1

ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব

Posted in






ধারাবাহিক


আমার বারুদবেলা-----১০
স্বপন দেব 



ভারতরক্ষা আইনে বিনা বিচারে বন্দী থাকাকালীন রুনু গুহ নিয়োগীর পাশবিক অত্যাচারের ফলস্বরূপ আমার স্নায়ুতন্ত্রের রোগে আমি প্রায়ই মাথায় একটা অসহ্য যন্ত্রনায় কাতর হয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতাম। কখনও বা পাগলের মত চীৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিতাম। ফলে জেল থেকে আমাকে নীলরতন সরকার হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে একটি কেবিনে প্রখ্যাত নিউরো সার্জন ডাক্তার অশোক বাগচির চিকিৎসাধীনে রাখা হয়। সেখানে যখন সুস্থ থাকতাম, নানান রকম দুষ্টুমি করতাম আমি। ডাক্তার বাগচির নির্দেশ মত পুলিশ কিন্তু আমার কেবিনে এবং ওয়ার্ডে থাকতে পারতনা। তারা ওয়ার্ডের বাইরে একটি বেঞ্চে বসে লক্ষ্য রাখতো। বৃষ্টি পড়লেই আমি ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে বাইরের ফাঁকা জায়গায় চলে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতাম। আমার ৪/৫ জন পাহারাদারকেও বাধ্য হয়ে আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ভিজতে হত। আমি তো কেবিনে এসে জামা পালটে নিতাম। কিন্তু ঐ পুলিশ বেচারাদের সারাদিন ভিজে উর্দি পরেই আমাকে নজরে রাখতে হত! আমার এই সব দৈনন্দিন অত্যাচারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে তারা বোধহয় রোজই রিপোর্ট করত ঊর্ধতন কতৃপক্ষের কাছে এবং ঊর্ধতন কতৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র দফতরে। এইসবের ফলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে আমার অসুস্থতা, বর্তমান অবস্থা, আরও কতদিন লাগবে আমার সুস্থ হতে এবং এছাড়া আর কি কি করণীয় জানতে চেয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয় ডাক্তার বাগচিকে।

পরদিন সকালে ডাক্তার বাগচি আমাকে ভিসিট করতে এসে আমাকে জানালেন স্বরাষ্ট্র দফতরের চিঠিটির কথা এবং জানতে চাইলেন কি উত্তর দিলে আমার সুবিধে হয়। আমি বলেছিলাম, আমাকে চীনে পাঠিয়ে দিতে বলুন চিকিৎসার জন্যে! উনি বললেন, এটা আমি পারিনা। চাইলে ভেলোর বা অন্য কোথাও পাঠাতে পারি। আমি শুনে বললাম, একদম না! পরে উনি বলেছিলেন, উনি নাকি লিখে পাঠিয়েছেন যে আমার এই রোগটি অত্যন্ত জটিল, আমার চিন্তা ভাবনা করার প্রায় কোনও ক্ষমতাই নেই আর এর চিকিৎসা বহুদিন ধরে চালাতে হবে এবং তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এইসবের পরিণতিতে কিনা জানিনা, ১৯৬৯ সালের মে মাসে একদিন আমার রিলিজ অর্ডার চলে এল সরাসরি হাসপাতালে। বিকেলে বাড়ির লোকজন যখন আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে এলেন, গোটা ওয়ার্ডের ডাক্তার, নার্স, এমন কি যেসব নার্সের সেইসময় ডিউটি ছিলনা তাঁরাও এবং ওয়ার্ডের প্রায় সমস্ত রোগী বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে শুভেচ্ছা জানালেন! আমি মুক্ত হলাম প্রায় ১৬ মাস পর।

বেরিয়ে এসে মাত্র দিন পাঁচেকের বিশ্রাম। অ্যামেরিকা তখন ভিয়েৎনামের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালাচ্ছে আর সমান তালে তাকে প্রতিহত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে ভিয়েতনাম। কলকাতার ছাত্র যুবকরা তখন ভিয়েতনামের সমর্থনে মিটিং, মিছিল, ইউ এস কনসুলেটের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। পোস্টারে পোস্টারে আর স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত কল্লোলিনী কলকাতা... “তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম!”

আমরা, মানে নকশালপন্থী ছাত্র যুবকরা ঠিক করলাম আরেকটু বিপ্লবী কায়দায় এর প্রতিবাদ জানানো উচিৎ। তখন মেট্রো, লাইটহাউস, গ্লোব আর এলিট সিনেমা হলে নিয়মিত হলিউডি সিনেমা দেখানো হত। আমরা ঠিক করলাম এই সব হলের একটাকে বেছে নিয়ে আমরা অপারেশন চালাবো। এর আগে এস ইউ সি এর মত কিছু দল সিনেমা হলে ঢুকে স্ক্রিন ছিঁড়ে দেওয়া বা দুএকটি আলো পাখা ভেঙ্গে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। পরের শো থেকেই আবার চালু হয়ে যেত সিনেমা। আমরা ঠিক করেছিলাম প্রোজেকশন রূমে ঢুকে সিনেমার রীলগুলি এবং প্রোজেকশন বক্সটাই অকেজো করে দেব। ২০শে জুলাই, সেদিন আবার আমার জন্মদিন, স্থির হল যে আমরা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবস পালন করব। ২০শে জুলাই বিকেল চারটের সময় হেদুয়া পার্ক থেকে একটা নিরীহ মিছিল বার করা ঠিক হল। বেশ কিছু ছাত্রী এবং যুবতীদের যোগদান করানোর চেষ্টা হল যাতে পুলিশ প্রশাসন কিছুতেই এটাকে একটা হিংসাত্মক মিছিল না ভাবে। সেইসময়ে ধর্মতলায় মেট্রো সিনেমার সামনে একটি আর লিন্ডসে স্ট্রীটে ঢোকার মুখে একটি পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকত আর সেখান দিয়ে কোনও মিছিল গেলেই ওরা মিছিলের সামনে পেছনে কর্ডন করে নিয়ে যেত। আমরা ঠিক করেছিলাম হেদুয়া থেকে বেরিয়ে মিছিলটি ধর্মতলা এবং লিন্ডসে স্ট্রীট পেরিয়ে যাদুঘরের কাছে গিয়ে হঠাৎ ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। আর এই মিছিলের মধ্যেই থাকবে গোটা চল্লিশের একটা অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ, যাদের কাছে থাকবে বোমা এবং ধারালো অস্ত্রাদি। মেট্রো সিনেমা হলের আগেই এরা চাঁদনি থেকে একে একে মিছিল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লাইট হাউস সিনেমার সামনে জড়ো হবে। আর আমাদের নিরীহ মিছিলটা মেট্রো সিনেমা আর লিন্ডসে ক্রসিং-এর মোড়ে দাঁড়ানো পুলিশ ভ্যান দুটিকে মিছিলের আগে পরে নিয়ে এলাকাটা পুলিশমুক্ত করে দেবে। ওরা সেই অবসরে লাইটহাউস সিনেমা হলে ঢুকে সিনেমার রীল এবং প্রোজেকশন বক্স জ্বালিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে যাবে। কিন্তু না। সেটা সম্ভব হলনা। কারণ খবরটি কোনও এক বিশ্বাসঘাতক ইতিমধ্যেই পুলিশের কানে তুলে দিয়েছিল। সেদিনটা ছিল রবিবার। হেদুয়ার জমায়েৎ আমাদের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে প্রায় হাজার দুইয়ে পৌঁছেছিল। স্লোগান দিতে দিতে ঠিক সাড়ে চারটের সময় আমাদের মিছিল হেদুয়া থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পড়তেই সামনের বেথুন কলেজ আর পিছনের স্কটিশচার্চ কলেজের ভেতর থেকে হুড়মুড় করে ধেয়ে এল লাঠিধারী সি আর পি। বেধড়ক লাঠি চালানো শুরু হল। মহিলারা মাটিতে পড়ে যেতে তাদের ওপর বেধড়ক লাঠি চালানো শুরু হতে আমরা, মানে ছেলেরা, তাদের পিঠের ওপর শুয়ে লাঠির আঘাত নিজেদের পিঠে নিচ্ছিলাম। সন্ধ্যে সাড়ে ছটা নাগাদ চারটি ট্রাকে আমাদের তোলা হল। মহিলারা ছাড়া পেলেন। আমাদের মধ্যেও অনেকেই পালাতে পেরেছিলেন। কিন্তু তবুও প্রায় শ আড়াই বিক্ষোভকারীকে নিয়ে ট্রাক যখন লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপে এল, তখন প্রায় রাত আটটা। সেন্ট্রাল লক আপে একসঙ্গে এত বন্দী রাখার ব্যবস্থা ছিলনা তখন। পুলিশ পাহারায় আমাদের সেন্ট্রাল লক আপের সামনে বসিয়ে রাখা হল। এর মধ্যে একবার রুনু গুহ নিয়োগী এসে আমাকে দেখে গেছেন এবং বলে গেছেন কাল সকালে দেখা হবে! তবে এর পরে যা ঘটল, তা একদিকে যেমন মজার আবার অন্যদিকে তেমনই রোমাঞ্চকর। পরের কিস্তিতে শোনাব সেই কাহিনী। (চলবে)

1 comment:

  1. তথ্য ও কাহিনীর ঠাস বুনোনে লেখা এক অসামান্য যুগের দলিল!

    ReplyDelete