0

ছোটগল্প - সপ্তর্ষি বোস

Posted in


ছোটগল্প


উপহার 
সপ্তর্ষি বোস


||

নীল রং তার ভীষণ প্রিয়। তার প্রিয় বাইসাইকলটা আসমানি। তার স্কুলব্যাগ নেভি ব্লু। প্রিয় নেলকলর তুঁত। তার টেবিলের ল্যাম্পশেড আকাশী। এছাড়াও তার মোবাইলের কভার চন্দ্রালোকিত নীল। গেল বার ক্রিসমাসের ছুটিতে মা'র সাথে বেড়াতে গিয়ে সেন্ট-মালোর সৈকত থেকে কুড়িয়ে এনেছিল সাতখানা নুড়িপাথর। তার সবকটাই নানান ধরণের নীল। তার চারটে ব্রা আছে নীল, তিনটে স্কার্ফ, দুটো ডেনিম কেপ্রি। একটা গগলস যাকে বলে ঘনশ্যাম আর একটা নীল পাথর বসানো নেকলেস। আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগে বাবা ওকে প্রমিস করেছিল আগামী জন্মদিনে একটা নীলা উপহার দেবে। তার ছ'মাসের মাথায় ওর বাবা ওদের ছেড়ে চলে যায়। কথা রাখেনি আর কখনো ফিরেও আসেনি। আর এবার তার সতেরোর জন্মদিনে মা দিয়েছে এই নেকলেসটা। প্রতিপদের চাঁদ যেমনি ঠিক তেমনি আকারে ছোট ছোট সাদা পাথর মেটালিক থ্রেড দিয়ে বোনা। আর ঠিক মধ্যিখানে একখানা নীল পূর্ণিমা। গাঢ় নিরেট রং কিন্তু একটা স্নিগ্ধ আলো জ্যোতস্নার মতো স্বচ্ছন্দে লেগে আছে !

মা ওকে এই হারটা দেবার পর থেকেই আজুরিন বায়না শুরু করেছে তার একটা ম্যাচিং রিং চাই। কিন্তু সেটা জোগাড় করে অসম্ভব না হলেও দুঃসাধ্য অবশ্যই। ঐ নেকলেস পাওয়ার জন্য তো তার মাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। প্যারিসের রাস্তায় এমন সব গয়নার দোকানে তাকে ঢুকতে হয়েছে যাদের দ্বাররক্ষীও তার চেয়ে বিত্তবান। অন্তত আদবকায়দা আর চলনবলনে। সেইসব দোকানে ঢুকে সবার চোখ এড়িয়ে ডিসপ্লেতে রাখা ডিজাইনগুলোর ছবি তুলে নিয়ে আসা, সে কি চাট্টিখানি কথা! পাথর দিয়ে সেরকম ডিজাইন বানানোর কারিগর পাওয়া গেছিল অপেক্ষাকৃত সহজে। কিন্তু মুশকিল হলো ঐ নীল পাথর নিয়ে। ঝুঠো মুক্তো সুলভ, নকল হিরেও পাওয়া যায় সহজেই। কিন্তু নীলা এমন এক পাথর, যার বিকল্প পাওয়া সহজ নয়। নীল পাথর পাওয়া যায় কিন্তু ঘন নীল রঙ ঠিক যেন সব আভা শুষে নিতে পারে, অথচ অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসে উজ্জ্বলতা; তা একরকম প্রায় না মুমকিন। তাই বাজারে আসল নীলার দর আর কদর দু'ই বেশি। প্রায় বছরখানেক অপেক্ষার পর যেমনটি চেয়েছিলেন তেমন পাথরের খোঁজ পেয়ে, নেকলেস বানিয়ে মেয়েকে উপহার দিয়েছেন গত জন্মদিনে। স্বভাবতই এখন তার সাথে মিল দেবার মতো আংটি পাবেন কোথায়!


||

আজুরিন সহজে অধৈর্য হয় না। সেটা ওকে যারা চেনে, তারা সব্বাই জানে। ওর মা, দাদু, গ্র্যানি, ওদের প্রতিবেশী আঙ্কল চার্লস আর সোফি আন্টি, ওর বেস্ট ফ্রেন্ড জুলিয়া আর স্কুলের প্রত্যেক টীচার। জানে না শুধু দানিশ। তাই প্রত্যেক শনিবার বিকেলে দানিশ যখন প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে আসে আর এসেই কাঁচুমাচু মুখে দেরীর জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তখন আজুরিন গম্ভীরভাবে একটা "উই", অর্থাৎ 'ঠিকাছে' গোছের জবাব দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দানিশ জানতেও পারেনা আজুরিন আসলে অন্যদিকে তাকিয়ে হাসে। সন্ধের অন্ধকার নামবার সাথে সাথেই রাস্তার ধারে জেসমিনগুলো যেমনি ফুটে ওঠে ঠিক সের'ম শান্ত, স্নিগ্ধ হাসি। দানিশ সত্যি চেষ্টা করে সময়ে চলে আসবার। কিন্তু শনিবার দিন গ্যারাজে এত ভিড় থাকে, যে চাইলেও পাঁচটার আগে বেরোতে পারেনা। কাজের চাপ থাকে ঠিকই কিন্তু সেটা তার খারাপ লাগার কার নয়। খারাপ লাগে কারন গ্যারাজের মালিক লোকটা তার বাবা। সে এক অদ্ভুত লোক। খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর খিটখিটে মেজাজ নিয়ে ব্যবসা চালায় সপ্তাহে ছ'দিন, সকাল ন'টা থেকে টানা দশঘন্টা। কেউ ঠিক জানেনা কোত্থেকে এসেছে সে। কারো ধারণা সে আদতে সিরিয়ান আবার কেউ বলে আলজিরিয়াতে নাকি আদি বাড়ি ছিল তার। দানিশ অবিশ্যি জ্ঞান হওয়া ইস্তক জেনেছে, প্যারিসই তার শহর। মাকে সে কোনদিন দেখেনি। বাবাকে ছোটবেলায় জিজ্ঞেস করলেও কোন জবাব পায়নি কোনদিন। উল্টে বড় হবার পর তাকে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছিল, মা তার জন্মের সময়ই মারা যায় এবং তার বেঁচে থাকার অধিকার, এই পৃথিবীতে তাকে কায়িক শ্রমের বিনিময়েই অর্জন করে নিতে হবে। হাইস্কুল শেষ করেই তাই সোজা গ্যারাজের কাজে ঢুকতে হয়েছে তাকে। আর সেখানে সে শিক্ষানবীশ মাত্র। তার বাবা ক্ষতিগ্রস্ত ইঞ্জিনের নামকরা ডাক্তার আর ব্যবসায় কড়া মালিক। তাই কাজ শেষ হবার আগে কোনদিনই ছুটি হয়না দানিশের।

সপ্তাহের শেষে এই বিকেলটায় আজুরিনের মন একদম ফুরফুরে থাকে। ক্লাস টিচারের বকুনি, স্কুল থেকে দু'কিলোমিটার হেঁটে আসা, পঁ দ্যু কারোস্যাল মানে কারাউসল ব্রিজের ওপর বিজাতীয় ট্যুরিস্টদের ভিড়, কোন কিছুই ওর মন খারাপ করতে পারেনা। তার কারণ আজুরিন জানে রোদ হোক, বৃষ্টি হোক, দিন হোক বা রাত, ট্রাফিক থাকুক অথবা না থাকুক, শহর বেঁচে থাক বা নাই থাক, দানিশ আসবেই। দানিশ জানে আজুরিন অপেক্ষায় আছে, তাই সে আসবেই। তবে তার কোনও সময় নেই, কোনদিন আগেই হাজির তো কোনদিন ঘন্টা পার হতে চললেও তার দেখা নেই। এই সময়টা কাটাতে অবশ্য আজুরিনের মন্দ লাগে না। সেইন এর ওপর যে ব্রিজ ধরেই এইপারে আসা হোক, সরাসরি রাস্তায় না উঠে, বাঁদিকের সিঁড়ি ধরে যদি নেমে যাওয়া হয় তাহলে নদীর ধার বরাবর লম্বা বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে। শুধু রাস্তা নয় সেইন নদীও এখানে দুপাশ থেকে কংক্রিট প্রাচীরে আবদ্ধ। তবে এই পাশের রাস্তাটায় কিছু গাছ আছে, পুরনো এবং দীর্ঘদেহী। তাদের ছায়ায় এদিক ওদিক বেঞ্চ পাতা থাকে, যেখানে এসে আজুরিন বসে প্রায়ই। একপাশে নদী আর অন্যপাশে, ব্রিজটা যে রাস্তায় উঠেছে, সেটা পার হলেই বিশ্বখ্যাত 'ল্যুভর'। আজুরিনরা বলে 'লে ম্যুসী'। ওর খুব প্রিয় জায়গা কিন্তু সর্বক্ষণ যা ভিড় থাকে তাতে ঢুকবার ইচ্ছেটাই জোগাড় হয় না। তার চেয়ে এই বেঞ্চগুলোই ভাল। এখানে মানুষ হয় হাঁটছে অথবা পাশেই কেউ ইজেল-রং নিয়ে ছবি আঁকায় মন দিয়েছে। কেউ কেউ বইয়ে ডুবে আবার কোথাও শ্যুটিং চলছে কোন উঠতি পরিচালকের। এইসবের মধ্যে থাকতে থাকতে কখন সন্ধে নেমে আসে স্বপ্ননগরীতে। দানিশ চলে আসে আর মুহূর্তে ওর সারাদিনের সব হোঁচট খাওয়া ভ্যানিশ! ল্যুভর আলোয় ভরে ওঠে।


||

ডেস্কটপটা শাট ডাউন করে চেয়ার থেকে উঠল উসমান। কর্মচারীরা সবাই চলে গেছে ইতিমধ্যে। তার অফিসটা যে গোছানো নয় একেবারেই সেটা তার অজানা নয়। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাগজ, ফাইল, কাস্টমার রিসিট ইত্যাদি। সারাদিন কাজের চাপে সময় পায়না বিশেষ। তবু অন্তত সোফাটা একটু গুছিয়ে, ভদ্রস্থ করে গ্যারাজের বাইরে এল সে। সিগ্রেটটা ধরিয়ে সবে তিনটে টান দিয়েছে, সামনে প্রায় ষাট মাইল স্পিডে এসে আচমকা ব্রেক কষল একটা ঝকঝকে নীল রঙের অডি ক্যুপ। তাতেও থামলনা গাড়িটা। স্পিড কমল বটে কিন্তু সোজা এগিয়ে এল আরও পাঁচ-ছ 'ফুট। বিপদজনকভাবে প্রায় উসমানের পায়ের গোড়ায় এসে স্তব্ধ হল শক্তিশালী ইঞ্জিনটা। উসমান ঘাবড়াল না একটুও। বিরক্তমুখে সিগ্রেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল শুধু। তারপর গাড়িটার দরজার কাছে গিয়ে বলল, আঁদ্রে, গাড়িটা নিয়ে আরো আগে আসা উচিত ছিল তোমার। গাড়ি থেকে যে নামল তার বয়স সম্ভবত চল্লিশের ওপর কিন্তু আদর্শ সুপুরুষ। ক্লিন শেভড এবং চোখে প্লাটিনাম ফ্রেমের চশমা। মুচকি হেসে আঁদ্রে বলল, উসমান, সার্ভিস সেন্টারে কিছুই ধরতে পারল না জান, অথচ স্পষ্ট জানি ব্রেকটা গড়বড় করছে।

- গাড়িটা এবার বদলে ফেল, বাজারে এর চেয়ে দামি গাড়ি তুমি অনেক পাবে।

- এই গাড়িটা আমার কত প্রিয় সে তোমার অজানা নয়। এবারের মতো ঠিক করে দিতেই হবে, তার জন্য যা লাগে লাগুক।

- আপাতত লাগবে সময়। কাল রবিবার। আমি কাজ করি না। চাইলে গ্যারাজে রেখে যেতে পারো।

- অগত্যা। এতদিন পর দেখা হলো এককাপ কফি খাওয়াবে না?

- ভেতরে আমার অফিসে চল তাহলে।

- একমিনিট, বলে গাড়ির ভেতর থেকে একটা লেদার স্লিং ব্যাগ বের করে, উসমানকে গ্যারাজের দিকে অনুসরণ করল আঁদ্রে।

কেবিনে ঢুকেই উসমান জল গরম করতে বসাল ইলেকট্রিক কেটলে। আঁদ্রে বলল, ছেলে কোথায় তোমার? কাজ শিখছে ভালোই?

- শনিবার দিনটা ওকে আগে ছেড়ে দিই একটু। বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে আসবে, তারপর দুজনে ফিরব।

- দেখ, তুমি জানো কিনা জানিনা, তোমার ছেলের বন্ধু মানে একটা ক্যাথলিক মেয়ে। আমি ল্যুভরের সামনে দেখেছি দু'একবার।

- তো? কি বলতে চাইছো? চোয়াল অল্প শক্ত হলো উসমানের।

- তুমি ভাল করেই জানো শেষ দু'বছরে মানুষের সেন্টিমেন্ট কীরকম বদলেছে। প্যারিস কি আর কাপিতাল দে লিবেরোস আছে বলে মনে হয় তোমার!

- আমি জানি তুমি ভালর জন্যেই বলছ। ফের সহজ হলো উসমান। পোর্সেলিনের কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বলল, বাদ দাও, তোমার ব্যবসা কেমন চলছে বল?

- ধুসস ব্যবসা আমার কোথায়, সিলেক্টেড এন্ড পেইড এমপ্লয়ী ওনলি। বাড়িয়ে দেওয়া কফি কাপটা হাতে নিয়ে উত্তর দিল লাস্ট দশ বছর ধরে ইউরোপের সবচেয়ে বড় জেমস্টোন ইমপোর্টার অর্গানাইজেশনের সিইও, আঁদ্রে পেতিত। 
- বাই দি ওয়ে, রিপেয়ারিং খরচটা কোম্পানির। তাই একটা ভাউচার দাও তো এস্টিমেটেড কস্টের। তোমার স্ট্যাম্প আর সইসমেত।

ওঠার আগে স্লিং ব্যাগটা সোফা থেকে তুলে আঁদ্রের হাতে এগিয়ে দিল উসমান। কে জানে কি হিরে জহরত আছে, যে গাড়িতে রেখে কফি খেতে বসে যায়না।


||

আজুরিন ভেবেছিল আজ মা'কে আংটির কথাটা জিজ্ঞেস করবে একবার। কিন্তু তার আগেই মায়ের মেজাজটা এমন খারাপ হয়ে গেল। মাকে তার কোন কলিগ বলেছে আজুরিন স্কুল পালিয়ে একটা মুসলিম ছেলের সাথে রাস্তায় চুমু খাচ্ছিল। সেটা সে নিজের চোখে দেখেছে। অদ্ভুত! আজুরিন অবাক হয়, এটা কী একটা সভ্য শহর নাকি তৃতীয় বিশ্বের কোন অশিক্ষিত বস্তি! প্রথমত স্কুল পালানো আজুরিনের অভ্যেস নয়। সেটা স্কুলে এনকোয়ারি করলেই জানা যাবে। তাছাড়া চুমু খাওয়া দুরস্থান, দানিশ আজ অব্দি পাবলিক প্লেসে ওর হাত ধরে থাকতে লজ্জা পায়। মাঝে মাঝে আজুরিন ভেবে পায়না, ক্যাথলিক ফ্যামিলিতে সে বড় হয়েছে না দানিশ। তিন নম্বর, ধর্ম কি কারো জামায় লেখা থাকে নাকি! যে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে জেনে ফেলবে লোকজন। দানিশের সঙ্গে তার সম্পর্কটা গোপন নয়। তার মা আজ পর্যন্ত আপত্তি করেনি কোনওদিন। কিন্তু তাই বলে এর'ম মিথ্যা বলে মাকে কষ্ট দেয়ার মানেটা কি? এত মুচমুচে গল্প বানিয়ে কেচ্ছা রটানো।

সমস্যাটা হলো ইদানিং মা'কে এগুলো বোঝানো ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দু'একটা উল্টোপাল্টা কথার পর তারও মাথা গরম। 
- তুমি তো সবরকম দেশ ধর্ম সংস্কৃতি মেনেই বিয়ে করেছিলে, কি হলো? খাবার প্লেটটা ঠেলে উঠে পড়েছিল আজুরিন। - নিজের বউ আর পাঁচ বছরের বাচ্চাকে ফেলে রেখে যে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারে, সে আর যাই হোক, ভালোবাসার মানুষ হতে পারেনা।

মায়ের থমথমে মুখটার দিকে ফিরে তাকায়নি আর। সটান উঠে এসেছিল সিঁড়ি দিয়ে নিজের ঘরে। এসেই দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজেছিল। সে ভালই জানে মা'ও খাবেনা আর। মা তার মতোই অভিমানী, তার চেয়েও চাপা। বাবা ছেড়ে যাওয়ার পর মা তাকে কী কষ্ট করে যে মানুষ করেছে সেটা তার জানা। মায়ের পুরো পৃথিবীটাই যে তাকে ঘিরে সেটাও সে বোঝে। কিন্তু লোকে কি বলল না বলল তাই নিয়ে ভাবার মতো সংকীর্ণতা সে তার লৌহকঠিন মায়ের থেকে যে আশা করেনা!


||

ব্যুরোর সার্ভারে ইউজারনেম আর পাসওয়ার্ডটা যখন হিট করল, তখন মাঝরাত পেরিয়ে পঁয়ত্রিশ মিনিট। কম্পিউটারেরও খটকা লাগে, সিস্টেম সেইভাবেই বানানো হয় এখন। স্ক্রিনে ফুটে উঠল, ইট হ্যাজ বীন আ লং টাইম। তোমার কি মনে আছে শেষ কবে তুমি সার্ভারে লগিন করেছিলে?

স্ক্রিনে খুলে যাওয়া ক্যালেন্ডার থেকে একটা তারিখ বেছে নিল সে। এগারো বছর আগের একটা দিন। "ডেট ভেরিফায়েড। ওয়েলকাম" ফুটে উঠল কম্পিউটারে। সে মাথা নাড়ল, তারপর খুঁটিয়ে দেখতে থাকল সাইটের সার্চ অপশনটা। হরেক রকম ভাবে মানুষ খোঁজা যায় এখানে। নাম, পদবী, গায়ের রঙ, চুলের প্যাটার্ন আরো কত কি। তবু তার কোনও লাভ নেই। তার যে ধরনের সার্চ চাই সেটা সে খুঁজে পেতে অপারগ। কি করা যায়? ভাবতে বসল সে। এমনিতেও তার মন ভালো নেই আজ। পুরনো সেই দিনগুলোর কথা চাইলেও সবটা ভোলা বোধহয় কখনোই সম্ভব হবেনা তার পক্ষে। ফিল্ড অপারেশনে আর আগ্রহী নয়, জানিয়ে এজেন্সি ছেড়েছিল তাও দশ বছর হয়ে গেল। তবে আজকের সন্দেহটা সত্যি হলে সেই প্রতিজ্ঞা ভাঙবার সময় এসেছে হয়ত। কিন্তু সেটা যাচাই হবে কিভাবে। এতদিনে ব্যুরোর ওয়েবসাইট অনেক পাল্টে গেছে। তাই হওয়া স্বাভাবিক ছিল, তবু উপায় যে একটা থাকতেই হবে। "বিপ বিপ"। টেক্সট এল তার মোবাইলে। পর্দায় আঙ্গুল ছোঁয়াতেই, "এজেন্সি উইল কল ইউ ইন ফাইভ মিনিটস্", ফুটে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হারিয়েও গেল আবার। অর্থাৎ মোবাইলে কিছু স্টোর হবেনা এরকম বার্তা পাঠানো হল তাকে, আনট্রেসেবল পুশ মেসেজ। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে নিঃশব্দে ব্যালকনিতে চলে এল সে। কলটা আসতে সেটা রিসিভ করল বটে কিন্তু কোনও কথা বললনা। ওদিক থেকে রেকর্ডেড কন্ঠ ভেসে এল, "প্লীজ এন্টার সিক্সটিন ডিজিট কোড।" অনভ্যস্ত আঙুলে ষোলটা কী প্রেস করার পর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। তারপর, "লেভেল ফোর একসেস ইস প্রোভাইডেড ফর ইউ এজেন্ট। ইউ উইল সী এডভান্সড সার্চ অন ইওর স্ক্রিন নাও।" রুমের মধ্যে কম্পিউটারের পর্দায় নতুন একটা বাটন ফুটে উঠেছে ততক্ষণে। "হ্যান্ডরাইটিং, ফিঙ্গারপ্রিন্টস এন্ড সিগনেচার সার্চ"।


||

দানিশের মনকেমন হয় হঠাৎ করেই, আবার মন খুশিয়াল হতেও সময় লাগেনা বিশেষ। আজ যখন ল্যুভর গিয়ে পৌঁছেছিল তখন ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা বেজে কুড়ি। আজুরিন খুব সম্ভবত সবে এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ আজ তার কপালে কোল্ড কফি। এটা ওদের দুজনের অলিখিত নিয়ম। যেদিন দানিশ আধঘন্টার চেয়ে বেশি দেরী করে আসে সেদিন ওকে আইসক্রিম খাওয়াতে হয়। আর তার আগে পৌছে গেলে আজুরিন ওকে কোল্ড কফি খাওয়াতে নিয়ে যায়। কিন্তু আজ কোনটাই হলোনা। আসলে আজ ওদের দুজনারই মন এত ভালো ছিল যে ওরা ভিড়কে পাত্তা না দিয়ে মিউসিয়াম ঘুরতে গিয়েছিল। আজুরিন লিটারেচারের ছাত্রী বলেই হয়তো একেকটা ছবির সামনে যা সময় নিয়ে দেখছিল তাতে ওরা শুধু রাফায়েল আর এঞ্জেলো দেখে উঠতে পেরেছে। দ্য গ্রেট মোনালিসা আরেকদিন হবে'খন। যাই হোক গ্যারাজে ফিরে মন খারাপ হতে সময় লাগেনি। কারন যথারীতি উসমান। কোন শনিবারই দানিশ আট'টার আগে ফিরতে পারেনা, সেটা তো তার অজানা নয়। তবে আজ সেই নিয়ে যে প্রতিক্রিয়াটা দেখাল সেটা দানিশের মেজাজ খারাপ করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই উসমানের মুখের ওপর কিছু বলাটা দানিশের দ্বারা হয়না, আজও হলনা। চুপচাপ বকুনি সহ্য করে নিজের মনখারাপ করে ফেলল।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে মোবাইলে একটা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনটা ভাল হয়ে গেল আবার। ছবিটা একটা সেলফি, তার আর আজুরিনের। আজুরিনের লাস্ট বার্থডে'র দিন দানিশ ওকে নিয়ে ফেরিতে উঠেছিল। তখন প্যারিসে সন্ধ্যে, তখন সেইন নদীতে আলো। আজুরিন যথারীতি পরে এসেছিল একটা নীল রঙের গাউন। দানিশ সাদা ট্রাউসার আর সাদা টি। ওখানে গিয়ে অবশ্য তার মনে হয়েছিল যে নিদেনপক্ষে নীল জ্যাকেট চড়িয়ে আসা যেত। আজুরিনের প্রিয় রং। ওরা কথা বলছিল স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে। বাবার কথায় কাজ শিখতে শুরু করার আগে দানিশ আর আজুরিন এক স্কুলেই পড়ত। যদিও দানিশ ছিল এক বছরের বড় তবু কমন বন্ধুর সংখ্যা অগুনতি। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ অন্ধকার অর্থাৎ নিকষ আঁধার যাকে বলে। বিরলতম কোন কারণে শহরের অনেকটা সেদিন কয়েক মিনিটের জন্য চলে গিয়েছিল পাওয়ার আউটেজের কবলে। আর সেই সুযোগে নদীর ওপর উঠে এসেছিল পূর্নিমার চাঁদ। সেলফিটা তখনি তুলেছিল আজুরিন। ফেরির ওপর বসে দুজনে শপথ নিয়েছিল, আলোয় আঁধারে আলাদা হবেনা কোনদিন। ভালবাসার নরম জ্যোতস্নায় দানিশের সাদা টিশার্ট হয়ে উঠেছিল নীলচে।


||

মনস্থির করতে বেশি সময় তার কোনদিনই লাগে না। দশ বছর আগে ব্যুরোর টপ এজেন্ট হওয়া সত্বেও যেদিন চাকরি ছেড়ে দেবে ঠিক করেছিল সেদিনও সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগেনি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি আলাদা। সে শতকরা নব্বইভাগ নিশ্চিত যে এই সেই লোক যে এগারো বছর আগে তুলাউনস শহরের ফুটপাথে বম্ব প্ল্যান্ট করেছিল। যা প্রাণ নিয়েছিল তিনটি শিশু সহ সতেরজন নিরীহ পথযাত্রীর। সেই শুরু ফ্রান্সের ইতিহাসে সন্ত্রাসবাদী হামলার। অন্তত ঘোষিতভাবে। ব্যুরোর তরফে সেই সময়ের বেস্ট এজেন্টকেই দেওয়া হয়েছিল দায়িত্ব। সত্যি বলতে কি, সরকারী নির্দেশ ছিল পুলিশ শুধু ঘটনার পারিপার্শ্বিক অনুসন্ধান করবে, আর আসল আততায়ীর খোঁজ যাকে বলে ম্যান্হান্ট, সেটা করবে এজেন্সী। তদন্ত যা হয়েছিল তার চেয়ে বেশি কিছু করা যেত বলে সে আজও বিশ্বাস করেনা। পুরো ঘটনার দায় নিয়ে একটি আধা-ধার্মিক আধা-সামাজিক সংগঠন বিবৃতি দিয়েছিল। তাদের ট্র্যাক ডাউন করেছিল সে। প্লাস বিস্ফোরক সাপ্লাইয়ের সূত্র ধরে আরও কিছু লোক ধরা পড়েছিল। কেবল শনাক্ত করা যায়নি ঘটনার পিছনে থাকা একজনকেই যে সম্ভবত সব দলের মধ্যে লিঙ্কের কাজ করেছিল। দুদিকের সোর্স আর ক্লু কাজে লাগিয়ে সে এটা নিশ্চিত হযেছিল, ঘটনার পিছনে এই লোকটির ভুমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় একবছর ইনভেস্টিগেট করে সে আরো কিছু তথ্য় জানতে পেরেছিল। যেমন লোকটা সম্ভবত বিদেশী কিন্তু ফ্রান্সে বহুদিন ধরে আছে আর ভাষা এতটাই সাবলীল যে সহজে বোঝা মুশকিল। নাম আর চেহারা বাদ দিলে অনেককিছুই জানতে পেরেছিল সে, লোকটার শ্যাডো আইডেন্টিটি নিয়ে। যেমন লোকটা প্যারিসে থাকে এবং খুব কাছের কেউ ছিল তার জীবনে, তার পার্টনার হতে পারে সন্তানও হওয়া অসম্ভব ছিলনা। কিন্তু এতসব জানা সত্ত্বেও এজেন্সীর অবস্থা হয়েছিল ধরি মাছ না ছুঁই পানি। তার কারণ এক, যারা ধরা পড়েছিল তারা কেউই লোকটাকে চোখে দেখেনি, সমস্ত যোগাযোগ হয়েছিল ফোনে তাই লোকটার কোন চেহারা পাওয়া যায়নি। দুই, আততায়ীর হাতের লেখা, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইত্যাদি পেলেও সেগুলো দুনিয়ার কোন সিস্টেমে ম্যাচ না করা। আর তিন, আততায়ী সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল যে তার পিছু ধাওয়া করা হচ্ছে, কারণ তার সব পুরনো পরিচয় সে ঝেড়ে ফেলছিল এক এক করে, খুব তাড়াতাড়ি। এজেন্সীর অবস্থা হয়েছিল এমন যে কেউ যেন মাকড়সার জালে নেমেছে প্রাণীটাকে ধরবে বলে আর মাকড়সা ততক্ষণে সেই জাল ছেড়ে পালাচ্ছে।

এত বছরের অজ্ঞাতবাস ভাঙবার কারণটা আদ্যন্ত সাধারণ একটা ফোনকল। ফোনের ওপাশের মানুষটাকে সে চেনে বেশ কয়েকবছর হতে চলল। কিন্তু শনিবার বিকেলবেলা যে কন্ঠস্বর তার সাথে কথা বলল সেটার সাথে দশবছর আগে পাওয়া একটা ভয়েস স্যাম্পলের অদ্ভুত মিল! অথচ এই লোকের সাথেই কথা বলেছে আজ অব্দি দশবারের বেশি। তাহলে খটকাটা হঠাৎ আজ বোধ হলো কেন? সন্ধে পর্যন্ত এই চিন্তা আচ্ছন্ন করে রাখল তাকে, তারপর মনে মনে সে বলে উঠলো 'ইউরেকা'। দশবছর আগে যে রেকর্ডেড কলটা তারা পেয়েছিল সেটা ছিল একটা পুরনো জমানার ল্যান্ডফোন থেকে ট্যাপ করা। আর আজও তার সাথে লোকটার কথা হলো ঠিক একটা ল্যান্ডলাইন নাম্বারে! পুরোটাই ভয়েস ক্ল্য়ারিটির হেরফের। স্মৃতিতে থাকা কন্ঠস্বর ঈষত গাড় এবং জড়ানো। এত সহজ একটা সমাধান এত জটিলভাবে সিদ্ধ হবার প্রয়োজন ছিল না যদি আরেকবার তার সাথে কথা বলা যেত তা সে মোবাইলে হলেও। কারণ ক্ল্য়ারিটি কমবেশি হলেও ভয়েস রেকগনিশন মানে কন্ঠস্বর সনাক্তকরণ করা কম্পিউটারের কাছে নিশ্চিতভাবেই বাঁয়ে হাত কা খেল। কিন্তু বিধি বাম সন্ধে পর্যন্ত আর যোগাযোগ করা সম্ভব হলোনা। সে এজেন্সীকে সরাসরি জানাতে পারত তার সন্দেহের কথা কিন্তু শুধুমাত্র তার স্মরনশক্তির ওপর ভরসা করে একজন মানুষকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে রিপোর্ট করার মত কাঁচা কাজ সে করতে পারেনা। অগত্যা পরিকল্পনা সাজিয়ে নিল সে। ব্যুরোর সিস্টেমে তাকে সার্চ করতেই হবে। আর সেজন্য তার চাই এমন কিছু যা ভয়েস স্যাম্পলের মতো অনিশ্চিত নয়, যা দিয়ে পুরনো প্রমাণগুলো ম্যাচ করিয়ে সন্দেহের উর্ধ্বে পৌঁছানো যেতে পারে। যেমন ফিঙ্গারপ্রিন্ট, হ্যান্ডরাইটিং অথবা সিগনেচার। সেসব সে জোগাড় করেছে বৈকী। তাও এত সুচারুভাবে, যাতে ওপ্রান্তের মানুষটির মনে ছটাক সন্দেহ না ঢুকে পড়তে সুযোগ পায়।

আজ সোমবার, সে জানে আজ একটা ফোন তার কাছে আসবে। এতদূর হয়তো সে একক দায়িত্বে আসতে পেরেছে কিন্তু তার পরবর্তী পদক্ষেপ অবশ্যই জানতে চাইবে তারা। সে জানে সেই পদক্ষেপ কী হতে পারে অর্থাৎ তাকে যা করতে বলা হবে। তার পূর্বাশ্রমে সে ছিল দ্য বেস্ট, তার কারণ শুধুই তার মগজ নয়, কিছুটা তার নিখুঁত টিপও। সে এটাও জানে, এবার কম্পিউটারাইজড ভয়েস নয়, কলটা আসবে একজন প্রৌড় মানুষের কাছ থেকে।


||

স্কুল ছেড়ে দিতে হলেও দানিশের জীবন থেকে রবিবারগুলো চলে যায়নি। গ্যারাজ বন্ধ থাকে এই দিনটা আর তাই কালকের দিনটা কেটেছে ছুটির দিনের মতোই। সকালে ব্রেকফাস্ট করে সে বেরিয়েছিল ফুটবল খেলতে। কয়েকটা মধ্য কৈশোরের ছেলে সারাদিন সামনের একটা মাঠে ফুটবল পেটায়। ওদের সাথেই খেলে দানিশ। তাছাড়া ওদের সাথে খেলার আরো কারণ এই পাড়ায় দানিশের নিজের বয়সী বন্ধু খুব কম। প্রায় বছর দশেক আগে দানিশরা যেখানে থাকতো সেটা শহর থেকে অল্প বাইরে, যদিও জায়গাটা খুব খুব সুন্দর ছিল। এখনকার মতো এপার্টমেন্ট নয়, নিজেদের বাড়ি ছিল ওদের। দানিশের মনে পড়ে ওর দেখাশোনা করার জন্য একজন আয়াও থাকতেন ওবাড়িতে। উসমান প্রায়ই বাড়ি থাকতনা যেহেতু। তারপর হঠাৎ সব ছেড়ে দিয়ে একদিন এখানে চলে এল উসমান ওকে নিয়ে। গ্যারাজটা এই এলাকাতেই। তখন উসমান ছিল অংশীদার পরে মালিক। আর এইসবের মধ্যেই, নতুন জায়গা নতুন স্কুল এসবের সাথে মানিয়ে নিতে নিতেই কোনওদিন বেশি বন্ধু হয়ে উঠলনা দানিশের। তবু আছে কেউ কেউ। কালই যেমন দেখা হল প্যাট্রিস এর সাথে। প্যাট্রিস ওর সাথে স্কুলে পড়ত। ওরা একসাথে খেলত স্কুলের সিনিয়র টিমে। দানিশ নম্বর টেন মানে এটাকিং মিডিও আর প্যাট্রিস ডিফেন্সিভ। দুজনের কম্বিনেশন প্লে ওদের টিমকে যে কত ম্যাচে খেলায় ফিরিয়েছে তার হিসেব নেই। কাল ওকে খেলতে দেখে প্যাট্রিস দাঁড়িয়ে পড়ল খেলা দেখতে। স্কুল ছেড়ে দেবার পর দেখা হয়না বললেই চলে তাই খেলা শেষে কথা বলছিল দুজনে। দানিশ জানত প্যাট্রিসের দাদা নিখোঁজ বেশ কিছুদিন ধরেই। আজ জানতে পারল পুলিশ নাকি জানতে পেরেছে সে ধর্ম পরিবর্তন করে কোনও সন্ত্রাসবাদী দলে নাম লিখিয়েছিল। নিখোঁজ হবার আগে কিছুদিন সে ওদের গ্য়ারাজেও কাজ করেছে, সেই সূত্রে নাকি পুলিশ উসমানকেও ডেকে জেরা করেছে। আশ্চর্য, এসব কিছু জানতই না দানিশ!

আরেকটা ব্যাপারে মন ঠিক করে ফেলেছে সে। কিছুদিন ধরে আজুরিন একটা নীল আংটির কথা বলছিল। না দানিশকে নয় তবে ওর মাকে বোধ হয় বেশিই বলে থাকবে। মায়ের সাথে এরম খিটিরমিটির তো আগে হতোনা! সে যতটুকু বোঝে, সাধ্যের মধ্যে হলে এতদিনে নিশ্চই আজুরিনের মা ওকে জিনিসটা এনে দিতেন। এবার দানিশ ঠিক করেছে জিনিসটা সে'ই এনে দেবে। তার জন্য যদি উসমানের সাথে ঝামেলা করতে হয়, সে তা করতে রাজি। ঝামেলা করতে হতে পারে তার কারণ একটাই, নীল জেমস্টোন একটা পাওয়া গেছে। প্যাট্রিস এখন কাজ করে প্যারিসের নামকরা একটা জ্যুলারী শোরুমে। কাল কথায় কথায় অর থেকে জেনে নিয়েছে এইরকম একটা পাথরের কথা। খুব বড় বা নামকরা জেমস্টোন তার চাই না, তবে কিনতে হবে ন্যায্য দাম দিয়ে নিশ্চয়। আর সেই টাকাটা তাকে চাইতে হবে উসমানের থেকে। সে ঠিক করে নিয়েছে আর সে ভয় পাবেনা। পুলিশের জেরার মতো বড় একটা ঘটনা যদি উসমান তার কাছে চেপে যেতে পারে তাহলে সে কেন বাপ বলে তাকে সমঝে চলবে? এইসব ভাবতে ভাবতে দানিশ খেয়াল করেনি ফোনটা বাজছে। হুঁশ ফিরল উসমানের চিৎকারে। উসমান সবে একটা নীল গাড়ির বনেট খুলে কাজ শুরু করেছে আর সেইমাত্র এসেছে ফোনটা। এর আগেও দুবার এসেছিল কিন্তু ওপ্রান্তের কথা শোনা যায়নি। এইবার তাই আর কাজ ছেড়ে না এসে সে দানিশের উপর গর্জাল শুধুশুধু। "এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখছ? যাও ফোনটা ধরো!"


||

"আমি সত্যি জানিনা তুমি আমার বাবা কিনা !" প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল দানিশ।
লাঞ্চব্রেকের পর দানিশ এসেছিল উসমানের চেম্বারে। টাকা চাই তার, অনেকগুলো। বলার স্বরে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল। যেন সে চাইতে আসেনি, দাবি করছে। অবাক হয়ে গেছিল উসমান। কারণ জিজ্ঞেস করাতে ব্যাপারটা ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যায়। উসমান এমনিতেই বিরক্ত ছিল ফলে স্পষ্ট শুনিয়ে দেয়, "যতক্ষণ না আমি জানতে পারব এতগুলো ইউরো তুমি কিভাবে খরচা করবে আমি কোন টাকা দেবনা তোমাকে।"
দানিশ হেরে গেলে চুপ করে যায়। দানিশ আজ চুপ করেনি। বেরিয়ে যাবার আগে বলেছিল, "আমি কি করব সেগুলো সব জানতে চাইবার আগে তোমার সব কীর্তিকলাপ আমাকে কোনওদিন জানিয়েছ কি? কখনো বলেছ তোমাকে পুলিশের জেরার কথা? আমি অবাক হবোনা যদি কোনো ভয়ংকর চার্জে তুমি কোনওদিন হাজতে যাও! কারণ আমি সত্যি জানিনা তুমি আমার বাবা কিনা!"

দানিশ বেরিয়ে যাবার পর বাকিদেরও ছুটি দিয়ে দিয়েছে উসমান। অন্যমনস্কভাবে সে এগিয়ে গেল আঁদ্রের নীল অডিটার দিকে। গাড়িটার ইঞ্জিনে কোনও প্রবলেম নেই। ব্রেকও নির্ঝঞ্ঝাট। সমস্যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। এক হতে পারে প্রসেসরে কোনও গণ্ডগোল। এখনকার দামি কোনও গাড়িই পুরোপুরি মেকানিক্যাল নয়। অনেকখানি অটোমেশন আছে, পুরো প্রসেসটা কম্পিউটার সিগন্যাল স্পেসিফিক। সেই এরিয়াটা উসমানের হাতের বাইরে। তবু করেছে সে যতটা টিউনিং করা যায়। আঁদ্রেকে কল করে গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছে আগেই।


||

ল্যুভরে আজ ভিড় একটু কম। অবিশ্যি এর আগে শনিবার বা ছুটির দিন ছাড়া এই চত্বরে আসেইনি আজুরিন। গত পাঁচবছরে বোধহয় সে প্রথম কোনো সোমবার স্কুল কামাই করল। একে তো মায়ের সাথে কথা নেই বললেই চলে তার ওপর দানিশ সকালবেলা জানতে চাইল, সে আজ স্কুলের পর কিছুটা সময় দিতে পারবে কিনা। আজুরিন নিজেও জানে স্কুল মিস না করলে চলত তবু কখনো কখনো অকারণটাই কারণ হয়ে যায়। বেশি অপেক্ষা করতে হলনা, দূরে দেখতে পেল দানিশকে। নীল হুডি আর ফেডেড জিন্স। হুডিটার পেটের কাছে বড় পকেট আছে একটা। দানিশ এসে দাঁড়ালো তারপর মুচকি হেসে আজুরিনকে বলল, "চল, দা ভিঞ্চি গুলো দেখে আসি।" আজুরিন হাতটা ধরল ওর। দানিশ মুখে কিছু না বললেও অবাক হলো একটু। রেনেসাঁ পর্বের পেইন্টিংগুলো যে হলটায় আছে সেটায় এত এত ফেমাস ছবি যে এক একটা দেওয়ালে প্রায় তিরিশটা করে। কোনটাই আট দশ স্কয়ার ফিটের কম না। একটা সরু প্যাসেজ দিয়ে ঢুকে দশ বারো মিটার দূরে একটা বোর্ডওয়াল তৈরী করা, সেটা যতটা না বড় তার চেয়েও বড় দেখাচ্ছে তার কারণ, সেটার মধ্যিখানে একটা অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ছবি। শুধু একজন মহিলার মুখ আর বাঁহাতটা ভাঁজ করে একটা চেয়ারের ওপর রাখা, ব্যস। এই মোনালিসা? পেইন্টিং নাহয় নাইবা বুঝল তাই বলে এত সাধারণ একটা মুহূর্ত আশা করেনি সে! দানিশ একা নয় আজুরিনের মুখেও স্পষ্ট হতাশার ছাপ। এরই জন্যে লোকে পাগল! মানুষ দেশবিদেশ থেকে ছুটে আসে এই দেখতে? ধুস্স্স।


||

ঘড়িতে প্রায় সাড়ে পাঁচ তখন আঁদ্রে নামল। এসেই বলল, "এক কাপ কফি খাওয়াবে প্লীজ? খুব ভাল লাগত।" নিজের বিরক্তিটা প্রকাশ করলনা উসমান। আঁদ্রে কেবিনে এসে বসল। আজও সেই লেদার ব্যাগটা রয়েছে কাঁধে। উসমান বলল, "তোমার গাড়ি ঠিক এখন।"
- জানতাম! পারলে তুমিই পারবে। কি হয়েছিল বলতো?
- হঠাৎ হঠাৎ স্পীড বেড়ে যাচ্ছিল তাই তো? রোটরে সমস্যা ছিল একটু। মডিউলেট করে দিয়েছি।
- যাক! জীবন বাঁচালে তুমি।
উসমান কফির কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে মুচকি হেসে বলল, "তুমি কি পারী শহরের সব টিনেজারকে চেন নাকি?"
- "কেন?", অবাক হল আঁদ্রে।
- "না হলে দূর থেকে একটা মেয়েকে দেখে ক্যাথলিক না বুদ্ধিস্ট তুমি জানলে কি করে?" চোখে চোখ রাখল উসমান।
আঁদ্রে ইতস্তত করল একটু। তারপর বলল, "তোমাকে একটা কথা বলা প্রয়োজন। সত্যি বলতে কি আমি আজ এসেছিলাম সেই কারণে।"
- কী কারণ?
- তোমাকে একটা জিনিস দিতে চাই। যেটা তুমি দেবে তোমার ছেলেকে। আর সে দেবে আজুরিনকে। যাকে ও ভালবাসে।
- আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
- স্বাভাবিক। সব কথা তোমাকে বলা যাবেনা তবে এটুকু বলতে পারি আমি ঐ মেয়েটিকে চিনি। কিন্তু সে আমাকে চিনুক, তা আমি চাইনা।
- আচ্ছা, কিন্তু তাই বলে তোমার কোনোকিছু আমার ছেলে তার কাছে পৌঁছে দিতে যাবে কেন?
- আমার নয়। জিনিসটা তারই। আর আমি চাই সেটা দানিশ তাকে দিক, আমি না। তুমি বুঝতে পারছনা !
- না, পারছিনা। যতক্ষণ না তুমি সবকিছু খুলে বলছ।

কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে কাপ টেবিলে নামিয়ে রাখল আঁদ্রে। লেদারের ব্যাগের চেনটা খুলে একটা প্যাকেট বের করল।


||

ফোনটা এসেছিল দুপুরের আগেই। যা অনুমান ছিল তাই শুনতে পেয়েছিল সে।

- টার্মিনেট। নিকেশ করো। আমরা বাকিটা সামলে নেব।

এই আদেশ সে আগেও পেয়েছে অসংখ্যবার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাফল্যের সাথে রিপোর্ট করেছে সে। কিন্তু আজ চমক লাগল তার। হয়তো অনভ্যাস। তার জবাব এখানে অনর্থক। ফোন কেটে গেছে। এক অদ্ভুত দোলাচলের সৃষ্টি হল তার মধ্যে। তার স্মৃতিতে থাকা এগারো বছর আগের একটা ভয়েস স্যাম্পল কি একটা মানুষের জীবন শেষ করে দেবার জন্যে যথেষ্ট? তাছাড়া লোকটা বিস্ফোরণের ঘটনায় দু-তিনটে দলের মধ্যে যদি যোগাযোগের মাধ্যম থেকেও থাকে, তার থেকে প্রমাণ হয়না যে সে সব কিছু জানত। আফটার অল মাস্টারমাইন্ড সে ছিলনা। সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি এরকম অনেক লোককেই রিক্রুট করে যারা ঘটনা ঘটা অব্দি আদপে কিছু জানতেই পারেনা। কিন্তু ফিঙ্গারপ্রিন্টস? আঙুলের ছাপ তো মিথ্যে বলেনা। আরো কিছু সত্যি জানা দরকার বলে মনে হয়েছিল তার।

- আমি যে খুব ভালোমানুষ নই সেটা বোধহয় তুমি জান। কিন্তু আজ থেকে বারো বছর আগে আমার একটা সংসার ছিল। শহরের কোলাহলের বাইরে একটা ছোট্ট বাড়িতে আমি থাকতাম স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে। অনেকটা হঠাৎ করেই একটা ঘটনায় জড়িয়ে পড়ি। ঘটনা না বলে ঘৃণ্য অপরাধ বলাই শ্রেয় যদিও। প্রথমে টাকার লোভে জড়িয়ে পড়লেও পরে কিছু বুঝতে পারিনি তা নয়। তবে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমাকে ঘর ছাড়তে হল। কিছুদিন অন্য দেশে লুকিয়ে থাকার পর এখানে এসে নতুন পরিচয়ে বাঁচা শুরু করলাম। ততদিনে পরিবারের কাছে ফিরে যাবার রাস্তা বন্ধ। তুমি দেখেছ আমি কিভাবে সিঁড়ি টপকে কোম্পানির এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি, তবু বারবার মনে হয় আমি হেরে গেছি। কারণ আমার হাতে রক্ত লেগে আছে। আমি এই জীবনের যোগ্য় নই। তাই আমি ঠিক করেছি আবার হারিয়ে যাব। শুধু আমার বাচ্চা মেয়েটাকে আমার করা একটা প্রমিস রেখে যেতে চাই।

আঁদ্রে চলে যাবার পর বাড়ি ফিরেছে উসমান। ব্যালকনিতে বসে অন্ধকারে সে ভাবছিল আঁদ্রের বলা কথাগুলো। তার সামনে একটা টেবল। তার ওপর রাখা একটা মোবাইল আর একটা ছোট নীল রঙের ভেলভেট বাক্স। সে ঠিক করল মোবাইলটা তুলে সে আঁদ্রেকে কল করবে। সে তার পূর্বাশ্রম ছেড়ে এসেছে, আর রক্ত মাখতে চায়না উসমান। সে আঁদ্রেকে জানিয়ে দেবে যে তার গাড়িতে কিছু সমস্যা সত্যিই আছে, সে যেন কোনওমতেই গতি ৫০ এর ওপর না ওঠায়। এজেন্সির কাছে তার জোগাড় করা সমস্ত প্রমাণ আছে, তারা পারলে তাকে আইনের পথে শাস্তি দিক। উসমান মোবাইলটা হাতে তুলতেই একটা টেক্সট ঢুকল। "ওয়েল ডান, এজেন্সি থ্যান্কস ইউ ফর সার্ভিসেস।"


||

বাইরে এসে আজুরিন আজ ওই পারে যেতে চাইল। পঁ দ্যু কারোস্যাল এ ওঠার আগে অবশ্য ওরা একটা আইসক্রিম পার্লারে দাঁড়িয়েছিল। আজুরিনের জন্য় একটা আইরিশ কফি আর নিজের জন্য় ভ্যানিলা উইথ সুইস ক্যারামেল নিল দানিশ। ব্রিজে ওঠার মুখে দুটো পুলিশ কার। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে বারণ নেই যদিও। ওপরে উঠেই আজুরিন দেখতে পেল ব্যারিকেড। ওপাশ থেকে এপাশে আসার চ্যানেলটাও বন্ধ করা হয়েছে আপাতত। অর্থাৎ মারাত্মক কিছু ঘটেছে নিশ্চয়। দানিশ এইসব দেখতে পছন্দ করেনা একদম। ওর দমবন্ধ হয়ে আসে। আজুরিন কৌতুহলী। এপাশ থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা এত ভিড়। দানিশকে অপেক্ষা করতে বলে সে উল্টো ফুটে ভিড়ের দিকে এগোল। ইস্স, কার এক্সিডেন্ট। কোনও মানে হয়! বাঁহাতের ফুটপাথ ভেঙ্গে উঠে পড়েছে গাড়িটা। ভেতরে একজনই ছিল মনে হয়, কারণ ড্রাইভিং সীটে রক্ত দেখতে পেল আজুরিন। এসব দেখলে দানিশের কী অবস্থা হবে ভেবে হাসি পেল তার। ছেলেটা সত্যি এত নরম। ভিড় থেকে বেরোতে বেরোতে শুনতে পেল, লোকটা অলরেডি ডেড।

দানিশের আইসক্রিম শেষ। আজুরিন এসে বলল, "কার। ব্রেক ফেইল মনে হয়। গাড়িটার যা অবস্থা। মালিকের সাথে ওটাও মর্গে যাবে।" দানিশ ব্রিজ থেকে নামতে নামতে শুধু জিজ্ঞেস করল, "কি গাড়ি?"
- অডি ক্যু। খুব সুন্দর দেখতে! ঝকঝকে নীল এক্কেবারে!

0 comments: