1

ছোটগল্প - অনিন্দ্য গৌতম

Posted in


ছোটগল্প


অপত্য
অনিন্দ্য গৌতম


“গুডমর্ণিং, তোমার নাম কি?” প্রশ্নটি যিনি করলেন তাঁর উচ্চতা আমার কোমরের ঈষৎ উপরে, পরনে নীল রঙের ফুলপ্যান্ট, কালো সোয়েটার আর পায়ে কেডস জুতো। 

“আমার নাম রণ, রণবীর সরকার, আর তোমার?”

প্রশ্নকর্তা এবার আমার পাশে এসে বললেন, তারপর গম্ভীরভাবে বললেন আমার নাম স্যমন্তকজ্যোতি দত্তরায়, ডাকনাম বুরুন, ঠাম্মা বলে শিবনাথ, আর বাবা বলে কিশমিশ।”

এই শেষ নামটি বলার সময় তেনার মুখের হাসিটি দেখে বুঝলাম পিতৃদত্ত এই নামটি তাঁর বিশেষ পছন্দের। 

“ তুমি কোথায় থাকো?” আবার প্রশ্ন। 

“ওই সামনের ফ্ল্যাট বাড়িটায়।” 

“ও ওটা তো গ্রীনভিউ হাউসিং। আমরা দক্ষিণায়ণ হাউসিং কমপ্লেক্সে থাকি, ব্লক জি, চারতলা, ফ্ল্যাট নম্বর থ্রি সি।” 

আমার সঙ্গীটি দেখলাম গুছিয়ে কথা বলতে ওস্তাদ। তার বাকবিস্তারের প্রতিভা দেখে মনে হয় এ ছেলে বড়ো হয়ে হীরেন মুখুজ্জে বা চার্চিল না হয়ে যাবে না। 

পরবর্তী দশ মনিটে সে জানিয়ে দিলো যে তার বাবা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়ার বরাহনগর ব্র্যাঞ্চে ম্যানেজার, মা একটি স্কুলে পড়ান, তাদের বাড়িতে বাবা – মা ছাড়াও বাসন্তীপিসী আর একটি পাগ প্রজাতির কুকুর আছে, কুকুরটির নাম ক্লিওপেট্রা। এই বাসন্তীপিসী মহিলাটি বুঝলাম পরিচারিকা, খোকার দেখভাল করেন।খঙ্খোকাখ খোকা তাঁকে বিশেষ পছন্দ করে না কারণ, তাকে তিনি জোর করে দুধ, ডিম, কর্নফ্লেক্স, ইত্যাদি অখাদ্য খাবারগুলি খেতে বাধ্য করেন। আর আইসক্রিম, আলুর চিপস, কোল্ড ড্রিঙ্কস, ঠাম্মার বানানো আচার ইত্যাদি পুষ্টিবর্ধক খাবার মোটেও খেতে দেন না। আর যেটা সবচাইতে সাংঘাতিক সেটা হলো বাসন্তীপিসী বাবা মা বেরিয়ে গেলে খোকাকে খাইয়ে দাইয়ে সিরিয়াল দেখতে বসেন, ফলে এই সময়টায় তিনি কার্টুন চ্যানেলের মতো শিক্ষণীয় জ্ঞান বর্ধনকারী অনুষ্ঠানগুলি দেখতে পান না। 

চাকুরীরত বাবা মায়ের এই সমস্যাটা বোধহয় সার্বজনীন। আমার ছোটবেলাতেও এমনটাই দেখেছি। তবে আমদের ছোটবেলায় টিভি ছিলো না। আমাদের ছিলো বই। শীর্ষেন্দু, সুনীল, সমরেশ, সত্যজিৎ রায়ের বই। চিলেকোঠার ঘরে বসে অলস দুপুরে আমরা সেইসব বই গিলতাম। এটুকুই যা তফাত। তানাহলে উত্তর কলকাতার সাবেকী বাড়িতে একুশ জনের একান্নবর্তী পরিবারে বড় হওয়া আমার সঙ্গে এই খোকার কোন তফাৎ নাই। 

খোকা যেভাবে উৎসাহ ভরে ঘাড় নাড়িয়ে তার নিজের কথা বলে যাচ্ছিলো তাতে বুঝলাম খোকা বাড়িতে কথা কইবার লোক বিশেষ পায় না --- আজকাল ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর ছোট ছোট পরিবারে যা হয় কি। তবে একটা জিনিস অবাক লাগলো আমার আন্দাজে খোকার বয়স সাত আট। এই বয়সে ওর মতো সম্পন্ন ঘরের ছেলেরা স্কুলে যায়, কিন্তু খোকা একবারও নিজের স্কুলের কথা বললো না। যাই হোক, খোকা এত উৎসাহ নিয়ে নিজের কথা বলছিলো যে আমি আর ওই প্রসঙ্গ তুলে তাকে অপ্রতিভ করলাম না। 

এমন সময় দূর থেকে কুয়াশার মধ্য থেকে ডাক এলো বুরুন, বুরুন। সঙ্গে একটা কুকুরের ডাক। বুঝলাম বুরুন কথিত বাসন্তী পিসীটি কুকুরটিকে প্রাতঃকৃত্য করাতে নিয়ে বেরিয়েছিলেন, বুরুনবাবু তাঁর সঙ্গী হয়েছেন। বুরুন এবার আমার দিকে চাইলো, তারপর ঘাড়টা উঁচু করে আমার গালে একটা চুমু খেয়ে “কাল এসো, আবার দেখা হবে বলে দৌড়ে পালিয়ে গেলো।” 

আমি পেশায় কম্প্যুটার ইঞ্জিনিয়ার। মাসছয়েক আগে আমার স্ত্রী শ্রীতমার সঙ্গে ডিভোর্সের পরে আমি আমার তৎকালীন কর্মস্থল বেঙ্গালুরু ছেড়ে হায়দ্রাবাদ চলে যাই। শ্রীতমার সঙ্গে বিগত তিন বছর আমার কোন সম্পর্ক ছিলো না। এই দুটো বছরে নিজের দশবছরের বিবাহিত স্ত্রী আর ছয় বছরের বাচ্চার থেকে আলাদা থাকার ফলে আমার দুটি প্রাপ্তি হয়। একটি ডিপ্রেশন অন্যটি এলকোহলিজম। ডিভোর্সের পর শ্রীতমা আমার ছেলে সাম্যর কাস্টডি খুব সহজে পায় কারণ আদালতে এটা খুব সহজেই প্রমাণিত হয় যে আমার বিহেভিয়ারাল সমস্যা আছে, আমি একটি মদ্যপ এবং রেগে গেলে আমার মাথার ঠিক থাকে না। কোর্ট রায় দেয় আমি সপ্তাহে একদিন সাম্যের সঙ্গে কথা বলতে পারবো , কিন্তু ওর মায়ের অনুমতি ছাড়া অর সঙ্গে দেখা করতে পারবো না। সেইদিন রাত্রে স্কচের সঙ্গে একগাদা ট্রাঙ্কুলাইজার খেয়ে আমি আত্মহত্যা চেষ্টা করি কিন্তু অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হড়হড় করে সব বমি করে ফেলি। আমার দাম্পত্যে, আমার পিতৃত্বে আমি অপদার্থ বলে আগেই প্রমাণিত হয়েছিলাম এবার এটাও প্রমাণিত হয়ে যায় যে আমি একলা বেঁচে থাকার জন্যও অনুপযুক্ত। বেঙ্গালুরুতে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব ছিলো না। তাই আমি হায়দ্রাবাদে এসে অপেক্ষাকৃত কম মাইনেতে অনেক ছোট একটা ফার্মে জয়েন করি। সেই থেকে দেড় বছর আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের এবং সাইকলজিস্টের তত্ত্বাবধানে আছি। বর্তমানে আমার অবস্থা অনেকটাই স্টেবল কিন্তু আমাকে এখনও রেগুলার ওষুধ খেতে হয়। 

ডিভোর্সের পর শ্রীতমা স্টেটসে সেটল করেছে, যতদূর জানি একটি লেবানিজ ছেলের সঙ্গে লিভ ইন করছে। সাম্যের সঙ্গে আমার স্কাইপে যেটুকু কথা হয় তাতে বুঝি ও একটা নতুন দেশে সম্পুর্ণ নতুন পরিবেশে, নতুন সংস্কৃতিতে গিয়ে একেবারে পালটে গিয়েছে, আমি হলপ করে বলতে পারি আর কয়েক বছর পর ও আমার সম্পুর্ণ অপরিচিত একটা মানুষ হয়ে উঠবে। 

ডিভোর্সের পর আমার মা অনেকবার আমার বিয়ের কথা বলেন, কিন্তু আমি রাজী হইনি। আমার কলিগ প্রিয়ার সাথে আমার বারদুয়েক শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার একটা সম্ভবনা তৈরি হয়েছিলো --- কিন্তু আমি বুঝেছিলাম যে শ্রীতমা যাওয়ার সাথে সাথে আমার পৌরুষের একটা অংশ নিয়ে চলে গেছে, যৌনতা আমাকে আর আকর্ষণ করে না, ইন ফ্যাক্ট এখন নগ্ন নারী শরীর দেখলে আমার বিবমিষা হয়। ডাক্তার বলেছেন এই ফ্রিজিডিটি, এই এভার্সন টু সেক্স এটা টেম্পোরারি ফেজ, এটা কেটে যাবে ---- কিন্তু আমার তা বিশ্বাস হয় না। মাস ছয়েক আগে এই পৃথিবীতে আমার একমাত্র জীবিত বন্ধন, আমার মা মাল্টি অর্গ্যান ফেলিওর হয়ে মারা গেছেন, তারপর থেকে এই পৃথিবীর একপ্রান্তে, এক মহানগরীর একটি বহুতলের বারোতলায় একটি সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে আমরা পাঁচজন বাস করি, আমি, আমার ঘরের চার দেওয়াল আর ছাদ। আমার অফিসের একটা কাজে দিন সাতেকের জন্য কলকাতায় এসেছি, উঠেছি কোম্পানির গেস্ট হাউসে, নিউটাউনের একটা হাউসিং কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাটে। রোজ সকালে ডাক্তারের পরামর্শ মতো আমায় ছুটতে হয়, আজও বেরিয়েছিলাম মর্নিং ওয়াক করতে সামনের পার্কটাতে, সেখানে এই খুদে বন্ধুটির সাথে আমার আলাপ। 

তার পরের দিন মাঠে গিয়েছি।

গিয়ে দেখি বুরুনের মুখ ভার। 

জিজ্ঞাসা করলাম “কি হলো?”

সে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো “তুমি এত দেরী করে এলে কেন? আমি তো ভাবছিলাম তুমি তো আর আসবেই না।”

তার এই ঠোঁট ফোলাবার ভঙ্গীটা আমার অপরূপ লাগলো। আমি যখন নিজের সন্তানের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি তখন তার বয়স চার মাস। তাই এমনভাবে আমার জন্য কেউ কোনদিন অপেক্ষা করে থাকেনি, এমনভাবে আমার ওপর কেউ অভিমান করেনি, এমনভাবে আমার কাছে আদরের প্রত্যাশায় থাকেনি। এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে একদম নতুন। আমি ওর মাথার চুলটা একটু ঘেঁটে দিয়ে বললাম “রাগ কোরো না বুরুনবাবু, ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেলো যে।” 

বুরুন আমার কোলের কাছে এসে বলে “আমার বাবাও ঘুম থেকে উঠতে দেরী করে, রোজ। আর মার কাছে বকুনি দেয়। মা প্রথমে জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দেয়, তারপরো না উঠলে গায়ে জল ঢেলে দেয়।”

দাম্পত্য জীবনের অতি পরিচিত খুনসুটির দৃশ্য। আমি দীর্ঘদিন সামাজিক সম্পর্কগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছি, এইসব সাংসারিক খুঁটিনাটির সঙ্গে বহুদিন পর পরিচিত হতে পেরে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক যেমন নিষিদ্ধ জিনিস হাতে পেলে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে আমারও তেমন মনে হতে লাগলো। 

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম “তোমাকে সবচেয়ে বেশী কে ভালোবাসে, বাবা না মা?”

বুরুন একটু ভাবলো, তারপর বললো “বাবা।”

আমি বললাম “কেন?”

“বাবা আমার জন্য ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক নিয়ে আসে, চকোলেট নিয়ে আসে। আমি দেয়ালে ড্রয়িং করলেও কিছু বলে না। বাবা বাড়িতে অফিসের কাজ নিয়ে বসলেই বাবার পিঠে দুমদুম করে কিল মারতে থাকি, আর বাবা আমাকে ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে, বিছানায় ফেলে কাতকুতু দেয়।”

“আর মা?”

এবার বোধহয় ও একটু ফাঁপরে পড়লো। ভুরু কুঁচকে ভীষণ জটিল একটা কোন সমস্যায় পড়েছে এমন মুখ করে কিছুক্ষণ থাকলো, তারপর বললো “ মাও ভালো, কিন্তু যখন বলে বুরুন দুধ খেয়ে নাও, বুরুন এখন খেলো না, বুরুন চুপ করে বসে থাকো ----- তখন ভালো লাগে না।”

“তাহলে কখন ভালো লাগে?”

“যখন আমার হ্যাপি বার্থডেতে মা বিশাল কেক বানায়, কুকিজ বানায়, সারা বাড়িটা মোমবাতি আর কাগজের ফুল দিয়ে সাজায়, অথবা ক্রিসমাসের দিন আমার বিছানায় চুপিসাড়ে এসে গিফট রেখে যায় যদিও মা ভাবে আমি বুঝি এখনও বিশ্বাস করি যে সান্টাক্লজ এসে গিফট রেখে গেছে, কিন্তু আমি বড় হয়ে গেছি সব বুঝতে পারি এটা মানতেই চায় না।”

বুঝলাম খোকার জীবনে বাবার দিক থেকে প্রশ্রয় বেশী আর মায়ের দিক থেকে বেশী শাসন। আমার ছোটবেলায় ঠিক এর উলটো ছিলো। আমাদের যতো আবদার ছিলো মায়ের কাছে, বাবাকে আমরা যমের মতো ভয় পেতাম। বুঝলাম একটা প্রজন্মের তফাতে অনেক কিছুই পালটে যায়। 

এমন সময় আবার ডাক এলো “বুরুন, বুরুন।”

বুরুন সেদিনের মতোই আমাকে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে চলে গেলো। 

সেদিন সারাদিন কাজ করতে করতে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম। বারবার বুরুনের মুখ, ওর দুষ্টুমিভরা চোখ, ওর নাক কুঁচকে হাসি, রেগে গেলে ওর ফোলা ফোলা দুটো ঠোঁট আমার মনে পড়ছিলো। নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর একটা সযত্নলালিত বাস্তববাদী, কাজপাগল, উচ্চাকাঙ্খী, উন্নাসিক মানুষের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়িয়েছি এই কয়েক বছর, আসলে মানুষের সঙ্গে খোলামেলা ভাবে মিশতে আমার অস্বস্তি হতো, আজ দেখলাম সেই অভেদ্য বর্মটাকে ভেদ করে এই প্রিয়দর্শন বালক আমার হৃদয়ে প্রবেশ করে আমার হৃদয়ে ফল্গুধারার মতো প্রচ্ছন্ন স্নেহের স্রোতকে উৎসারিত করে বের করে দিয়েছে। 

তার পরের দিন মাঠে যেতেই বুরুন আমার হতটা চেপে ধরে বললো “গল্প বলো।” আমি মহা মুশকিলে পড়লাম। একেতো গল্প উপন্যাসের জগত থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন, তায় গল্প বলার কোন অভ্যেসই আমার নেই। কিন্তু খোকা নাছোড়বান্দা। ওর জোরাজুরিতে গল্প বলতে শুরু করলাম এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলাম আমার ছেলেবেলায় পড়া অনেক গল্প এখনও দিব্যি মনে আছে। 

ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে, তার ওপর এই জায়গাটা জলের আবার জলের ধারে। ফলে একটানা অনেকক্ষণ বসে থাকলে শরীরের অনাবৃত অংশগুলি ঠাণ্ডা হয়ে আসে। বুরুন আমার কাছে বসেছিলো। আমি ওকে রাজকাহিনী থেকে গায়েব গায়েবীর কথা, বাপ্পাদিত্যের গল্প বলছিলাম, বুরুন হাঁ করে করে শুনছিলো, তারপর আমার বুকের কাছটায় এসে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। আমি ওর কাঁধের ওপর হাতটা দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বসলাম। দেখলাম ওর গাল আর কানদুটো অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমি আলতো ভাবে ওর গাল আর কানদুটো ঘষে দিতে লাগলাম। ও চুপটি করে ওর মাথাটা আমার বুকের কাছে রেখে বসে রইলো। আমি আমার ছেলেটাকে বহুদিন ছুঁয়ে দেখিনি, তার শৈশবের ছবি আমার মনে এখন অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, অনেকটা পুরনো সাদা কালো ছবির মতো। আজ এই সদ্য পরিচিত বালকটির স্পর্শ আমার মনে আমার সেই হারিয়ে যাওয়া প্রবাসী সন্তানের জন্য এক অদ্ভুত হাহাকার তুলল। আমি আমার ছেলেকে এখন হপ্তায় একবার দেখি তাও স্কাইপে, সেখানে মার্কিনী ইংরাজীতে ওর সঙ্গে কথা বলে আমার সুখ হয় না, মনে হয় ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করি, কিন্তু জীবনে কিছু জিনিস একবার নিজের ভুলে হারালে আর ফেরত পাওয়া যায় না, তাই ওইটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। 

আমি একজন উচ্চাকাঙ্খী যুবক ছিলাম, যৌবনের দর্পে, তীব্র উচ্চাশায় সব সম্পর্কগুইলোকে দুমড়ে মুচড়ে, মাড়িয়ে, গুঁড়ো করে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখানে আমার চারপাশে এক নিঃসীম শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই। একদিন আমার রূপ ছিলো, যৌবন ছিলো , তীব্র প্রাণশক্তি ছিলো, তখন আমার কাছে অর্জন করার জিনিস শুধু বিত্ত, ভোগ করার জিনিস শুধু নারীদেহ, সুরা আর ভোগের হরেক রকম সামগ্রী যা এই পণ্যমনস্ক সভ্যতা আমাদের চারদিকে ছড়িয়ে রেখেছে। তার তাড়নায় উদভ্রান্তের মতো ছুটেছি, আজ এই উত্তর চল্লিশে যখন স্থিতু হয়ে বসলাম তখন জমা খরচের হিসেব করতে গিয়ে দেখি খরচের ঘরেই অংক বেশী।

যে সময় সাম্য আমার জীবনে এসেছিলো, তখন আমার আর শ্রীতমার মধ্যে তীব্র অশান্তি শুরু হয়েছে, একটা সময় সাম্যের পিতৃত্ব নিয়েও আমার মনের মধ্যে সংশয় ছিলো, ফলে ওর শৈশবটা আমি কিছুই উপভোগ করতে পারিনি। আর যখন প্রথম ওর অভাব বোধ অনুভব করতে শুরু করলাম, তখন ও আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। আমার শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত এই শহরে এই অপরিচিত বালকের হাত ধরে আমার অতৃপ্ত শুষ্ক পিতৃহৃদয়ে যেন একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো।

তারপর তিনটে দিন আমি যেন নতুন করে বাঁচলাম। আগে প্রতিটা দিন ক্লান্ত হয়ে নিজের শরীরটাকে ঘষটাতে ঘষটাতে ঘরে ঢুকেই মদের গ্লাস নিয়ে বসে পড়তাম। ততক্ষণ মদ খেয়ে যেতাম যতক্ষণ পর্যন্ত না চোখদুটো ঘুমে ঢুলে আসছে। বিগত এতগুলো বছরে আমি টিভি দেখিনি, কোন বই পড়িনি, যেকোন সামাজিকতা থেকে নিজেকে ছোঁয়াচে রুগীর মতো দূরে সরিয়ে রেখেছি । অথচ বিগত কটাদিন আমি একদম মদ ছুঁইনি, গোগ্রাসে গিলেছি সদ্য কলেজ স্ট্রিট থেকে কিনে আনা সত্যজিৎ, সমরেশ, সুনীল শীর্ষেন্দুর ছোটদের গল্পগুলো। আমার মনে পড়ে গেছে উত্তর কলকাতার সেই বাড়ি, তার শ্যাওলা ধরা উঠোন, সেই কলতলা, সেই শ্রীহীন ঘরগুলো, যেখানে আমার সমগ্র শৈশব কেটেছে, আমার মনে পড়ে গেছে ঠাকুমার আচারের বয়াম, কয়েতবেল মাখা, নীলষষ্ঠীর সাবু নারকেল, অরন্ধনের গোটা সব্জী সিদ্ধ। আমার মনে পড়ে গেছে বিজয়া দশমীর কুচো নিমকি, জিবেগজা আর লুচি আলুর দম, লক্ষ্মী পুজোর তিলের নাড়ু, নারকেল ছাপা, আর নারকেল কোরা দিয়ে বানানো পাঁচমিশেলি ডালের খিচুড়ি ভোগ আর নারকেলের ফোঁপড়া, আমার মনে পড়ে গেছে তালনবমীর তালের বড়া, ইশকুলের বাইরে মন্টুদাদার হাতের ঘুগনী আর আলুকাবলি, আমড়া আর কুলের আচার। সবচেয়ে বেশী মনে পড়ছে সেই নিস্তব্ধ দুপুরগুলো, যখন ছাতে কয়েকটা পায়রা ছাড়া আর কেউ নেই --- তখন চিলেকোঠার ঘরে একটা তক্তপোশে আধশোওয়া হয়ে বসে আমি এক অন্য জগতে চলে গিয়েছি, সেখানে সবাই একটা ছেলেকে অঙ্কে তেরো পাওয়ার জন্য দুয়ো দেয়, সেখানে দারোগারা বেজায় ভীতু, আর চোরেরা ভীষণ চালাক, সেখানে একটা খোঁড়া লোক ইয়েতির সন্ধানে হিমালয়ে ওঠে, আবার হায়ারোগ্লিফিক্স পড়তে মিশরে ছুটে যায়, আবার কোন এক গোয়েন্দা আমারই মতো কিশোর বয়সী এক সহকারীকে নিয়ে সমাধান করে চলে আশ্চর্য সব অপরাধ। এক কথায় এই কদিনে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলাকে নতুন করে পাচ্ছিলাম। 

আর বুরুন বোধহয় জীবনে প্রথমার এমন একজন মনোযোগী শ্রোতা ওর এই অতিক্ষুদ্র জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার আমার কাছে উপুড় করে দিলো। তার বাবার সাথে খুনসুটি, মায়ের কাছে বকুনি খাওয়ার প্রতিদিনের জীবন যাপনের অজস্র খুঁটিনাটির বর্ণনা আমি হাঁ করে শুনতাম। একটা ছোট পরিবার, বাবা মা আর শিশু কি আশ্চর্য স্বর্গীয় শান্তির নীড় রচনা করেছে। আজ এই বালকের মুখ থেকে অতি পরিচিত সংসার যাত্রার এই কাহিনী গুলি শুনে আমি অনুভব করলাম আমার জীবনটা রিক্ত দিগন্ত বিস্তৃত, ঊষর মরুপ্রান্তরের মতো রিক্ত। রিক্ত এবং অসম্পূর্ণ। বাৎসল্য কি এতবছরে কোনদিন উপলব্ধি করিনি, আজ জীবনে প্রথমবার বাৎসল্যের স্বাদ পেয়ে আমার মনে হলো জীবনে এমন অনুভূতিও আছে যা এমন নাড়ি ধরে টান দেয়।

আজ আমার ফিরে যাওয়ার দিন। গতকালও আমার চলে যাওয়ার কথাটা বুরুনকে বলার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। বুরুন মহা উৎসাহে গল্প করছিলো যে গতকাল তার বাবা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে তার মাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে রান্না করতে গিয়েছিলো। আনাড়ি হাতের পরীক্ষা নিরীক্ষা বেশীদূর সফলতা পায়নি, উলটে সারা রান্নাঘরটা যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নেয় ও শেষ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় যে মাছ, মাংস, সব্জী সবকিছু পুড়ে গিয়ে ঝামা হয়ে গিয়েছে। তারপর বাবার কপালে যা জুটেছে তা বলতে গিয়ে খোকা হেসেই কুটোপাটি। শেষ পর্যন্ত হোটেলের খাবার খেয়া ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়েছে। খোকাকে এতটাই তৃপ্ত, আর এতটাই খুশি মনে হচ্ছিল যে ওর মনটা খারাপ করে দিতে ইচ্ছা করলো না। ভাবলাম কাল অফিসফেরত ওদের বাড়ি গিয়ে ওকে কিছু দিয়ে আসবো, আর এই সুযোগে ওর বাবা মার সাথে আলাপও হয়ে যাবে। 

পরের দিন যখন দক্ষিণায়ন হাউসিং কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাট নম্বর থ্রি সির বেল বাজালাম তখন ঘড়িতে সাতটা দশ। বুরুনের কাছ থেকে শুনেছি যে তার বাবা মা মোটামুটি এই সময়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। আমার বেল বাজানোর পর দরজাটা যিনি খুললেন তিনি একজন মধ্যবয়সী মহিলা। কালো, মোটা, চোখে চশমা, এঁকে মাঠে দেখেছি ইনিই বুরুনের বাসন্তী পিসি।

আমি বললাম “আপনি আমায় দেখে থাকবেন। মাঠে। তবে আমাদের আলাপ হয়নি। ইয়ে একটু বুরুনের সাথে কথা বলা যাবে।” 

ভদ্রমহিলা আমাকে আপাদমস্তক জরিপ করলেন, তারপর বললেন “কিছু যদি মনে না করেন আগে আপনার সঙ্গে একটু আলাদা ভাবে আগে কথা বলতে চাই। কথা দিচ্ছি বেশী সময় নেবো না।”

“বেশ তো’, আমি ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলাম, ভদ্রমহিলা আমায় বাধা দিয়ে বললেন “ এখানে না, অন্য কোথাও নীচের পার্কে বসার ব্যবস্থা আছে সেখানে চলুন।”

আমি অবাক হলাম। এ আবার কী উদ্ভট প্রস্তাব! তবে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এই নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। আবার কৌতুহলও বাড়ছিলো। 

দুজনে পার্কে একটা বেঞ্চিতে বসলাম। 

“আপনি বুরুন সম্বন্ধে কতটুকু জানেন?” প্রশ্ন করলেন বুরুনের বাসন্তী পিসী। 

আমি ভিতরে ভিতরে কিছুটা বিরক্তও হচ্ছিলাম। তবুও বিরিক্তি চেপে রেখে ওর পরিবার সম্বন্ধে যা শুনেছিলাম সংক্ষেপে বললাম। 

“হুম এরকমই একটা কিছু আশা করেছিলাম।” চশমাটা খুলে ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকালেন। 

“আপনি রোহিনী চৌধুরীর নাম শুনেছেন? অভিনেত্রী রোহিনী চৌধুরী।”

আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম। রোহিনী চৌধু্রী বাংলা সিনেমার বেশ নামকরা নায়িকা ছিলেন। ন্যাশানাল এওয়ার্ডও পেয়েছেন, এখন ছবি না করলেও সিরিয়ালে কাজ করেন। 

“রোহিনী চৌধুরীই বুরুনের মা। বুরুনের বাবা অভ্রজ্যোতি দত্তরায়ের সঙ্গে বুরুনের মার বুরুনের জন্মের মাস তিনেক আগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বুরুন ওর মায়ের কাছেই থাকে। অবশ্য থাকা ব্যাপারটা আলঙ্কারিক , কারণ রোহিনী এখন হিন্দি সিরিয়ালের জন্য মাসের বেশীর ভাগ সময়টাই মুম্বইতে থাকে। বুরুন এখানে ওর দিদিমা আর আমার কাছেই থাকে।”

“তাহলে ও যেসব কথা বলেছিলো”

“ওগুলো বানানো কথা। ফিগমেন্ট অফ হিজ ইমাজিনেশন।” আমার কথা কেড়ে নিয়ে বললেন ভদ্রমহিলা।“ও ওর কল্পনায় একটা জগত তৈরি করে নিয়েছে, যেখানে ওর বাবা মা খুব কেয়ারিং, ওকে প্রচুর সময় দেন, এই জগতটাতে বাস করতেই ও কমফর্টেবল ফিল করে। এটা নিয়ে কেউ ওকে চ্যালেঞ্জ করলে বা রিডিকিউল করলে ও ভায়োলেন্ট হয়ে যায়। ইনফ্যাক্ট মাসখানেক আগে ও একবার এই কারণে ভায়োলেন্ট হয়ে ওর স্কুলের একটা বাচ্ছাকে সাংঘাতিক ভাবে হার্ট করে। চোখে পেনসিল ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। অল্পের জন্য বাচ্ছাটা বেঁচে গেছে। কিন্তু ওকে স্কুল খেকে এক্সপেল করে দিয়েছে। অ্যান্ড হিজ মাদার হ্যাজ টু পে অ্যান অ্যাস্ট্রনমিকাল সাম টূ কভার ইট আপ।”

বুরুনের নিজের ইশকুলের গল্প না করার কারণটা পরিষ্কার হলো আমার কাছে। 

আমি বললাম “কিন্তু এটাতো একটা মানসিক রোগ, এর…” 

“চিকিৎসা! চলছেতো, হি ইজ আন্ডার সাইকিয়াট্রিক সুপারভিশন। বাই দি ওয়ে আমি কিন্তু একজন ট্রেইনড নার্স, আমার স্পেসালাইজেশন আছে এই ব্যাপারে।” 

পুরো ব্যাপারটা এতোটাই অবিশ্বাস্য যে আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না। 

“এই অবস্থায় ওর সঙ্গে আপনার দেখা করাটা সমীচীন হবে না মিঃ সরকার। মনে মনে ও আপনাকে একটা ফাদার ফিগার হিসেবে কল্পনা করে নিয়েছে, এখন আপনার কাছে মিথ্যেবাদী হিসেবে ধরা পড়লে ওর মনের ভেতর একটা অ্যডভার্স এফেক্ট পড়বে। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড।” 

আমি বুঝলাম। এমনিতেও ওর তৈরি করা স্বপ্নের পৃথিবীটা ভেঙ্গে দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার ছিলো না। আমি চুপচাপ ভদ্রমহিলাকে নমষ্কার করে বেরিয়ে এলাম। বাইরে বেরিয়ে এসে প্রথমেই ওর জন্য কেনা উপহারটা একটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। বুরুন তার বাস্তব জগত থেকে বাঁচতে একটা কল্পনার জগত তৈরি করে নিয়েছে, সেখানে ও পাকাপাকি থেকে যাবে না সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে আমি জানি না, কিন্তু আমারতো সেটুকু অবলম্বনও নেই। আমাকেতো এই দুর্বহ বোঝা নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে ---- সহসা আমার ভীষণ শীত করতে লাগলো,মনে হলো আমার একটু উষ্ণতার বড়ো দরকার। 

1 comment:

  1. চমৎকার গল্প। বাস্তবের বড় কাছাকাছি, মন খারাপ করে দেওয়া। লেখকের কাছ থেকে এরকমই উচ্চমানের আরো গল্পের প্রত্যাশা করি।

    ReplyDelete