0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


রাজোচিত
অনিন্দিতা মণ্ডল


পর্ব ২

এখানে মধ্যাহ্ন সূর্য বড় প্রখর। তবু শারদারম্ভে উত্তাপ কিছু সহনীয় হয়েছে। এই স্কন্ধাবার যেখানে সেই স্থান উষর বালুময়। হরিদ্রাভ অরন্য নেই বললেই চলে। তবে এর পূর্বে সিন্ধু ও তার পঞ্চকন্যা আঁচল পেতে ভূমিকে স্নিগ্ধ করেছে। স্কন্ধাবারের নির্জনে তখন বসে আছেন এক দীর্ঘদেহী বিদেশী। নীলনয়ন স্বর্ণকেশ যুবকের আচরণ ও অভিব্যক্তি রাজকীয়। বয়স ত্রিশের আশেপাশে। বাজুবন্ধে বহুমূল্য রত্নখচিত অলঙ্কার। মাথায় একটি সুদৃশ্য রত্নখচিত বলয় তাঁর সোনালি চুলগুলিকে বেষ্টন করে আছে। একটি কাঁধ উন্মুক্ত। সেটিতে নজরে পড়ে তাঁর পেশীবহুল এবং অপরূপ দেহকান্তি। আরেকটি কাঁধ থেকে রেশমের বস্ত্র খণ্ড আভুমি লুটিয়ে আছে। তাঁর সম্মুখে এক পক্ক কেশ বৃদ্ধ। স্ববংশীয়। বৃদ্ধের মুখে জ্ঞানের বিভা। তিনি নিম্নস্বরে কিছু বলে চলেছেন। যুবক শুনছেন। তিনি বলছেন – সিন্ধু থেকে পীতবালুর দেশে যাত্রা করা সমীচীন। কারণ তার দক্ষিণপশ্চিমে মহাসাগর। সচরাচর যে সাগর তাঁরা দেখেছেন এ সে নয়। তাঁদের দেশের কাছে সুনীল সাগর সীমায়িত। কিন্তু তাঁরা শুনেছেন ইন্দ্রস্থানের সীমা ঘিরে যে সাগরের মেখলা তার নাকি সীমা নেই। সেই অসীম অনন্ত সাগরকে দেখতে জানতে তাঁদের বড় সাধ। জ্ঞানসাগরের এক অঞ্জলি মাত্র পান করা আরেক জ্ঞানবৃদ্ধের শিষ্য কখনও সীমায় খুশি হতে পারে? তাঁরা শুনেছেন সেই অনন্ত সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছনো যায় চৈনিক ভূখণ্ডে। প্রাচ্যের নানা সম্পন্ন দেশে। কিন্তু ইন্দ্রস্থানের পূর্ব প্রান্ত সম্বন্ধে তাঁদের কোনও ধারণা নেই। যেন মনে হয় ওই ঘন অরন্য পেরোলেই সমুদ্র। কিন্তু সে তো ধারণা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে কি আছে তা জানা নেই। অতএব রথ এখানেই থামালে চলবেনা। নৌবিদ্যায় নিজেদেরকে দক্ষ করে তুলতে হবে। পৃথিবীর যেটুকু অংশে মহান গ্রীক সৈন্যের পায়ের চিহ্ন পড়েনি সেখানেও পৌঁছতে হবে। তবে ওই পীতবালুর প্রদেশ বড় ভয়ংকর। পানীয় জলের অভাব খুব। অত্যুষ্ণ আবহাওয়া। যুবক সব শুনছেন। তার দৃষ্টি কিন্তু মাঝে মাঝেই সুদুরে চলে যাচ্ছে। স্কন্ধাবারের দুয়ারের রেশমের হালকা পর্দা মাঝে মাঝে হাওয়ায় সরে যাচ্ছে। তাঁর চোখে পড়ছে নীল আকাশ। সামনে রাখা সুদৃশ্য পাত্রে নানা ফল ও সুরা। মিষ্টি সুরা তাঁদের দেশ থেকে আনা। মাঝে মাঝে দু একটি ফল মুখে দিচ্ছেন। কখনও সুরাপাত্র মুখে ধরছেন। শরীরি আনন্দে তাঁর স্ফূর্তি হয়। এমন যে শরীর, সেই শরীরকে তিনি মনে মনে স্তুতি না করে পারেন না। যতই দার্শনিক পণ্ডিতরা বলুন জীবন অনিত্য, দেহ নশ্বর, শরীর তাঁর কাছে দেবতার সমান। তাঁর দীর্ঘ সুবলিত দেহ শরীরি আনন্দের প্রধান যন্ত্র। তিনি নানাভাবে সেসব পূরণ করেন। কখনও অবশ্য তাঁর মনে একটি প্রশ্ন জাগে। কেন তিনি নির্যাতন করতে ভালোবাসেন? তাঁর অপ্রাপ্য কিছুই নেই। সব পেয়েছেন। আর তাই ইচ্ছাপত্রে লিখে রেখেছেন, মৃত্যুর পর তাঁর শবাধার থেকে হাত দুটি যেন বাইরে মেলে দেওয়া হয়। সেই শোভাযাত্রায় সকলে যেন দেখতে পায় যে দিগ্বিজয়ী বীর, মহান সম্রাট আলেকজান্ডার যা কিছু অর্জন করেছিলেন তার সবটুকুই ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন। এমন চিন্তারও ছেদ ঘটছে কখনও। তাঁর আশেপাশে কিছু দাসরমণী তাঁকে ঘিরে আছে। কখনও অন্যমনস্কভাবে তিনি তাদের কারোকে ছুঁয়ে দেখছেন। ঠিক যেন একটি আঙুর ছুঁয়ে দেখছেন। মনে পড়ে পিতা তাঁর মাকে পরিত্যাগ করে আরেকটি রমণীকে বিবাহ করছিলেন। সেই বিবাহবাসরেই তিনি পিতাকে হত্যা করেন। অথচ পিতা তাঁকে যথেষ্ট ভালবাসতেন। আসলে বাল্যেই তাঁর মস্তিষ্কে দানা বেঁধেছিল এক বাসনা। সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হবেন তিনি। তার জন্য অল্পবয়সেই সিংহাসন ও শাসন ক্ষমতা চাই। চাই একটি সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী। কে বলতে পারে অবচেতনে এই বাসনা পূরণের লক্ষ্যই তাঁকে পিতৃহন্তায় পরিণত করেছিল কিনা? তীক্ষ্ণধী যুবক এরিস্টটলের শিষ্য। নিজের মনের গহনে কি আছে তা অনায়াসে বুঝতে পারেন। তখনকার একটি দিন আজ তাঁর মনে পড়ছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী সম্রাট। নিজের দরবারে বসে আছেন। হঠাৎ হাতে প্রজ্জ্বলিত দীপ নিয়ে সভায় এলেন ডায়ওজেনিস। ডায়ওজেনিসের উন্মাদরোগ সম্পর্কে সভায় সকলেই অবহিত। জ্ঞানউন্মাদ তিনি। কেউ কিছু বলছেন না। নিস্তব্ধ সভায় তিনি একেক জনের মুখের ওপরে দীপ ধরছেন। কিছুকাল কি যেন পর্যবেক্ষণ করছেন। তারপর মাথা নেড়ে সরে যাচ্ছেন। সম্রাট নিস্তব্ধতা ভেঙে জানতে চাইলেন – পণ্ডিত প্রবর, এই দ্বিপ্রহরে দীপ হাতে কিসের সন্ধান করছেন? ডায়ওজেনিসের চোখে কিন্তু উন্মাদলক্ষণ নেই। তিনি উত্তর দিলেন – মানুষ খুঁজছি। সারা সভা নিস্তব্ধ। একটি সূচের পতন শোনা যায়। এত বড় ধৃষ্টতা? সম্রাট মানুষ নন? কিন্তু সম্রাট বুঝেছেন ডায়ওজেনিসের মনের কথা। তিনি জগতসভায় এমন মানুষ খুঁজছেন যার অন্তরদীপ সদা প্রজ্জ্বলিত। তাঁর সন্ধানের অর্থ যে অন্তরের আলোয় আলোকিত প্রকৃত মানুষ তিনি খুঁজে পাননি। সেদিনের কথা মনে পড়লে যুবক কিছু বিষণ্ণ হন। কি করে তিনি অন্তরের আলো খুঁজে পাবেন? জানা নেই। তাদের দেশে দার্শনিকের অভাব নেই। তবু এই আলো কেউ দিতে পারলেন না। তিনি আবার বাস্তবে ফিরে আসেন। সামনে বসা পণ্ডিত দিওদোরাসকে জিজ্ঞেস করেন – পীতবালুর দেশ অতিক্রমের প্রয়োজন কি? আমরা প্রাসি ও গঙ্গারিদাইয়ের দিকে অগ্রসর হতে পারি। সেখানেও অনন্ত সমুদ্র আছে। তারা নৌবিজ্ঞানে বিশেষ পারদর্শী। পণ্ডিত মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, সত্য যে সেদিকের আবহাওয়া অতি মনোরম। সেদেশে প্রচুর পরিমানে মিষ্টি নলখাগড়া জন্মায়। বসমরণের পরিবর্তে উৎকৃষ্ট শস্য জন্মায়। তবে সেদিকে এমন ছোট ছোট রাজ্য ও জনসঙ্ঘ নেই। এদিকে যেমন রাজ্যে রাজ্যে বিবাদ আছে, ঐক্য নেই, সেখানে তা নয়। সে এক বিশাল সাম্রাজ্য। গ্রীক সেনাবাহিনী সেই সাম্রাজ্যের রণকৌশল জানেনা। সেখানে বিশাল নদী বহমানা। সুশিক্ষিত রণহস্তী পলকে শত্রুসৈন্যকে পরাহত করতে পারে। না জেনে সেদেশ আক্রমণ করা অনুচিত। শুনতে শুনতে আপাতনির্লিপ্ত মুখমণ্ডল ক্রোধে অগ্নিবর্ণ হয়ে উঠছে। বৃদ্ধ অনুভব করতে পারছেন। হঠাৎ তিনি অঙ্গুলিহেলনে বৃদ্ধকে থামিয়ে দিলেন। আরেকটি হাত দিয়ে এক সুরাবর্ণ সুন্দরীকে কাছে টানলেন। একটি ক্ষিপ্র টানে তার পরনের একমাত্র সূতিবস্ত্রটি সরিয়ে দূরে নিক্ষেপ করলেন। তারপর হাতের ইশারা করলেন। অন্য এক রমণী বীণার ঝঙ্কার তুলল। সারা দেহে হিল্লোল তুলে বিবসনা সুন্দরী নৃত্য শুরু করল। বৃদ্ধ বিরক্ত। সত্য কঠিন। তাকে মেনে নিতে হয়। হা সম্রাট! কটু সত্য গ্রহণ করতে পারো না? এই সব বিলাস ব্যাসন তাঁর দেহেমনে আর রেখাপাত করেনা। তিনি মনকে নিয়ে গেলেন তাঁর বিষয়ে। ইন্দ্রস্থানের পরাক্রমশালী প্রাচী ও গঙ্গাহৃদির রাজত্বে। মানস চক্ষে দেখতে থাকলেন সে রাজ্যের সুখশান্তি ও সম্পদ। কিন্তু যুবকের ঔদ্ধত্যের সীমা নেই। চাইলেও বৃদ্ধ সভা ত্যাগ করতে পারলেন না। 



এমন সময়ে পর্দার ওপারে প্রতিহারীর অস্তিত্ব ঘোষিত হলো। বড় অসময়। কিন্তু যুবকের মন অদ্ভুত। এই ক্রোধের উত্তুঙ্গ শিখরে, পরক্ষণেই স্থিতধী। তিনি আবার একটি ইশারা করলেন। নৃত্যকী বস্ত্রখণ্ড কুড়িয়ে দেহ ঢেকে নিল। বাদ্য থামল। প্রতিহারী অন্দরে প্রবেশের অনুমতি পেলো। জানা গেলো প্রাচ্যদেশীয় এক বাম্ভন সমন তিনটি সঙ্গী সমভিব্যাহারে এসেছেন সম্রাটের দর্শনপ্রার্থী হয়ে। প্রত্যেককে যথাযথ পরীক্ষা করা হয়েছে। সকলেই নিরস্ত্র। ধর্মপ্রচারক ও পরিব্রাজক। সম্রাট হাত তুললেন। মধ্যাহ্ন শেষে দর্শন হবে। এখন তিনি বিশ্রামে। বাম্ভন সমনের যথাযথ সেবা করা হোক। আবার শুরু হলো নৃত্যগীত। অন্য কক্ষে বিশ্রামরত অতিথি। সম্রাট মনে মনে ভাবছেন, একই সঙ্গে রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা ও দার্শনিক জিজ্ঞাসার উত্তর মিলতে পারে। 

0 comments: