেদ – নাট্যবেদ। সমাজের সর্বজনের তৃপ্তির জন্য ঋকবেদ থেকে ‘আবৃত্তি’, সামবেদ থেকে ‘গান’, যযুর্বেদ থেকে ‘অভিনয়’ এবং অথর্ব বেদ থেকে ‘রস’ সমূহ নিয়ে ‘বেদ চর্চায় অনধিকারী নারী’দের শিক্ষা ও তৃপ্তির জন্য সৃষ্টি হলো পঞ্চম বেদ। অথচ গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধেও মেয়েদের গান করাকে হীনবৃত্তি বলে মনে করা হতো।
পৌরানিক ব্যাখ্যায় গান হলো দেবভোগ্য বিনোদনের সামগ্রী, গীত-বাদ্য, ইত্যাদি গন্ধর্বদের বিদ্যা বা ‘গান্ধর্ব’, তাদের পৃথক জগত। তারা দেবতা নন, কিন্তু ‘দেবতুল্য’। গন্ধর্বলোকের উল্লেখ বেদ-পুরাণে আছে, তারা ‘অনার্য’ নয়। অনার্যদের গান বেদ পুরাণ স্বীকৃত ছিলনা। আমাদের অতি পরিচিত লোকগাথা বেহুলা-লখীন্দরের কাহিনি আমরা জানি – সর্প দংশনে মৃত লখীন্দরের দেহে পুনরায় প্রাণ সঞ্চার করতে দেবতারা সম্মত হয়েছিলেন সদ্য বিধবা তরুণী বেহুলার দ্বারা তাঁদের নৃত্য-গীতের মাধ্যমে বিনোদিত করার শর্তে। সঙ্গীত যে দেবভোগ্য বিনোদন সামগ্রী এটা প্রতিষ্ঠিত করতেই মনুষ্য রচিত এই কল্প-কথা। তারপর যখন শ্রেণী বিভাজন হলো গান হয়ে গেলো রাজসভায় বন্দি – রাজা-বাদশাদের বিনোদন সামগ্রী। তানসেন থেকে যদুভট্ট কিংবা আরও পরে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ সৃষ্ট নব্য জমিদারদের বাগান বাড়ির সঙ্গীত বিলাস তো সেই একই পরম্পরা। ‘জনপদের গান’ কিন্তু ছিল বাংলার পল্লীতে পল্লীতে লোক-আচার ও ধর্মিয় আবেগ ও আচারের মধ্যে।
রাজসভার গান এখানে আলোচ্য নয়, বিষয় বাংলা গানের বিবর্তন - সেকাল থেকে একালে পৌঁছানোর জন্য তার পথ-পরিক্রমাটিকে বোঝা, কারণ বাংলা গানের শিকড় কোনওদিনই রাজসভার গান বা ওস্তাদি গানের মধ্যে ছিলনা। মুঘল বাদশাহ আকবরের দরবারে মিয়া তানসেন যখন রাগসঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ হয়ে উঠেছেন তখন কিন্তু সেই সুর বাংলার পল্লীতে এসে পৌঁছায়নি। বাঙালি তার গান তৈরি করেছে তার আপন জীবন-ছন্দ দিয়ে, নিজস্ব ধারায় কাব্যের আশ্রয়ে। পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, পল্লীবাংলার নিজস্ব সুরকে হিন্দি মনসা মঙ্গলে ‘বাঙ্গাল রাগ’ বলে উল্লিখিত হয়েছে। পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র লিখেছেন “ইহা আমাদের চির পরিচিত ‘ভাটিয়াল রাগ’। এই সুর কোনও প্রচলিত ধারার ধার ধারে না, উহা পল্লীহৃদয়ের সমস্ত করুণ রস নিংড়াইয়া লইয়া আত্মপ্রকাশ করিত। এই নদীমাতৃক দেশের ইহা নিজস্ব সুর”। গান কেন বাঙালির এত কাঙ্খিত প্রাণের জিনিস তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সংগীত চিন্তা’ গ্রন্থে জানিয়েছেন “আত্মপ্রকাশের জন্য বাঙালি স্বভাবতই গানকে অত্যন্ত আপন করে চেয়েছে...গানকে ভালোবেসেছে বলেই সে গানকে আপন হাতে, আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করতে চেয়েছে।” শুরুর লগ্ন থেকেই বাংলা গান ছিল জনপদের গান এবং কাব্য আশ্রিত। সমাজের রূপান্তর বা এগিয়ে চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে গান নানান রূপে, নানান ধারায় প্রবহমান থেকেছে, সমৃদ্ধ হয়েছে।
বাংলায় শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের সময়কালে বাংলা যে ভক্তি রসের প্রবল ধারায় মথিত হয়েছিল, সেটাই বাংলার প্রথম নবজাগরণ কাল। সেই সময়কাল বাংলা গানেরও প্রথম নব জাগরণ কাল। তারও প্রায় পাঁচশ বছর আগে চর্যাপদ কালে মঙ্গল কাব্য সমূহে যে গান তাও নিশ্চিত ভাবেই জনপদের গান। কিন্তু সে গানের গায়ন রীতি বা ধারাবাহিকতা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়না। কেন যায়না তার একটা কারণ হতে পারে – প্রায় সমসাময়িক কালেই ঘটে গিয়েছিল মুসলমান আক্রমণ ও ইসলামের প্রবেশ। তবুও সুফি ও ভক্তি আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে, ঘটে গিয়েছিল শ্রী চৈতন্য দেবের আবির্ভাবে বাংলার প্রথম নব জাগরণ – বাংলা গানেরও নবজাগরণ। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস প্রমুখের কীর্তনকে বলা হতো মহাজন পদাবলী। ‘কীর্তন’ই বাংলার প্রথম নিজস্ব সঙ্গীত ধারা। ১৫৮২ খৃস্টাব্দে নরোত্তম দাস ঠাকুর প্রবর্তন করেন ‘কীর্তন’ গানের। সমকালে মুঘল সম্রাট আকবর বাদশার দরবারে, মিয়া তানসেন উজ্জ্বলতম রত্ন রূপে বিরাজমান। সুতরাং আর একবার বলতে হয় বাংলা গান তার জন্মলগ্ন থেকেই জনপদের গান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তার কোনও শিকড় কোনওদিন ছিলনা। সেই জন্যই প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীত শাস্ত্রে কীর্তন গানের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায়না। কীর্তন গানেরও নানান ঘরাণা বা গায়ন। যেমন নরোত্তম দাস ঠাকুর প্রবর্তিত ‘গরাণহাটি ঘরাণা’, মনোহর দাস সৃষ্ট ‘মনোহরশাহী ঘরাণা, পদকর্তা বিপ্রদাস ঘোষ প্রবর্তিত ‘রেনেটি ঘরাণা’, গোকুলানন্দ প্রবর্তিত ‘ঝাড়খণ্ডী ধারা’, ইত্যাদি। বাঙালির আপন সঙ্গীতধারায় আর এক বিশিষ্ট অবদান ‘আগমনী গান’। এ গানও বাঙালির নিজস্ব। আগমনী গানে বাৎসল্য ও করুণরসের অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়। এ গানের বিষয়বস্ত্ত পল্লীবাংলার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের গার্হস্থ্য জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং বাস্তবতার এক নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায় আগমনী গানে। আগমনী গানের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন রামপ্রসাদ সেন। পরবর্তী সময়ে আরও যাঁরা এ গান রচনায় বাংলার সঙ্গীতভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (আনু. ১৭৭২-১৮২১), রামবসু (১৭৮৬-১৮২৮) ও দাশরথি রায় (১৮০৬-১৮৫৭), প্রমুখ।
মধ্যযুগের বাংলাগানের ধারায় আর একটি অসামান্য সংযোজন বাউল গান। অনুমান করা হয় খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে কীর্তন গানের উদ্ভবের সমকালে বা তারও আগে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। কারণ মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ গ্রন্থে বাউল শব্দটির ব্যবহার আছে। একালের লোক-আঙ্গিক বাংলা গানের ধারায় বাউল সুরের জনপ্রিয়তা প্রবলতম। অবশ্য বাউল গান লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে লালন শাহ বা লালন ফকীরের সৃষ্টিগুনে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি হরিনাথ মজুমদার বা কাঙ্গাল হরিনাথও (১৮৩৩) এই গানের সার্থক প্রচারক ছিলেন। দুশো বছর পরে আজকের নবীন প্রজন্মের কাছেও সমান লোকপ্রিয় বাউল গান। লালন তাঁর সমগ্র জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে জাত-ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র জেহাদ বজায় রেখেছিলেন তাঁর গানে। বাউল দর্শন মানবমুখী ও জীবন নির্ভর লালনের গানেরও মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানুষ। রামমোহন রায়ের সমসাময়িক ছিলেন লালন। প্রায় একই সময়ে দুজনের জন্ম। রামমোহনের আধুনিক চিন্তা আঘাত করেছিল সমাজের অন্ধত্ব, কু-প্রথা ও কু-সংস্কারকে। অশিক্ষায় আচ্ছন্ন গ্রামীণ লোকচিত্তে কি আলোড়ন চলছিল তার লেখা-জোখা আমরা প্রায় কিছুই জানি না। লালন প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায়ের মন্তব্য উদ্ধার করি। তিনি লিখেছেন, দেশের শিক্ষিত নাগরিকমহলে যে সময়ে রেনেশাঁস বা নবজাগরণ চলছিল, সেই সময়েই চলেছিল অশিক্ষিত গ্রামীণ লোকচিত্তে অন্য এক আলোড়ন। এ সম্বন্ধে ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। সে রকম ইতিহাস যখন লেখা হবে তখন লালনকে তাঁর যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া যাবে।
প্রাক আধুনিক যুগ বা মুঘল যুগের শেষ পর্বে বাংলা কাব্য সঙ্গীতে আবির্ভাব হয়েছিল রায়গুণাকর ভরত চন্দ্রের (১৭১৩-১৭৬১)। তাঁর রচিত ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যে, আদিরসের প্রাধান্য থাকলেও এটি মধ্যযুগের বাংলা সঙ্গীত ধারার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন রূপেই মান্য। প্রায় সমকালেই সৃষ্ট হয়েছিল হরু ঠাকুর (১৭৩৯) প্রবর্তিত ‘কবিগান’। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে বাংলা গানে আধুনিক কাব্য সঙ্গীতের ছন্দময়তা প্রথম আসে রামপ্রসাদ সেনের শ্যামা বিষয়ক গানে। আজ আড়াইশ বছর পরেও সে গানের প্রতি বাঙালির মুগ্ধতা কিছুমাত্র কমেনি। ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না / এমন মানব জমিন রইলো পতিত / আবাদ করলে ফ’লতো সোনা’ এ শুধু সঙ্গীত ছন্দই নয়, আধুনিক কাব্যের মতো এক দার্শনিক সত্যকেও প্রকট করে। এবং কখন? যখন কলহপ্রবণ, পরশ্রীকাতর, আত্মমর্যাদাহীন বাঙালি খাল কেটে কুমির আনার মতো ঔপনিবেশিক শক্তিকে তাদের নয়া শাসনকর্তা রূপে আহ্বান জানাতে চ’লেছে। ‘রামপ্রসাদ বৈষ্ণবদের ভাব আত্মস্ত করে কঠোর শাক্ত ধর্মকে কোমল শ্রী দান করেছিলেন। রাজনৈতিক বিপ্লব ও দুর্ভিক্ষাদি নানা বিপদে পড়িয়া বাঙলা তখন নয়নজল দিয়া মাতাকে পূজা করিতে চাহিয়াছিল’ – রামপ্রসাদের গান সেই শত সহস্র বঙ্গসন্তানের নয়নজল – আকুল কন্ঠের ‘মা’ ডাক। রামপ্রসাদ সেনের (১৭২১-১৭৮১) সঙ্গীত রচনা কাল বা তার জীবন কালেই ঘটে গেছে পলাশির যুদ্ধ, বাংলায় দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তি স্থাপন এবং রায়গুণাকরের মৃত্যু। বিস্ময়কর এই যে, প্রায় আড়াইশো বছর আগে লোকান্তরিত রামপ্রসাদ সেন আজও বেঁচে রয়েছেন তাঁর গানে। তাঁর গান যেন উদার আকাশের বিশালতা, সুরের মাধুর্যে মনের সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণা, বিক্ষোভ বিদ্বেষ মুছে দেওয়ার শক্তি নিয়ে এখনও বাংলার কাব্যসঙ্গীতের ভাণ্ডারে অক্ষয় ঐশ্বর্য হয়ে রয়েছে।
রামপ্রসাদ তাঁর সৃষ্টির মধ্যগগনে থাকাকালীন আরও আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে এল ‘বাংলা টপ্পা গান’, প্রবর্তন করলেন রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবু (১৭৪২ – ১৮২৯)। টপ্পা গানের উৎপত্তি পাঞ্জাবে হলেও রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবুই বাংলায় টপ্পা গানের প্রচলন করেন। কাব্যছন্দ আশ্রিত টপ্পা গান বাংলার নিজস্ব গান হয়ে ওঠে – হয়ে ওঠে বাংলা কাব্য সঙ্গীতের দিক-দর্শনী। টপ্পা গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কথা – এ তো অত্যন্ত বাঙালির গান। বাঙালির ভাবপ্রবণ হৃদয় অত্যন্ত তৃষিত হয়েই গান চেয়েছিল, তাই সে আপন সহজ গান আপনি সৃষ্টি না করে পারেনি (সঙ্গীত চিন্তা)।
রামপ্রসাদী এবং টপ্পা গানের প্রায় সমকালেই সৃষ্টি হয়েছিল হরু ঠাকুর ও রাম বসু প্রবর্তিত ‘কবিগান’ (১৭৩৯)। ভারত চন্দ্র রায় গুণাকরের ‘বিদ্যা সুন্দর’ থেকে রামনিধি গুপ্তর টপ্পা গান – এ সবই প্রবর্তিত হয়েছিল মধ্য যুগের সেই সময়ে যখন ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল শাসনের গ্রন্থি শিথিল হতে শুরু করেছে। বাংলাতে তখন স্বাধীন নবাব আলিবর্দী খাঁর শাসন। বাংলা গান প্রাক-আধুনিক যুগে প্রবেশ করতে চলেছে।
মধ্যযুগের আর একটি আঞ্চলিক সঙ্গীত ধারা ‘আখড়াই গান’। শান্তিপুরে এই গানের উৎপত্তি ১৮ শতকের গোড়ায়, নিধুবাবুর মাতুল কলুই চন্দ্র সেনকে বাংলায় আখড়াই গানের প্রবর্তক বলা হয়। আদতে ‘আখরাই গান’ উত্তর ভারতের ‘আখাড়া গানে’র এক বিবর্তিত রূপ। সেই হিসাবে ‘আখড়াই’ অনেক প্রাচীন সঙ্গীত ধারা। বাংলাতে এসেও এই গান নানা ভাবে বিবর্তিত হয়েছে। মালদহ, নদীয়া কিংবা হুগলীতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আখড়াই গান পরিবেশিত হতো। শেষে বাবু কলকাতায় এসে আখড়াই গান মার্জিত হয় কলুই চন্দ্র সেনের হাতে। এই গানের দুটি পর্যায় থাকতো – ‘খেউড়’ ও ‘প্রভাতি’। পরে এই গানেরই আর একটি রূপ ‘হাফ আখড়াই’ সৃষ্টি হয়, নিধু বাবুরই এক শিষ্য মোহন চাঁদ বসু উদ্ভাবন করেন ‘হাফ আখড়াই’। এই রীতির গানও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, কারণ ততদিনে এসে গেছে ‘পাঁচালি’ গান ও আরও আকর্ষণীয় ‘থিয়েটারের গান’। ‘আখড়াই গান’ কবিগানেরই আর এক রূপ একথাও মনে করা হয়। কারণ কবি গানের চারটি পর্যায়ের দুটি পর্যায় ছিল ‘খেউড়’ ও প্রভাতি’ – আখড়াই গানেও তাই। অনেক গবেষক বলেন অস্লীল আদিরসাত্মক ‘খেউড়’ থেকেই কবিগানের উৎপত্তি। কবিগানের তিনটি মূল বৈশিষ্ট – সংলাপ ধর্মী গান অর্থাৎ গানের মধ্যে প্রশ্ন ও উত্তর। খেউড়’ বা অশ্লীলতার প্রয়োগ এবং হেঁয়ালি মূলক তত্ত্বের প্রয়োগ। প্রায় গ্রাম্য মেয়েদের ‘ঝুমুর’ গানেও প্রশ্নোত্তর মূলক গান থাকতো, তবে তা নৃত্য সহযোগে। তাই অনেক গবেষক মনে করেন ‘ঝুমুর’ থেকেই ‘কবি গানে’র উৎপত্তি। এগুলি সবই আঞ্চলিক গানের বিভিন্ন রূপ মাত্র, নানান নানান রূপে বিবর্তিত হয়েছে- পরিমার্জিতও হয়েছে। প্রথমে ‘কবি গানে’ ‘খেউড়’ বা অস্লীলতার প্রয়োগ হতো, আবার সেই কবিগানই নদীয়ায় বৈষ্ণব প্রভাবে গীত হতো কৃষ্ণ উপাখ্যানকে বিষয়বস্তু করে। কবিগানের বিবর্তনে ‘ঝুমুর’ গানের প্রভাব ছিল, এতে গবেষকদের কোনও সংশয় নেই। অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত কলকাতার বাবু সমাজে ‘কবি গান’ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। রাম বসু, হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি, মাধব ময়রা, প্রমুখ ছিলেন সেকালের প্রসিদ্ধ কবিয়াল।
এই আলোচনার ক্ষেত্রে, বাংলা গানে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব-পরবর্তী সময়কালকে আধুনিক যুগ বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছি, কারণ তখন থেকেই বাংলা গান আধুনিকতার ছোঁয়া পেলো – যথার্থ অর্থে আধুনিক হতে শুরু করলো। রবীন্দ্রনাথই বাংলা গানের মুক্তিদাতা -এই উচ্চারণে কোন সংশয় নেই। প্রাক-আধুনিক পর্বের বাংলা গানের ধারায় সর্বাধিক উল্লখযোগ্য সংযোজন দাশরথী রায়ের (১৮০৬-১৮৫৮) ‘পাঁচালি গান’। দাশরথী রায়কে ‘পাচালি’র জনক না বলে এ গানের শ্রেষ্ঠ রূপকারই বলা উচিত। দাশরথী রায়ের অনেক আগে থেকেই পল্লী বাংলার এবং উড়িষ্যার বৈষ্ণব সম্প্রদায় এ গান গাইতেন। পরে নব্য বাবু সমাজের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ‘পাঁচালি’ গায়ন রীতি ও সুরে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে, কৃষ্ণ উপাখ্যান থেকে রামায়ণ, মহাভারত ও মঙ্গল কাব্য এ গানের বিষয় বস্তু হয় এবং কীর্তন, আখড়াই, টপ্পা ও কবি গানের কিছু সংমিশ্রণ ঘটে। আধুনিক ‘পাচালি’গানের প্রথম রূপকার ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস। আনুমানিক ১৮২০তে লক্ষ্মীকান্তর মৃত্যু হয়, দাশরথী রায় তখন কিশোর । লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাসের পর শুরু হয় দাশরথী রায়ের পাঁচালির যুগ। প্রাক আধুনিক যুগের আরও এক সঙ্গীত ধারা গোবিন্দ অধিকারীর (১৭৯৯-১৮৬১) ‘যাত্রা গান’।
১৮৫৮তে ‘পাঁচালি’ গানের শ্রেষ্ঠ রূপকার দাশরথী রায়ের মৃত্যু আর তার তিন বছর পরে রবীন্দ্র নাথের জন্ম। রবীন্দ্রনাথের স্পর্শে বাংলা গান আধুনিক হবে, কিন্তু কি ছিল তার আবির্ভাব পূর্ববর্তী বাংলা গান, কেমন ছিলো বাঙালির গান শোনার কান? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার সমাজে নতুন মধ্যশ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল সেই মধ্যশ্রেণীর ‘বাবু কালচার’ বাঙালির রুচি বিকৃতি ঘটিয়েছিল, সে কথা আমরা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বা ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’ গ্রন্থে জেনেছি। তাদের রুচি তখন আদিরসাত্মক ‘কবিগান’, ‘আখড়াই’, ‘হাফ আখড়াই’, ‘ঝুমুর’, ‘তরজা’, ‘পাঁচালি’, ইত্যাদিতে। রবীন্দ্রনাথ যখন বাল্য বয়সে ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ রচনা করছেন, দাদা জ্যোতিরীন্দ্রনাথের গান গাইছেন, শাস্ত্রীয় গায়নের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি প্রতিভা যদুভট্টর কাছে তালিম নিচ্ছেন, বাঙালি সমাজ তখন মেতে আছেন সেই সব নিম্ন রুচির গানে। ‘কীর্তন’, ‘রামপ্রসাদী’, ‘টপ্পা’, দাশরথী রায়ের ‘পাচালি’, এমনকি ‘আখড়াই’ গানের পরিশীলিত কাব্য ভাষা থেকে কলকাতার ‘নব্য বাবু সমাজ’ মেতেছিল নিম্নরুচির গানে তথাপি, বিদ্যাসুন্দর থেকে থিয়েটারের গান – বাংলা গানের এই যে ধারা, তা নিশ্চিত ভাবেই ‘জনপদের গান’, তাই শাস্ত্রীয় গান, যাতে বাংলা গানের শিকড় ছিলনা রবীন্দ্রনাথকে আকর্ষণ করেনি। ‘কবিগান’কে ‘নষ্ট পরমায়ু কবির দলের গান’ বলে আখ্যায়িত করেও বলেছেন – ‘তথাপি এই গান আমাদের সাহিত্য এবং ইতিহাসের একটি অঙ্গ – এবং ইংরাজ রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক’ (সঙ্গীত চিন্তা)।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানের মুক্তি ঘটালেন সত্য – কিন্তু সেই মুক্তির প্রস্তুতিতে আরও একটি সঙ্গীত ধারা সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলেছিল সেটি হলো- ‘থিয়েটারের গান’। কত যে কালজয়ী থিয়েটারের গান বাংলা গানের বৈভব বৃদ্ধি করেছে তা পৃথক আলোচনার বিষয়। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তখন সমাজ সংস্কার, শিল্প-সাহিত্যে-শিক্ষা-সংস্কৃতি - সবেতেই এক অভূতপূর্ব জোয়ার। থিয়েটারে গান হয়ে উঠেছিলো বাঙালির সহজলভ্য বিনোদন সামগ্রী। ১৭৯৫এ রুশ পর্যটক গেরেসিম লেবেডফ কর্তৃক ‘দি ডিসগাইস’ নাটকের অনুবাদ ‘কাল্পনিক সঙ বদল’ নাটকের মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে বাংলা থিয়েটারের সূচনা হয়েছিল, কিন্তু সে থিয়েটারের কোনও ধারাবাহিকতা ছিলনা, কেমন ছিল সে থিয়েটারের গান তাও জানার উপায় নেই। বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হলো আরও ৬৩ বছর, যখন রাম নারায়ণ তর্করত্ন প্রথম অভিনয়োপযোগী বাংলা নাটক ‘কুলিন কূল সর্বস্ব’ লিখলেন। এরপর জমিদার বাড়ির আঙ্গিনার থিয়েটার কলকাতার নব্য অভিজাত শ্রেণীর সবচেয়ে আদরের বিনোদন সামগ্রী। বাঙালির থিয়েটারে বিবর্তন আমার আলোচ্য বিষয় নয়, তবু ছুঁয়ে যেতে হবে বাঙালির গান শোনার কান তৈরী হওয়া এবং বাংলাগানের আধুনিক হয়ে ওঠার প্রস্তুতিপর্বটিকে বোঝার জন্য। ১৮৫৯এ বাংলার নাট্যক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তাঁর প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ অভিনীত হলো ‘বেলগাছিয়া থিয়েটার’এ। এবং শর্মিষ্ঠা নাটকের গীতিকার রূপে বাংলা থিয়েটারে প্রবেশ করলেন মহাকবি গিরীশ চন্দ্র ঘোষ ১৮৬৪তে। তারপর জমিদার বাবুদের আঙ্গিনার বন্দিদশা থেকে বাংলা থিয়েটার মুক্তি পেলো ‘ন্যাশনাল থিয়েটারের’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ১৮৭২এ, থিয়েটার হয়ে গেলো সর্বসাধারণের। গানই ছিলো সেকালের থিয়েটারের প্রাণ, জনপ্রিয়তার সেরা উপাদান। নাটকে একাধিক গান সংযোজিত না হলে সে নাটক দর্শক আনুকুল্য পেতোনা। ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘আলিবাবা’ নাটকে ৩৬টি গান ছিল। নাটকের গানই ক্ষীরোদ প্রসাদকে নাট্যকার রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, ‘ধন ধান্যে পুষ্প ভরা’ সহ দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের প্রায় সব গানই থিয়েটারের গান। বাঙালির গান শোনার কান প্রস্তুত, গানই তার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রাণের জিনিস, সেকথা চতুর ইংরাজ বণিকদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ইতিমধ্যে টমাস আলভা এডিসন তাঁর অত্যাশ্চর্য ‘ফোনোগ্রাফি’ যন্ত্র আবিস্কার করেছেন। একটি মোম নির্মিত চোঙাকৃতির আধারে ধ্বনি মুদ্রণ করে পুনরায় তা শোনার এই যন্ত্রটিই পরিচিত হলো ‘গ্রামোফোন’ বা বাঙালির ‘কলের গান’ নামে। উনিশ শতকের একদম শেষ প্রান্তে এদেশে ‘কলের গান’ চলে এলো, আর কালো গালার চাকতিতে ধ্বনি-মুদ্রিত বাংলা গান সেই যন্ত্রবাহিত হয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের অন্দর মহলে পৌঁছে গেলো, উন্মুক্ত হয়ে গেলো এক নতুনতর বিনোদন সামগ্রীর বিপণন দরজা। গ্রামোফোন কম্পানী বিজ্ঞাপন করতো ‘সুখী গৃহকোণ শোভে গ্রামোফোন’। ১৯০২তে অমরেন্দ্র নাথ দত্তর এমারেল্ড থিয়েটারের দুই নৃত্য-গীত শিল্পী শশিমুখী ও ফণীবালার কন্ঠে গীত দুটি বাংলা গান রেকর্ড করা হলো। শশীমুখীর কন্ঠে ‘সরল মনে সরল প্রাণে’ এবং ফণীবালার কন্ঠে ‘আমি কি কেবলই কুসুমেরই’ – এই দুটি গানই কলের গানের প্রথম ধ্বনি-মুদ্রিকা বা রেকর্ড।
সেই শুরু। বাংলা গানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো, বাংলা গান ‘সেকাল থেকে একালে’ প্রবেশ করলো। বাঙালির জনপদের গান হয়ে গেলো বিপনন সামগ্রী। সে কথা লিখবো আর একটি নিবন্ধে। হয়তো সে নিবন্ধের শিরোনাম হবে ‘গানের একাল – গানের আকাল’।
অসাধারণ এক নিবন্ধ। পুরাণের যুগ থেকে বর্তমান অবধি বিস্তৃত এই চর্চায় ঋদ্ধ হলাম।
ReplyDeleteস্বল্প পরিধিতে বিস্তৃত আলোচনা। ভাল লাগলো পড়ে।
ReplyDelete