মুক্তগদ্যঃ পল্লববরন পাল
Posted in মুক্তগদ্য
মুক্তগদ্য
নিজস্ব কুরুক্ষেত্রে
পল্লববরন পাল
এক
উঠোন সেজে উঠেছে আবর্জনা-আগাছা-জঞ্জালে – যেন বসন্তের সাজ – শীতের বাদামি ঝরাপাতা আর বৃক্ষের কঙ্কালে – সকলের চোখের সামনেই একটু একটু করে নির্মাণ –অথচ সময়ের কোতোয়ালি দৃষ্টিকে নিপুণ অভিমানের আড়ালে রেখেই।
সদর দরজা থেকে আকাশ-ছাদউঠোন পেরিয়ে দালানে ওঠার সিঁড়ি। পঞ্চাশোর্ধ প্রাচীন বাড়ির পলেস্তারা খসাইঁটের ভাঁজে ভাঁজে বনস্পতির উলঙ্গ শেকড়বাকড় – যেন দাঁতালো বিদ্রুপ হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিবেশী রোদ্দুরে। ধুসর প্রৌঢ় চুনকামি দেয়ালে দেয়ালে, কড়িকাঠের সেগুনের অসংখ্য উইশিরার বক্ররেখায় আর কব্জা ভাঙা জানলার খড়খড়ি পাল্লার ধুলোয় আটকে আছে পঞ্চাশ বছর আগের হৈহৈ অধ্যায়–আবছা ক্লান্ত মাকড়শার জালে ঝুলে থাকা টুকিটাকি স্বপ্ন – যেন দূর সম্পর্কের কোনো রঙ চটা শিলালিপির দীর্ঘশ্বাস।
একএকটা ঘরের মধ্যে এক একটা মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস – আবাল্য স্মৃতির হলুদউপন্যাস। কেউ লেখেনি, কেউ পড়েনি, তবু কী সদর্প সাড়ম্বর অক্ষর ধুলোয় নিপুন প্যাপিরাস চাষ!
রোজের যাওয়া আসার এতোদিনের অভ্যস্ত পথে বাড়িফেরার বিষণ্ণ গোধুলি অকস্মাৎ হাহাকার করে উঠলো।
কাল রবিবার। এই মলিনআবর্জনা-ধুলোর বিরুদ্ধে ঘর্মাক্ত আস্ত একটা দিনের হার-না-মানা লড়াই...
ও শৈশব,
সন্ধ্যেবেলা তাড়াতাড়ি এসো – উষ্ণ ধোঁয়ার আলপনা আঁকা পেয়ালায় জীবনমুখি চায়ের সবান্ধব নিমন্ত্রণ রইলো।
-------------------------------------------
দুই
একটা দরজা। তার দু’দিকে দু’টো জানলা। নীল। মাথার ওপর সিঁদুরে লাল ত্রিভূজ ছাদ। দরজার নিচে তিনটি সিঁড়ির ধাপ। সেই ধাপের প্রান্ত থেকে একটা খয়েরি রঙের রাস্তা এঁকেবেঁকে নাচতে নাচতে গেছে পুকুর পাড়ে – যে পুকুরে ভেসে যাচ্ছে সাদা হাঁস, তার গোলাপি ঠোঁট। পুকুরপাড় ছাড়িয়ে রাস্তা গেছে মাঠের দিকে। সবুজ মেঘের মতো গাছ। টঙে বসে আছে পাখি। বাড়ির পিছনে ঘন জঙ্গল। তারও পিছনে ধূসর পাহাড় চূড়োর মাঝখানের উপত্যকায় উঁকি দিচ্ছে আগুন সূর্য।
শৈশব।
আমাদের প্রত্যেকের। এই অবধি হুবহু একই রকম।
আমরা সবাই সেই নীল দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলাম খয়েরি রাস্তায়।
কেউ কেউ দৌড়ে গেছি মাঠে। গাছের ছায়ায় কেউ বসেছি বাঁশি হাতে। হাওয়ায় হাওয়ায় ঘাসের ছন্দে সুর তুলতে। তরতর করে কেউ উঠে গেছি মগডালে – পাখির কাছে গিয়ে বলেছি – তুমি কি ব্যাঙ্গমা? তবে মেঘের দেশের রূপকথার কাহিনী শোনাও। এ ডাল থেকে কেউ ও ডালে লাফ দিয়ে দোল দোল দুলুনি। ডালের গোড়ায় বসে কেউ একমনে একের পর এক ফল খাচ্ছি। কেউ কাঁচা ডাল ভেঙে মড়াৎ।
কেউ কেউ ঝাঁপ পুকুরের জলে। কেউ ডুব সাঁতারে মাছের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। কেউ হাঁসের কাছে পাঠ নিচ্ছি ভেসে থাকার। কেউবা স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে উঠে এলাম।
আমাদের কারুর কারুর জঙ্গলের রোমাঞ্চে নেশা। কেউ আবার জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের দুর্গম পাথরের খাঁজে খাঁজে ভর করে চলেছি শিখর জয়ের লক্ষ্যে। কেউ আরো দূরে পাহাড় পেরিয়ে চলেছি সূর্যসন্ধানে।
দিনের শেষে ফের সবাই যে যার মতো ফিরে আসি ঐ সেই খয়েরি রাস্তা ধরে।
শৈশবে। নীল দরজায়।
--------------------------------------------------------------------
তিন
কৃষ্ণ বলিলেন -
মোবাইল টেপো। ছবি তোলো। বেচে দাও। ব্যাস।
কলকাতা ডায়মণ্ডহারবার রাণাঘাট তিব্বত। সিধেরাস্তা। সোয়া ঘন্টার পথ।
যুদ্ধের দুটিমাত্র পিঠ। মুদ্রার মতোন। হার আর জিত। হেড আর টেল। ত্রিসিংহ স্তম্ভ পিঠ, যাকে তুমি জয় বলে জানো – ভুল। স্তম্ভ তো স্থবিরতা, ইতিহাস, সমাপ্তি চিহ্নমাত্র, মৃত। অন্য পিঠে দ্যাখো – সংখ্যা – গণিত – মুদ্রামান, তোমার অর্জন – জয়। সমগ্র আকাশ।
মাটি আর আকাশ – মাঝখানে অনর্থক কুয়াশার দিকশূন্য স্তর – সম্পর্ক স্মৃতি ইতিহাস - মায়া। শুধু মুধু বাড়িয়ে কী লাভ? ধুয়ে জল খাবে? মায়ার চেয়ে মুদ্রার দাম বেশি। সম্মানও।
মায়া নয়, মুদ্রায় এসো।
যে অধ্যায় সমাপ্ত – তাকে বেচে দাও। যে সময় ডিঙিয়ে এসেছো – বেচে দাও। যে বইয়ের পৃষ্ঠা হলুদ – বেচে দাও।
বেচে দাও। বেঁচে ওঠো।
একটি মাত্র চন্দ্রবিন্দুর ব্যবধান। হলুদ চুম্বনের দাগ – তোমার কপালের।
পাহাড় জঙ্গল মাঠ পুকুর। হাঁস মাছ পাখি ফল ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী রূপকথা সব। দাও বেচে। নইলে প্রোমোটরকে দাও। ভেঙে গুঁড়িয়ে সমতল করে বানাবে স্বর্গরাজ্য। বিলাস আমোদ। অনেক মুদ্রা পাবে বিনিময়ে। লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি।
হে সারথি মধুসূদন,
কিছু যে বাদ পড়ে গেলো তালিকায়।
কী ভাবে বেচবো সূর্য? জন্মসূত্র?
নীল দরজা? মাতৃ যোনি?
আমরা তো সকলেই যে যার মতোন করে সূর্য সন্ধানী। শৈশবে ফিরতে হবে সন্ধ্যেবেলা। নিমন্ত্রণ আছে।
0 comments: