ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক৬
পরের দিন রাত্তিরে দশটা নাগাদ একটা গুজব কানাঘুষোয় গোটা আশ্রমে ছড়িয়ে পড়ল। রাত আটটা থেকে ন'টার মধ্যে যখন ফার্স্ট ব্যচ খেতে বসেছে, ঘরগুলো খালি, তখন কে বা কারা রণজিৎদার ঘরের জানলা দিয়ে ওঁর বিছানায় কোন কড়া অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছে। বিছানার চাদর ফুটো ফুটো, ভাঁজকরা লেপে পুড়ে তুলো বেরিয়ে পরেছে। হ্যাঙারে ঝোলানো দুটো টেরিলিনের শার্ট-- সেগুলোও গেছে।
রণজিৎদা প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত।
--ওরা আমাকে মারতেই চেয়েছিল। ভাগ্যিস খেতে গিয়েছিলাম। ঠাকুর রক্ষে করেছেন।
দু’দিন পরে সোমবার। স্কুল শুরু হবে সকাল আটটায়, কারণ গরম বেড়ে গেছে। এইভাবে দু' সপ্তাহ চলবে, তারপর ছুটি।
মিটিংয়ে ঠিক হল আমরা পালা করে ক্লাস বাংক করব। প্রথম দিন বিপ্লব ও প্রশান্তের সায়েন্স এর প্র্যাকটিক্যাল আছে, ধরা পরে যাবে। ফলে প্রথম দু'দিন আমি আর গুরু। পরের দু'দিন ওরা।
সেইভাবে তৈরি হলাম। চৌকির নীচে খালি জায়গাটা জল দিয়ে মুছে সতরঞ্চি পেতে দুজনের বালিশ ফিট করা হল। তক্তপোষের ওপরে টানটান বিছানা। একটা ডবল সাইজের চাদর মেজে অব্দি ঝোলানো, যাতে কারও চোখ চৌকির নীচে না যায়।
এই প্ল্যানের কথা মানস জানে না। ও যে মেজমহারাজের স্পাই। ও বেরিয়ে গেলে বিপ্লব ও প্রশান্ত বাইরে থেকে দরজায় তালা মেরে চাবি নিয়ে চলে গেল। তাতে কি! আমি দরজার কড়ার একটার নাট ঘরের ভেতর থেকে সাঁড়াশি দিয়ে আলগা করে আবার হালকা করে লাগিয়ে দিয়েছি। বাথরুম পেলে হাত দিয়েই নাট খুলে নেব, তালাশুদ্ধ জোড়া কড়া আলগা হয়ে যাবে। ফিরে এসে আবার ভেতর থেকে নাট লাগিয়ে নেব। বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগানো-- কোন কথা হবে না।
এমন চমৎকার প্ল্যান! কিন্তু এবার ভগবান আমার সঙ্গে নেই।
খানিকক্ষণ নীচু স্বরে গল্প করতে করতে দুজনেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। গাঢ় ঘুমে তখন একটা হেরে যাওয়া টেনিস বলের পুরনো ম্যাচ রি-ওয়াইন্ড করে আবার স্বপ্নে দেখছি--এবার হয়ত জিতে যাব।
এমন সময় ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘরের মধ্যে কারা যেন চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, নীচু গলায় কথা বলছে। কিস্যু মাথায় ঢুকছে না।
ধরা পড়ে গেলাম? কেউ বেইমানি করেছে? কোন শালা!
চাদরের তলা দিয়ে ফ্লোর লেভেল থেকে চোখ রেখে যা দেখলাম তাতে আমার ভয়ের চোটে হাত-পা পেটের ভেতরে!
