0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক 


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত

॥১৮॥


কাউকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়/বাধা দেয় বিগত জনম 


জেরেকা

বহুদিন দুর্গম জঙ্গল পাহাড় জনবসতিহীন নির্জনে ত্রস্ত শিকার হরিণীর মতো জেরেকা পালিয়ে বেড়িয়েছে। এই পাহাড়ি উপত্যকার প্রতিটি বস্তিতে থেকেছে কিন্তু কোথাও দশদিনেরও বেশি বাস হয়নি। এই অহল্যা ভূমিতে প্রকৃতিই যেন তার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। কোনও নিশুতিরাতে চুপিচুপি অরণ্যঘেরা বস্তিতে কোনও জনজাতি ভাইয়ে ঝোপড়িতে ঢুকতো। কোনও একরাতের আঁধারে তাদের জমায়েত করে আত্মজ্ঞান করাতো। কখনো এমন সময় আসতো,মাঝরাতে খবরি ভাই খবর দিত সিপাহী জওয়ান কিংবা মিলিটারি রেড করতে আসছে। যারা আসতো তারা এতো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসতো যেন একটা দেশ জয় করতে হবে। তারাও হয়তো জানত না যে একটা নিরস্ত্র মধ্যবয়েসী মহিলাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। জেরেকা খবর পেয়ে খালি পায়ে একবস্ত্রে আবার ছুটতো গভীরতম অরণ্যে।

এখানের সমস্ত অরণ্যবস্তি তার আপন। সমস্ত গাছ পথ ঘাটিপথ পাথর তার চেনা। কিন্তু ধামসার বোল যে ঠিকানার কথা বলেছে সেটা তার জানা ছিল না। গতরাতে চারজন রাশিয়ান সৈনিক জেরেকার নির্দেশমতো দুধঝর্ণার কাছাকাছি একটা শবর বস্তিতে তাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে। সকালবেলায় যখন সূর্যের লাল রঙ ফিকে হতে শুরু করেছে তখন ধামসায় প্রথম জেরেকার কাঠি পড়েছিল। সেটা ছিল মৃদু। তারপর তার শবর ভাইয়েরা মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে ম্যাসেজটা রিপিট করেছিল।জেরেকা যে সন্দেশ ছড়িয়ে দিয়েছিল তা হলো এই, ‘আমার খেড়িয়া শবর গোলগো ভুনিয়া সান্ডি গিদি নাগো ঢেলকি ভাইয়েরা, তোমাদের সমূহ বিপদ। তোমাদের বস্তি উচ্ছেদ করার জন্য আজ প্রচুর কামানের গোলা বর্ষণ হবে। তোমরা যদি প্রাণে বাঁচতে চাও তো বিশ্রামবেলার (দুপুর) আগেই দুধ ঝর্ণার পাশে বড় ময়দানে তোমাদের ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে জমায়েত হও। বিদেশী দিকুরা তোমাদের সহায়’।এই অব্দি ঠিক ছিল। হঠাত্‍ কোথা থেকে ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট থেমে থেমে এক ধামসার সংবাদ প্রবাহ ভেসে এল। সেটাতে বলা হয়েছিল, জঙ্গলের সমস্ত জনজাতি ভাইদের বলা হচ্ছে যে সংবাদ এখন দেওয়া হচ্ছে তারা যেন ধামসা বাজিয়ে রিপিট করে। এটা আমাদের দলনেতার আদেশ। আর একটু পরেই সেই সংবাদ অরণ্যের সর্বত্র পুনরাবৃতি হতে লাগলো। জেরেকা হতবাক। বিভ্রান্ত। এটা কার কাজ? শত্রু না মিত্র? নাকি একান্তই নিজের জন?

ম্যাসেজে ছিল সকলকে একটি বিশেষ জায়গায় একত্রিত হতে। জেরেকার নির্দেশিত দুধ ঝর্ণার পাশের মাঠে নয়, একটা খাড়া উঁচু স্লেটের মতো মসৃণ চ্যাটালো পাথরপাহাড়ের উল্টো দিকে একটি গুহামুখের কাছে। এই জায়গাটি দুর্গম ও জেরেকার সম্পুর্ণ অপরিচিত। এমনতো নয় সৌমেনের কোনও শিক্ষিত সৈনিকের? না না তার কোনও উপায় নেই। কেননা ধামসার বোল একটু বিশেষ ধরনের। একেবারে নিজস্ব বলা যেতে পারে। এবং এই ম্যাসেজের শেষে একটি শাব্দিক সিগনেচার আছে যা পেরো এবং গোরাচাঁদের কাছেই সীমাবদ্ধ। জেরেকাকে অনেকবার অনেক তথ্য, বিপদের সংকেত এবং বন্দী হওয়া থেকে সতর্ক করে দিয়েছে এই ধামসার বোল।তবেতো নিশ্চয়ই পেরোর কাজ। তবু খুঁতখুঁত করে জেরেকার মন। আহ! যদি গোরাচাঁদ এইসময় পাশে থাকতেন! কিন্তু একটা কথা মনে হতে জেরেকার মন শান্ত হয়। এই নির্দেশ যেই দিয়ে থাকুক সেটা ভালোই করেছে। এলাকার অরণ্যবাসী জনতার সঙ্গে রাশিয়ান সৈন্য ওই ময়দানে থাকলে বিপদ তো থাকবেই, ওই লোকেশনটির খবর মিলিটারীর কাছে যেতেই পারে। সম্ভাব্য ভারী বোমবাজি না হলেও সমস্ত আদিবাসীরা একসাথে সরকারের ভুল নীতির খপ্পরে পড়ে যাবে। তাছাড়া রাশিয়ান সেনারা তো আমার দেওয়া ড্রাম ম্যাসেজের কথা জানেই। কোথায় জমায়েত হবার আছে সেটা ওরা যখন জেনেই ফেলেছে তখন গোপন সংকেতের কোনও মনে হয়না। এই বরং ভালো। এখানের অধিবাসী সবাই একসাথে কোথায় আশ্রয় নিয়েছে কেউ জানতে পরবেনা। জনজাতি ভাইদের উপর স্থির বিশ্বাস এই গোপন খবরটি কোনভাবেই দিকুদের কাছে প্রকাশ করবেনা। আর করবেই কখন? এখনই সেখানে যাবার জন্যে পা বাড়ানো ছাড়া কোনও গতি নেই। এই ভালো হলো। বরং ওই গোপন আশ্রয়ে থাকার দুদিন পর কিছু পাকা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। খাদ্য আহরণ প্রকৃতিগত দুর্গমতা ও বন্যপ্রাণী অরণ্যবাসীদের কাছে কোনও বিপদই নয়। বিপদ হলো সভ্য সমাজের অসভ্য মানসিকতা। ওদের আছে প্রাণী বশকরে শৃঙ্খলিত করে পোষার প্রবণতা। এটাকেই ওরা সামাজিকতা ভেবে অরণ্যবাসীদের ক্রীতদাস বা চাকর করার প্রথা করে নিয়েছে। এটা করতে নানা উপায় ধরে নিয়েছে। নানাভাবে ধর্মান্তরিত করা সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থা নিয়ম তৈরি করা শ্রেণী বিন্যাস বর্গাদার সিষ্টেম বন্ধুয়া মজদুর ইত্যাদি অনেক ধরনের শ্রেণীবৈষম্যও ক্রীতদাস করার শিকার ব্যবস্থা। 

জেরেকা এখন নিজে থেকে চলাফেরা করতে পারছেনা। শরীরে অনেক কাটাছেঁড়া ঘা। সবগুলো ভালকরে শুকোয়নি। যার ঘরে এসেছে সে তার বউ বাচ্চা নিয়ে অন্য একজনের ঘরে শুতে গেছিল। কিছুক্ষণ আগে ওদের গোবর নিকনো আঙ্গনে কাঠের উনুনে একধরনের মিষ্টি বুনো কন্দ সিদ্ধ হতে দিয়েছে। আরএকটা উনুনে একধরনের জংলী চাপাতা জলে ফুটছে। জেরেকাকে দিয়েছে খেজুরগাছ থেকে ভোরে নামানো একভাঁড় খেজুর রস। গত তিনদিন ধরে মাটির গর্তে থাকা এক হাঁড়ি মহুল পচানো হয়েছে। সেটা এখন তুলে বাখরা মিশিয়ে উত্তেজক মদ তৈরি হচ্ছে। এইসব খাবার খুবই শক্তিবর্ধক জেরেকা জানে।কিন্তু জেরেকা আশ্চর্য হয়েযাচ্ছে ওদের আচরণ দেখে।ঢাক ও ধামসার সংকেত প্রত্যেকে জেনে গেছে। চরম বিপদ আসন্ন। দুপুরের আগেই প্রায় পাঁচমাইল দূরে গন্তব্যে পৌছাতে হবে। তার আগেই কামানের গোলার আঘাতে মৃত্যু প্রিয়জনকে ছিনিয়ে নিতে পারে। হয়তো নিজেই মরে গেল বা চরম আহত হয়ে পড়ে রইতে পারে শেয়াল শকুনির খাদ্য হয়ে। তাছাড়া এতদিনের আদি বাসস্থান কেউ ছিনিয়ে নিতে চাইছে এবং নতুন কোন যায়গায় কেমন করে নতুন বসবাস বা খাদ্য হবে। এইসব ভাবনা ওদের মুখ দেখে চলাফেরা দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। ওরা আশ্চর্য রকমের শান্ত। এই শান্ত সৌম্য ভাব দেখে শোষকশ্রেণী নিজের নিজের দলে টানতে নানাধর্মের বোঝা ওদের মাথায় চাপিয়ে দিচ্ছে এখনও। অথচ আদিবাসী কোনও ধর্মী নয়। ওরা ধর্মপূর্বী। ওরা ইতরধর্মী। ওরা প্রকৃতি ধর্ম মানে আর প্রকৃতি পূজা করে। ওদের দ্রোহ পতাকাতে সূর্য চাঁদ তারা এইসব প্রতীক। শুধু এইদেশে নয় পৃথিবীর সব আদিবাসীরই পতাকা চিহ্ন এক। ওদের শান্ত থাকার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক করে তোলা হয়েছে।আসলে যারা আদিবাসী নয় তারা আদিবাসীদের চাকর শ্রেণীতেই অন্তর্ভূক্ত করে। 

কুটিরের সামনে আঙ্গনে বসে বসে জেরেকা এইসব ভাবছিল। সে নিজেই তো আদিবাসীদের একজন। তাই জানে। পিছনের কথা কেমন করে বিলকুল ভুলে গিয়ে বর্তমানের কথা ভাবতে হয়। এই ধামসার সংকেত তাকে রাশিয়ানদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার রাস্তা বাতলে দিয়েছে। তাকেও এদের সাথে পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু গোরাচাঁদকে না বলে উধাও হয়ে যাওয়া কী ঠিক হবে? বাঁচার লড়াইয়ে এক মানসিকতা নিয়েই চলা উচিত। এই শিক্ষা তিনিই দিয়েছেন। 

জেরেকা মুখ নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো। একবার ফাঁকা দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকালো। সামনে একটা ছোট টিলার মতো বাদামী পাহাড়। তার নিচে অজস্র ঝোপঝাড় আর খেজুর গাছের জঙ্গল। মাটিতে পড়ে আছে অসংখ্য মরা শুকনো পাতা। হওয়ায় উড়ে উড়ে এদিকেই আসতে চাইছে কিন্তু থেমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে হারানোর বিষন্নতা। হঠাত্‍ ডানপাশের ঝোপে ঢাকা পথে পাতা মাড়িয়ে চলার আওয়াজে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে গোরাচাঁদ এবং দুজন শবর আসছে। জেরেকার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উত্সাহে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে যেতে গোরাচাঁদ এগিয়ে এসে ধরে ফেললেন। 

-আমি ড্রাম ম্যাসেজ বুঝে নিয়েছি জেরেকা। আমার সাথে দুজন রাশিয়ান সৈনিক রয়েছে। ওরা ওই দূরে গাছের নিচে অপেক্ষা করছে। আমাকে ওরা নিয়ে যাবে। একটা সুখবর। রাশিয়ান সেনারা এমব্যাসী ও সরকারের সামরিক দপ্তর থেকে স্টে অর্ডার আনিয়ে নিয়েছে। আগামী আদেশ পর্যন্ত কোনোরকম গোলাগুলি চলবেনা। হয়তো দু চার দিন অব্দি। এই স্থগিতাদেশটি নিশ্চয়ই সৌমজিতের কাছে পৌছে গেছে। এটাতো তার অমান্য করার নয়। নাহলে কোর্ট মার্শাল হয়ে যাবে। 

-কিন্তু ম্যাসেজ তো সবার কাছে চলে গেছে। অনেকে বস্তি ছেড়ে চলতেও শুরু করে দিয়েছে। ওদের তো ফেরানো যাবেনা?

-না না। ফেরানো উচিতও নয়। এই সংকেতটি পেরো করেছে। সংকেতের ধরণ পেরোরই। আমি নিশ্চিত। ওর নিশ্চই কোনও প্ল্যান আছে। তাছাড়া ওকে ফেরানো দরকার। আমাদের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রতিটি আদিবাসী ভাই ওকে মনে প্রাণে লিডার রূপে কামনা করে। আমরাও তাই চাই। জেরেকা আমি চাই তুমি ওই লোকেশনে যাও। ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।

-আর আপনি?

-রাশিয়ান মেজর আমাকে এখানে এক শর্তে আসতে অনুমতি দিয়েছে। বলতে পারো এখানে আসতে বাধ্য করিয়েছে। আমি তোমার সাথে দেখা করে ফিরে গিয়ে মেজর জেনারেল সৌম্যজিতের কাছে একটা উপস্থাপনা নিয়ে যাই। যতদিন না এই এলাকার জন্য ভারত সরকারের সাথে ভেষজ ঔষধি সংরক্ষণ চুক্তি না হচ্ছে ততদিন মাইন্স ওনারদের ঠেকিয়ে রাখতে আর অহেতুক গোলাবর্ষণ না করতে। তাহলে ওরা আদিবাসীদের সংরক্ষনের ব্যবস্থাও সরকারের অনুমোদন নিয়ে করতে পারে।

-একবার ইংরেজ আর এবার আবার বিদেশী?

-ভেবে দেখ জেরেকা। ওরা কিন্তু এখানের ভেষজসংগ্রহ করতে চায়। আর কোনও ইনটেনশন নেই। তার বিনিময়ে ওই রাক্ষসটাকে যদি পথে আনতে পারি। একটা শেষ সুযোগ দাও জেরেকা। তুমি যাও। তোমাকে বয়ে নিয়ে যেতে এই ডুলি আর দুজন বাহক সঙ্গে নিয়ে এসেছি। 



0 comments: