0

ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জল রেখা ৩
নন্দিনী সেনগুপ্ত



--‘না দাদু, এইরকম পাহাড় নয়।’

--‘তাহলে দিদিভাই... কি করবি?’

--‘কি করব?’

--‘ফিরে যাবি?’

---‘না-আ-আ-আ-আ...’

লাফিয়ে উঠে সর্বশক্তি দিয়ে বলে ওঠে নীরদা। বলে যায়.... ‘ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। এই জায়গাটা দারুণ। দেখব, দেখব কি আছে।’

মৃদু হাসি খেলে যায় সুনন্দর মুখে। শিশুর উচ্ছ্বাস দেখে নিজেও কি ফিরে যেতে চান নিজের অল্প বয়সে? শৈশব, না কৈশোর? কোন স্মৃতি উঠে আসে তাঁর মনে? ভেসে আসে আবছা ছবির মত কৈশোরের মাদারিপুরের স্মৃতি। কিছু স্মৃতি তিনি ভুলতে চান, কিছু রেখে দিতে চান খুব যত্ন করে। কিন্তু মানুষের মন কি আর অত বাছাবাছি করতে পারে? সবরকম ছবি ভিড় করে আসে। পাহাড়ের শীতল হাওয়ায় শ্বাস টানেন সুনন্দ। মেঘ নেমে এসেছে পাহাড়ের গায়ে। তাঁর কি আড়িয়াল খাঁয়ের সেই জলের গন্ধের কথা মনে পড়ছে?

নীরদা আবার লাফিয়ে উঠে বলে, ‘যাবো না-আ-আ-আ। এইখানে থাকবো। কলকাতায় যাবো না।’

নাতনির কথায় বর্তমান সময়ে ফিরে আসেন সুনন্দ, সুনন্দকিশোর মুখোপাধ্যায়। বলেন, ‘যাবি না? বেশ, তাহলে চল, তোকে এইখানে কোনও বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিই। কলকাতায় ফিরেও বা কি হবে? সেই এক কমলা ইউনিফর্ম, সেই এক পাড়ার ইস্কুল। সেই একই দিদিমণি আর ম্যাডামদের হাঁড়িপানা মুখ। প্যাচপেচে গরম। তার চেয়ে এখানেই বেশ। কত নতুন নতুন বন্ধু হবে তোর। নতুন রঙের ইউনিফর্ম হবে বেশ। সিলেবাসও আলাদা হবে। কি বলিস!’

নাহ, এতটা হজম করা বেশ কঠিন হবে নীরদার পক্ষে। সে বেশ বুঝতে পারছে, নতুন বই, নতুন স্কুল, নতুন ইউনিফর্ম, নতুন টিচার এতদূর অবধি ঠিকই আছে।কিন্তু, নতুন বন্ধু হওয়া মানে পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে যে রোজ দেখা হবে না, সেটা না বুঝবার মত শিশু তো সে নয়। ক্লাস ফাইভে উঠেছে সে। নাহ, সে ভাবতেই পারছে না যে তার প্রাণের বন্ধু নিবেদিতার সঙ্গে তার রোজ দেখা হবে না। কাজেই, নিজের অজান্তেই মিলিয়ে যায় তার মুখের হাসি। শুধু কি বন্ধু? বাড়ির সবাই, দাদু, ঠাম্মা, দেয়াসি, ছোটিদাদান, ছোটিআম্মা, কাকাই, কাম্মা, দাদাই, বউদি, সর্বোপরি নীল... তার প্রিয় ভাই নীলকে ছেড়ে সে কি ভাবে থাকবে? আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না? যদি দাদু নীলকেও এখানে ভর্তি করে দেয়, তাহলে সে থাকতে পারবে। সেটাই কিছুক্ষণ ভেবে সে বলেও ফেলে দাদুকে।

হাহাহাহা করে হেসে ওঠেন সুনন্দ। বলেন, ‘আরে, নীল কোথায় ভর্তি হবে, সেটা ত ঠিক করবে ওর বাবা মা। তাছাড়া দেখ, নীল তো এখন সবে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হল। ওকে তো হস্টেলে নেবেই না। এখানে থাকতে হলে তোকে একাই থাকতে হবে। মিশনারি বোর্ডিং স্কুল। দুর্গাপূজাতেও ছুটি দেবেনা। সেই ক্রিসমাসে বাড়ি যাবার পারমিশান পাবি।’

নীরদা কিছু বলে না, কিন্তু বেড়াতে এসে এরকম একটা প্রস্তাবে সে খুশি হয়না। পাহাড়, মেঘ, আশেপাশের গাছপালা... এত সুন্দর পরিবেশে হঠাৎ নিজেকে খুব একা মনে হয় ওর। এর মধ্যে ঠাম্মাও উঠে এসেছে পাহাড়ের উপরে মন্দিরের চাতালে-- যেখানে ওরা বসে আছে। ঠাম্মা পায়ের বাতের ব্যথায় একটু পিছিয়ে পড়েছিল ওদের থেকে। সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়, তাই।

এষা কিন্তু ঠিক খেয়াল করেছেন নীরদার গম্ভীর মুখ। পিঠে হাত রাখলেন এসে। অল্প অল্প হাঁপাচ্ছেন। পিঠে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে বলে ওঠেন,... ‘কি হল নীরি, নীরু, এই পাহাড়টা নয়? এটা বুঝি তোর স্বপ্নের পাহাড়টা নয়? যাকগে, না হল, দ্যাখ, দ্যাখ একবার, কি সুন্দর জায়গাটা। জানিস তো-- ড্রাইভার বলছিল পিছনের ঐ জঙ্গল থেকে নাকি হাতির দল বেরিয়ে আসে। একটু পরেই দিনের আলো মরে যাবে, তখন নাকি ওরা পিছনের ঝর্ণায় জল খেতে আসবে। এই পাহাড়ের মন্দিরের চাতাল থেকে, দ্যাখ, দ্যাখ চারপাশ দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের নীচের জঙ্গলে নাকি হাতি দেখা যাবে।’

একটানা এতগুলো কথা বলে আরও হাঁপাতে থাকেন এষা। নীরদা কিছু বলে না, ঠাম্মাকে শুধু দেখায় বসবার জন্য পাথরের বেঞ্চিটা। এষা ধীরে ধীরে বসেন।নীরদাও বসে ঠাম্মার পাশে। কিন্তু হাতির খবরেও তাকে বিশেষ উত্তেজিত দেখায় না। এষা বুঝতে পারেন নীরদার মন ভালো নেই। আস্তে আস্তে পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পরে নীরদা ভুরু কুঁচকে খুব আস্তে বলে, ‘আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে এখানে থাকবো না।’

এষা হঠাৎ চমকে ওঠেন। ‘আমাকে ছেড়ে? কেন? আমাকে ছেড়ে থাকবি কেন তুই এখানে? এখানে কে আছে? কে আছে? কার সঙ্গে তুই থাকবি আমাকে ছেড়ে?’ আর্তনাদের মত শোনায় এষার কণ্ঠস্বর।

এবার নীরদা জবাব দেয়, ‘আমি থাকতে চাই না তো। কিন্তু দাদু বলল যে।’

এষা আবার চীৎকার করে ওঠেন, ‘কি? কি বলল দাদু?’

নীরদা এবার গড়গড় করে বলে যায়। ‘দাদু বলেছে এখানে বোর্ডিঙে দিয়ে দেবে। আমি বুঝি তোমাদের খুব জ্বালাই কলকাতায়? তাহলে আগে বললেই পারতে, আমি নাহয় আরেকটু চেষ্টা করেই দেখতাম লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকতে পারি কিনা।’

এষা চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। কিচ্ছু বলেন না। নীরদা গিয়ে ধরে ঠাম্মাকে। ধরে বুঝতে পারে ঠাম্মা কাঁপছে। থরথর করে কাঁপছে। ঠাণ্ডা হাওয়াতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখ বুজে বসে থাকেন এষা। জড়িয়ে ধরেন নীরদাকে। ফিসফিস করে বলতে থাকেন, ‘কোথাও না, আমাকে ছেড়ে তোকে কোথাও থাকতে হবে না নীরু।’ নীরদা পরম স্বস্তি পায়। খুব নিরাপদ মনে হয় ঠাম্মার আলিঙ্গন।

এমন সময় একটা শোরগোল ওঠে চাতালের পশ্চিম দিকের কোণে। পাহাড়ের নিচে হাতির দল বেরিয়েছে। যেসব মানুষজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, সবাই গিয়ে ভিড় জমায়। সুনন্দ কিছুক্ষণ আগে থেকেই ক্যামেরা তাক করে বসেছিলেন ঝর্ণার দিকে। দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে গেলেন এষা। সুনন্দ নীরদাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন একটা বেঞ্চির উপরে। নীরদা দেখতে পেল হাতির দলটা ঝর্ণা পেরিয়ে ঢুকে যাচ্ছে আরেকটা জঙ্গলে। একটা বাচ্চা হাতিও আছে দলটায়। দাদু বলল বাচ্চা হাতিটা যে হাতিটার পায়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছে, সেটা নাকি ওর মা। ভিড়ের মধ্যে একজন বাঙ্গালী ট্যুরিস্ট হঠাৎ বলে ওঠে, ‘হাতি যদি উঠে এসে মন্দিরের চাতালে মানুষদের অ্যাটাক করে!’ সেটা শুনে সুনন্দ একটু হেসে বললেন যে হাতি নাকি চট করে পাহাড়ের উঁচু ঢালে উঠতে চায় না। কাজেই পাহাড়ের উপরে এই মন্দিরের চাতালে যারা আছেন সবাই মোটামুটি নিরাপদ।

এষা নিজের মনে মৃদুস্বরে গজগজ করে ওঠেন, ‘চিরকাল লেকচার দেবার অভ্যেস। ব্যস, একটা চান্স পেল ত শুরু। এদিকে কথা নেই, বার্তা নেই, বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে একটা বেমক্কা ইয়ার্কি! কি? না, চল এখানে বোর্ডিঙে ভর্তি করে দেবো। যত সব। হুঃ, দেখে দেখে আমার হাড়মাস কালি হল। ঢং! বেড়াতে এসে নতুন করে ফাজলামি।’

এবার নীরদা একটু একটু হেসে ঠাম্মাকে প্রশ্ন করে, ‘দাদু তাহলে ঠাট্টা করছিল? সত্যি নয়?’

এষা গজগজ থামান না, ‘না ত। কি? পাহাড়ে বেড়াতে এসে ঠাণ্ডা হাওয়ায় যত দুষ্টুবুদ্ধি চাগিয়ে উঠেছে তোর দাদুর মাথায়। কলকাতায় দেখিস এত জোরে জোরে হাসতে আর কথা কইতে? দ্যাখ, দ্যাখ ঐ লোকটার কাঁধে হাত দিয়ে এমন করে গপ্পো করছে যেন ইজের পরা বয়সের ইয়ার। উফফ, ঘরজ্বালানে পরভোলানে একনম্বরের।’

নীরদা এবার লক্ষ্য করে, সত্যি তো! দাদুর মুখে এরকম হাসি সে দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। যাক বাঁচা গেল। তার মানে দাদু ওর সঙ্গে ইয়ার্কিই করছিল। যদিও দাদু কোনও ফালতু কথা, ইয়ার্কি এসব পছন্দ করে না। কিন্তু হতে পারে খোলা হাওয়া, পাহাড়, মেঘ, ঝর্ণা এসব দেখে মন হাল্কা হয়ে গিয়েছিল দাদুর। দাদুও বাচ্চা ছেলের মতই ওর সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিল। পুরো জিনিসটা বুঝতে পেরে খুব ভালো লাগতে থাকে নীরদার। দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে, হাওয়াটাতে শীতের কামড় নেমে আসছে জোরালোভাবে। একটা একটা করে আলো জ্বলে উঠছে মন্দিরে, চাতালের আশেপাশে, সিঁড়িতে। ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে টুংটাং। আরতি শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আরতি দেখে তবে হোটেলে ফিরতে চায় ঠাম্মা। ভালো লাগছে নীরদার। খুব ভালো লাগছে এই দিন-রাতের সন্ধিক্ষণ।


0 comments: