undefined
undefined
undefined
প্রবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
ইতি নাসিকা সংবাদ
দীপারুণ ভট্টাচার্য
"তেজ পাতে তেজ কেন? ঝাল কেন লঙ্কায়?
নাক কেন ডাকে আর পিলে কেন চমকায়?"
সুকুমার বাবু এই সব্বনেশে প্রশ্নটি তুলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত নোটবুকে। কিন্তু ধরুন সত্যি সত্যিই কারুর বুক যদি কেঁপে ওঠে! প্রিয় মানুষের সঙ্গে শুয়ে ঘুমের মধ্যে, যদি চমকে ওঠে পিলে! তবে নিশ্চিন্তে মেনে নিন নাসিকা গর্জনই এর একমাত্র কারণ।
ছোটবেলায় বাপ-ঠাকুরদা'র কাছে শুনেছি স্বাধীনতা সংগ্রামে মহান বিপ্লবীরা তরুণদের 'ডাক' দিয়েছিলেন, স্নেহময়ী মা তার আলাভোলা খোকন সোনাকে ঘুম পাড়াতে চাঁদ-কে ডাকেন "আয় আয় চাঁদমামা টি দিয়ে যা", এ সবই কিন্তু প্রাণের ডাক। আর ধ্বনিগম্ভীর ও বহুবিধ সুরের বাহারে,স্ফীত উদরের থরথর কম্পনে, গুম্ফের শাস্ত্রীয় নৃত্য সহযোগে রাত্রিকালীন যে ডাক শয্যায় পরিবেশিত হয় সে ডাকের ভার যে কতখানি তা এই বড়বেলায় বুঝলাম। আর এও জানলাম যে এইসব ডাকের সব বিচিত্র ভাষার শব্দ বা ধাতুরূপের সন্ধান অন্তত ভারতীয় শব্দ ভাণ্ডার দিতে পারবে না। অভিজ্ঞতা থেকে দু একটি উদাহরণ পেশ করতে পারি - ফোঁ রররররর্ ফোঁৎ, ঘ্রররর ঘ্রিসসস, ভ্রুসসসস ইত্যাদি।
এমন কোন শব্দ ও তার অর্থ এই মায়াময় সংসারে যদি কারুর জানা থাকে তাহলে এই অধমকে অবগত করিয়ে কৃতার্থ করবেন।
এখন প্রশ্ন হলো নাক কেন ডাকে? এ বিষয়ে ডাক্তার বাবুরা অনেক গম্ভীর আলোচনা করতে পারেন ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু আমিতো আর ডাক্তার নই তাই দুই লাইনেই পেশ করছি -
"এই ডাকেতে সাহস ভরে যদিবা দাও সাড়া,
কাটবে প্রহর বিরক্তিতে এবং নিদ্রা হারা।"
ভুক্তভোগীরা বিলক্ষণ জানেন যে বিষয়টি হাসি মজার মতো হালকা নয় আদৌ। বহু দাম্পত্য কলহের ঊষা লগ্নের পাঞ্চজন্য বাজিয়েছে ওই নাসিকা গর্জন। এই উপমহাদেশে নেহাত এখনও নারীদের ভিতর ততটা বিদ্রোহী সত্তার জন্ম নেয়নি। তাই এখনও বহু দাম্পত্য টিকে আছে। নাহলে এখানেও পশ্চিমি দুনিয়ার মত সংসার ভাঙার শব্দ নাকের গর্জনকে ছাড়িয়ে যেত। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও বিষয়টা সত্যি। স্বামী ও স্ত্রীর মাঝখানে যখন নাক তার ডাক (পড়ুন গর্জন) পেশের মাধ্যমে, নাক গলিয়ে ফেলে তখন ওঠে পরিত্রাহি রব। শুনেছি সয়ং চার্লি চ্যাপলিন সাহেবেরও একটা বিয়ে শুধু মাত্র নাসিকা গর্জনের কারনেই ভেঙেছিলো। ওদের না হয় অনেক অনেক আছে। একটা আধটা ভেঙেগেলে কি বা আসে যায়! ঠিকই বলছি চার্লি সাহেব হাতের পাঁচ আঙুলের মতোই পাঁচটি বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু আমাদের তো সবে ধন নীলমণি! সেটাও যদি ভেঙে যায়….হায় হায়….!
হ্যাঁ, আমাদের দেশের অনেক নারীদের কিন্তু শোক করা ছাড়া বিশেষ কিছু করার থাকেনা। রাম কুমার চট্টোপাধ্যায় এর একখানা গান মনে পড়ছে, সেখানে একজন নারী তার বান্ধবীদের বলছেন তার স্বামীর সম্পর্কে;
"স্বামী নয় ধুমের খণি, নাক ডাকে ঘুমের ঘোরে।
বাপ-মা যখন পাত্র দেখে, দেখেনি ঘুম পাড়িয়ে তাকে।।"
কিন্তু আজ সময় বদলেছে। বদলেছে এযুগের নারীর মন। তারা কেন মুখ বুজে সইবেন রাতভর স্বামীর নাসিকা বাণ! একথা অবশ্য একেবারেই ভুল যে নাক ডাকা পুরুষদের জন্মগত অধিকার। অনেক মহিলাও এ গুনের অধিকারিণী। তবে সে সংখ্যাকে নগন্যই বলা যায়। তাই পুরুষের নাক ডাকাকে ঘিরেই সাধারণত খিটিমিটির ঢেউ লাগে সংসার সংগ্রামে।
যেমন ধরুন না কেন, আমার প্রিয় বন্ধু, জনপ্রিয় নাগের কথাটা। প্রায় আট বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর বান্ধবী নাকচাবি দে'কেই সে বিয়ে করে। সে অবশ্য বেশ কিছুদিন আগের কথা। সম্প্রতি এক ডাক্তার বাবুর প্রেস্ক্রিপশন নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে জনপ্রিয় এসেছিলো আমার কাছে। তখনই এবিষয়ে আমি বিশদে জানতে পেরেছি। ধর্মত বলছি কারোর আপন জীবনে নাক গলানো বা কান পেতে শোনা আমার রক্তে নেই। আমি নিতান্তই নিরীহ টাইপ।
বেড়ালটা আসলে বেরিয়েছিল ফুলশয্যার পরের রাতেই। জনপ্রিয় ঘুমাচ্ছে অথচ নাকচাবি নিদ্রাহীন। তাই যা হওয়ার তাই হলো, রাম ধাক্কা….
- কি হলো, এত বিচ্ছিরি ভাবে নাক ডাকছো কেন?
এ প্রশ্নের কোনো উত্তর হয়না। তাই জনপ্রিয় জড়ান গলায় বলল, বেশি হয়ে গেছে বুঝি?
প্রশ্নের উত্তরে মহিলারা যদি প্রশ্নই ফিরে পান তবে তাদের ভিতরের বাঘিনী জেগে ওঠে। এ আমি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে পারি। হলোও তাই। নাকচাবি গলা চড়িয়ে বলল, বেশি মানে, আমি তিন ঘন্টা ধরে জেগে আছি। এখন রাত দুটো বাজে।
- তোমার কষ্ট হচ্ছে? আমি কি করবো বলতো!
- এত দিনতো বলোনি যে তুমি এমন বিচ্ছিরি ভাবে নাক ডাকো?
- আমিওতো আজই জানলাম!
- সব তোমার বদমাইশি! তুমি জানতে না? ন্যাকামি হচ্ছে!
- আমি জানতাম একটু আধটু…..
- বাজে বোকোনা। এমন জানলে কোন দুঃখে…
- তোমার বাবাও তো নাক ডাকে না কি?
- তোমার মতো নয়। আর তাছাড়া আমি ছোট বেলা থেকেই আলাদা ঘরে শুই।
- ইশ বিয়ের আগে যদি একটু অভ্যাস করে আসতে!
- যাও সোফায় গিয়ে শোও….
সে রাতের পর, জনপ্রিয়ের তাই হলো যা অন্যদেরও হয়ে থাকে। "আমি না ঘুমানো পর্যন্ত তুমি ঘুমাতে পারবে না"। অগত্যা শ্রী হরি।
এই ঘটনার মাস দুই পরে এক পারিবারিক ভ্রমণে জনপ্রিয়-নাকচাবি গেল জিম করবেট জঙ্গলে। জঙ্গলের মধ্যেই রাত্রি বাস। পাশাপাশি ঘর। এক ঘরে জনপ্রিয়-নাকচাবি অন্য ঘরে তার দাদা, বৌদি আর ছয় বছরের ভাইপো, পিংলু। সে বেচারি সারা দিন বাঘের গল্প শুনে শুনে ক্লান্ত। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে জেগে উঠলো স্বভয়ে। প্রাণপণে মাকে জড়িয়ে ধরলো, মা, বাঘ এসে পড়েছে, আমাকে বাঁচাও। ছেলের মাথায় নরম হাত বুলিয়ে মা বললেন, ঘুমিয়ে পড়ো সোনা, বাঘ নয়, ওটা তোমার কাকামনি। এর পরই দরজায় টোকা দিলো দাদা, 'জনো, পাশ ফের….।'
নাকচাবি তখনও কিছু বলেনি। ব্যাপারটা সীমা ছাড়াল ফেরার ট্রেনে। রাতের অন্ধকারে স্বশব্দে ছুটে চলেছে ট্রেন। সবাই নিদ্রা মগ্ন। হঠাৎ একটা চিৎকারে নাকচাবি'র ঘুম ভাঙলো। শুনলো একজন সহ যাত্রী বলছেন, "ঘাড় ধরে নামা ব্যাটাকে! নাক কেটে হাতে ধরিয়ে দে। অসভ্য ইতর ছোটলো…" মেয়েরা সব পারে কিন্তু স্বামীর অপমান সইতে পারেনা। বাড়ি ফিরেই হুকুম হলো, যে করেই হোক নাসিকা গর্জনের ইতি চাই, চাই, চাই।
অগত্যা জনপ্রিয় ছুটলো নাক-কান-গলার এক ডাক্তার বাবুর কাছে। সব শুনে তিনি স্বযত্নে বোঝালেন নাক ডাকার কারণ ও ফলাফল। বললেন,…..
নাক ডাকার মূল কারণ হলো ঘুমোনর সময় নিঃশ্বাসের সমস্যা। ঘুমের মধ্যে প্রশ্বাস এবং নিঃশ্বাস বারবার ব্যহত হলেই মানুষ নাক ডাকে। আসলে শব্দটির উৎস নাক ও গলার সংযোগ স্থল। ঐ অংশে আমাদের কিছু 'সফ্ট টিস্যু' ও পেশি থাকে। ঘুমের সময় গলার ওই পেশির সংকোচন প্রসারণ হয়। তার ফলে যদি গলার ভিতরের শ্বাসনালির পথ বারবার বন্ধ হয় এবং খোলে তখনই নাক থেকে শব্দ বের হয়। নাক ডাকার ফলে শরীরের উপরে চাপ সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে হৃদরোগের কারণ হতে পারে। তাই নাক ডাকাকে দীর্ঘদিন অবহেলা করা উচিত নয়।
দীর্ঘ দিন অবহেলা করলে, এর থেকে হতে পারে sleep apnea, যা খুবই মারাত্মক। যারা নাক ডাকে তাদের সবারই যে এই রোগ হবেই এমন নয়। তবে এই রোগে আক্রান্ত মানুষদের ঘুমের মধ্যে মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় ৪৬% বেড়ে যায়। এমন মানুষও আছেন যারা ৬ ঘন্টার ঘুমের মধ্যে প্রায় ২৫০০-৩০০০ বার নাক ডাকেন। পলিসমনোগ্রাফি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করতে হয় সত্যি sleep apnea হয়েছে কিনা। যদি তা হয় তবে একটি যন্ত্র এখন বেরিয়েছে যেটি নাকে লাগিয়ে শুলে, সমস্যা অনেক অংশেই কমে যায়।
এসব বলার পর ডাক্তার বাবু বললেন, এখুনি অত চিন্তা করার কিছু নেই। আগে লাইফ স্টাইলে কিছু পরিবর্তন করুন। আমি লিখে দিচ্ছি। তাতে যদি কিছু না হয় তাহলে মাস ছয় বাদে আসুন। তখন দেখবো কি করা যায়।
ডাক্তার বাবুর প্রেস্ক্রিপশন নিয়ে সেদিন সে বাড়ি ফেরে। কিন্তু ডাক্তারদের হাতের লেখা বোঝা কি এতোই সহজ। কাজেই বন্ধুটিকে আসতেই হলো একজন ডাক্তারি হস্ত লেখা বিশারদ, মানে আমার কাছে। অনেক পড়ে ও ভেবে চিন্তে ডাক্তার বাবুর প্রেস্ক্রিপশনের একটা বাংলা তর্জমা করেছিলাম সেদিন। আমার বন্ধু সেটা কতটা পালন করেছে ঠিক জানিনা। তবে জনপ্রিয়-নাকচাবি এখন আগের চেয়ে যে বেশ আমোদেই আছে; এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। সত্যি, দেখলেও ভালো লাগে।
শুয়ে পড়ে কাত হয়ে যাও
কমিয়ে ফেলো ওজন,
অনেক খানি জল পান আর
রাতে হালকা ভোজন।
ভোজন শেষে বিছানা বালিশ
নয় গো তাড়াতাড়ি,
শান্ত মাথায় এদিক ওদিক
হোকনা পায়চারি।
বদ নেশাটা হোকনা বিদায়
বিড়ি সিগারেট খরচা,
নিয়ম করে হোকনা শুরু
হালকা শরীর চর্চা।
বালিশ খানা উঁচুই ভালো
হোক সে নরম তুলো,
নিয়ম করে সাফাই করো
নাসারন্ধ্র গুলো।
হিসাব করে ঠিক করে নাও
ঘুমের সময় খানা,
নাক ডাকাটা কমবে তবেই
ওমনি ওষুধ বিনা।
এদিকে আমার হয়েছে অন্য জ্বালা। অফিসের কাজে মাঝে মধ্যে বাইরে যেতে হয় আমায়। বৌ বলে আমি না থাকলে তার নাকি ঘুমই হয় না। কেন? আমার নাক ডাকার তালে তালেই সে তার ঘুম গভীর করতে শিখেছে।
বোঝো কাণ্ড।
এখন ভাবছি বৌকে একটা কানের ডাক্তার দেখাবো কিনা!
0 comments: