0

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রাচীন কথা



উত্তরাপথের পথে
সৌরেন চট্টোপাধ্যায়
= নবম পর্ব =





কান্যকুব্জ নগরীর পূর্ব সিংহদ্বার থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে অটবী-অধ্যুষিত নাতিউচ্চ পার্বত্য মালভূমি অঞ্চলে ছোট ছোট কয়েকটি টিলার মাঝে মাঝে হরিৎ শাদ্বলাচ্ছাদিত সমভূমি। একটি নাতিউচ্চ সমতল-শিখর টিলার উপরিভাগে স্থান্বীশ্বরের স্কন্ধাবার। সেখানে বর্তমান অধিরাজ মহামহিম কুমার রাজ্যবর্ধনের যুদ্ধকালীন পট্টাবাস নির্মিত হয়েছে। তার শীর্ষদেশে একটি সুউচ্চ দণ্ডের শীর্ষে পুষ্পভূতি বংশের ভগবান বিবস্বান-লাঞ্ছিত নিশান সগৌরবে উড্ডীয়মান; তার আশেপাশে মন্ত্রী-অমাত্যদের পট্টাবাস। টিলার সানুদেশে তরাই-এর ছোট-বড় বৃক্ষ-সংকুল অরণ্যানীর বৃক্ষান্তরালে তুরঙ্গ-নায়েক বৃহদশ্ব কুন্তলের দায়িত্বে স্থান্বীশ্বরের বিশাল অশ্বারোহী বাহিনীর গুপ্ত সেনানিবাস। বড় বড় গাছের ফাঁকে লতাগুল্ম বিশেষ নেই, বৃক্ষচ্যুত শুষ্ক পত্র ছাড়া মোটামুটি পরিচ্ছন্ন বনতল জুড়ে স্থান্বীশ্বরের রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর শিবির।
টিলার উপরে স্কন্ধাবারের বাইরে সমস্ত অঞ্চলটির চতুর্দিক ঘিরে স্থান্বীশ্বরের অপরাজেয় তুরঙ্গবাহিনীর সহস্রাধিক সশস্ত্র অশ্বারোহী সেনানী প্রহরারত। তাদের পিঠে ধারালো তীরপূর্ণ দ্রোণ, স্কন্ধে মেষ-অন্ত্রে প্রস্তুত জ্যা সমন্বিত দুই অরত্নি পরিমাপের ছোট শার্ঙ্গ ধনু, এবং উন্মুক্ত কৃপাণ। তারা ধীর গতিতে চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে অহোরাত্র প্রহরা দিচ্ছে; একটি মক্ষিকারও সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।

মালবরাজ দেবগুপ্তর হাত থেকে কনৌজ অধিকার করলেও রাজ্যবর্ধনের মনে বিন্দুমাত্র আনন্দ নেই। তিনি প্রিয়জনবিহীন মৃত্যুপুরীসদৃশ কান্যকুব্জ নগরীর রাজভবনে রাত্রিযাপন করতে কিছুতেই রাজি হলেন না। যে প্রাসাদ তাঁর পরমপ্রিয় ভগ্নী ও ভগ্নীপতির বিচরণস্থান ছিল, সেখানে কোন পাষাণ-হৃদয়ে তিনি বাস করতে পারেন! তিনি আর মুহূর্তকাল কনৌজের রাজপুরীতে থাকতে চাইলেন না। দেবগুপ্তের হাতে ভগ্নীপতি মৌখরিরাজ গ্রহবর্মার নিষ্ঠুর হত্যা ও প্রাণপ্রতিমা ভগ্নী রাজ্যশ্রীর কোনও সংবাদ না পেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর মন ক্রোধে, বেদনায় অশান্ত। সেনানায়ক কুন্তলের অধীনস্থ সৈনিকরা নগরী ও তার আশপাশের সমস্ত স্থান তন্নতন্ন করে সন্ধান করেও রাজ্যশ্রীকে খুঁজে পায়নি।

সুহৃৎ মহামাত্য ভণ্ডী রাজ্যবর্ধনের মনবেদনা সম্যক উপলব্ধি করে অল্প সময়ের মধ্যেই যথাযথ ব্যবস্থা করলেন। মহামন্ত্রীর পরামর্শে ছয়জন বিচক্ষণ অমাত্য ও দুই সহস্র সেনানীর চারজন সেনানায়কের হাতে রাজ্য পরিচালনা ও রক্ষার ভার ন্যস্ত করে রাজ্যবর্ধন শিবিরে ফিরে এলেন। কনৌজের রাজভবন পরিত্যাগ করলেও রাজ্যবর্ধন তখনই স্থান্বীশ্বরে প্রত্যাগমন না করে নগরীপ্রান্তে মালভূমির উপর সেই স্কন্ধাবারেই কিছুকাল অবস্থান করবেন এবং সেখান থেকেই তাঁর ভবিষ্যৎ কর্তব্য-কর্ম নিরূপণ করবেন স্থির করেছেন।

বাইরে দ্রুত শীতের সন্ধ্যা নামছে। যুদ্ধশেষে পরিশ্রান্ত রাজ্যবর্ধন সপারিষদ স্কন্ধাবারে ফিরে এসে ঈষদুষ্ণ জলে হস্তপদাদি প্রক্ষালন করে দুগ্ধফেননিভ বেত্র-পট্টিকায় শ্রীঅঙ্গখানি এলিয়ে দিলেন। অঙ্গমর্দক ক্ষতস্থানে ভেষজের প্রলেপ দিয়ে শরীর মর্দন করার পর বস্ত্রকর্মান্তিক এসে সযত্নে পরির্বহ পরিবর্তন করে শীতোপযোগী নরম সুতিবস্ত্রে রণক্লান্ত অধিরাজের দেহ আবৃত করে দিল।

