প্রাচীন কথাঃ কৃষ্ণদেব রায়
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
বিন্দুতে সিন্ধু-দর্শন -৩
কৃষ্ণদেব রায়
গত কিস্তিতে আপনাদের মহেঞ্জোদাড়ো আর হরপ্পায় পাওয়া এক নগ্নিকা ব্রোঞ্জ মূর্তি আর একটি সীলমোহর দেখিয়ে এনেছি। সঙ্গে অবিশ্যি কিছু জ্ঞানও দিয়েছি! সে যাই হোক, এই লেখাটিকে আমি মোটেও রাবার ব্যান্ডের মত টেনে বা টিভির মেগা সিরিয়ালের মত বিরক্তিকর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইনা। আমার লেখার শিরোনামেই আমি এটা বলে দিয়েছি। “বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন” মানে খুব অল্প কথায় আমাদের প্রাচীনতম সভ্যতার কিছু হাল-হদিশ দিতে এবং ১৯৯০ সাল থেকে একশ্রেণীর হিন্দু মৌলবাদী, কখনও কখনও সরকারি মদত পুষ্ট হয়ে, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যে, আর্যরাই নাকি এই প্রাচীন সিন্ধু-সভ্যতার স্রষ্টা এবং আর্যরা মোটেই বহিরাগত নয়, বরং ভারতবর্ষই নাকি ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। এর পিছনে একমাত্র কারণ হল বৈদিক ধর্মকে হিন্দুধর্মের পূর্বসূরী ধরে নিয়ে তার মাহাত্ম্য প্রচার ও সেই প্রচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা। ইতিহাসকে বিকৃত করার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধেই আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে সিন্ধু-সভ্যতা একান্ত ভাবেই আর্যদের ভারতে আগমনের অনেক পূর্বের সভ্যতা এবং সেই সভ্যতার স্রষ্টারা আর্য তো নয়ই, বরং সিন্ধুসভ্যতা একান্তভাবেই দ্রাবিড়জাতি দ্বারা সৃষ্ট সভ্যতা। যদিও এই দ্রাবিড়রাও ভারতবর্ষের বাইরে থেকেই কোনও এককালে ভারতে এসেছিল এবং সেটা আর্যদের ভারতে আসার অনেক পূর্বে। শুধু মুখে বললেই তো হবেনা! মুখে তো ওঁরাও বলছেন যে আর্যরাই ভারতের আদিম অধিবাসী এবং তারাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা! আমাদের তাই এক এক করে প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, স্থাপত্যবিদ্যা বা কারিগরিবিদ্যা, রেডিও কার্বন বিশ্লেষণের মত বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলি থেকে পাওয়া তথ্য বিচার করে দেখতে হবে। আর যুক্তিপূর্ণ ভাবে প্রমাণ করতে হবে যে এই সব অপপ্রচারের কোনও বৈজ্ঞানিক, প্রত্নতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। বরং এর বিপরীত যে ধারণা, তার সপক্ষে অনেক প্রমাণ আছে। তাই, এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় আর্য কারা? সিন্ধুসভ্যতার প্রকৃত স্রষ্টা কারা? আর্যরা কি সত্যিই ভারতের আদিম অধিবাসী ছিল? এটা যে সত্যি দ্রাবিড়ীয় সভ্যতা তার প্রমাণ কি? বৈদিক ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ, সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক ব্রোঞ্জ নির্ভর অন্যান্য সভ্যতাগুলি থেকে পাওয়া তথ্য, আর্যদের দ্বারাই কি মহেঞ্জোদড়ো ও হরপ্পা নগরী ধ্বংস হয়েছিল? আর্যরা কোনপথে ভারতে প্রবেশ করে? বৈদিক ভাষার সঙ্গে ইরানের ধর্মগ্রন্থ ‘আবেস্তা’র ভাষা ও শব্দের সাদৃশ্য, ঋগবেদে বেশ কিছু দ্রাবিড় শব্দের উপস্থিতি এবং আর্যরা কি করে তাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত একটি সভ্যতা বা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরাভূত করতে সক্ষম হল, সিন্ধুসভ্যতা কি মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পার মত আকস্মিক ভাবে হঠাৎ কোনও কারণে সত্যিই ধ্বংস হয়েছিল? নাকি এটা এক অন্য সভ্যতার সঙ্গে মিশে গিয়ে আরো একটি উন্নত সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল? এই প্রশ্নগুলির সঠিক বিচার এবং বিশ্লেষণ করলেই হিন্দু মৌলবাদী আর তাদের তাঁবেদার কিছু ঐতিহাসিকের মিথ্যা প্রচারকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
আর্য কারা? আর্যরা কোনও জাতি নয়। এটা একটা ভাষাগোষ্ঠীর নাম। সমস্ত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের আর্য বলা হয়ে থাকে। এরা থাকতো পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, গ্রীস, অ্যানাথোলিয়া, ইরাক, ইরান অঞ্চলে।এদেরই একটা অংশ ইউরোপের দিকে যায়। আর একটা অংশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢোকে। এই জন্যই পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশেঅনেক প্রাচীন শিল্প, পৌরাণিক দেব-দেবী, ভাষা ও শব্দের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
তাহলে আর্য কারা এটা তো আমরা জানলাম। কিন্তু আর্যরা যদি সিন্ধুসভ্যতার জনক না হয়, তাহলে এই সিন্ধু সভ্যতা কাদের দ্বারা সৃষ্ট? এই প্রসঙ্গে আমি অন্তত চোখ বন্ধ করে একটুও ঢোঁক না গিলে বলতে পারি যে, আর যাঁরাই হন, আর্যরা কিছুতেই এই সিন্ধুসভ্যতার জনক নয়। কেন? সেই কেনর জবাব দিতেই আমরা এখন ঢুকে যাবো সিন্ধুসভ্যতার অন্দরমহলে। সিন্ধুসভ্যতার মূল দুটি স্তম্ভ হল, ‘মহেঞ্জোদাড়ো’ আর ‘হরপ্পা’ নামে দুটি নগরী। সিন্ধুসভ্যতার কবর খুঁড়ে আমরা আর কিছু পাই বা না পাই, আর কিছু জানি বা না জানি, অন্তত এই দুটি শহরের উপস্থিতি এবং তার স্থাপত্য সম্পর্কে নিশ্চিৎ হতে পেরেছি। আর সেইজন্যেই শুধুমাত্র এই দুটি শহরের উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে সিন্ধুসভ্যতার জনক আর্যরা ছিলেন না। কারণ আর্যরা ছিলেন পশু-পালক, যাযাবর শ্রেণীর মানুষ। তাঁরা ছিলেন একান্তভাবেই নগর সভ্যতার বিরোধী। ঋগবেদে এমন অনেক স্তোত্র আছে যেখানে তাঁরা ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করছেন নগর এবং শহরগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়ার আকুল আবেদন জানিয়ে। আর্যদের দেবতা ইন্দ্রের আর এক নাম তাই পুরন্দর। অর্থাৎ পুর বা শহরের বিনাশকারী। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ৫৩ সূক্তের সপ্তম ঋকে আছে, “হে ইন্দ্র তুমি শত্রুধর্ষণকারীরূপেযুদ্ধ হতে যুদ্ধান্তরে গমন কর, বল দ্বারা নগরের পর নগর ধ্বংস কর।”
হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদড়োতে যে নরকঙ্কাল গুলি পাওয়া গেছে, তাদের খুলির হাড় দেখে অনুমান করা যায় যে তখন সেখানে, মানে হরপ্পা বা সিন্ধুসভ্যতার সাম্রাজ্যের মধ্যে, অনেক জাতি বসবাস করত। সিন্ধুসভ্যতার অন্তিম অবস্থায়, মানে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর খননের একদম ওপরের স্তর থেকে আমরা মোট ৩৭টি নরকঙ্কাল পেয়েছি। এই নরকঙ্কালগুলির মধ্যে বেশীরভাগই আদি অস্ট্রেলীয় বা প্রোটো-অস্ট্রালয়েড।এদের ললাট অনুন্নত এবং নাসিকা অনতিপ্রশস্ত। বেশ কিছু করোটি পাওয়া গেছে যাদের দ্রাবিড়ীয় বা বর্তমান ভারতের আদিম অধিবাসীদের অনুরূপ মানুষের পরিচয় দেয়। কিছু মোঙ্গলয়েড এবং মাত্র গোটা দুই ককেশিয়ান গোত্রের মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এই কঙ্কালগুলি দেখে কিন্তু ভয় পাবেন না! এরা আমাদের অনেক কথা বলবে, অনেক কথা জানাবে। এদের সঙ্গে গল্প করলেই বেরিয়ে আসবে সিন্ধুসভ্যতার অনেক অজানা তথ্য। আপাতত এই দ্রাবিড়ীয় এবং অস্ট্রালয়েড কঙ্কালের আধিক্য এবং মাত্র দুটি ককেশিয়ান বা আর্য গোষ্ঠীর কঙ্কালের অস্তিত্ব আমাদের খুব সুদৃঢ় ভাবেই একথা জানাচ্ছে যে, সিন্ধুসভ্যতার জনক যদি আর্যরা হত, তাহলে ৩৭টি নরকঙ্কালের মধ্যে ৩১টি দ্রাবিড়ীয় ও অস্ট্রালয়েড কঙ্কালের বদলে অন্তত সমসংখ্যক ককেশিয়ান কঙ্কাল পাওয়া যেত। যে দুটি ককেশিয়ান বা আর্য কঙ্কাল পাওয়া গেছে, তা থেকে পণ্ডিতদের সিদ্ধান্ত এই যে, ঋগ্বেদ বা তার সমসাময়িক যুগে হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে যে আর্য অনুপ্রবেশ ঘটেছিল এবং আর্য সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল, তার বহু আগে থেকেই দফায় দফায় বেশ কিছু আর্যদের আগমন ঘটে এই সিন্ধুসভ্যতায় এবং তাঁরা কালক্রমে সিন্ধুসভ্যতারই অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকেন। এঁরা অশ্বের ব্যবহার জানতেন না। এই ককেশিয়ান নরকঙ্কাল দুটি তাঁদেরই। আবার কেউ কেউ এঁদের আর্মিনীয় বা আর্মেনয়েড বলে চিহ্নিত করেছেন।
সিন্ধু সভ্যতার জনক বা স্রষ্টা যদি আর্যরাই হন তাহলে অতি অবশ্যই সিন্ধুসভ্যতার সমগ্র পরিব্যাপ্তি ও শহরগুলিতে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যাবে। বৈদিক, ইরানীয় এবং গ্রীক সাহিত্যধর্মী গ্রন্থ এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা সমূহের আদি রূপের মধ্যে সমগোত্রীয় যে শব্দগুলি আমরা পাই, তার ভিত্তিতেই আর্য সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্টগুলি নির্ধারন করা যায়। আসুন এক ঝলক দেখে নিই সেই বৈশিষ্টগুলি কি এবং সিন্ধুসভ্যতায় তাদের আদৌ কোনও অস্তিত্ব ছিল কিনা। যে সমস্ত গ্রন্থ থেকে আমরা নিশ্চিৎ ভাবেই আর্য সংস্কৃতির বস্তুগত ও অন্যান্য বিষয়ে সম্যক একটা ধারণা পাই, সেগুলির মধ্যে রয়েছে ঋকবেদ, জেন্দ-আবেস্তা এবং হোমারের ইলিয়াস আর অডিসি। এইসব গ্রন্থাবলীর কালনির্ণয়ের মাপকাঠি নিয়ে পণ্ডিতেরা নানা মত পোষণ করলেও আমরা সাধারণ ভাবে গ্রাহ্য প্রচলিত সময়কেই ধরে নেব। প্রথম গ্রন্থটি, অর্থাৎ ঋক বেদ মোটামুটিভাবে ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব অব্দে রচিত বলে ধরে নেওয়া হলেও গ্রন্থটির শেষ দিককার অংশের রচনাকাল ১০০০ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত বলে ধরে নেওয়া হয়। জেন্দ-আবেস্তা নামক ধর্মগ্রন্থটির কাল ধরা হত ১৪০০ খ্রীষ্টপূর্ব অব্দে এবং হোমার রচিত গ্রীক মহাকাব্য দুটির রচনাকাল ৯০০—৮০০ খ্রীষ্টপূর্ব অব্দের। ( চলবে )।
0 comments: