2

বইঘর - চয়ন

Posted in

বইঘর


বইঘরে অবলোকন 
চয়ন


নমস্কার। বইঘর থেকে কথা বলছি অবলোকন পাত্র। আজ আমার ডাকে সাড়া দিয়ে যে দুজন এখানে এসেছেন তাঁদের পায়ের ধুলোয় বইঘর ধন্য। আসুন পরিচয় করিয়ে দিই। আমার ডানপাশে যিনি আছেন গত দুশো বছরের মধ্যে পৃথিবীতে এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি যার সঙ্গে তাঁর কোনও না কোনও যোগ নেই। এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে তিনি যাননি। দীর্ঘ শীর্ণ দেহ ,চাড়া দেওয়া গোঁফ; স্থান কালের অধীনতা অস্বীকারকারী একামেবাদ্বিতীয়ম্ ঘনশ্যাম দাস। আমার বাঁ পাশে বসে থাকা এই প্রবীণ মানুষটিকেও আপনারা সবাই চেনেন। মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে, দাড়ি গোঁফ আছে , চোখে একজোড়া সোনার চশমা। প্রশস্ত ললাটের অধিকারী, শান্ত, সংযত, ঋষিপ্রতিম, ঊনসত্তরটি ভাষায় সাবলীল জ্ঞানের যে কোনও মার্গে অবাধ বিচরণশীল, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, কালজয়ী, অমর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। আজ প্রফেসর শঙ্কুর সঙ্গে কথা বলবেন শ্রীদাস। আমার কাজ দোহারের। 

অবলোকন : ঘনাদা, আপনার মুখে আপনার পেটেন্ট বাঁকা হাসি। কারণ, আমি অবশ্যই জানি। কিন্তু,বলব না। আপনি কথা আরম্ভ করুন।

দাস : প্রফেসর শঙ্কু, প্রণাম। 

শঙ্কু : কীর্তিমান হও ঘনশ্যাম। বল কী জানতে চাও। 

দাস : আচ্ছা, প্রোটোভিট্রোমর্ফিজেনেরাস সলিউশন, ট্যানট্রাম বোরোপ্যাক্সিনেট, একুইয়স্ ভেলোসিলিকা এগুলো কী জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ প্রফেসর? একটু যদি ফর্মূলাটা বলে দেন। 

শঙ্কু : তোমাদের কেতাবী বিজ্ঞানে এর হদিশ পাবে না। এ শুধু পৃথিবীর একটি মানুষই বানাতে পারে। আর সেরকম মানুষ পৃথিবীতে একটিই আছে। তার নাম...

দাস : ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। জানি তো। ব্যাঙের ছাতা, কচ্ছপের ডিমের খোল, আর সাপের খোলস মেশানো কম্পাউণ্ড, গলদা চিংড়ির গোঁফ দিয়ে তৈরী মিরাকিউরল... সত্যিই একজনই বানাতে পারে! পরে অবশ্য বলেছেন স্বর্ণপর্ণী দিয়ে বানিয়েছিলেন এই ওষুধ। তার মানে হয় হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের আদল আর নয়তো স্রেফ ভাগ্য! বিজ্ঞানের সব শাখায় আপনার অবাধ বিচরণ কিন্তু আপনি ঘোষণা করেন যে, 'কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকেই আমি সম্পূর্ণ মানুষের সৃষ্টি বলে মনে করতে পারি না।' বিরাট ফাঁক রয়ে গেল যে একটা! 

শঙ্কু : কী ফাঁক ঘনশ্যাম? 

দাস : সেই ফাঁক যার মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানের সঙ্গে মিশে যায় ভূত, প্রেত, টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ারভয়েন্স। বটুকেশ্বরের তন্ত্রসামগ্রী আর নিওস্পেকট্রোস্কোপ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ হয়ে যোগসাধনা আর বিজ্ঞানকে এক করে তোলে। আপনার পোলার রিপলেয়ন থিওরি আর ভূতপ্রেতের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণামূলক বইয়ের মধ্যে কোনও ফারাক থাকে না। সামূহিক কল্প বিশ্বাসের শক্তি আর বিজ্ঞানের শক্তি মিলে মিশে একাকার হয়ে এক ডুলুং ডো গড়ে তোলে যেখানে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র আর ক্রাগের মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার, অমঙ্গলকারী গ্রহরাজ শনি আর আর গ্রোপিয়াস, অ্যালকেমি আর বিজ্ঞানসাধনা সবই একই অঙ্গে লীন!

অবলোকন : আপনি উত্তর দেওয়ার আগে একটা কথা বলে নিই প্রফেসর। ঘনাদার তথ্যনিষ্ঠা কিংবদন্তিপ্রতিম। সম্পূর্ণ কাল্পনিক বা অস্তিত্বহীন কোনওকিছুকেই তিনি তাঁর বিশ্বে প্রবেশাধিকার দেন না।

শঙ্কু : জানি অবলোকন। আমি তোমায় শ্রদ্ধা করি ঘনশ্যাম। কিন্তু, তুমি আর আমি একেবারে দুরকম চোখে বিশ্ব দেখি। বিজ্ঞানকে আমি পুরোপুরি মানুষের সৃষ্টি বলি না কেন সে তুমি জান অবলোকন। অনন্ত সম্ভাবনা, অনন্ত মহাবিশ্ব। কখন, কোন সম্ভাবনা বাস্তবরূপ নেবে সেটা একা মানুষ নিয়ন্ত্রণ করবে কী ভাবে? মানুষের চেয়ে অনেক বড় একটা শক্তির অস্তিত্ব আমি মানি ঘনশ্যাম। সে শক্তি বিশ্ব প্রকৃতির অণু পরমাণুতে। আমার উত্তরাধিকারই আমায় ত্রিলোকেশ্বর নাম দিয়েছে। আমি বিষ্ণু, শিব বা সূর্য কোনওটাই না। তবু, আমি তিমিরাতীত জ্যোতিকে দেখি। দেখি অসংখ্য কিশোর কিশোরীর হাসি ভরা মুখের মধ্যে। হ্যাঁ, তুমিও তাই দেখ আমি জানি। তবে আমাদের মৌলিক পার্থক্য হলো আমি মানবকেন্দ্রিক বিজ্ঞানের গা জোয়ারিটা মানতে পারি না। কোটি কোটি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস বা বিস্ময়বোধ, অজানা রহস্যের প্রতি টান, প্রাচ্য পাশ্চাত্য ছাড়ানো সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের আনন্দ আমি ওদের মধ্যে চারিয়ে দিতে চেয়েছি। ধন্য অ্যালকেমি যার থেকে কেমিস্ট্রি শব্দটা এসেছে। ধন্য হারুণ অল্ রশিদের বাগদাদ। ধন্য সুমেরীয় সভ্যতা। ধন্য তাজমহল,ধন্য পার্থেনন। ধন্য ধন্য মানি আমি এই সবকে। আলতামিরার বাইসন যে আঁকে সে অমর ঘনশ্যাম। সেই মানবের আত্মা। তাই সে অমর গুহামানব। যুগ যুগ ধরে জ্ঞান সঞ্চয় করে চলে। এ সেই জ্ঞান যা বোঝে আজও বিজ্ঞান জানে না অন্ন বস্ত্র বাসস্থান জনিত সমস্যা দূরের উপায়, স্মৃতির রহস্য, মৃত্যুর পরের অবস্থা। যন্ত্র যে সভ্যতার প্রভু হতে চলেছে সেই জড়বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত বিশ্বকে প্রশ্ন করে মহাকাশের দূত, কম্পু। আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রাণিত করতে চাই যারা আমার কথা শোনে তাদের।

অবলোকন : ঘনাদা, প্রফেসর মনে হচ্ছে বিজ্ঞান আর ক্ষমতার সমীকরণের কথা বলছেন। সেই পুঁজির উদ্ভবের সময় থেকে আমি দেখে আসছি কেমন করে তা বিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করে। উপনিবেশ যখন গড়ে উঠছে সেই তখন থেকে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষমতা কায়েম রাখার জন্য। ব্যারাকপুরে ইংরেজ সৈন্যরা অজানা জ্বরে মরছে যখন তখনই রোলাণ্ড রস্ কলকাতায় মশা নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করছেন এ আমার নিজের চোখে দেখা। ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরীই হয়েছে উপনিবেশের রক্ষীদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য। বিজ্ঞানের পশ্চিমমুখীনতা, তাকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার যে প্রবণতা তার একটা বিরোধিতা তৈরী হওয়ার দরকার নেই কি?

দাস : একশবার আছে অবলোকন। তুমি দেখেছ কীভাবে এই বিরোধিতা বারবার আমি নিজে করেছি। তাই আমি অবাক হয়ে প্রফেসরের কথা শুনছিলাম! বিজ্ঞান আর ক্ষমতার যৌগপত্যের কথা কে বলছেন না যিনি স্নাফ্ গানের প্রয়োগ প্রথম করেন চাকর প্রহ্লাদের ওপর! মেনে নিচ্ছি উনি আর আমি একই রকম নারী বর্জিত বিশ্বে বাস করি। সাধারণ মানুষ আর চাকর বাকর বেষ্টিত সে দুনিয়া। কিন্তু, অবলোকন, শিবু, গৌর, শিশির, সুধীর, রামভুজ, বানোয়ারী আর আমার মধ্যে আদতে কোনও তফাৎ আছে কি? আমার নামের সঙ্গে জোড়া দাদা বা বড়াবাবু শব্দদুটো স্রেফ আদরের ডাক। আর ওদিকে? সাধারণ মানুষের প্রতি কী নিঃসীম অবজ্ঞা। অবিনাশবাবুকে উনি নগন্য মানুষ বলেন, খোকার পোস্ট অফিসের কেরানি বাবা ওঁকে 'বাবু' বলেন, প্রহ্লাদ আর ওঁরা এঁর কাছে প্রায় এক। পশ্চিমি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে দহরম মহরমে বারবার যে ক্ষমতার গরিমা প্রকাশ পায় সেটা দেখে আমার ওঁকে বলতে ইচ্ছে করে, আমার দেশের নাম মানুষের দুনিয়া। হটেনটট, হাউসা মোড়ল, পেত্রা, তানাকা সবাই এক সেখানে। আপনার জগৎ তার মধ্যে নেই বোয়ানা। সেই 'জল'এর অভিযানের সময় যেমন বলেছিলাম ফিংককে। 

শঙ্কু : একটু বেশি কঠোর হচ্ছ না ঘনশ্যাম? তুমি ভুলে যাচ্ছ আফ্রিকা আর স্বপ্নদ্বীপে অবিনাশবাবু কী ভাবে আমার প্রাণ বাঁচান? নকুড়বাবুর কথা ভুলে যাচ্ছ? এঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা মনে নেই তোমার? একবার ভাব তো লাল খাতায় অবিনাশবাবু নিজের ভাষায় কথা বলে কেমন ভাবে আমার বয়ানের ওপর ওঁর স্বাক্ষর রেখেছেন স্বপ্নদ্বীপে? গরিলার হাত থেকে আমায় উদ্ধার করার ঘটনাটার সবটাই ওঁর গলায় শোনা যায়। প্রহ্লাদের প্রতি আমার মনোভাব একটা বিশেষ শ্রেণী চরিত্র প্রসূত ঠিকই। তার জন্য আমি গর্বিতও নই। কিন্তু, ঘনশ্যাম, ও আর নিউটন ছাড়া আসলে যে আমার কেউ নেই সেটাও তো ঠিক? খুব প্রভুত্বকামী মনে হচ্ছে কি আমাকে? খুব অমানবিক? 

দাস : ক্ষমা করবেন। আমি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। তবুও, আমার মূল আপত্তিটা থেকেই যাচ্ছে। কঙ্গো অভিযানে আপনি কিন্তু নিজে বলছেন যে স্ট্যানলি, ম্যাঙ্গোপার্ক, লিভিংস্টোনের পথে চলেছেন আপনি। কিগানি ক্যানিবলদের দেখছেন জিম ম্যাহনির চোখে মানে সাদারা যা বারবার বলে এসেছে আঁধার মহাদেশ সম্পর্কে সেই চোখে। বলছেন যে দুহাজার মাইল বিস্তৃত ট্রপিকাল রেইন ফরেস্টের অনেক অংশেই 'সভ্য' মানুষের পা পড়েনি এখনও। কিং সলোমনস্ মাইনস্, ব্যালান্টাইন, বয়েজ্ ঔন্ পেপারের গন্ধটা যে বড় প্রকট প্রফেসর শঙ্কু! মানবপ্রেমী ত্রিলোকেশ্বরের বিশ্ববীক্ষণ আর ঊনবিংশ শতকের ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গী এক? কাহিন্দিরা ভাঙা ইংরিজি না শিখলে সভ্য হবে না? শুধু ম্যাকফারসনরা গীতাঞ্জলি পড়লেই প্রাচ্য প্রতীচ্য মিলন সম্পূর্ণ? 

অবলোকন : প্রফেসর মুখ নামিয়েছেন। লজ্জা পাবেন না প্রফেসর শঙ্কু। আসলে আপনারা দুই অমর একে অপরের পরিপূরক। আপনার কথা শুনে জন্মানো বিস্ময় বোধ নিয়ে ঘনাদার বিশ্বে যে পা রাখবে সে অক্লেশে বুঝবে জীবন পরস্পর বিরোধিতাতেই গড়া। ঘনাদা, আপনার আর প্রফেসরের সম্মিলিত স্বর শুনেই সে বুঝতে শিখবে যে আপনারা যে ভুবন গড়েন তার প্রেরণা 'শুধু অবসর বিনোদন নয়, মানসিক বিলাস নয়।' এর চালিকাশক্তি হলো 'সামনে ও পেছনের এই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে দুর্জ্ঞেয় পণ্যময় জীবনের কথা জীবনের ভাষায় বলার বিরাট, বিপুল এক দায়।' ১৯৪৪এ এই কথা আমায় বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। আপনাদের দুজনকে অসংখ্য ধন্যবাদ বইঘরে আসার জন্য।

2 comments:

  1. অবলোকনকে শতকোটি প্রণাম।

    ReplyDelete
  2. অবলোকনের অভিবাদন।

    ReplyDelete