1

প্রবন্ধ - উত্তম বিশ্বাস

Posted in


প্রবন্ধ


ঠাণ্ডা রসের ঠিলে 
উত্তম বিশ্বাস



অঘ্রাণ আসলেই খেজুর গাছগুলির ঝুটি ধরে ধরে কোপাতে থাকে গাঁয়ের শিউলিরা। খেজুরে হত্যা ভাবছেন? না, এ কোপ সে কোপ নয়। সারাবছর ধরে সন্যাসীর জটার মতো পুষে রাখা গাছগুলির মাথার ওপর জমাটবদ্ধ শুকনো চোমর, কম্বলের সুতোর মতো ভাঁজে ভাঁজে সাজানো সপরা, আর কাঁটা ওয়ালা বেগো, পাতা---সব কাটতে কাটতে গাছগুলির মাথাটা যখন অনেকটা ফর্সা হয়ে আসে; ওটুকু আরও একটু চেঁছে ছুলে মসৃণ করা হয়, ওটাকে তখন বলা হয় কপাল। আর ওই কপাল ঘেমেই পৌষ থেকে ফাগুন অবধি গড়িয়ে আসে গাছেদের সকল আনন্দ নিসৃত, দুঃখ নিসৃ্‌ত--- চিন্তা নিসৃত শীত শীতল রস। গাছগুলিকে তখন দারুণ ফুরফুরে দ্যাখায়;---ঠিক যেন বৎসরান্তে একবার করে নাপিত ডেকে, অশৌচ পুত্র কন্যাগুলিকে ধরে ধরে মস্তক মুণ্ডন করে ছেড়ে দেওয়া আর কী! তবে সব গাছে ইচ্ছে হলেই এমন ইস্পাতের ধার দেওয়া দা’এর কোপ দেওয়া যায় না। কম করে পাঁচ থেকে সাত বছর না হলে কোনও চারা গাছকেই দা’ কাঠারির ভয় ভীত দেখিয়ে রস আদায় করা একদম নিষেধ। এতে তাদের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে যে! সামান্য রসের জন্যে চারা গাছের প্রতি এতটা বলাৎকার, জেনে বুঝে কেউ কী করতে চায় নাকী! 

শীতের দিনে সর্ষে ফুল ছোলা-মটর, আর গমক্ষেতের আল ছুঁয়ে কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে ঠিলে গুলি দুলতে থাকে ঠিক যেন যুবতীর বক্ষভারের মতো!--- এটাই আসলে রসময়ী বাংলার শীত প্রকৃত সৌন্দর্য। কিন্তু এরা অসম্ভব রহস্যময়ী!-- এদের মন পাওয়া অতটা সহজ ভাবছেন, ততটা নয়! এদের কাছ থেকে এক ফোঁটা আদায় করতে চাইলে তার হ্যাপা অনেক। আসুন আজ সেই রসের সন্ধানেই আমরা একটু গাঁয়ের পথে যাত্রা করি।

পাহাড়িরা চা পাতা তোলে যে ঝুড়িতে, তার চাইতেও সরু বাঁশের সলা দিয়ে বোনা খাঁচা বানিয়ে নেয় শিউলিরা। স্থানীয় মুচিদের কাছে আগে থেকে বায়না দিতে হয়। শিউলিদের ভাষায় যার আর এক নাম ঠোঙা। এই ঠোঙার ভেতর শিউলিরা গুছিয়ে নেয়, তিন পদের দা’। এগুলি হাসুয়ার চেয়ে সামান্য বেটে, অথচ অত্যন্ত ধারালো। এক নং থাকে কোপের দা’; যেটা দিয়ে ঝোপালো পাতা, শুকনো খোমা, শক্ত গুড়ি কুপিয়ে, কেটে ছেঁটে পাদানি ইত্যাদি প্রস্তুত করতে হয়। অনেকগুলি পাতা কেটে উপরের দিকে উঠতে থাকলে তবেই গাছের সাদা ও নরম অংশ বেরিয়ে আসে। এবার সেটিকে খুব সাবধানে চেঁছে ছুলে গাছ কপাল তৈরি করে শিউলিরা। গাছ তো ঝোড়া হয়ে গেল। এবার পাতা গুলি নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে,--- খুব দাগী, শুকনো পাতা এগুলি জ্বালানীর জন্যে আলাদা গাদা মারা থাকবে। মাঝের পাতা চলে যাবে চাটাই মাদুর শিল্পের কাজে। শপরা আর চোমর যাবে বিয়েবাড়ি, অথবা অন্নপ্রাশনের প্যাণ্ডেল সাজানোর কাজে। শুকনো ফুল আর কাঁটা যাবে হস্তশিল্পে,কিম্বা শহর ও গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন কুটীরশিল্পমেলায়। 

দুই নং দা প্রয়োজন হয় ঠি দিন পনেরো পরে। ঝোড়া গাছগুলি যখন একটু শুকিয়ে আসে, তখন চাচের দা দিয়ে এক পরল ছাল ফেলে দিয়ে চাঁচ দিতে হয়। এর জন্যে লাগে চাচের দা। চাঁচ দেওয়া হয়ে গেলে প্রতিটি শিউলিই মনে মনে ওপরওয়ালাকে ডাকতে থাকে! কেননা এই সময় হুট করে যদি বৃষ্টি অথবা নিম্নচাপের মতো অকাল বর্ষণের অভিশাপ নেমে আসে, তাহলে গাছগুলিতে ফাংগাস অথবা মাজরাপোকার আক্রমণের আশঙ্কা থাকে অনেকটাই। তখন রস যা নামবে,-- হয় তিতো, না হলে মারাত্মক রকম ঘোলাটে আর গ্যাজলানো।

গাছগুলি আপাতত সর্ষে ক্ষেতের আলে মটর ক্ষেতের মাঝে,-- ঝাঁঝালো মুলোর গন্ধ মেখে শীতের ঝলমলে রোদে দাঁত ছাড়িয়ে মনের সুখে আরও দিন দশেক হাসতে থাকুক। শুধু কি হাসি? কতো রকম ভঙ্গিমা এদের এক এক জনের! না দেখলে বিশ্বাসিই করতে পারবেন না। কেউ বা চোদ্দপাটী বার করে, কেউ বা নস্যিটেপা ঠোঁটে কুঞ্চিত মুখে, কেউ বা কিশোরী শ্যামার মতো আধো আধো চাহনীতে চেয়ে থাকে বাংলার মাঠ-ঘাট জুড়ে। অপরদিকে ওদের শরীরের ঠাঁটও এক এক জনের এক এক রকম। কেউ রণরঙ্গিণী বেশে, কেউ বা কুঁজো, কেঊ আবার দশাসই পেট নিয়ে! এদেরই মধ্যে কেউ কেউ আবার এক্কেবারে লাজবতী লতা! অপরপক্ষে কারও চাউনিতে হিংসুটে ভাব, কেউ বা চতুর,-- কেউ আবার মাথামোটা হ্যাদাভোদা আত্মভোলা! এদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন বডিল্যাংগুয়েজ নিখুঁতভাবে লক্ষ্য করে শিউলিরা। কেউ কেউ এমন গাছুড়েও আছে, যারা ওদের গতরের গড়ন দেখে আগেভাগে একটা আন্দাজ করে নিতেই পারে,--- কার কাছ থেকে গোটা শীত সিজেনে আদৌ ক’ফোটা গলানো, বা আদায় করা যাবে! অতএব আরও দিন দশেক গাঁয়ের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা ল্যাংটো পাছায় সারামাঠ ঘুরে ঘুরে গাছের মাথা গুণে গুণে হিসাব রাখুক, আর মনে মনে প্লান কষে নিক,-- কার ঠিলেটি ঢিলিয়ে ভাঙবে, আর কার ঠিলেয় পেঁয়াজকলি, কিম্বা গমের কাঠি চুবিয়ে চোঁ চোঁ করে সাবাড় করবে ঠাণ্ডা নৈশ রাতের রস! 
আর গাঁয়ের শিউলিদের মা ঝিয়েরা কুপি জ্বালিয়ে, দাঁতের আগায় শুকনো খেজুর পাতা চিকিয়ে চিকিয়ে চাটাই বুনতে থাকে, আর একখান পাটির বিনুনি প্রস্তুত হলেই, আতার ছালে সেলাই করে হাঁটে বিক্রি করে তুলে দেয় শিউলির হাতে। কেননা মাটির ঠিলেগুলি কিনতেও ত অনেক টাকা লাগে! অভাবের সংসার গাছেদের আতাবাতা বেয়ে যেটুকু উপার্জন করা যায়, সেটুকুই লাভ! 

শনশনিয়ে শীত এসে পড়ে। শিউলিরা মাথায় ফেট্টি বেঁধে ঢুঁ মারে জাওয়া বাঁশের ঝাড়ে। বুড়ো আঙ্গুলের মতো মোটা সাইজের কঞ্চি কেটে এনে সেগুলি তিন চার ইঞ্চি পরিমানে কেটে নিয়ে,-- চিরে নলি বানায়। আর এক দফায় বাঁশের গোড়া কেটে প্রস্তুত করে নেয় কাঠের গোঁজা বা খিল,-- যাতে ঠিলে ঝোলাতে হয়। এদের একত্রে বলা হয় “খিল-নলী।”---এই খিল নলী প্রতিস্থাপনের দিনগুলিতেই আসলে খেজুর প্রতিমাশিল্পের প্রকৃত চক্ষুদান পর্ব শুরু হয়ে যায়। তখন প্রতিটি গাছের রূপ যায় পাল্টে,-- চোখ, নাক, কপাল চাঁছা নাকে নোলক পরা গাছগুলোকে দেখলে, এবার সত্যি সত্যি মানুষ মানুষ মনে হয় তাদের। খিল নলী প্রতিস্থাপনের দিন গাছে ঠিলে পাতে না কেউ। এদিন কোনও কোনও গাছে দু’এক ফোঁটা ঝরলেও, শিউলি তার দা’এর আগায় মাখিয়ে মন ভরে আস্বাদ নেয় একা একা। বুকের ওপর মুখের ওপর যখন টুপটুপ করে ঝরে পড়তে থাকে আঠালো রস,---তখন এর ভাগ পৃথিবীর আর কাউকেই দিতে চায় না সে! 

গাছগুলির শীরের টান শুরু হবার সাথে সাথেই পালপাড়ার পাঁজায় বাঁশ পাতার আগুন আর ছাই ওড়ে খুব! সস্তা ধাতুর আংটি পরা হাতে ঠুং ঠাং ঠোকা দিয়ে, উল্টেপাল্টে বেছে বেছে পোড় খাওয়া ঠিলে গুলো কিনে আনে শিউলিরা। এরপর বাড়িতে এনে, টানা তিনদিন পুকুরে চুবিয়ে রাখাই দস্তুর। কেননা, আগুনমুখো ঠিলেরা ওদের তপ্ত বুকে রসের ফোঁটা পড়তেই চোঁ চোঁ করে শুষে নেবে প্রথম কাটের রস! এ কারণে আগে থেকেই খুব ভালোভাবে ঠাণ্ডা জলে শীতল আর রসালো করে নেওয়া হয় ওদের বুক। তারপর ঘরের বধুদের হাতে, “ঘটিগুলি মাজে! বাটিগুলি মাজে”র মহিমায় নিত্য দিনের রোজনামচা আর ঠোকাঠুকিতে নথিভুক্ত হয়ে যায় মাটির পাত্রগুলি।

রোদের দিকে পিঠ দিয়ে শিউলিরা বালিধরা পেতে, (সরু মসৃণ কাঠের বাটাম) তাতে ভাজা বালি দিয়ে কাগজের মত পাতলা দাগুলি ঘষে ঘষে ধার দিতে থাকে। আর বাড়ির বৌ ঝিরা দাওয়ায় ঠ্যাং ছড়িয়ে বস্‌ নগ্ন উরুর ওপর কাঠের চাকতি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কোস্টার বেটে কাটতে থাকে। এগুলি পাকিয়ে হবে ঠিলের কানাচ। অর্থাৎ ঠিলে ঝোলানো ফাঁস, বা দড়ি। ওদিকে উঠোনের এক কোণে মুখ সরু পঁচিশ গণ্ডা ঠিলে মুখোমুখি উপুড় হয়ে অল্প আঁচে, অথবা নাড়া(ধানের গোড়া) শুকনো শিরিশপাতা, ভিজে পলবিচালি অথবা ছোট লতাপাতা জ্বালিয়ে তিরী করা হয় সুগন্ধি ধোঁয়া! এই আগুনে ধিমে ধিমে পোড় খেতে থাকে ঠিলেগুলি। এসময় একটু সতর্ক থাকতে হয়, কেননা আগুন দপ করে জ্বলে উঠলে সমস্ত ঠিলেগুলি একসাথে চটপ্ট ফটফট আওয়াজ নিয়ে ফেটেফুটে সারাপাড়ার ঘুম ছুটিয়ে দেবে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, যে ঠিলেগুলি ধোঁয়া খেয়ে খেয়ে সবচেয়ে কালো হয়ে উঠবে, ওদের রসই হবে সবচেয়ে লাল এবং সুগন্ধযুক্ত, স্বাদেও তেমনই!--- এক্কেবারে নেশাধরানো!----যার আদি নাম জিরেন রস। সন্ধ্যায় এই রস নামালে দ্যাখা যায়, খড়ধোয়া জলের মতো ঈষৎ লাল, স্বচ্ছ সুগন্ধে ভরপুর! বাংলার শ্যামল প্রকৃতির এমন আদি রসের উপাখ্যান পৃথিবীর আর কোনও দেশে পাওয়া যায় কিনা আমার সন্দেহ!

রসিক শিউলি এবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজের কোমর আর খেজুরগাছ বেড় দিয়ে বেঁধে নেবে মোটা পাটের দড়া(দড়ি)। সাপোর্ট হিসাবে বিচালির তৈরি বোলেন থাকবে পায়ে। যদিও উলম্ব খেজুর গাছে অনেকগুলির বুকে বছরমাপা এক একটি খাঁজ কাঁটা ভাজ থাকে, সেখানেও পা রেখে ওঠে কেউ কেউ। এবার একগাছি মোটা দড়ির সাথে শিউলির কোমরে বাঁধা বাঁশের ঠোঙায় থাকে খিল নলী, তিন পদের দা, বালি, আর আঁকশিতে বাঁধানো একটি ঠিলে।

এসময় হুড়মুড়িয়ে গায়ের পরে এসে পড়ে ইতুপুজো। দারুণ শৈত্যপ্রবাহের ঠ্যালা খেয়ে সর্ষে ফুলের মঞ্জরিগুলি তিরতির করে কাঁপতে থাকে। আর তিনমাথার ব্যানাঝোপের আলে বসে হলুদ শাড়ি পরা গাঁয়ের মেয়েরা বৃদ্ধা হরিদাসীর মুখে ইতু ঠাকুরের উপকথা শুনতে শুনতে হারিয়ে যায় রূপকাথার দেশে! যেখানে দৈন্য নেই, দুঃখ নেই, আছে শুধু কিশোরী মনের কাঙ্ক্ষিত রাজপুত্তুর! উঠোনের এককোণে ঝুড়ি চাঁপা দেওয়া ইতুঠাকুরের ঘট। চালের আলপনা আর আধখাওয়া পেট নিয়ে উঠতি বয়সের মেয়েরা মাঠে বসে শুনতে থাকে পুরোনো দিনের পাঁচালী! আর এসব দেখবার নেশায় দুষ্টু বালকের মতো হাঁ করে চেয়ে থাকে রাখাল শূন্য খাঁ খাঁ মাঠ! আর একইভাবে ধু ধু প্রান্তরের দিকে একা একা ভিজে চোখে চেয়ে থাকা অশ্রুদানী খেজুর গাছেরাও! পুরোনো ব্রতকথা শুনে ওরাও হয়ত কাঁদে; কিন্তু কার জন্যে কাঁদে সেটা কেউ জানে না! জানে কেবল আবহমানের আলোহাওয়া আর ইটভাটার অসভ্য আগ্রাসী আগুন! পাশাপাশি আত্মীয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলি এক এক করে বিক্রি হয়ে যায় জলের দরে! হাত মাপা দামে! কিনে নেন ফায়ারব্রিকসের মালিক। ফাড়াই করে পুরে দেন পাঁজায়! এর কোনও প্রতিকার নেই! অভাবের আগুন গিলে খায় গোটা শিউলিসমাজকে! এসব কথা একা একা ভাবে, আর ওদের চোখে মুখে ধারালো দা’এর পোচ দিতে গিয়েও মাঝে মাঝে আনমোনা হয়ে পড়ে অভাবী শিউলিরা। এর ফলে কখনও কাঁটার খোঁচা, কখনও বা সাপের ছোবলেও প্রাণ যায় অনেকের!
গাছ গুলিরও যে একেবারে দয়াধর্ম নেই, তা এমন নয়!—ওদের মধ্যে কেউ কৃপণ, কেউ আবার অতি উদার। তবে বোকার মতো যে গাছটি হাউহাউ করে কেঁদে ভাসাতে পারবে,--- তারই হবে জয়জয়াকার! কিন্তু সবাই ত আর সমান না, কেউ ঝরে ঝর ঝর করে, কেউ ফ্যালে ফোঁটায় ফোঁটায়, কেউ আবার মিনিটে একটিমাত্র ফোঁটা ফ্যালে। কিন্তু একটি বারের জন্যেও শিউলির অশ্রদ্ধা আর আক্রোশের এলোমেলো কোপ এসে পড়ে না ওদের কপালে!

সকাল হলে রসিক মালকোঁচা মেরে আবার উঠে পড়ে গাছে। শিউলির শীতার্ত বুক, নগ্ন উরু, রক্তশূন্য ধমনী ছলকে ওঠে কাঙ্ক্ষিত নবীন রসের আনন্দে। খুব সন্তর্পণে পেড়ে আনে রস ভর্তি ঠিলে। এরপর বাঁশের বাকে বাঁধিয়ে দুলকি চালে ছুটে চলে গাঁয়ের পথে। 

মেয়েরা জিরেন রসের জন্যে আগেভাগে আলাদা আখা বানিয়ে রাখে। পাল পাড়া থেকে বানিয়ে আনে বড় মাপের মাটির কড়াই,--- নাম জেলো। তবে ইদানীং টিনের চাতালেও গুড় জ্বাল দিচ্ছে কেউ কেউ। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, টিনের পাত্রে গুড় পুড়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা থাকে, অথবা স্বাদ নষ্ট হবার যে ভয় থাকে,--- মাটির জেলোতে তার সিকিভাগও ঝুঁকি নেই। এবার রসটুকু ঠিলের মুখে সপরা চেপে ধরে ছেকে নেওয়াই নিয়ম, কেননা ওর সাথে মিশে থাকে সাঁজালের ছাই, পাখির বিষ্ঠা, বাদুড়ের বমি, কচুর ডেগো, ধুতরার বিচি, আরও অনেক পদের উপসর্গ! --- অবশ্য ধুতরা, কচুর মতো এসব বাড়তি বালাই হয়ত যোগ করা হয় রসিক চোরের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রাতের রসটুকু বাঁচানোর জন্যে! এ ছাড়াও আরও নানারকম টুকুটাকি গ্রাম্য দাওয়াই ব্যবহার করে থাকে শিউলিরা। এসব খেয়ে মৃত্যুর খবর না পাওয়া গেলেও, পাগল হবার উপকথা কিন্তু বহু প্রচলিত আছে! অর্থাৎ সাধু সাবধান! 

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, শুধুমাত্র রসের কারবারি যারা, তারা রসটুকু সংগ্রহ করেই সকাল সকাল বাজারে পৌঁছে যায়। আর বাকিরা আনে উনোনের ধারে। বাজারে রস পাঠাতে হলে কুয়াশা ভাঙার আগেই পাঠাতে হবে, কেননা বেলা বেড়ে গেলেই ওতে গ্যাজা উঠতে শুরু করবে। জিরেন রসের স্বাদ পেতে যারা বাজারে আসেন, তারা গ্লাস ভর্তি রস চোঁ চোঁ করে মেরে দেন শুধুমাত্র গন্ধ আর মিষ্টির টানে। যেদিন শুনবেন শীতের সকালে খুব হৈ চৈ চেঁচামেচি হচ্ছে, বুঝবেন এ ঝগড়া নিতান্তই রসকেন্দ্রিক। রস খেতে এসে নিশ্চয়ই ভেজাল ধরে ফেলেছেন কেউ!-- খাবার পর গোঁফের কাছে ঠোঁটের কোনায় যদি একটু চিটচিটে টান না অনুভব করা গেল, তাকে আবার জিরেন রস বলে নাকি কেউ!

একবার গাছের চোখে পোচ পড়লে মোটামুটি দিন তিনেক রস ঝরতেই থাকবে। প্রথম দিনের দিন যেটুকু সংগ্রহ করা হয়,-- জিরেন রস। আর দ্বিতীয় দিনে ঝরে সামান্য ঘোলাটে আর মৃদু ঝাঁঝালো,-- ওলা বা দোকাট। আর তৃতীয় দিনের এক্কেবারে তীব্র ঝাঁঝালো ঈষৎ জলপাই কালারের---তে’ঝরা! তার পরেও যদি অভাগা গাছগুলির কান্না না থামে, তখন কাঠবেড়ালি, ভাম, দাঁড়াশ সাপ, পিঁপড়ে, প্রজাপতি, মথ মৌমাছি,---নানা প্রজাতির পাখিরা এসে ওদের নাকচোখ চেটেচুটে শুকোনোর দায়িত্ব নিয়ে নেয়! তবে বড় গাছের নীচে থাকা অথবা ছায়ার গাছগুলি রোগাটে বা সিকিভাব বেশি, অসুস্থ্যও হয় ঘনঘন! এদের নিয়ে খুব দুর্ভোগ পোহাতে হয় শিউলিদের! তখন রস তো দূরের কথা, নিউমোনিয়া রোগীর মতো নাক মুখে শ্লেষ্মার স্রোত দেখলে, আপনারও গাছের ব্যথায় বুকের ভেতরটা খচখচ করে উঠবে!

রসের কড়াই গরম হলেই প্রথম একপরল মোটা ফ্যানা উৎলে উঠবে। কড়াই ছাপিয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই উড়কি(নারকেলের মালা দিয়ে তিরী হাতা) দিয়ে ওটুকু ফাটিয়ে দেয় শিউলিরা, অথবা ওপর থেকে আলতো করে অন্য একটি পাত্রে তুলে রাখে,-- যাকে বলা হয় মোলো। এছারাও হাতের কাছে রাখে কাঁচা খেজুর পাতা। রসের কড়াই উৎলে উঠলেই কাঁচা খেজুর পাতা ছুপে ধরলেই তক্ষুনি রস রণে ভঙ্গ দেয়। এরপর জেলো ভর্তি রস নাচতে শুরু করলেই পাড়াময় ভুরভুরে গন্ধ শীতের কুয়াশা ফুঁড়ে হুহু করে ছুটতে থাকে। শিউলিপাড়া, সর্ষে ক্ষেত, ফেরিঘাট, বুড়ো বটতলা দুর্গা দালান মসজিদ মাজার সব একাকার করে নিয়ে মিষ্টি নলেন নলেন গন্ধে তখন ম ম----! ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তখন বাটি হাতে কাঙালের মতো দাঁড়িয়ে পড়বে উনোনপাড়ে! অসীম ধৈর্য নিয়ে শুনতে থাকবে গরম গুড়ের ঘাইমারা শব্দ! ওদেরকে ঢাল করে বয়স্ক কেউ কেউ হাঁকডাক দিতে থাকবেন ঘনঘন। কেউ বা লোভ সম্বরণ করতে না পেরে, মুখফুটে বলেই ফেলবেন,-- “এক চিমটি গুড় দিস মা!” 

মাঝে মাঝে ময়লা ফ্যানা ঘুরতে ঘুরতে জেলোর গায়ে জড়িয়ে উঠবে।--ওটুকু লেগে যাওয়ার আগেই ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে তুলে নেওয়াই নিয়ম, তা না হলে গুড়ের কালার ও গন্ধ দুটোই নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এবার রস আরও ঘন হয়ে এলে মুসুর দানার মতো বুটবুটি নিয়ে ফুটতে থাকবে। ওটাকে বলা হয় মুসুরফুট। এসময় আগুনেই সবচেয়ে সাবধানী হতে হয়। অল্প জ্বালে নাচতে থাকে উড়কি। ফুট বাতাসার আকার ধারণ করলেই, শুরু হয়ে যায় কাউনডাউন। বুটবুটিগুলি একটি দুটি করে ফাটতে শুরু করলেই জেলো নামিয়ে উড়কি দিয়ে ঘোলা মারতে হয়। এবার শুরু হয় শীতল করার পালা। কাঁচা খেজুরের ছড় কেটে তৈরি হয় বীজমারা কাঠি। ওর চওড়া মুখ দিয়ে জেলোর গায়ে ঘষে ঘষে ঘন করতে গরম গুড়। বীজ মরে ধুলো হয়ে এলে, সেটুকু সমগ্র গুড়ের সাথে ঘুলিয়ে নিয়ে চটপট প্রসারিত থালার ওপর ভিজে ন্যাকড়া বিছিয়ে, প্রস্তুত হয়ে যায় প্রমানসাইজের পাটালি। সবাই যে পাটালি করে, এমন নয়। কেউ ঠিলে ভরে, কেউ বানায় ভেড়োঁ। কেউ পাঠায় মোয়ার দোকানে, কেউ পাঠায় ভিয়েনে। ঢেঁকিতে আতপ চাল ধুলো হয়; পাড় পড়ে দুম দুম, কথা কয় ক্যাঁচ ক্যাঁচ!--- পৌষে পিঠে পিঠে পাবে নবান্নের মাঠ। খেয়াঘাট ভরা থাকে ঠিলে ভরা গুড়ে। ফুটপাথে হাঁক দেয় ফেরিওয়ালা, “মোয়া আছে মোয়া!” আর কড়াইয়ের গায়ে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে,--- ওটুকু ঝিনুক বাটির কারবারিদের জন্যে বরাদ্দ করা থাকে। গ্রামের কচিকাচারা তখনও শুকনো মুখে ঝিনুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকে উনোনের পাশে! মালিক কড়াই থেকে সরে গেলেই সে কী আনদ! সে কী উল্লাস! এদের মধ্যে হয়ত কেউ পাবে, কেউ পাবে না। কেউ বা কালিঝুলি মেখেই ভূত হবে!--- তবু নলেনের যে স্বাদ , যে নেশা ধরানো গন্ধ--- তা পৃথিবীর আর কোনও খাবারে আছে কিনা আমার জানা নেই!

1 comment:

  1. বেশ ভালো লাগলো উত্তমের লেখাটা পড়ে । প্রাঞ্জল গদ্য ।

    ReplyDelete