1

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in
ধারাবাহিক


গার্ড (অনুবাদ গল্প) 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 



প্রতি রবিবার, রেলের গার্ড মিঃ ঠীল নিয়মমাফিক চার্চে যায়। নয়ে-সিটাও গ্রামের, হ্যাঁ, গ্রামই বটে, একটা রেললাইন থাকলে কি আর সেই জায়গাকে শহর বা গঞ্জ বলা যায়? হ্যাঁ, সেই নয়ে-সিটাও গ্রামের সবাই প্রতি রবিবার চার্চে মিঃ ঠীলকে দেখতে পেতো। কোনও রবিবার এই নিয়মের বিচ্যুতি ঘটেনা। হ্যাঁ, অবশ্য দূরে কোথাও বিশেষ ডিউটি পড়লে বা অসুস্থ হলে কি করা যাবে? যদিও গত দশ বছরে মিঃ ঠীল মোটে দু’বার অসুস্থ হয়েছিল। তবে সেটাও ঠিক শারীরিক অসুস্থতা নয়, অ্যাকসিডেন্ট। একবার কোনও একটা রেলের ইঞ্জিন থেকে একটা কয়লার টুকরো ছিটকে এসে লেগেছিল তার গায়ে। রেলওয়ে ট্র্যাকের মধ্যেই উল্টে পড়ে গিয়ে তার পা ভেঙে গিয়েছিল। আরেকবার দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যাওয়া একটা থ্রু ট্রেন থেকে একটা ওয়াইনের বোতল উড়ে এসে সোজা লেগেছিল তার বুকের মাঝখানে। এই দুটো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ছাড়া এবং ডিউটি না থাকলে, মিঃ ঠীলের প্রতি রবিবারে চার্চে যাওয়ার রুটিন কোনওভাবেই ভাঙ্গে না। 



প্রথম পাঁচ বছর মিঃ ঠীল শন-শর্নস্টাইন থেকে দুক্রোশ রাস্তা ঠেঙ্গিয়ে নয়ে- সিটাওতে একা একাই আসতো। একদিন তাকে খুব রোগা অথচ সুন্দরী এক মহিলার সাথে দেখা গেলো। যদিও লোকে বলে যে রোগা নয়, রুগ্ন। ওই মহিলার ক্ষীণ এবং রুগ্ন চেহারার পাশে মিঃ ঠীলের পাহাড়প্রমাণ পালোয়ানসদৃশ চেহারা যে ভীষণ বেমানান লাগত, এটাও লোকে বলে। আবার, এও দেখা গেলো যে এক সুন্দর রবিবার বিকেলে ওই চার্চের ঈশ্বরের বেদির সামনে মিঃ ঠীল ওই মহিলার সঙ্গে একসাথে জীবন কাটাবার শপথ নিলো। তার পরের দুবছর লাগাতার প্রতি রবিবার দুজনকে পাশাপাশি দেখা যেত চার্চে আসতে। মিঃ ঠীলের রোদ্দুরে তামাটে হয়ে যাওয়া ফোলা ফোলা গালের পাশে তার স্ত্রীর ফ্যাকাসে গর্তে ঢুকে যাওয়া গাল যতই বেমানান দেখাক না কেন, দুজনে একসাথে নিবিষ্টচিত্তে ধর্মগ্রন্থের অক্ষরগুলির দিকে চেয়ে থাকতো। কিন্তু এক রবিবারের সকালে দেখা গেলো যে চার্চে গার্ড ঠীল একা বসে আছে। আগের মতো একা। 



পরে জানা গেলো চার্চে সেদিন একা আসবার আসল কারণটা। চার-পাঁচদিন আগেই তার স্ত্রী মারা গিয়েছে। 

তবে স্ত্রীর মৃত্যুতে গার্ড ঠীল বিশেষ বিচলিত ছিল না, এটাও লোকে বলে। কারণ বাহ্যিকভাবে তার বিশেষ কোনও পরিবর্তন অন্তত লোকের চোখে ধরা পড়েনি। রবিবারে চার্চে আসবার সময় যে ইউনিফর্ম পরে সে আসতো সেটা বেশ আগের মতই কড়কড়ে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা, এমনকি তার বোতামগুলো পর্যন্ত আগের মতই পালিশ করা, চকচকে। তার লাল চুল সুন্দর করে তেল দিয়ে আঁচড়ে আগের মতই পরিপাটি সিঁথি করা। শুধু কোটের ওই পশুর লোমওয়ালা কলারটা আগের তুলনায় একটু নিচে নামানো থাকতো আর আগের থেকেও বেশি মনোযোগ দিয়ে সে চার্চে প্রার্থনাসঙ্গীত এবং পাদ্রিদের আধ্যাত্মিক উপদেশাবলী শুনতো। লোকে সবসময় বলতো যে স্ত্রীর মৃত্যুতে তার মনে বিশেষ কোনও রেখাপাত হয়নি এবং তাদের মতামত অভ্রান্ত প্রমাণিত হলো, কারণ ঠিক একবছরের মাথায় এক রবিবারে ঠীল দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে গেলো। এবার পাত্রী আল্টে-গ্রুন্ড গ্রামের এক স্থূলকায়া দশাসই চেহারার মেষপালিকা। 

চার্চের ধর্মযাজক স্বয়ং এই ঘটনায় কিছু উদ্বিগ্ন হলেন। যখন মিঃ ঠীল বরবেশে চার্চে বিয়ের আসরে প্রবেশ করলো, তখন যাজক প্রশ্ন করলেন, 

-‘বেশ, তাহলে তুমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চাও?’ 

-‘মৃত মানুষের সাথে তো আর ঘরসংসার করা সম্ভব নয়, যাজক মহাশয়!’ 

-‘বেশ, বেশ! না, মানে... আমি বলছিলাম যে, মানে, তুমি নিশ্চিত তো? তুমি একটু তাড়াহুড়ো করছ না কি?’

-‘হ্যাঁ, মানে তাড়াহুড়ো তো বটেই... তাড়াহুড়োই একটু। ওই ছেলেটার জন্যই সব।’ 

মিঃ ঠীলের প্রথমপক্ষের স্ত্রী পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিল। সেই ছেলের নাম রাখা হয়েছিল টোবিয়াস। 

‘ওহ হ্যাঁ, ছেলেটা!’ যেন হঠাৎ এইমাত্র তার ঠীলের পুত্রসন্তানের কথা মনে পড়ল, ধর্মযাজক মহাশয় এইভাবে চমকে উঠলেন... ‘কিন্তু সেটা তো আলাদা ব্যাপার! তুমি যখন ডিউটিতে যাও, তখন ছেলেকে কোথায় রেখে যাও?’

ঠীল চিন্তাক্লিষ্ট মুখে বলে যায় কীভাবে সে এক বুড়ির জিম্মায় টোবিয়াসকে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। একদিন সেই বুড়ি ছেলেকে গরমজল ঢেলে আরেকটু হলেই পুড়িয়ে দিচ্ছিল। আরেকদিন ছেলে কোল থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় ঠোক্কর খেয়ে আলু গজিয়ে গিয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে বড় কোনও বিপদ হয় নি এর মধ্যে। কিন্তু এভাবে তো আর দীর্ঘদিন চালানো সম্ভব নয়। তাছাড়া ছেলেটা দুর্বল, রুগ্ন। তার বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। যদিও ছেলেটির পরলোকগতা মায়ের আত্মা সদাসর্বদা ছেলেটিকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করে চলেছে, সেজন্য সে তার প্রথমা স্ত্রীর কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ; তবুও, সে একরকম বাধ্য হয়েই দ্বিতীয়বার বিবাহের পদক্ষেপ নিতে চলেছে। 

মোটামুটিভাবে গ্রামের লোকজন সবাই নবদম্পতিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। এরাও দুজনে প্রতি রবিবার চার্চে আসতো। দ্বিতীয় স্ত্রী উচ্চতায় ঠীলের প্রায় মাথায় মাথায়, কিন্তু প্রস্থে দেড়গুণ! চোখমুখের পেশির এক অদ্ভুত পুরুষালি কাঠিন্য প্রায় তার স্বামীরই মতন। কিন্তু অভিব্যক্তির নানা পরিবর্তন, যেটা ঠীলের মুখে সেভাবে লক্ষ্য করা যেতোনা, সেটা তার স্ত্রীর মুখে খুব ভালোভাবে বোঝা যেত।

এটা কেউ জানে না যে কিরকম বউ ঠীলের পছন্দ ছিল। তার মনে যদি এরকম কোনও ইচ্ছে থেকে থাকে যে তার স্ত্রী ঘর-গেরস্থালী সামলানোয় বিশেষ পারদর্শী হবে, অত্যন্ত পরিশ্রমী হবে, তাহলে দ্বিতীয় স্ত্রীর ক্ষেত্রে তার ইচ্ছে ভীষণভাবে পূর্ণ হয়েছিল। তবে নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও দ্বিতীয় স্ত্রীর যে তিনটি জিনিস সে মেনে নিয়েছিল তা হলো, সীমাহীন আধিপত্যমূলক মনোভাব, লোভ এবং ক্রোধ। দ্বিতীয় বিবাহের ছয়মাসের মধ্যেই পাড়া-প্রতিবেশী বুঝে গিয়েছিল যে গার্ডের ঘর-গেরস্থালি এবং বাড়ির আসল মালকিন তার স্ত্রী ছাড়া কেউ নয়। সকলেই তখন গার্ড ঠীলকে কিছুটা করুণার চোখে দেখতে লাগলো। 


(চলবে) 

[গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘বানভ্যার্টার ঠীল’ গল্প অবলম্বনে রচিত] 





1 comment:

  1. খুব ঝরঝরে অনুবাদ ! ভালো লাগছে পড়তে

    ReplyDelete