পরদিন প্রভাতে রাজ্যবর্ধন স্নান-পূজা সমাপনান্তে প্রাতঃকালীন আহারে বসেছেন। উষ্ণ মেষদুগ্ধ ও কদলী সহযোগে সামান্য কিছু চিপিটক দিয়ে অধিরাজের জলযোগ সমাপ্ত হলে অমাত্য-সখা ভণ্ডী অন্দরে প্রবেশ করলেন। চির বিশ্বস্ত মাতুল-পুত্রকে দেখে রাজ্যবর্ধন খুশি হলেন। ভণ্ডীদেব আসন গ্রহণ করে বললেন,‘‘রাজন, আমি জানি আমরা এখন এক চরম দুঃখ ও বিপদের মধ্যে কালযাপন করছি; এখন আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্কতা ও দূরদর্শিতা অবলম্বন করতে হবে। এমতাবস্থায় আপনার চিত্ত স্বাভাবিক ভাবেই বিক্ষিপ্ত জানি, তথাপি পরবর্তী যে কোন পরস্থিতির জন্য আমাদের অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে।’’

‘‘তুমি যথার্থ বলেছ ভণ্ডী,’’ রাজ্যবর্ধন বললেন, ‘‘কান্যকুব্জ আমাদের অধিকৃত হলেও আমাদের প্রাণপ্রিয় একমাত্র ভগ্নী রাজ্যশ্রীর খোঁজ এখনো পাইনি। তার জন্য আমার মন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। তোমার নির্দেশে যারা ভগ্নী রাজ্যশ্রীর সন্ধানে গিয়েছিল, তারা সকলেই কি প্রত্যাবর্তন করেছে? কেউ তার অন্তর্ধানের সামান্যতম সূত্রও কি পায়নি?’’

‘‘না রাজন,’’ ভণ্ডী বিষণ্ণকন্ঠে বললেন, ‘‘কনৌজ-রাজপুরী আক্রান্ত হওয়ার পর রাজঅন্তঃপুরের বেশিরভাগ দাসীরা মালব-সৈনিকদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়, বয়স্কারাও তাদের নৃশংস উৎপীড়ন থেকে রেহাই পায়নি; স্বাভাবিকভাবেই সেই অভিশপ্ত রাত্রে ওরা সকলেই নিজেদের মান-প্রাণ বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিল। সৈনিকদের অকথ্য অত্যাচারে হতাহতের সংখ্যাও কম নয়। আমাদের বিশ্বস্ত বিশেষ চরেরা রক্ষক ও দাস-দাসী থেকে শুরু করে রাজধানীর সাধারণ প্রজাদের কাছে অনেক অনুসন্ধান করেছে, কিন্তু কেউই তাঁকে দেখেনি।’’

‘‘রাজ্যশ্রীর এই অন্তর্ধানের বিষয়ে তোমার কি মনে হয় ভণ্ডী?’’

‘‘সংবাদকের কাছে যা শুনেছি, তাতে মনে হয় রাজপুরীর যামচেটিদের অনেককেই উৎকোচে বশীভূত করা হয়েছিল। আর ভগ্নী রাজ্যশ্রীকে যদি অপহরণ করা হয়ে থাকে, তাহলে যে বা যারা করেছে, তা সকলের অলক্ষ্যেই করেছে। অথবা এমনও হতে পারে, তিনি নিজেই হয়তো আত্মরক্ষার্থে একা বা কারও সাহায্যে ছদ্মবেশ ধারণ করে অন্তঃপুরের বাইরে কোথাও আত্মগোপন করে আছেন; সেক্ষেত্রে তিনি নিজে না চাইলে তাঁর সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। আর যদি কোন দাস-দাসী বা নাগরিক তাঁকে দেখেও থাকে, রাজ-রোষের ভীতিতে তারা প্রকাশ্যে আসতে চাইছে না, বিশেষতঃ রাজ্য এই কয়দিন বহিঃশত্রুর হস্তগত ছিল বলে। অর্থ-সম্পদের লোভে কেউ হয়তো সংবাদ দিলেও দিতে পারে।’’

‘‘ঠিক আছে, আমরা এখানে যে কয়দিন অবস্থান করব, তার মধ্যে যে কেউ ভগ্নীর সংবাদ দিলে তাকে দুই লক্ষ সুবর্ণমুদ্রা ও তিনটি বড় গ্রাম পারিতোষিক হিসাবে প্রদান করা হবে, এ কথা কান্যকুব্জ রাজধানীতে ঘোষণা করে দাও।’’ মহামাত্যের কথা অনুমোদন করলেন অধিরাজ রাজ্যবর্ধন। তাঁদের কথোপকথনের মধ্যেই প্রতিহারী এসে জানালো, সেনানায়েক বৃহদশ্ববার কুন্তল অধিরাজের সাক্ষাৎপ্রার্থী। এই শৈত্যের সময় পট্টাবাসের শীতল অন্ধকারের চেয়ে বাইরের সূর্যোকরোজ্জ্বল উন্মুক্ত প্রান্তর অনেক বেশী শ্রেয় বিবেচনা করে কুমার ও ভণ্ডী রাজপট্টাবাসের বিতানক সরিয়ে বাইরে এসে দেখলেন কুন্তল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে একজন সহিসের হাতে তার প্রিয় কৃষ্ণ-অশ্বটির লাগাম।

‘‘অধিরাজের জয় হোক!’’ কুন্তল আভূমি নত হয়ে প্রণাম জানিয়ে বলল।

‘‘কি ব্যাপার কুন্তল! কোন বিশেষ সংবাদ আছে কি?’’ ভণ্ডী এগিয়ে গিয়ে ব্যাকুল-কন্ঠে শুধালেন, ‘‘ভগ্নী রাজ্যশ্রীর কি কোনও সন্ধান পেয়েছো?’’

‘‘এখনও পাইনি মহামন্ত্রী, তবে অনুসন্ধানে আমাদের পঞ্চাশ জন বিশেষ প্রশিক্ষিত চর কনৌজ নগরী ও তার আশেপাশে সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।’’ 

কুন্তল সবিনয়ে বলল, ‘‘আশা করছি খুব শীঘ্রই আমরা তাঁর সংবাদ পেয়ে যাব। আমি অন্য একটি কারণে মহামান্য অধিরাজ ও আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি।’’

‘‘বল, কি তোমার নিবেদন।’’ ভণ্ডীদেব বললেন।

‘‘আজ অতি প্রত্যুষে আমি নিত্য অভ্যাসমত একাকী অশ্বারোহণে বেরিয়েছিলাম। কান্যকুব্জ নগরীর পশ্চিমে যমুনা নদীর বালুকাময় তটভূমিতে গিয়ে চতুর্দিকে ভস্মীভূত প্রচুর কুটীর ও বস্ত্রাবাস, আর নদীর ধারে একটি ক্ষুদ্র অথচ রাজকীয় আড়ম্বড়পূর্ণ শিবির এবং ভিন্ন প্রদেশবাসী সৈনিকদের দেখতে পাই। কৌতূহলবশতঃ কাছে গিয়ে জানতে পারি, পূর্ব ভারতের পরাক্রমশালী রাজ্য গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক সানুচর সেখানে অবস্থান করছেন। নিজের পরিচয় দিয়ে গৌড়েশ্বরের সাক্ষাৎপ্রার্থী হলে তিনি অত্যন্ত সমাদরে আমাকে তাঁর বস্ত্রাবাসে আহ্বান করে আপ্যায়ন করেন এবং আমাদের কনৌজ অধিগ্রহণের ঘটনা আগ্রহের সঙ্গে জানতে চান।’’

‘‘আর তুমিও অমনি গৌড়রাজের শিবিরে অতি উত্তম খাদ্যপানীয় উদরসাৎ করতে করতে সমস্ত কিছু তাঁর কাছে প্রকাশ করে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করলে!’’ ভন্ডীদেব ব্যঙ্গের স্বরে বললেন।

‘‘না, না, মানে ঠিক তা নয়, মানে...’’ কুন্তল থতমত খেয়ে বলতে গেল, ‘‘গৌড়েশ্বর অত্যন্ত অমায়িক ব্যক্তি, অত বড় রাজা হয়েও আমার মত একজন সামাম্য সৈনিকের সঙ্গে...’’

‘‘বুঝেছি, তারপর কি হল বল।’’

মহামন্ত্রীর মুখে চিন্তার গাম্ভীর্য দেখে থেমে গেল কুন্তলের কথা। সে বিনীতকন্ঠে বলল, ‘‘আমি কি কোন ভুল করেছি?’’

‘‘কতটা ভুল করেছ জানি না, তবে একটু বেশী আপ্লুত হয়ে কাজটা ঠিক করনি তুমি।’’ ভণ্ডীর গম্ভীর কন্ঠস্বরে প্রচ্ছন্ন ধমক।

‘‘তিনি আর কি বলেছেন তোমাকে?’’ ভণ্ডী ঘুরে দাঁড়িয়ে শুধালেন।

‘‘মহারাজ শশাঙ্ক স্থান্বীশ্বর-অধিরাজ রাজ্যবর্ধনের সাক্ষাৎপ্রার্থী, নেহাৎই সৌজন্য সাক্ষাত; এও বলেছেন যে, আমাদের অধিরাজ অনুমতি দিলে তিনি নিজে আসবেন এই স্কন্ধাবারে।’’

দিনের প্রথম প্রহরের শেষ ভাগ, শীতকালীন প্রভাতে মিঠে রৌদ্রে তৃণাচ্ছাদিত মালভূমির উপরে প্রিয় অমাত্য ও মাতুলপুত্র ভণ্ডী এবং বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা কুন্তলের সঙ্গে পাদচারণা করতে করতে রাজ্যবর্ধন এতক্ষণ তাঁর দুই পরম সুহৃদের কথা মন দিয়ে শুনে বললেন, ‘‘কুন্তলকে তুমি অকারণে তিরস্কার করছ ভণ্ডী, মহারাজ শশাঙ্কের মতন একজন শ্রদ্ধেয় রাজার বন্ধুত্বসুলভ ব্যবহারে যে কোন ব্যক্তিই অভিভূত হত, তাই নয় কি?’’