ঘরের মধ্যে তিনজন হাঁটাচলা করছে ও নীচু গলায় পরামর্শ করছে।
একজন রণজিৎদা ওয়ার্ডেন, আর একজন চামচা মানস, ও নির্ঘাৎ ঘরের চাবি বিপ্লবদের থেকে চেয়ে এনেছে। কিন্তু তৃতীয়্জন? আমাদের কেমিস্ট্রির হেড-- সুনন্দ স্যার।
অমন কড়া কেমিস্ট্রির এইচ ও ডি সুনন্দ স্যার, রোজ সন্ধ্যেবেলা নিয়ম করে আশ্রমের গেটের উল্টোদিকে শুকতারা সিনেমার পাশে ওঁর বন্ধুর ইলেকট্রিক গুডস্ এর দোকানে বসে আড্ডা মারেন। কিন্তু ক্লাসে উনি টেরর। ওঁর সেট ডায়লগ—ওরে, দিনের বেলায় আকাশে তারা দেখিয়ে ছাড়ব!
তা উনি স্কুল ছেড়ে চুপিচুপি আমাদের ঘরে! কেসটা কী?
ধরাপড়ার ভয়ের থেকেও কৌতুহল বেশি। নাকটা বাড়ালাম। না, ওঁরা কিছুই টের পার নি। আর মানস দালাল হলেও আসলে একটি ঢেঁড়স।
দেখি, রণজিৎদা কোথা থেকে একটা মাস্টার কী জোগাড় করেছেন। তাই দিয়ে কাঠের র্যাকের উপরে রাখা আমাদের চারজনের ট্রাংক একে একে খুলছেন আর মানসকে জিগ্যেস করছেন কোনটা কার ট্রাঙ্ক। যা বুঝলাম, গুরুর ট্রাংক সার্চ করা হয়ে গেছে। এবার আমার পালা। জামাকাপড় হাটকে একটা পানামা সিগ্রেটের প্যাকেট বেরল।
এবার আমার ফাঁসি হবে। কিন্তু কোনভাবে যদি বেঁচে ফিরি তো মানসকে দেখে নেব।
মনে পড়ল গার্লস স্কুলে পড়ার সময় ক্লাস থ্রি তে হাতের লেখা লিখতে হত। রেখা বলে মেয়েটি লিখেছিল --পাপের বেতন মৃত্যু। কথাটা এখন মনে পড়ে গেল।
কিন্তু সিগ্রেটের প্যাকেটের মত মারাত্মক কন্ট্রাব্যান্ড পেয়েও সার্চ পার্টির কোন হেলদোল নেই। ওরা এর ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ছেন। তবে কি ওঁরা অন্য কিছু খুঁজছেন? কী সেটা?
বিপ্লবের ট্রাংক খুলতেই --ইউরেকা! রণজিৎদা ও মানসের মুখে একগাল হাসি। কোণা থেকে বেরল খবরের কাগজ দিয়ে মুড়ে রাখা একটা বীকার। তাতে টলটল করছে একটা তরল পদার্থ।
অ্যাসিড! সেরেছে। তবে কি বিপ্লবই রণজিৎ দার বিছানায় অ্যাসিড ঢেলেছে? কী করি! কীভাবে ওদের খবর পাঠাই? গুরুকে ঘুম থেকে তুলতে গেলে সার্চ পার্টি টের পেয়ে যাবে।
পোদো , তুই এখন মহাভারতের সঞ্জয় হয়ে যা। অর্জুন হওয়া তোর কপালে নেই।
এবার রণজিৎদা তুলে ধরল একটা পুরনো নোংরা ঘরমোছার ন্যাকড়া গোছের একটা টুকরো কাপড়। সুনন্দস্যার সন্তর্পণে বীকার থেকে একটু অ্যাসিড ঢাললেন। নাঃ, কোন ধোঁয়া নয়, কিছু নয়। বীকারের দশফোঁটা অ্যাসিড ওই ন্যাকড়া বেমালুম হজম করে নিল।
সুনন্দস্যার মুখ বেঁকালেন।--এটা নয়।
এরপর প্রশান্তর ট্রাংক। ওর ট্রাংক থেকেও ওইরকম একটা বীকার বেরল। সেটার থেকেও দশফোঁটা ওই কাপড়ে ঢালা হলে স্যার মাথা নেড়ে বললেন-- নাঃ। এগুলো একটাও নয়।
ক্রুদ্ধ হতাশ রণজিৎদা এবার ওই কাপড়টার কোণা দুহাতে ধরে মারলেন একটা হ্যাঁচকা টান। ফ্যাঁস করে শব্দ হল। একটা কানি ছিঁড়ে আলগা হয়ে রণজিৎদার হাত থেকে ঝুলতে লাগল।
উল্লসিত রণজিৎ দা বললেন-- দেখলেন স্যার? এরাই আসল কালপ্রিট।
স্যারের গলায় তাচ্ছিল্যের সুর।
--না ভাই রণজিৎ; ওটা আপনি জোর লাগিয়ে টেনে ছিঁড়লেন, পচা কাপড়। আপনার বিছানায় জামাকাপড়ে ঢালা হয়েছে সালফিউরিক অ্যাসিড। সম্ভবতঃ যেগুলো পায়খানা সাফ করতে কাজে আসে। আর এগুলো হল হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড। এতে অমন করে লেপে ফুটো হয় না।
রণজিৎদা ভাঙবেন তবু মচকাবেন না।
--স্যার, এরা ল্যাব থেকে অ্যাসিড চুরি করে লুকিয়ে রেখেছে। কেন? হয়ত ওই সালফিউরিক অ্যাসিড ওরাই এনেছে, কিন্তু অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। ভাল করে জেরা করলেই জানা যাবে।
সন্ধ্যেবেলা পুরো ক্লাস টেন এর প্যারেড নিলেন বড় মহারাজ।
--এসব কী শুরু হয়েছে? তোরা ভেবেছিসটা কী? সাপের পাঁচ পা দেখেছিস! ওয়ার্ডেনের বিছানায় জামাকাপড়ে অ্যাসিড ঢেকে দেওয়া? ল্যাব থেকে অ্যাসিড চুরি করে আনা! তোরা কী চাস? আর বিপ্লব ও প্রশান্ত, সত্যি কথাটা বলে ফেল। কে অমন নোংরা কাজটি করেছে?
বলবে না?
মেজমহারাজ বললেন-- মুখ খোলানোর কায়দা আমার জানা আছে। এই যে আমাদের গুডবয় প্রদ্যুম্ন। তুমিই বলে ফেল, তোমাদের ঘরে অ্যাসিড লুকিয়ে রাখা হচ্ছে আর তুমিই জান না?
--- ঠিক বলেছেন মহারাজ, আমাদের ঘরের ব্যাপার হলে আমি নিশ্চয়ই জানতাম। কিন্তু কে বলেছে যে আমাদের ঘরে অ্যাসিড পাওয়া গেছে? আমি বিশ্বাস করি না।
-- কী বলছ? ওয়ার্ডেন রণজিৎ ও কেমিস্ট্রির স্যারের সামনে বিপ্লব আর প্রশান্তর ট্রাংক খুলে চেক করা হয়েছিল, তার ভেতরে অ্যাসিডের বীকার পাওয়া গেছে।
-- হতে পারে না! রণজিৎদা মিথ্যে কথা বলছেন। উনি কী করে জানবেন কোনটা প্রশান্তর আর কোনটা বিপ্লবের? ওদের সামনে কেন খোলা হয় নি? আর ওরা দুজন ক্লাসে রইল, চাবি ওদের পকেটে অথচ ওদের ট্রাংক খোলা হয়ে গেল? রণজিৎদা ম্যাজিক জানেন নাকি? সব মিথ্যে কথা। কেমিস্ট্রির স্যারকে কার না কার ট্রাংক দেখানো হয়েছে!
--শাট আপ্। মানস তোমাদের রুম পার্টনার। ও দেখিয়ে দিয়েছে কোনটা কার; আর ওই একটা মাস্টার কী দিয়ে ওগুলো খুলেছে।
-- সরি মহারাজ। কারও পারমিশন ছাড়া তার বাক্সপ্যাঁটরা হাটকানো ও অন্য চাবি দিয়ে খোলা চুরির পর্যায়ে পড়ে।
এখন যদি প্রশান্ত আপনার কাছে রাইটিং এ নালিশ করে যে আজ সন্ধ্যের পর থেকে ও বাক্স খুলে একশ টাকার খুচরো পাচ্ছে না--তো আপনি নিশ্চয়ই তারও তদন্ত করবেন?
মহারাজ প্রশান্ত ও বিপ্লবের মুখে র্দিকে তাকালেন। ওরা আস্তে করে ওপর নীচে মাথা নাড়ল।
মেজমহারাজ ধৈর্য হারালেন।
-- চোরের মায়ের বড় গলা! এই দুজনকে এখনই সাতদিনের জন্যে সাসপেন্ড করে বাড়ি পাঠিয়ে দিন। আর এই অকালপক্ক উকিল প্রদ্যুম্ন? তুইও এর মধ্যে আছিস, এতে কোন সন্দেহ নেই। দু'দিন সময় দিলাম। ভাল করে ভেবে নে। দোষ স্বীকার করলে শাস্তি কম হবে।
অ্যাসিড কান্ডে সারা আশ্রম তোলপাড়।
দুটো সিনিয়র ছেলে --লেখাপড়ায় ভাল-- সাসপেন্ড হবে।
আমরা গিয়ে মহারাজকে বললাম-- যা করি নি তার শাস্তি কেন ভোগ করব? রণজিৎদার কথা ছাড়ুন; উনি একপক্ষ কাজেই বায়াসড্। যদি কেমিস্ট্রির হেড সুনন্দ স্যার বলেন যে এই দুজনের কাছ থেকে যে অ্যাসিড পাওয়া গেছে সেটাই আসল জিনিস তো মেনে নেব।
আপনি ওনাকে ডেকে জিগ্যেস করুন।
এদিকে আমরা ডেসপারেট; সুনন্দ স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম।
স্যার একটু দেখুন না! আপনার নাম করে মহারাজ এই দুই ছাত্রকে সাসপেন্ড করছেন। আপনি যা সত্যি তাই বলবেন-- রণজিৎদা একটা পচা ন্যাকড়া ছিঁড়ে বলছেন যে ওটা নাকি আপনার সামনে অ্যাসিড ঢেলে পরীক্ষা করা হয়েছে । আপনি তো জানেন ওটা সালফিউরিক অ্যাসিড নয়।
স্যার গম্ভীর; এক এক করে আমাদের মুখে চোখ বোলালেন। তারপর বললেন--চিন্তা কর না; যেটা সত্যি সেটাই বলব।
আমরা ফিরে আসছি--উনি ডাকলেন। অ্যাই শোন, এই কালো ছেলেটা! কোন ক্লাসে পড়িস? তুই তো আমার ছাত্র নোস্!
--না স্যার, ক্লাস টেন আর্টস্।
--বটে, তুই কী করে জানলি যে রণজিৎ নিজে জোর লাগিয়ে ন্যাকড়া ছিঁড়েছিল আর আমি বলেছি যে ওর ঘরে যে অ্যাসিড ঢালা হয়েছে সেটা সালফিউরিক?
বক্কেশ্বর শ্রীমান পোদোর মুখে কেউ লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে দিয়েছে।
--কী রে বল? এমনি এমনি চলে যাবি? না বললে তোকে দিনের বেলায় তারা দেখিয়ে ছাড়ব।
রামে মারলেও মারবে, রাবণে মারলেও মারবে! যা থাকে কপালে!
ঠাকুরের নাম নিয়ে ডাইভ মেরে স্যারের পা ছুঁয়ে দিলাম।
--একী একী! ওঠ, উঠে সত্যি কথাটা বল।
--স্যার, আপনার পা ছুঁয়ে বলছি। আমার সেদিন শরীরটা ভাল ছিল না। খাটের নীচে বিছানা করে ঘুমোচ্ছিলাম। আপনারা যখন সার্চ করছিলেন আমি তখন জেগে গেছলাম। প্লীজ স্যার, এসব মহারাজকে বলবেন না।
--বেরিয়ে যা ! যত বাঁদরের পাল আশ্রমে জুটেছে।
আমরা প্রায় দৌড়ে বেরোলাম। কানে এল দোর্দন্ডপ্রতাপ সুনন্দস্যার হো-হো করে হাসছেন।
সুনন্দস্যার মহারাজের প্রশ্নের উত্তরে সত্যি কথাই বলেছিলেন। এমনকি এটাও বলেছিলেন , সায়েন্সের নতুন স্টুডেন্টরা অমন একটু আধটু বিউরেট, পিপেট, বীকার ঘরে নিয়ে আসে। এটা নিয়ে উনি ছেলেদুটোকে বকে দেবেন। আলাদা করে শাস্তি দেওয়ার দরকার নেই।
সরকারি ভাবে অ্যাসিড কান্ডের সেখানেই ইতি। ওটা রহস্য হয়েই রইল।
ফুটনোটঃ
মূল ঘটনার সাতদিন পরে একদিন শ্রীমান পোদো বিকেলে খেলার মাঠে না গিয়ে লাইব্রেরি থেকে বই ইস্যু করাল-- স্বামী অভেদানন্দের "মরণের পারে"। তারপর বই বগলদাবা করে হোস্টেলে ফিরে এল।প্রেয়ারের ঘন্টা না পড়া অব্দি জমিয়ে পড়বে।
কিন্তু ঘর যে বন্ধ। কী আপদ, বার বার কড়া নেড়েও কোন সাড়া নেই। কোন শালা ভেতরে ঘোড়া বেচে ঘুমুচ্ছে! সবাই খেলার মাঠে, নইলে ওর দরজায় ধাক্কার চোটে দোতলায় ভীড় জমে যেত।
অবশেষে দ্বার খুলিল এবং পোদোর প্রবেশমাত্র পুনঃ বন্ধ হইল, তথা দ্রুত খিল আঁটিয়া দেওয়া হইল।
ঘরের মধ্যে অপরাধী মুখে দাঁড়াইয়া দুইটি প্রাণী-- গুরু অমিয়দা ও উঁহার দক্ষিণহস্ত প্রশান্ত।
না , দাঁড়াইয়া বলিলে ভুল হইবে, উভয়েই উবুড় হইয়া বসিয়া ঘর মোছার বালতিতে ন্যাকড়া ডুবাইয়া মেজে পরিষ্কার করিতে রত। কিন্তু ঘর কেরোসিন ও সরিষার তেলের গন্ধে পরিপূর্ণ। উহারা তেল ও কেরোসিন দিয়া ঘর মুছিতেছে! কী কারণে?
কিংকর্তব্যবিমুঢ় পোদো বিছানায় উঠিয়া বসিল।
সহসা তাহার দৃষ্টিপথে ধরা দিল প্রশান্তর জানলার উপরে নয়ফুট উঁচুতে একটি ঘুলঘুলি যে স্থানে চড়াইপক্ষী খড়কুটো দিয়া বাসা বাঁধিয়াছে। সেখান হইতে একটি ধারা দেওয়াল বাহিয়া মেজে পর্য্যন্ত পৌঁছিয়াছে এবং তাহার কটু গন্ধ কেরোসিন তেলের গন্ধেও চাপা পড়ে নাই।
পোদোর মাথায় টিউবলাইট জ্বলিয়া উঠিল। সে চক্ষু গোল গোল করিয়া গুরুকে বলিল-- তাহলে তোমরাই! এতবড় অপারেশনটা দুজনে মিলে করলে--গুরু আর ডানহাত, বাঁহাত টের পেল না! এ বহোত না ইনসাফি!
গুরু দাঁত বের করল। ‘শোন, ডানহাতের কথা বাঁ হাত জানবে না। সব সাকসেসফুল অপারেশনের এটাই মন্ত্র। রাগ করিস নে! তোকে বললে তুই রাজি হতিস না। উল্টে মানা করতিস। কাজটা ঠিক করি নি। কিন্তু তখন ঝোঁকের মাথায়।
--কিসের সাকসেস? ঘরের মধ্যে ছড়িয়েছ, একটু পরে মানস বিপ্লব সব জেনে যাবে।
-- না, জানবে না। জমাদার বৃহস্পতি দাস মুখ খুলবে না। এটা দোয়াতে করে ঘুলঘুলিতে চড়াইয়ের বাসায় রেখে দিয়েছিলাম, কিন্তু আজকে ওদের নড়াচড়ায় বোধহয় উল্টে গেছে। ঘরমোছা শেষ হলে সব দরজা জানলা খুলে রেখে দেব, গন্ধ চলে যাবে।
কিন্তু এই গল্পটা আশ্রম ছাড়া পর্য্যন্ত কাউকে বলবি না। তোর প্রাণের বন্ধু বিপ্লবকেও না।
অ্যাসিড রহস্যের ফলশ্রুতিতে আশ্রম জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন হল। রণজিৎ দাকে ওনার অনুরোধে একতলায় লোয়ার ক্লাসের বাচ্চাদের ওয়ার্ডেন করে দেওয়া হল। দোতলায় টেন ও ইলেভেনের জন্যে কোন ওয়ার্ডেন থাকবে না। কাছেই হেডস্যার আছেন। ফলে বেয়াড়া ছেলেপুলেরা একটু সমঝে চলবে।
হ্যাঁ, মানস এর রুম বদলে গেল। ট্রাঙ্ক খোলার ব্যাপারের ওর সক্রিয় ভূমিকার ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ায় জুনিয়র ব্যাচের ছেলেরা পর্য্যন্ত ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে দালাল--দালু-পচা আলু এসব বলতে আরম্ভ করল। প্রশান্ত ওকে সবার সামনে ডেকে বলল-- একশ' টাকা ফেরত দে।
--কিসের টাকা?
--যেটা আমার ট্রাঙ্ক থেকে নিয়েছিলি?
-- বাজে কথা! আমি আবার কবে তোর ট্রাঙ্ক থেকে টাকা নিলাম?
-- তা জানি না। তবে তুই মাস্টার কী দিয়ে আমাদের ট্রাঙ্ক খুলতে পারিস --কাউকে না জানিয়ে -এটা তো সত্যি! চুপি চুপি কতবার খুলেছিস তার ঠিক আছে? দেখছি ট্রাঙ্কে টাকা নেই। তুই ছাড়া কে করতে পারে?
-- মানস, টাকাটা দিয়ে দে।
আমাদের গুরুর গলার স্বর খাদে নামা , ক্যাজুয়াল।
বিব্রত মানস আমাদের সবার মুখের দিকে অনুনয়ের ভঙ্গিতে তাকায়। আমরা কোন কথা বলি না।
তারপর কোন কথা না বলে বিছানা থেকে উঠে গটগটিয়ে বেরিয়ে যায়।
মানস ফিরল দু'ঘন্টা পরে। তখন প্রেয়ারের সময় হতে বেশি বাকি নেই। সোজা নিজের বিছানা জামাকাপড় বইপত্তর গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। তার আগে কারও দিকে না তাকিয়ে বলল-- মেজমহারাজ আমাকে নীচের তলায় ১৫ নম্বর ঘরে বদলি করে দিয়েছেন।
পরে জানলাম, ও মহারাজদের কাছে রুম বদলে দেওয়ার জন্যে কান্নাকাটি করেছে। ওঁরা প্রথমে রাজি হন নি। দশদিন পরেই গরমের ছুটি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ও ভয় পাচ্ছে ওর গায়েই না কেউ অ্যাসিড ঢেলে দেয়। ওর অবস্থা দেখে মহারাজরা মেনে নিলেন। আগামী দশদিন পর্য্যন্ত আমরা চারজন, মানসের তক্তপোষ খালিই থাকবে।
বিপ্লব বলে-- আপদ গেছে, বেশ হয়েছে। থাকলে আরও ঝাড় খেত।
0 comments: