প্রবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
কেনা বই চেনা বই
দীপারুণ ভট্টাচার্য
।। যাত্রা শুরু ।।
বহু বাঙালি সন্তানের মতোই আমারও শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় ও প্রথম ভাগ-দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে। এরপর এসেছে স্কুলের বিভিন্ন পাঠ্য বই। পাঠ্যবই ছাড়া অন্য বই পড়া শুরু হয়েছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে। ছেলেবেলা থেকে উপহার হিসেবে যা বই পেয়েছি তা ছিল খুবই সাধারণ। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বই কেনা ছিল বিলাসিতার সামিল। কিন্তু যে জাতি রবীন্দ্র, বঙ্কিম বা শরৎচন্দ্রকে 'আমাদের' বলতে গর্ব বোধ করে তারা বই কেনার বিরোধিতা করতে পারেনা কোনভাবেই। আমার বই কেনা শুরু হয় এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই। প্রথমদিকে বই কিনতাম টিফিনের পয়সা জমিয়ে।
তবে সমস্যা ছিল কি কিনব, কেন কিনব বিষয়ে অজ্ঞতা। তখন বলার মতো অভিভাবকও ছিলেন না। কাজেই বইয়ের দোকানে গিয়ে বই কেনা আমার পক্ষে ছিল সত্যিই কষ্টকর। তাই আমার বই কেনা শুরু হয় বইমেলা দিয়ে। সেখানে কলেজস্ট্রিটের মতো কেউ জানতে চান না, "কি দাদা কি বই?" প্রশ্ন শুনেই খানিকটা কুঁকড়ে যেতাম, মনে মনে বলতাম, যদি জানতাম কি বই...!
আমার বইমেলা যাওয়া শুরু ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে, বন্ধুদের সঙ্গে। যেহেতু বই বা নিজের পছন্দ সম্পর্কে কোন ধারণা আমার ছিল না, তাই তখন বই কেনাটা সম্পূর্ণ ভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো বইয়ের দামের উপর। এভাবেই ধীরে ধীরে বইমেলা ও কলেজস্ট্রিট থেকে আমি বেশ কিছু বই সংগ্রহ করেছিলাম। এ বাদেও আমার কাছে বইমেলার একটা বড় আকর্ষণ ছিল বইয়ের সঙ্গে সময় কাটানো।
এমন উদ্দেশ্যহীন ভাবে বই কেনা ও পড়ার মধ্য দিয়েই আমার বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়। কিছুদিন বাদে ভাল-মন্দ বোধ হলে বুঝতে পারি আমি ততদিনে বেশ কিছু আজেবাজে বই পড়ে ফেলেছি। এ নিয়ে আমার মধ্যে একটা দুঃখবোধ কাজ করত। পরে সুনীল বাবুর অর্ধেক জীবন পড়তে গিয়ে দেখি তার অভিজ্ঞতাও আমার চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয়, এটা জানার পর এ নিয়ে আর কোনদিন দুঃখ করিনি।
।। বই রাখা ।।
ধীরে ধীরে বুঝলাম বই কেনার মতো বই রাখাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দর ভাবে গুছিয়ে রাখা, যা দেখলেও মন ভরে। প্রয়োজনের সময় চট করে পাওয়া যায়। সংরক্ষণ ভাল হলে দীর্ঘ দিন বই ভালো থাকে। এই জন্যই চাই বইয়ের আলমারি। স্কুলের লাইব্রেরিতেই আমি প্রথম বইয়ের সুন্দর আলমারি দেখি। তারপর আমার এক মাষ্টার মশাইয়ের বাড়িতে। তাঁর কাছে মাঝে মাঝেই আমি বই চাইতাম। তিনি দিতেনও ভালোবেসে। সমস্যাটা হলো তখন, যখন আমার বন্ধুরাও বই চাইতে শুরু করল। একরকম বাধ্য হয়েই একদিন মাষ্টার মশাই শোনালেন একটা পুরাতন গল্প। এরপর আর কেউ তাঁর কাছে বই চায়নি। তিনি বলেছিলেন, "একজনের বাড়িতে প্রচুর বই। এত বই যে ঘরের মধ্যে চলা ফেরা তো দূরে থাক বসা দাঁড়ানোর ও কোন উপায় নেই। তার এক বন্ধু এসব দেখে বললেন, তুমি একটা বইয়ের আলমারি কেন আনছো না। একথা শুনে ভদ্রলোক মুচকি হেসে বলেন, লোকের বাড়ি থেকে বই আনা যায়, কিন্তু বইয়ের আলমারি তো আর আনা যায় না!"
বিষয়টা যে একেবারেই অসত্য নয় তা সকল বই প্রেমীরাই জানেন। আমার নিজের সংগ্রহেও এমন কিছু বই রয়েছে। আবার আমারও বেশ কিছু বই এমন ভাবেই সংরক্ষিত হয়ে আছে অনেক পুস্তক প্রাণ মানুষের সংগ্রহে। এই জন্যই বই দেওয়ার আগে এক বন্ধু-দাদা খাতায় লিখে সই করিয়ে রাখতেন। তবে যারা এই ভাবে বই সংগ্রহে বিশ্বাস রাখেন তাদের অবশ্য কোন ভাবেই ঠেকানো যায় না। এমনই এক প্রবাসী মানুষ তার পাশের বাড়ির বন্ধুর কাছে বই চাইতে গেলে তিনি বলেন, "তুমি আমার ঘরে বসে যত খুশি পড় কিন্তু বই নিয়ে যেতে দেবো না।" এই ভদ্রলোকও সুযোগ পেলেন একদিন। যেদিন সেই বইয়ের মালিকের ঘাস কাটার যন্ত্রটি খারাপ হলো। এবার চাইতে এলে ভদ্রলোক বললেন, "যন্ত্রটা দিয়ে তুমি আমার বাগানে যত খুশি ঘাস কাটতে পারো কিন্তু নিয়ে যেতে দেবো না।"
নীরদচন্দ্র বাবু তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, "…এই জন্য যে বইগুলো আমার খুব প্রিয়, উহাদের প্রত্যেকটির তিনটি সংস্করণ কিনিয়াছি - একটি ছাপা-বাঁধাই-চিত্রের সৌন্দর্যের জন্য, দ্বিতীয়টি বিদ্বান সম্পাদকের ব্যাখ্যা ও ভাষ্যের জন্য, তৃতীয়টি দৈনন্দিন পড়া ও অন্যকে পড়িতে দিবার জন্য।"
আমার অবশ্য জানা নেই নীরদ বাবুর বইগুলো ফেরত আসতো কি না! তবে তাঁর মতো বই সংগ্রহকারী মানুষ সত্যিই বিরল। তিনি নিজে লিখেছেন, "…এম. এ পড়িবার সময় পাঠ্য বিষয়গুলির যত বই আমার ছিল, আমার অনেক অধ্যাপকের ও তত বই ছিল না। … আমি কখনও নিত্য পাঠ্য বই নিজের না হইলে পড়িতে পারিতাম না। তাই কিনিতাম - এম. এ-র পাঠ্য পুস্তক কিনিবার জন্য পিতা তখন (১৯১৮-২০) আমাকে এক হাজার টাকা দিয়াছিলেন।" সত্যি বলতে এমন গ্রন্থকীট পুত্রের এমন বিত্তবান বাবা থাকাটা কিন্তু খুবই প্রয়োজন।
এক বইমেলা উদ্বোধনে এসে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডাঃ আব্দুল কালাম বলেছিলেন অন্য এক কথা। তিনি বলেছিলেন, প্রতিমাসে কিছু কিছু বই কিনুন। বইগুলো একটা নির্দিষ্ট ঘরে রাখুন এবং রোজ বইগুলোর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটান। আপনাকে দেখে আপনার ছেলে মেয়েরাও শিখবে। আর আপনার নাতি নাতনিরা পেয়ে যাবে এক চমৎকার সুন্দর লাইব্রেরি।
ঢাকায় এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আমি দেখেছি এমনই একটা সুন্দর লাইব্রেরি। যা তারা তিন পুরুষ ধরে গড়েছেন ধীরে ধীরে।
তবে, অনেকে আবার সুন্দর করে বই গুছিয়ে রেখেই বেশি আনন্দ পান। এই প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের এক গল্প মনে পড়ছে। তিনি যে বিলিতি বই কিনতেন তা বেশ অর্থব্যয় করে বিলাত থেকে চামড়া দিয়ে বাঁধিয়ে আসতো। তাঁর সংগ্রহ বর্তমানে কোলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রাখা আছে। অনেকেই বইয়ের জন্য তাঁর এই অপব্যয় বিষয়ে তাঁকে কথা শোনাতেন। একবার এক ধনী বাঙালি বাবু তাঁকে এবিষয়ে বললে তিনি চুপচাপ তার কথা শোনেন। কথা শেষ হলে বিদ্যাসাগর মশাই লোকটির কোর্টের বুকপকেটে রাখা ঘড়িটির সোনার চেনের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে প্রশ্ন করেন, "এটা কি?" লোকটি বেশ গর্ব ভরে বলেন, 'ঘড়ি বেঁধে রাখার সোনার চেন।' তখন বিদ্যাসাগর মশাই বলেন, "ঘড়ি কি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না।"
ভালোবাসার আর পাঁচটা জিনিসের মতো বইকে কতটা যত্ন করা উচিত তা কিন্তু পুস্তক প্রেমীরাই জানেন।
।। বই পড়া ।।
একটা সাইন বোর্ডের গল্প পড়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল, "সন্ধের পর বাঁদিকের রাস্তা ব্যবহার করবেন না। পথে বন্য প্রাণী আক্রমণ করতে পারে। যারা পড়তে পারেন না তারা উল্টো দিকের মুচির দোকান থেকে জেনে নিন।" এই সাইন বোর্ডের মতোই শিক্ষাহীন মানুষের কাছে এই সব বইয়ের আলোচনা অর্থহীন।
ভারতের স্বাধীনতার বয়স ৭০ বছর পেরিয়ে গেছে। তবুও দেশ থেকে নিরক্ষরতার অন্ধকার আমরা দূর করতে পারিনি। ১৯৪৭ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১২% আজ (২০১৭) ৭৪% । এই পরিসংখ্যান আমাদের আনন্দ দিতে পারে কিন্তু ভাবতে হবে, আমরা বিশ্ব স্বাক্ষরতার (৮৪%) থেকে এখনও অনেকটা পিছিয়ে। তার থেকেও বড় কথা হলো ২০১৭ সালে ২৬% নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা ১৯৪৭ সালের ৮৮% নিরক্ষর মানুষের সংখ্যার থেকে বেশি। অর্থাৎ কিনা ব্রিটিশ ভারত থেকে এখন বেশি সংখ্যক নিরক্ষর মানুষের বাস আমাদের ভারতে। তাই আমাদের দেশে পুস্তক প্রেম বিষয়টা এক অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিজন কুমার ঘোষ, তাঁর 'বাজার সরকারের ডাইরি' বইতে লিখেছেন, "পৃথিবীর সবচেয়ে বই-পড়ুয়া দেশটি হল ফ্রান্স। শতকরা একশো ভাগই শিক্ষিত। শ্রেষ্ঠ সাহিত্য গঁকুর পুরস্কার প্রাপ্ত বই নিয়ে সেখানে বাবুর সঙ্গে পরিচারিকার আলোচনা হয়।"
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে ঠিক কতগুলো বই বিক্রি হয়? বাংলা ভাষার বইয়েরই বা বিক্রি সংখ্যা কত? সত্যি বলতে আমাদের বইয়ের বাজার এখনও স্বাবলম্বী নয়। পাশাপাশি রয়েছে বইয়ের কালো বাজারি। তাই সংখ্যাটা সঠিক ভাবে কেউ বলতে চান না। বইয়ের ISBN রেজিস্ট্রেশন থেকে জানা যায়, এদেশে গড়ে প্রতি বছর ৯০,০০০ নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। তবে ISBN এখনও বাধ্যতামূলক নয় বলে প্রকাশ সংখ্যাটা ৯০ হাজার থেকে অনেক বেশি হবে বলেই আমার ধারণা। উন্নত দেশের দিকে তাকালে একটা সংখ্যা পাওয়া যায়। আমেরিকায় ২০১৫ সালে ৬৫ কোটির কিছু বেশি বই বিক্রি হয়েছিল। সে দেশের জনসংখ্যা ৩০ কোটি। অর্থাৎ মাথাবিচ্ছু বছরে দুটি বই। আমরাও একদিন বই কেনা ও পড়াতে আমেরিকা বা ফ্রান্সকে ধরতে পারবো; এই আশাতেই গ্রন্থ প্রেমীদের বেঁচে থাকা।
।। বই উপহার ।।
নীরদ চন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন, "বই হল বউয়ের মতোন। একবার ভালো বাসিলে তাহাকে ছাড়িয়া যাওয়া কঠিন।" একথার সত্যতা বই প্রেমীরাই অনুভব করেন। হয়তো এই অনুভূতি সঞ্চারিত করার জন্যই তারা বই উপহার দিয়ে থাকেন প্রিয় মানুষদের। তবে বই উপহার পাওয়া ও দেওয়ার কিছু সমস্যা রয়েছে। আমার বড় পিসি সম্পূর্ণ রবীন্দ্ররচনাবলী আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। সে আমার জীবনের প্রথম পাওয়া বড় সম্পদ। এ বাদে বিভিন্ন সময়ে বন্ধু বান্ধব বা প্রিয় মানুষদের থেকে বই উপহার পেয়েছি। কবিতা আবৃত্তি করেও বই উপহার পেয়েছি কয়েকবার। এমন বই বেশ কয়েকবার পেয়েছি যা আমার সংগ্রহে আগে থেকেই ছিল। তবু উপহারের মর্যাদা দিয়ে তাকে তুলে রেখেছি যথাস্থানে। কিন্তু সবাই বোধহয় এভাবে ভাবেন না।
বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় এই ফুটপাত থেকেই কিনি ম্যাক্সিম গোর্কির মা ও ইস্পাত এবং আরও অনেক অনুবাদ সাহিত্য। এই ফুটপাতেই কাফকার মেটামরফসিস বইটা হাতে নিয়ে বেশ অবাক হয়েছিলাম। যখন দেখলাম, কোন এক রাজুকে দেওয়া রাঙাদাদুর উপহার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফুটপাতে এসেছে আবার বিক্রি হতে।
ফুটপাত থেকেই 'সেই সময়' বা 'লোটা কম্বল' এর মতো বই আমি সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য হলাম যখন কিনলাম সুকুমার রায় সমগ্র। বইটি আমারই বড় পিসি উপহার দিয়েছিলেন তাঁরই ছাত্র সুগত দাশকে। বাড়ি এসে পিসিকে বইটা দেখাতেই বেশ কষ্ট পেলেন। যেন বলতে চাইছিলেন, 'সুগত তুমিও…'।
নতুন বইয়ের পাশাপাশি কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের বাজার কিন্তু নেহাৎ ছোট নয়। বহু ছাত্র-ছাত্রীরা এই বাজার থেকে পাঠ্য বই সংগ্রহ করেন। ২০১০ সালের The Telegraph কাগজের এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে কলেজ স্ট্রিট ও সংলগ্ন অঞ্চলে পুরোনো বইয়ের বাজার বছরে ব্যবসা হয় কমপক্ষে ৭-৮ কোটি টাকার মতন।
একটা গল্প দিয়ে উপহার পর্ব শেষ করা যাক। জনৈক কাকা এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেলেন তার ভাইপোর জন্মদিনের উপহার কিনতে। দোকানদার বিভিন্ন জিনিস দেখালেন। কিন্তু কাকা কিছুই পছন্দ করতে পারলেন না। সবেতেই বললেন, "এটা ওর আছে।" শেষে বিরক্ত হয়ে দোকানদার বললেন, "ভাইপো'কে বরং বই উপহার দিন, স্যার।" একটু ভেবে কাকা বললেন, "বই, বাড়ীতে সে ও আছে বেশ কয়েক খানা!"
।। বই সাজানো ।।
বই মূলত লোকেরা কেনেন শিক্ষা, আরাম, আনন্দ ও ঘর সাজাবার জন্য। ছোটবেলা এক আত্মীয়ের বাড়িতে দেখতাম দেওয়াল জোড়া কাঁচের আলমারি ভর্তি রবীন্দ্র, বঙ্কিম, শরৎ, বিভূতি, তারাশংকর রচনাবলী। কিন্তু সে বাড়িতে কাউকে কখনো বই পড়তে দেখিনি। একবার একটি বই চাইলে ভদ্রলোক বেশ বিব্রত বোধ করেন। পরে সংকোচের সঙ্গে বলেন, "আলমারির চাবি হারিয়েছে অনেকদিন। নানা কাজে নতুন চাবি তৈরি করা হয়নি।"
গতবছর দিল্লির বইমেলার এক দোকানে জনৈকা ভদ্রমহিলা সুচিত্রা ভট্টাচার্য ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি বই এক সঙ্গে নেবেন বলে খুব দরাদরি করতে শুরু করেন। শেষে তার চাহিদা ও বিক্রেতার শেষ দরের মধ্যে ৫০টাকার পার্থক্য রয়েই গেল। তাই তিনি বই না নিয়েই চলে গেলেন। দোকানে বসা মানুষটি আমার পরিচিত। বললাম, "দিয়ে দিলেই পারতেন, মাত্র ৫০টাকার জন্য!" ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে তিনি বললেন, "ভারি তো ঘর সাজাবে।" প্রশ্ন করলাম, "কি করে বুঝলেন?" তিনি বলেন, "ও আমি চোখের ভাষা বুঝি, কত বছর হলো বলতো!"
বেশ মোটা বই না হলে, ঠিক ঘর সাজানো যায় না। তাই সাজাবার বাজারে রচনাবলী বা সমগ্রের চাহিদাই সব থেকে বেশি। তবে এটা ভাবলে ভুল হবে যে এই স্টাইল আজকালকার। ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত, কলিকাতা কমলালয় (১৮২৩) গ্রন্থে এই বিষয়ে এক চমৎকার সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়:
" বাবুসকল নানা জাতীয় ভাষায় উত্তম উত্তম গ্রন্থ অর্থাৎ পার্সি ইংরাজি আরবি কেতাব ক্রয় করিয়া কেহ এক কেহ বা দুই গেলাসওয়ালা আলমারির মধ্যে সুন্দর শ্রেণী পূর্বক এমত সাজাইয়া রাখেন যে দোকানদারের বাপেও এমন সোনার জল করিয়া কেতাব সাজাইয়া রাখিতে পারেনা, আর তাহাতে এমন যত্ন করেন এক শত বৎসরেও কেহ বোধ করিতে পারেননা যে এই কেতাবে কাহারো হস্ত স্পর্শ হইয়াছে। অন্য পরের হস্ত দেওয়া দূর থাকুক জেলদগর (বাইন্ডার) ভিন্ন বাবুও কখনো হস্ত দেন নাই, এবং কোনোকালেও দিবেন এমত শুনা যায় না।"
এইসব ধারাবাহিকতা পেরিয়ে এসেছে আজকের ইন্টারনেটের লেখালিখি, ই-বুক, ব্লগ ইত্যাদি। এ এক অন্য জগৎ। অনেক সুবিধা অসুবিধার মধ্যে এর বিশেষ অসুবিধা হলো এসব দিয়ে কোনভাবেই ঘর সাজানো সম্ভব নয়!
কেউ কেউ বলেন বর্তমান ইন্টারনেটভিত্তিক লেখালিখির ফলে বইয়ের বিক্রি কমেছে। কিন্তু ইন্টারনেটভিত্তিক সংস্থা যখন বইপ্রকাশে মন দেন কিম্বা ফেসবুকে বারবার পড়া গল্পগুলো গ্রন্থ আকারে প্রকাশ পাওয়ার পর যখন তা এক বইমেলাতেই এক সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায় তখন বিশ্বাস হয় ছাপানো বইই এখনো পর্যন্ত মূল মাধ্যম আর ইন্টারনেট তার সহায়ক মাত্র। লেখাটি শেষ করি শ্রী নীরদচন্দ্র চৌধুরীর একটি পরিচিত উক্তি দিয়ে - "বই কিনিয়া পড়া বিবাহ করিবার মত, ধার করিয়া পড়া বারবনিতার গৃহে যাইবার তুল্য।"
এই মন্তব্য আজও কতটা সঠিক সে অবশ্য পাঠকেরাই বিচার করবেন।
অপূর্ব ভাই !! বড্ড মনোগ্রাহী লেখা ।
ReplyDelete