‘‘আমাকে মার্জনা করবেন রাজন,’’ ভণ্ডী সবিনয়ে কিন্তু দৃঢ় ও সংযত ভাবে বললেন, ‘‘আমরা এখানে শিকার বা কোনও প্রমোদ ভ্রমনে আসিনি। যে পরিস্থিতিতে ও সময়ে আমাদের এই অকস্মাৎ যুদ্ধাভিযান করতে হয়েছে তা একবার ভেবে দেখুন দেব, আর এই সময় দেশান্তরে আত্ম-পরিজনহীন অবস্থায় কে মিত্র, কে শত্রু সে বিষয়েও সম্পুর্ণ অন্ধকারে আছি।’’

‘‘তোমার যুক্তি বুঝলাম, কিন্তু গৌড়েশ্বর তো আমাদের শত্রু নন! যত দূর শুনেছি তিনি একজন প্রকৃত বীর এবং ধার্মিক প্রজাবৎসল রাজা।’’

‘‘মহারাজ শশাঙ্ক ঠিক এই সময়ে কনৌজ নগরীর উপান্তে অবস্থান করছেন শুনে আমার মনে কিছু সন্দেহের উদ্ভব হয়েছে রাজন, তাই আমি একটু উদ্বিগ্ন।’’ ভণ্ডীর গলায় দুঃশ্চিন্তার প্রলেপ।

‘‘তোমার এমন সন্দেহের কারণ কি মিত্র?’’

‘‘প্রথমতঃ, ঠিক যে সময়ে মালবরাজ দেবগুপ্ত কনৌজ আক্রমণ করেছে, ঠিক সেই সময়েই সুদূর গৌড় থেকে শশাঙ্কও এখানে এসে উপস্থিত হলেন কেন? আর তিনি কেনই বা কনৌজ নগরীর কাছেই যমুনার তীরে শিবির সংস্থাপন করলেন? এই জায়গাটি তো কোনও তীর্থস্থান নয়! আর যদি নিছকই ভ্রমণেচ্ছায় তিনি আর্যাবর্তে এসে থাকেন, তাহলে কনৌজ, মধুপুরী (মথুরা), স্থান্বীশ্বর বা অন্য কোনও কাছাকাছি রাজ্যের সম্মানীয় অতিথি হওয়াই তো তাঁর মতন রাজার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল, তাই নয় কি!’’

‘‘তাই তো! এতটা তলিয়ে তো আমরা কেউই ভাবিনি!’’ রাজ্যবর্ধন তাঁর এই ধীমান মিত্রের কথায় চমৎকৃত হলেন। বললেন, ‘‘আর কি কি সন্দেহের কারণ আছে তোমার মিত্র?’’

‘‘আবার দেখুন, প্রয়াগ ও মথুরার মাঝে গঙ্গা-যমুনার দোআব অঞ্চলে কনৌজ; তার ঠিক দক্ষিণে যমুনার অন্য তীরে মালব ও তার রাজধানী অবন্তী নগরী (উজ্জয়িনী); আর সেই মালবই কয়েকদিন আগে রাতের অন্ধকারে কূটঘাত-যুদ্ধে কনৌজ অধিকার করেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগছে, মালবের সঙ্গে গৌড় জড়িত হয়ে পূর্বপরিকল্পিত ভাবে এই কূটঘাত সঙ্ঘটিত করেনি তো! শুনেছি কূটনৈতিক ও যুদ্ধবিশারদ হিসাবে মহারাজ শশাঙ্ক যথেষ্ট প্রতিভাবান, তাই এমন একটা সময়ে এই স্থানে তাঁর উপস্থিতি আমার একেবারেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তার উপর ভেবে দেখুন, তাঁর শিবিরের অনতিদূরেই কনৌজে এত বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেল, অথচ তিনি একেবারেই নিষ্ক্রিয় রইলেন, এটাও কি আশ্চর্যের নয়!’’

‘‘কিন্তু আমরা কনৌজ নগরীতে কারও কাছেই গৌড়েশ্বর বা গৌড়ীয় সেনার কথা শুনিনি, এমনকি সংবাদক বা আমাদের অন্য কোনও গুপ্তচরও এদের বিষয়ে কিছুই বলে নি।’’ রাজ্যবর্ধন বললেন। ‘‘যাই হোক, তিনি যখন নিজেই আমার দর্শনাভিলাষী হয়েছেন, তখন শুধুমাত্র সন্দেহের বশে আমি কোনও মতেই তাঁকে বিমুখ করতে পারি না। পিতা বলতেন --- ‘অরাবপ্যুচিতং কার্যমাতিথ্যং গৃহমাগতে। ছেত্তুঃ পার্শ্বগতাং ছায়াং নোপসংহরতি দ্রুমঃ।। (শত্রুও গৃহে এলে যথাসম্ভব আতিথেয়তা করা উচিত। গাছ তার ছেদনকারীকেও ছায়া প্রদান করে।) কুন্তল তুমি এখনি নিজে গিয়ে মহামান্য গৌড়েশ্বরকে এই স্কন্ধাবারে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসো।’’

‘‘যথা আজ্ঞা দেব।’’ বৃহদশ্ব কুন্তল রাজাজ্ঞা পালনে তৎপর হল।

মহামন্ত্রী ভণ্ডীদেব আর কিছুই বলতে পারলেন না। তাঁর মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। কি যেন একটা অমঙ্গল আশঙ্কায় তাঁর হৃদয় শঙ্কিত। তিনি বিমর্ষ মনে রাজ্যবর্ধন সমভিব্যাহারে শিবিরে ফিরে এলেন।


*********



দ্বিপ্রহরের পর গৌড়েশ্বর শশাঙ্কদেব কিংখাবের শিবিকায় আরোহণ করে সপারিষদ স্থান্বীশ্বর-অধিরাজ কুমার রাজ্যবর্ধনের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে সকাশে উপনীত হলেন;তাঁর সঙ্গে শুধু গৌড়ের প্রধান অমাত্য মহিম ভট্ট আর মাত্র চারজন পদাতিক দেহরক্ষী সৈনিক। শশাঙ্ক টিলা-সংলগ্ন মালভূমির সানুদেশে এসে শিবিকা থেকে অবতরণ করে চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে স্থান্বীশ্বরের সুরক্ষিত স্কন্ধাবার দেখে মনে মনে প্রশংসা করলেন। ভাবলেন, এই রণনিপুণ সশস্ত্র ও বিশ্বস্ত সৈন্যবাহিনীর মধ্যে প্রায় নিরস্ত্র ও জনবলহীন একা তিনি কিভাবে তাঁর কার্যসিদ্ধি করবেন। শশাঙ্কদেবের ভাবনার মাঝেই বনান্তরাল থেকে দশজন সৈন্যসহ সেনানায়ক কুন্তল গৌড়েশ্বরের প্রত্যুদ্গমন করে টিলার গায়ে ছোট পাকদণ্ডি পথটি ঘুরে মালভূমির উপরে অধিরাজ রাজ্যবর্ধনের পট্টাবাসে নিয়ে গেলেন।

সুসজ্জিত রাজপট্টাবাস-সংলগ্ন অস্তিকাগারে কুমার রাজ্যবর্ধন রাজাসনে আসীন। ছায়াসঙ্গী মহামন্ত্রী ভণ্ডীদেব এগিয়ে এসে গৌড়রাজকে অভিবাদন জানিয়ে আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালেন। শশাঙ্ক প্রত্যভিবাদন জানিয়ে আসন গ্রহণ করলে মন্ত্রী মহিম ভট্ট একটি ক্ষুদ্র চন্দন কাষ্ঠের পেটিকা সামনের মঞ্চকে রাখলেন। পেটিকা থেকে একটি বহুমূল্য গল্বর্ক বার করে রাজ্যবর্ধনের হাতে দিয়ে সবিনয়ে বললেন, ‘‘হে স্থান্বীশ্বর রাজ, গৌড়াধীপ মহারাজ শশাঙ্কের বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ যৎসামান্য কৌশলিকা, আপনি অনুগ্রহ করে গ্রহণ করে কৃতার্থ করুন।’’

গৌড়াধীপ শশাঙ্কের গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম, বিশাল মুখমণ্ডলে পুরুষ্টু গুম্ফ, স্কন্ধ পর্যন্ত লম্বমান কুঞ্চিত ঘন কেশ, ঈষৎ ক্ষুদ্র চক্ষুদ্বয়ে প্রখর বুদ্ধির ছাপ। তাঁর পরণের রাজকীয় পরির্বহের উর্ধাংশ একটি কাশ্মিরী দোশালায় আবৃত, ললাটের উপরিভাগে কেবল একটি হীরকখচিত সুবর্ণ-নির্মিত বলয়ের প্রত্যভিজ্ঞান এবং মণিবন্ধে একটি রত্নমণ্ডিত সুবর্ণ বলয় ছাড়া আর কোনও অলঙ্কারের বাহুল্য নেই।

সাধারণ কুশলাদি ও পরিচয় বিনিময়ের পর শশাঙ্ক বললেন, ‘‘হে স্থান্বীশ্বররাজ, আপনার পিতৃদেব পরম ভট্টারক মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের নানা যশ-কীর্তির কথা আমি পূর্বেই শুনেছি, এবং আমি তাঁর প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। আমি এই বৎসর প্রয়াগ তীর্থে পূর্ণকুম্ভ যোগে স্নান করে পুণ্যার্জনের আশায় কয়েকদিন আগেই গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ থেকে প্রয়াগে এসেছি। সাধ ছিল ফেরার পথে সেই কীর্তিমান প্রাজ্ঞ নরপতির সান্নিধ্যে থেকে ধর্মনীতি ও রাজনীতির কিছু অমূল্য উপদেশ নিয়ে যাব। জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় হলেও আমি আশৈশব ধর্মপিপাসু, ধর্মপথে মোক্ষলাভই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, রাজকার্য আমার কাছে নিতান্তই একটি কর্তব্য ছাড়া কিছু নয়। তবুও কোনও মহাপ্রাণ ব্যক্তি বা ধর্মরাজ্য দুর্দশা প্রাপ্ত হয়েছে শুনলে আমি আমার যৎসামান্য শক্তি নিয়ে তার পাশে দাঁড়াবার প্রয়াস করি। আমি সর্বান্তঃকরণে স্থান্বীশ্বর-রাজের মিত্রতার মনোবাসনা নিয়ে নিজেই আপনার দর্শনাভিলাষী হয়েছি।’’

‘‘হে মহামান্য গৌড়েশ্বর, আপনার কথা আমি অনেক শুনেছি। আপনি নিজে স্থান্বীশ্বরের আতিথ্য গ্রহণ করে আমার সাক্ষাৎলাভ করতে এসেছেন, এবং আমাকে বন্ধুত্বপাশে আবদ্ধ করতে চান --- এ আমার পরম আনন্দ ও গর্বের বিষয়;’’ শশাঙ্কের মধুর বাচনভঙ্গীতে অভিভূত হয়ে বললেন রাজ্যবর্ধন, ‘‘কিন্তু এই অস্থায়ী স্কন্ধাবারে আপনার উপযুক্ত অতিথি সৎকার কিভাবে করব, তা ভেবে পাচ্ছি না; বিশেষত বর্তমানে আমরা এক ঘোর দুঃসময়ে পতিত হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।’’

‘‘এখন আতিথেয়তার প্রকৃষ্ট সময় নয় মিত্র, আমি আপনার সমব্যাথী।’’ শশাঙ্ক বললেন, ‘‘আমি এমন সময়ে এই স্থানে উপস্থিত থেকেও কনৌজরাজ গ্রহবর্মাকে কোনওরূপ সাহায্য করতে না পারায় নিজেই অনুতপ্ত।’’

‘‘ক্ষমা করবেন মহারাজ,’’ পাশ থেকে মহামাত্য ভণ্ডী হঠাৎ বলে উঠলেন। গৌড়রাজের কূর্চভাগ কুঞ্চিত হল, তিনি ভণ্ডীর আপাদমস্তক ভাল করে দেখে মৃদু হাসলেন। ভণ্ডী সবিনয়ে অধিরাজ রাজ্যবর্ধনের অনুমতি নিয়ে বললেন, ‘‘মালবরাজ দেবগুপ্ত রাত্রির অন্ধকারে কূটযুদ্ধে কনৌজ আধিকার করল, আর আপনার মতন একজন পরাক্রমশালী বিচক্ষণ রাজা নগরীর সামান্য দূরত্বে অবস্থান করেও কিছু জানতে পারলেন না, বা জেনেও কোন সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেলেন না...’’

‘‘স্থান্বীশ্বরের মহামন্ত্রী হিসাবে আপনার মনে সন্দেহের উদ্রেক হওয়া অমূলক নয়,’’ শশাঙ্ক ভণ্ডীকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে স্মিতহাস্যে বললেন, ‘‘যে কোনও মানুষের মনেই এই প্রশ্ন ওঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আবার আমি এই বিশেষ সময়ে এখানে কেন? এটাও খুবই সন্দেহজনক বইকি! আমি যথাসাধ্য আপনাদের সন্দেহ নিরসনের প্রযত্ন করছি। আমি পক্ষকাল আগে কিঞ্চিৎ পুণ্যার্জনের আশায় প্রয়াগে পূর্ণকুম্ভে স্নান এবং সেই সঙ্গে আর্যাবর্তের বিখ্যাত তীর্থস্থানগুলি দর্শনের অভিলাষে সুদূর গৌড় থেকে এখানে এসেছি। এই অভিযানে আমি কোনও রাজা নই,আমার পরিচয় একজন সাধারণ তীর্থযাত্রী; তাই অতি প্রয়োজনীয় কয়েকজন সাহায্যকারী ছাড়া আমার সঙ্গে কোনও সৈন্যসম্ভারও নেই, নেই কোনও রাজকীয় আড়ম্বর। নিরাপত্তা ও মানুষের অযথা কৌতূহল থেকে দূরে থাকতে তাই নিজের পরিচয়ও আমি যথাসাধ্য গোপন রেখেছি। যে কোনও জায়গায় রাত্রিবাসের জন্য বস্ত্রাবাস নির্মান করলে সাধারণ মানুষের কৌতূহল উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক, তাই যে সব স্থানে সাধু-মহাত্মারা একত্রিত হয়ে বাস করেন, সেই স্থানগুলিই বেছে নিয়েছি, আর সমগ্র উত্তরাপথ জুড়ে এমন জায়গার তো কোনও অভাব নেই!’’

কথার মাঝেই পাদাৎ এসে তাম্বুল-করঙ্ক দিয়ে গিয়েছে। মহারাজ শশাঙ্ক আয়েস করে একটি তাম্বুল মুখে নিয়ে চর্বন করতে করতে বলে চললেন, ‘‘কুম্ভস্নান শেষে আমি প্রথমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি মথুরা ও বৃন্দাবন দর্শনের বাসনায় গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চলের এই স্থানে আসি। এখান থেকে মথুরা খুব বেশী দূরে নয়,আর আর একটু উত্তরে গেলে হৃষিকেশ ও হরিদ্বার –- পুণ্যসলিলা দেবী গঙ্গার অববাহিকার সূত্রপাত এবং দেবভূমি হিমালয়ের প্রবেশদ্বার। ইচ্ছা আছে উত্তর ভারতের বিখ্যাত তীর্থগুলিতে পূজা নিবেদন করে ভগবান শঙ্কর ও শ্রীকৃষ্ণের চরণাশীর্বাদ নিয়ে দেশে ফিরব।’’

‘‘কিন্তু সেই দুঃখজনক রাত্রে আপনি তো এখানেই ছিলেন!’’ ভণ্ডী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘‘না, আমি সেই দিনই প্রভাতে সানুচর মধুপুরীর উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলাম, তিনদিন পরে যখন ফিরলাম তখন যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। ফিরে এসে দেখলাম পাষণ্ড মালবরাজ কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে কাপুরুষের মত কনৌজ অধিকার করে নিয়েছে। যমুনা তীরের যত সাধু-সন্তের কুটীর ছিল সেগুলিতে এবং আমাদের পরিত্যক্ত একটি বস্ত্রাবাসেও অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। পরে পলায়নরত প্রজাদের কাছে কনৌজরাজের মর্মান্তিক পরিণতি শুনে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছে।’’

বলতে বলতে গৌড়রাজের কন্ঠস্বর ভারী হয়ে এলো, তিনি নত মস্তকে যেন শোকাবেগ সংবরণ করলেন। তাঁর কথা শুনতে শুনতে রাজ্যবর্ধনেরও শোকোচ্ছাস প্রবল হল। ভণ্ডী কেবল স্থির দৃষ্টিতে মহারাজ শশাঙ্ককে অবলোকন করতে লাগলেন। গৌররাজও অপাঙ্গে ভণ্ডীকে দেখে ভাবতে লাগলেন, এই যুবকটি অত্যন্ত বুদ্ধিসম্পন্ন,এ থাকতে কুমার রাজ্যবর্ধনকে সহজে করতলগত করা যাবে না।

‘‘মিত্র রাজ্যবর্ধন,আমি আপনার মনোবেদনা মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারছি। আশা করি ওই দুর্ঘটনার পরিপেক্ষিতে আমার অবস্থান আপনি বুঝতে পেরেছেন।’’শশাঙ্ক মুখ তুলে বললেন, ‘‘এখন আমার কিছু প্রস্তাব আছে, আপনি অনুমতি দিলে তা নিবেদন করতে পারি।’’

‘‘আপনি সত্যই মহানুভব বন্ধু,’’ রাজ্যবর্ধন বাষ্পাকুল কন্ঠে প্রত্যুক্তি করলেন, ‘‘এমন দুঃসময়ে আপনার মতন বিবেচক ও শক্তিশালী রাজাকে সাথী পেয়ে আমার মনোবল বৃদ্ধি পেল, আপনার প্রস্তাব নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করুন।’’

‘‘আমার প্রথম প্রস্তাব হল, আজ থেকে স্থান্বীশ্বর ও গৌড় এক হয়ে মালবরাজ দেবগুপ্তের মত পররাজ্যলোভী নিষ্ঠুর রাজাদের যথাযোগ্য শাস্তি দান করে উত্তরাপথের বুকে এক ধর্মাশ্রয়ী ন্যায় ও সুশাসিত সাম্রাজ্য স্থাপন করবে, আর মহামান্য মণ্ডলেশ্বর রাজ্যবর্ধনই হবেন সেই ধর্মযুদ্ধের নায়ক ও ভাবীকালে উত্তরাপথের একচ্ছত্র অধিশ্বর। তার জন্য আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আপনাকে সাহায্য করব।’’

অকস্মাৎ গৌড়াধীপের এমন ঘোষণা শুনে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বিস্মিত রাজ্যবর্ধন কিছু বলার আগে ভণ্ডীদেব বললেন, ‘‘আপনার প্রস্তাব অতীব উত্তম মহারাজ, কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, স্থান্বীশ্বরের বর্তমান অধিরাজের সদ্য পিতৃবিয়োগ হওয়ায় রাজ্যপ্রাপ্তি ঘটলেও তিনি এখনও রাজ্যপরিচালনার সুযোগ পান নি, তার আগেই তাঁকে মালবরাজের প্রতিবিধান করতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। তাছাড়া তিনি বয়সেও নবীন, রাজনীতির কূট-কৌশল এখনও তাঁর আয়ত্তাধীন হয়নি তা আপনি ভালই জানেন, অথচ আপনার মতন বর্ষীয়ান বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ থাকা সত্বেও কুমার কি করে সর্বাধিনায়ক হতে পারেন! আর এই পরিকল্পনা সফল হলে আপনার কি লাভ, এবং আপনার ভূমিকা কি হবে?’’

‘‘আপনার এই প্রশ্ন অতি সঙ্গত মহামন্ত্রী,’’ শশাঙ্ক মনের বিরক্তি চেপে স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, ‘‘প্রথমতঃ, আর্যাবর্তের পূর্বপ্রান্তে একেবারে শেষে খুবই ক্ষুদ্র রাজ্য আমার গৌড়দেশ, আবহাওয়া আর জল-মাটির গুণে আমার প্রজা তথা সৈনিকরা অলস ও আয়েসি, আর তারা যুদ্ধবিদ্যায়ও তেমন পটু নয়। অপরদিকে স্থান্বীশ্বররাজ শুধু রাজাই নন, তিনি একজন রাজাধিরাজ -- মণ্ডলেশ্বর। গৌড়ের মত ছোট ছোট রাজ্যগুলি শুধুমাত্র দেশীয় রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেই নিজেদের কীর্তি স্থাপন করেছে, কিন্তু স্থান্বীশ্বর-অধিপতি মহামান্য প্রভাকরবর্ধন দেশীয়রাজ্য ব্যতিরেকে বিদেশী রণদুর্মদ হূণদের পরাজিত করে আর্যাবর্তে যে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করেছেন তা অতুলনীয়। অধিরাজ রাজ্যবর্ধন তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী, তিনি মাত্র অষ্টাদশ বৎসর বয়সেই স্থিতধী রণনায়ক হিসাবে তাঁর কীর্তিমান পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে যশস্বী হয়েছেন। এ ছাড়া স্থান্বীশ্বরের ভৌগলিক অবস্থান, যেখান থেকে সমস্ত উত্তরাপথের সাম্রাজ্য পরিচালনা ও শাসন করা সুবিধাজনক। আর সর্বশেষ কারণটি হল, আমি নিজে কোনওদিনই রাজ্যলোলুপ নই, রাজনীতি অপেক্ষা ভগবান মহেশ্বরের প্রসাদলাভই আমার জীবনের পরম মোক্ষ। সমস্ত দেশের মঙ্গলার্থে এই ধর্মযুদ্ধে আমি স্থান্বীশ্বররাজের অধীনে সামান্য একজন সৈনিকের ভূমিকা পালন করতেই ইচ্ছুক। আমি সব সময় এই আপ্তবাক্যটি স্মরণ করি... ‘ধনানি জীবিতঞ্চৈব পরার্থে প্রাজ্ঞ উৎসৃজেৎ। সন্নিমিত্তে বরং ত্যাগো বিনাশে নিয়তে সতি।।’ (জ্ঞানী ব্যক্তিরা নিজের ধন এবং জীবন পরের জন্য উৎসর্গ করেন। এগুলির বিনাশ যখন হবেই, তা সৎ কাজে ত্যাগ করাই ভালো।) তাই অনেক চিন্তা করেই আমি এই প্রস্তাব নিবেদন করেছি, এখন মিত্র রাজ্যবর্ধনের যা ইচ্ছা।’’

গৌড়াধীপ শশাঙ্ক মানবচরিত্র অনুধাবনে অসম্ভব পারদর্শী এবং তিনি অসাধারণ বাগ্মী। কোন কথা, কাকে, কখন, কিভাবে বললে কার্যসিদ্ধি হবে তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। তাঁর ভাষণ অচিরেই ফলপ্রদ হল। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, সদ্যযুবক রাজ্যবর্ধন অভিভূত হয়ে পড়লেন। মহামন্ত্রী ভণ্ডীদেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, রাজ্য তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মত। কিন্তু আমারও একটি প্রস্তাব আছে, মিত্র।’’

‘‘বলুন মিত্র, আপনার যে কোনও প্রস্তাব পরম সমাদরে বিবেচিত হবে।’’ শশাঙ্ক হাসিমুখে বললেন।

‘‘পিতার আদেশে আমি ভারতবর্ষের বহিঃশত্রু হূণদের দমন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সর্বগুণাকর কুমার হর্ষবর্ধন সর্বক্ষেত্রেই আমার পরিপূরক;আমি নিজে রাজসিংহাসন অভিলাষী নই, তাই আমার স্থলে হর্ষদেবই হবেন আপনার এই পরিকল্পনার সার্থক রূপকার। পরবর্তীকালে আমি তাকেই উত্তরাপথের সার্বভৌম সম্রাটরূপে দেখতে চাই।’’

‘‘অতি উত্তম প্রস্তাব,’’ শশাঙ্কদেব সানন্দে বললেন, ‘‘আমি যেন দেখতে পাচ্ছি আপনারা দুই ভ্রাতা একাধারে শিব-বিষ্ণুরূপে আর্যাবর্তের রাজচক্রবর্তী সম্রাট হয়ে সুশাসনে একে শ্রেষ্ঠতম ঐশ্বর্যশালী ও সমৃদ্ধিশালী সুবর্ণ-দেশে পরিণত করবেন। আমার আর একটিমাত্র অনুরোধ আছে মিত্র, আশা করি নিরাশ করবেন না।’’

‘‘নিশ্চয়ই মিত্র, বলুন কি আপনার ইচ্ছা।’’

‘‘আপনার মতন সিংহহৃদয় উদারমনা মিত্রকে পেয়ে আমার মন আনন্দে পরিপূর্ণ। বহুদিন যাবৎ স্বজনবান্ধবহীন অবস্থায় প্রবাসে কাল কাটাচ্ছি; আগামী কাল আমার জন্মতিথি। আমার একান্ত ইচ্ছা আপনি কাল আমার পট্টাবাসে আতিথ্য স্বীকার করে আপনাকে সামান্য সেবা করার সুযোগ দিয়ে আমার মনোবাসনা পূর্ণ করুন; কিন্তু বলতে লজ্জিত হচ্ছি যে এই প্রবাসে আমার জনবল ও অর্থবল অতি সামান্য, আপনার মতন রাজাধিরাজের সপারিষদ অতিথিসেবা করার সামর্থ এই সময় আমার নেই, তাই...’’

‘‘এ তো অতি উত্তম কথা!’’ রাজ্য সোৎসাহে বললেন, ‘‘আপনার কুন্ঠিত হওয়ার কোন কারণ নেই, মিত্র। আমি অবশ্যই যাব, আমার সঙ্গে শুধু মহামাত্য আমার মাতুল-পুত্র ভণ্ডী আর চিরসহচর কুন্তল যাবে।’’

‘‘আপনি সত্যিই মহদাশয়। আজ আমি অত্যন্ত পরিতৃপ্ত মনে বিদায় নিচ্ছি।’’

সভা ভঙ্গ হল। গৌড়েশ্বর রাজ্যবর্ধনকে আলিঙ্গন করে বিদায় নিলেন।


*** (সংবাদকের দেওয়া সংবাদে একটি মাত্র ভুল ছিল। সে মালবরাজ দেবগুপ্তর দ্বারা কান্যকুব্জ অধিকারের সময় সন্ন্যাসীবেশী গৌড়েশ্বর শশাঙ্ককে চিনতে বা তাঁর ভূমিকার কথা জানতে পারেনি। তাই স্থান্বীশ্বরের রাজপুরুষদের তাঁর কথা না বলায় কেউ তাঁর কথা জানতে পারেন নি। সুতরাং অভিযানে রণকৌশল ইত্যাদির পরিকল্পনার সময় শশাঙ্কের বিষয়ে কোনও চিন্তাই কেউ করেননি। সকলের অজান্তে ঈশাণ কোণের একটি অজানা মেঘ থেকে যে কি ভীষণ দুর্যোগ ঘনিয়ে আসতে পারে তা কল্পনাতীত।) --- (ক্রমশ প্রকাশ্য)


0 comments: