স্মৃতির সরণীঃ মেরিন মুখোপাধ্যায়
Posted in স্মৃতির সরণী
স্মৃতির সরণী
পাথরপ্রতিমার ডায়রি
মেরিন মুখোপাধ্যায়
“এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো। ...
... কোকিলের গান ব্যবহৃত হ'য়ে গেছে।’’
পাথরপ্রতিমায় প্রথম এসে পৌঁছই একটা জানুয়ারী মাসে; তখন ঠাণ্ডা বেশ। জেলা অফিস থেকে শৈলজা-দাদা যখন গাড়ি করে ব্লক অফিসে পৌঁছে দিলেন তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। কিছু বুঝতে পারলাম না। শুনলাম সামনেই নদী। সামনে? আমার মেণ্টাল ম্যাপ বলছে চারিদিকে নদী। গুগ্ল ম্যাপ-ও তাই বলে। এরই মধ্যে ১৫ খানা গ্রাম পঞ্চায়েত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। যাঁরা প্রথম প্রজন্মের পঞ্চায়েত দেখেছেন, তাঁরা গ্রাম পঞ্চায়েত গুলিয়ে ফেলেন। বরং অঞ্চল পঞ্চায়েতে তাঁরা স্বচ্ছন্দ। সেই সময়ে এই গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে একটা কথা চালু ছিল খুব – “ওপরে ভগবান, নিচে প্রধান!!” মনে আছে বহুদিন আগে, অন্য এক ব্লকে, গ্রামের মায়েদের সঙ্গে বাচ্চাদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা আর পুষ্টির বিষয়ে কেন্দ্রের ভূমিকা নিয়ে একটা মীটিং চলছে; এমন সময় ঝড়ের মতো এক প্রৌঢ় ব্যক্তির আবির্ভাব। কল্পনা করলে একেবারে ‘আবদুল মাঝি, ছুঁচলো তার দাড়ি’, সেই চেহারা! এসেই চেয়ারে ধপ করে বসে বললেন – “আই ইজ্ দ্য এক্স-প্রধান। এখানে কি হচ্ছে আমার জানা দরকার।”
পঞ্চায়েতের সে যুগ গিয়েছে।
এই লেখা অবশ্য পঞ্চায়েতের চালচিত্র নয়। এই গুলো টুকরো টুকরো এলোমেলো স্মৃতি।
দিন ১:- বিডিও সাহেবের গেস্ট রুমে থাকার একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা হয়ে গেল। আধা ঘণ্টার মধ্যে কানাই বাবুর প্রবেশ। ব্লকের সিআই। তবে কোঅপারেটিভ সার্ভিসে নিজেকে আটকে রাখেননি। মোটামুটি গোটা ব্লক নখদর্পণে। এলোমেলো দু-চারটে কথার পরেই বললেন, ‘‘রাতে জানলা বন্ধ করে শোবেন।’’ ‘‘কেন মশাই? সুরক্ষা নিয়ে কোনো সমস্যা আছে না কি? খোদ ব্লক-অফিস কমপাউন্ড-এ আছি যে!!’’ উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘‘মশারি টাঙিয়ে, ভালো করে গুঁজে শোবেন।’’ ‘‘কেন মশাই, মশা আছে না কি? এই শীতে?’’ হেসে বললেন, ‘‘না না; কারও মনে থাকে না এটা কাকদ্বীপ মহকুমা; সুন্দরবনের দেশ। সাপ একটু বেশিই আছে।’’ বলে মুচকি হেসে প্রস্থান। সে রাতটা আর ঘুম এল না। তার পরদিন থেকে রোজ তোষক, লেপ উল্টিয়ে দেখে, মাশারি গুঁজে, খাটের তলায় টর্চের আলো ফেলে, জানলা বন্ধ করে, তবে ঘুম।
দিন ২:- সকালে উঠে নদী ঘাটে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে পড়লো দাঁড়িয়ে আছি পশ্চিমবাংলার একেবারে শেষ প্রান্তে। রামগঙ্গা ফেরিঘাট। এখানে নদী ঠিক চেনা নয়; সমুদ্দুরের আভাস লেগে গেছে, টাইডাল – শান্ত, শ্লথ ভাবের বদলে এই শেষ পৌষেও তার গায়ে সাগরের অশান্তি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জোয়ার লেগে গেল; সামনে মকর স্নান, গঙ্গাসাগরের হাওয়া দিচ্ছে। শুনেছি এরপরেও আরও দক্ষিণ প্রান্তে মানুষ আছেন, জি-প্লট, কে-প্লট একেবারে দক্ষিণতম, প্রায় সমুদ্রের ওপরে দ্বীপ। এবার যাওয়া হলো না ... ফিরে আসতে হবে।
গতকাল রাতে ব্লক অফিসের পাশেই নিমগাছে প্যাঁচা ডাকছিল... বড় নিষ্ঠুর ডাক... পাখিসুলভ প্রায় কিছুই ওর মধ্যে নেই। তাই সকালে উঠেই নদীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম; অন্য রকম শব্দ শোনার আশায়... স্টীমারের ভেঁপু শুনতে মন্দ লাগলো না।
দিন ৩:- শেষ বিকেলে কথা হচ্ছিল বৃদ্ধ মানুষটির বাড়ির দাওয়ায় ব'সে। এই কাকদ্বীপ মহকুমাতেই সুন্দরবন অঞ্চল শুনে জিগ্যেস করলাম, ‘‘বাঘ দেখেছ কত্তা?’’ সে বললে, ‘‘বাঘ ওভাবে দেখা যায় না বাবু। বাঘ কেউ দেখেনি। যারা বলে বাঘ দেখেছি তারা মিছা কথা কয়। আমার জ্যাঠারে বাঘে নিয়ে গেস্ল ... বাবার সঙ্গে জ্যাঠা বনে কাঠ কাটতে গেছিল ... তিন হাত দূর থেকে বাঘে টেনে নিল ... বাবা টের পায়নি ... বাঘ দেখতেও পায়নি। বাবু, যারা বাঘ দেখে তারা আর ফেরে না।’’
সন্ধ্যার আঁধারে গা-টা ছমছম করে উঠল ...
দিন ৪:- নদীর ওপারে দুর্বাচটি গ্রাম। খেয়া পার হতে লাগলো ১ টাকা। এখনও আছে না কি এরকম দাম? এক টাকা? আচ্ছা তাই সই। ওপারে পৌঁছে ভ্যানো; তারপর আবার বাস। দুর্বাচটি পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে গেল। সরু কাল্ভার্টের ওপর দিয়ে গ্রামে ঢোকার মুখেই চায়ের দোকান। চা খেতে খেতে শোনা গেল গ্রামের ৩০% পুরুষ লেবারের কাজ নিয়ে চলে যায় কেরালা... প্রতি বছর। পয়সা সেখানে অনেক বেশী। চায়ের দোকানেই দু-তিন জন দিব্যি মালয়ালী ভাষায় কথা বলছে। আমাদের সঙ্গী ফিলিপ কেরলের লোক। মাতৃভাষায় জবর আড্ডা শুরু হয়ে গেল।
দিন ৫:- গ্রাম চৈতন্যপুর। পুরনো একটা লজঝরে অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে চলেছি তো চলেছিই। বেশ খানিকদূর গিয়ে (যাকে আমাদের ভাষায় বলি ‘বেশ ইন্টেরিয়র’) পেল্লায় বাড়ি দেখে চমকেই গেলাম। জানা গেল, অনুকুল ঠাকুরের আশ্রম। শোনা গেল, এখানেই হচ্ছে স্বনির্ভর দলের প্রশিক্ষণ শিবির। গিয়ে বসা গেল। আমাদের ভূমিকা দর্শকের। দেরী হয়েছে পৌঁছতে, তাই চটপট বসে গেলাম।
মন দিয়ে শুনছি। হঠাৎ পিঠে খোঁচা! চমকে উঠে পিছন ফিরতেই দুটো হাসি হাসি মুখ। একজন পাঁচ বছর, একজন ছয় (পরে জেনেছিলাম), একজনের হাতে ব্যাট, অন্যজনের হাতে বল। যারা যারা প্রশিক্ষণ শিবিরে রয়েছে, বোধহয় তাদের মধ্যে আমাকেই পেয়েছে ভরসা করার মতো। চাপা গলায় নির্দেশ এল খেলায় যোগ দেবার। আমিও এদিক ওদিক তাকিয়ে উঠে পড়লাম। সত্যিই তো! বল্লেবাজ আছে, গেন্দ্বাজ আছে – ফিল্ডার কই? তাই সারাদিন ট্রেনিং মনিটরিং (যা করতে গেছিলাম আর কি) লাটে তুলে ঝিঁঝিঁতেই মন দিলাম। সময় কেটে গেল।
দিন ৬:- দিগম্বরপুর গ্রাম পঞ্চায়েত। দাওয়ায় বসে কথা হচ্ছিল গ্রামীণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ঝুঁকি কি? ইয়ে... মানে ভাল্নারেবিলিটি। বুঝলেন? হ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা! ভাল্নারেবিলিটি কি? কেন, ঝুঁকি!! ওঃ, তাই তো! তা, আপনি দিদি, কেন ঝুঁকিপূর্ণ? আসলে, আমার বাচ্চাটা হাসপাতালে না, বাড়িতে হয়েছিল, পাশ করা ডাক্তারের সাহায্য ছাড়াই, অনেকগুলো টিকে দেওয়া হয়নি; সারা বছর ভালো করে খাবার পায় না — অপুষ্টি, মেয়েটার অল্প বয়েসে বিয়ে দিতে হল, বছর না ঘুরতেই বাচ্চা; বিয়ে না দিয়ে রাখার আবার আরেক বিপদ, চারদিকে দালাল ঘুরছে। তারপর সুন্দরবন অঞ্চল, প্রায়ই সাপে কাটে। হাসপাতালে সাপের বিষের ওষুধ ফুরিয়েছে। এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বেরিয়ে এল। একে একে। খুব একটা শিক্ষা হল। ভাষার/শব্দের মারপ্যাঁচ এড়িয়েও মানুষ বোঝে; যদি কিনা সত্যিই বোঝাতে চাই।
দিন ৭:- প্রশ্নটা ঘুরছে একে একে। সেই এক ‘ঝুঁকি’। আপনার কি মনে হয়? এর মোকাবিলা করবেন কি করে? করেন কি করে? বিষয়টা ভালো না; সরাসরি আপদ-বিপদ আর তার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন। কার স্মৃতিতে কি ধরা আছে জানা তো নেই। অবশ্য পনেরো মিনিট কেটে গেছে, আর সবাই বেশ নির্মোহ ভাবে উত্তরও দিচ্ছে। প্রোজেক্টের সবাই ঝড়ের মতো নোট নিচ্ছে – কম্যুনিটি স্পীকিং ফর ইটসেল্ফ বড় একটা দেখা যায় না; এখানে শুধু স্পীকিং নয়, সমাধানের রাস্তাও বাৎলাচ্ছে। দিব্যি চলছে। এবার আপনি বলুন; এবার আপনি – শুধু এইটুকু খেই ধরিয়ে দেওয়া। “রীতাদি, এবার আপনি” বলতেই সুর কেটে গেল – কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন দলনেত্রী রীতা। কি হল, উনিই তো এতক্ষণ সবাইকে কথা বলাচ্ছিলেন! তাহলে? পরের ঘটনা বলার মতো, লেখার মতো মনের জোর এখনো খুঁজে পাইনি।
হাওয়া ভারী হয়ে গেল।
দিন ৮:- রামগঙ্গা গ্রাম। বিকেল বেলার মীটিং। জোরদার আলোচনা চলছে পঞ্চায়েতের কাছে কি কি দাবী এখনও প্রাপ্য। জনা তিরিশ মহিলা-র হইহই, সমস্বর... সরগরম স্কুলবাড়ি। এর মধ্যে কারও একজনের চোখে পড়লো অন্ধকার কোণে মুখ শুকনো করে একজন বসে। “কি রে, চুপ করে আছিস কেন? মুখ শুকনো কেন? খাসনি দুপুরে? রান্না করিসনি? কেন? তোর মেয়েটা কই? স্কুলে যায়নি আজ?” উত্তরের অপেক্ষা না করে, উপর্যুপরি প্রশ্ন। এসে থামলো “ওঃ, আজ আবার স্বামী গায়ে হাত তুলেছে? চল তো দেখি!” জনা তিরিশের দল মীটিং পণ্ড করে চলল চড়াও হতে। স্বামীজীর কপালে আজ অশেষ দুঃখ।
দিন ৯:- রেডিও শোনেন বুঝি? এখনও? হ্যাঁঅ্যাঅ্যা। শুনতে হয় তো, কাজের প্রয়োজনেই। আচ্ছা? কি শোনেন? কেন, রঙিন পাখির চাষ! এরকম অনুষ্ঠান হয় বুঝি? হয় তো! হপ্তায় একদিন। অনেক কষ্ট করে আমরা দশজন মেয়ে ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছি। কেউ সাহায্য করেনি, খোঁজ নেয়নি, ট্রেনিং দেয়নি। তাহলে? কেন, ওই রেডিও শুনে শুনে শেখা! আগে ফি হপ্তায় পাখি মরে যেত জানেন? এখন মরে না। আমরা শিখে গেছি।
গোটা ব্লকে এই একমাত্র স্বনির্ভর দল একটু অন্যরকম জীবিকা বেছে নিয়েছে। বদরিকা, মুনিয়া পাখি পালন। সেটা দেখতেই আসা।
শীতের ধূসর বিকেল, হলুদ, নীল, কমলা রঙের পাখির ওড়াউড়িতে পলকে রঙিন।
দিন ১০:- ফিরতি পথে সঙ্গে দপ্তরের উচ্চপদস্থ আমলা। গাড়ির মাথায় লাল বাতি জ্বলে। একটু এগিয়ে মোড় ঘুরতেই দেখি প্রচুর লোকের জমায়েত। রাস্তায় চাপ চাপ রক্ত; ধোয়া চলছে। শোনা গেল, একজনকে মিনি-ট্রাক ধাক্কা মেরে পালিয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বাঁচার আশা কম। পাঁচ কিলোমিটার দূরে ট্রাকটিকে আটকও করা হয়েছে। গ্রামের পুরুষরা জটলা করছেন, আলোচনা করছেন। এরপর মহিলারা যেটা করলেন, সেটা অভুতপূর্ব। দশ বারোজন মিলে মোটা গাছের গুঁড়ি এনে রাস্তা আটকে অবরোধ। প্রশাসন না আসলে উঠবে না। আমরা গাড়ির ভেতর অধৈর্য। স্যর প্রশাসনকে ফোন করুন না। আপনি (বকলমে আমরা) কেন আটকে থাকবেন? আপনি জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চেরও উপরে। জোর ধমক খেলাম। “মানুষের সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে শেখ।” অগত্যা লালবাতি নিভিয়ে বসে থাকা। অবরোধ উঠল তিন ঘণ্টা পরে। পুলিশ আসার পর। হ্যাঁ, ওখানে এখনও পুলিশই প্রশাসন!
0 comments: