0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী 



কথামালা
বিপুল দাস



আমার জন্ম শিলিগুড়ি হাসপাতালে। আমার ১২/১৩ বছর বয়স পর্যন্ত সেই হাসপাতালটা ছোটোই ছিল। তখন কখনও সেটার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় খুব আপন মনে হতো ঘরগুলো। তারপর কবে সেই একতলা ছোট্ট বাড়িটা ভেঙে দোতলা হ’ল, ক্রমে তিনতলা, চারতলা, বড়ো বড়ো বিল্ডিং, আলাদা আলাদা বিভাগ। এখন কতবার সেই হাসপাতালের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করি। এখন আর সেই অনুভূতি হয় না। একবারও মনে পড়ে না এখানেই কোনও এক এগারই শ্রাবণ, বুধবার অঝোর ধারায় ভুবনজোড়া কান্নার মাঝে আমার প্রথম কান্না মিশে গিয়েছিল। সেই যে আমার হৃদয়জুড়ে বিষাদের মেঘ চিরকালের আসন পেতে বসেছে – তারপর যত দিন যায়, মেঘ ঘনতর হয়ে ওঠে। জলভার দুঃসহ হয়ে উঠলে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে ‘আয় বৃষ্টি’ বলে ডাক দিই।

বাবা মায়ের ছোটো ছেলে আমি। দাদা আমার চেয়ে বারো বছরের বড়ো, দিদি আট বছরের। ভাইবোনের সঙ্গে যে বন্ধুর মতো মেলামেশা, সেটা কেমন, আমার জানা নেই। শুধু শাসন ছিল। দাদার, দিদির, বাবার, মায়ের। তিন সন্তানকে মানুষ করার সংগ্রামে আমার ভিটেমাটি-ছেড়ে-আসা-বাবা আমাদের খোঁজ নেবার সময় পাননি। মা নির্ভেজাল সাদাসিধে গ্রাম্য মহিলা। অসুখবিসুখ হ’লে খোঁজ নেওয়া আর দু’বেলা খেতে দেওয়া ছাড়া সন্তান মানুষ করার অন্যান্য বিষয়ে আশ্চর্য রকম উদাসীনতা ছিল তার। বাবা সে তুলনায় আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। কিন্তু বাবামায়ের সঙ্গে, দাদাদিদির সঙ্গে কোনও দিনই আমার হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ভীষণ বদরাগি ছিল আমার দাদা। একবার সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় আমার পিঠে কাবলি জুতোর প্রচন্ড প্রহার পড়েছিল। সে জুতোর নীচে আবার একটা পেরেকের মাথা বেরিয়ে ছিল।

আমার সেই দাদা (বড়দা ডাকতাম। আমার কাকা এবং জ্যাঠা, যাঁরা ‘দালানকোঠা, নাইরহলের বাগান, পুষ্কর্ণি, আমবাগান, ধানি জমি ইত্যাদি কে রক্ষা করিবে, নচেৎ শ্যাখেরা ভোগ করিবে’এই বাহানায় ওদেশে থেকে গিয়েছিলেন, তাঁরা একটি করে লায়েক ছেলেকে এপারে আমাদের এখানে পাঠিয়ে দিতেন, তারা আমাদের সঙ্গেই সকালে ফ্যানাভাত, দুপুরে ডালভাত ও রাতে রুটিসব্জি খেত। পরবর্তীকালে ঘাঁড়ে রোঁয়া গজালে অন্যত্র উড়ে যেত। এদেরই আমি মেজদা, সেজদা ডাকতাম।) ছিল পড়াশোনায় অসম্ভব মেধাবী। এখনও তার পুরনো বন্ধুরা অঙ্কে বড়দার অসাধারণ মেধার কথা বলে। কিন্তু নিজের পড়াশোনার ক্ষতি করে আমার জন্য সময় ব্যয় করতে রাজি ছিল না।

খুব, ভীষণ, টানাটানির ভেতর দিয়ে আমাদের সংসার চলত তখন। ডিম, দুধ, মাংস দূরের কথা, সপ্তাহে হয়তো এক আধদিন মাছের টুকরো পাতে পড়ত। ওপার থেকে আবার একজন দাদা এলে বাবা আরও দু’টো টুইশান নিত। দাদার ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। কিন্তু আই এস সি পাশ করার পর বাবা সারেন্ডার করলেন। তিনি আর একা সংসার টানতে পারছেন না। দাদা অনেক কান্নাকাটি করলেও চাকরি নিতে হয়েছিল। এই দাদাকে পরবর্তী কালে দেখেছি রাক্ষসের মতো মাছ-মাংস-মিষ্টি খেতে। বাটিতে মাংস কম হলে বা মাছের পিস ছোটো হলে সব ছুঁড়ে ফেলত বউদির মুখের ওপর। স্মরণ থাকে যে, ব্লাড-সুগার বিপজ্জনক সীমা পার হলেও দাদা বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে প্রাণভরে খেয়ে গেছে এবং অকালেই সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করেছে। এই সাইকোলজি নিয়ে পরে ‘খাদক’ নামে একটা গল্প লিখেছিলাম।

আমার দিদি প্রতিবন্ধী। তখন পোলিও নির্মূল কর্মসূচিতে অমিতাভ বা শাহ্‌রুখ ছিল না। ফরিদপুর জেলার অন্তঃপাতী রাখালতলি গ্রামে পালস্‌ পোলিও অভিযান ছিল না। ফলে পোলিওমাইলাইটিসের ভাইরাস দিদিকে পেড়ে ফ্যালে। স্থানীয় ওঝার কেরামতিতে খুব তাড়াতাড়ি তার ডান পা সরু পাটকাঠির মতো হয়। মাকে রান্নাঘরে সাহায্য করা এবং নিজের পড়াশনা ছাড়া তার কোনও অস্তিত্ব বোঝা যেত না। নিজেকে একেবারে নিজের ভেতরেই গুটিয়ে রাখত দিদি। এ ভাবেই দিদি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে(এদেশে এসে)। একটা সরকারি চাকরিও জুটে যায়। অবসর নেবার কিছুদিন বাদে সে-ও রক্তের চিনির আধিক্য-হেতু চির-চিনির দেশে চলে যায়।

আমার পরিবার বিষয়ে সাতকাহন বলার উদ্দেশ্য আমার অবস্থান বুঝতে পাঠকের সুবিধা। আমি কেমন সঙ্গীহীন একা একা বেড়ে উঠেছি। সংসারে সব সময় কেমন ত্রস্ত থেকেছি। ক্রমে আমারও একটা একেবারে নিজস্ব পৃথিবী আমিই তৈরি করে নিয়েছিলাম। আমার গোপন ভুবন। সেখানে আমিই হেডস্যার, আমিই কানাই। গরমের ছুটির দুপুরে মহানন্দার বিস্তীর্ণ বালুচরে একা একা ঘুরে বেড়াতাম। ফাল্গুন-চৈত্র দুপুরের দিকে একটা বালুর ঝড় ওঠে। নাকেমুখে বালি ঢুকে পড়ে। দাঁত কিচকিচ করে। দূর থেকে দেখতাম শুকনো বালু, শুকনো পাতা, ছেঁড়া কাগজ নিয়ে একটা গরম বাতাসের স্রোত পাক খেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে করত ঘুর্ণির কেন্দ্রে গিয়ে দাঁড়াতে। দেখি না কী হয়। যথেচ্ছ বুনোকুল খেয়ে মহানন্দার টলটলে সবুজ জলে ঝাঁপ দিয়েছি। বাড়ি একদম পাশে এই নদী আমার বাল্য-সহচর। প্রাণভরে সাঁতার কেটেছি। সময়ের জ্ঞান থাকেনি। শেষে মা খুঁজতে এলে অন্য ঘাটে উঠে এক দৌড়। তখন আমার চোখ টকটকে লাল।

নদীর পারে শিমুলতলায় বসে একা একা কত সময় কেটেছে আমার। ওপারে পলাশবন। বসন্তে এপার থেকে দেখি ওপারে থোকা থোকা আগুন। একা একা সেই আগুন দেখি। অস্পষ্ট, কেমন একটা ছুঁই-ছুঁই-করেও ছুঁতে না পারার ইশারা আমার বুকের ভেতরে খেলা করে।ভরা বর্ষায় পাহাড় গড়িয়ে আসে গেরুয়া জলের স্রোত। পাহাড়ে ধস্‌ নামে। শেকড়সুদ্ধ চা-গাছ, শালগাছ, মরামানুষ ভেসে যায়। একবার উপুড় হয়ে ভেসে যাওয়া সাদা লাশ দেখেছিলাম। ছিপ দিয়ে চ্যালামাছ ধরছিলাম। উত্তরে উজান থেকে একজ লোক চিৎকার করে আমাকে কী যেন বলছিল। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। সে হাত ইশারা করে আমাকে পার থেকে দূরে সরে যেতে বলছিল। হঠাৎ নাকে বিকট একটা পচা গন্ধ এল। দেখলাম একটা মরামানুষ, ফুলে ঢোল, ভেসে যাচ্ছে। খুব ভয় পেয়েছিলাম। সেই গন্ধ এখনও মাঝে মাঝে নাকে আসে। অনেক দিন একা মাছ ধরতে যাইনি।

এখন আর সে নদী চিনতে পারি না। এখন নদীর পারে কখনও দাঁড়ালে বুঝি নদী আর আমার নেই। আমার সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। ওপারে সেই পলাশবন এখন বিশাল বসতি। এপারে নদীপার বলে কিছু নেই। নদী অনেক দূরে সরে গেছে। পাড়জুড়ে লোকালয়। দোতলা বাড়ি। সেখানে টিভি চলছে। যেখানে ছিল বালুচর, বুনোকুলের ঝোঁপ – সেখানে পাকা রাস্তা। নিউতরুণ বয়েজ ক্লাব। আর আমার সেই স্বচ্ছসবুজ জলের টলটলে নদী, স্পষ্ট নুড়ি দেখা যেত, সে নদী অতি শীর্ণ, দীর্ণ, সমস্ত শহরের আবিলতা নিয়ে বিষাদময় এক ভিখারিনির মতো বয়ে যায় দক্ষিণে। তার এই ক্লেশভার, এই অপমান দেখে আমার চোখে জল আসে। এই নদীতে একা এক দুপুরে মাছ ধরার সময় প্রথম সাদালাশ দেখেছিলাম। যুবতী নারীকে অসংবৃত স্নান দেখেছিলাম। প্রথম উন্মুক্ত নিটোল ধবল স্তনভার দেখেছিলা। বাড়ি ফিরে সেদিন আমার জ্বর এসেছিল। প্রাইমারি স্কুলের বেঞ্চে কে যেন ছুরি দিয়ে খারাপ কথা লিখে রেখেছিল। সেই প্রথম আমি ‘যোনি’ শব্দের চালু প্রতিশব্দটি শিখলাম। তখন ধানখেতের আলের ওপর দিয়ে স্কুলে যাই। বর্ষাকালে আল ডুবে থাকে। তখন ঘুরপথে পালবাড়ির পেছন দিয়ে যাওয়া হয়। যে রাতে খুব বৃষ্টি নামে, পরদিন সকালে সব জল-থৈথৈ। ধানখেতের সব জল যেখান দিয়ে সাদা ফেনা তুলে বড়ো মাঠে পড়ছে, সেখানে হাতজাল ধরে স্রোতের উল্টোমুখে দাঁড়িয়ে থাকে বদনড্রাইভার। চকচকে পুঁটিমাছের ঝাঁক লাফ দিয়ে দিয়ে জালে পড়ে। দেখতে থাকি। স্কুলের দেরি হয়ে যায়। শীতকালে পায়ের ওপর আমন ধানের শিষ লুটিয়ে পড়ে। ধানকাটা হয়ে গেলে স্কুলে যাওয়ার পথে খা খা মাঠের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরেও কেমন শূন্যতা এসে ভরে যায়। বেলা সাড়ে দশটার সময়ও মাঠের শিশির শুকোয় না। আকাশ মেঘলা, উত্তুরে হাওয়ায় ছেঁড়া সোয়েটারের ভেতরে আরও কুঁকড়েমুকড়ে যাই। ধানগাছের গোড়া থেকে ব্লেড দিয়ে নাড়া কেটে বাঁশি বানাই। খারাপ শব্দটা শেখার পর বাঁশি বাজাতে আর ভালো লাগে না।

(ক্রমশঃ)

0 comments: