0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in

গল্প


রীনাত্মা
সনাতন সিংহ


(১)

…কি রে, এত দেরি করলি? আর একটু হলে ট্রেন পেতি? হাতে একটু সময় নিয়ে বের হতে পারিস না!

বছর পঞ্চান্নর অসিত বাবুর কথা শেষ না হতে হতে পিজি হাসপাতালের নাইট গার্ড শ্যামলদা বললেন …প্রায় তো এমন দৌড়ে এসে ট্রেন ধরিস! হাঁপাচ্ছিস তো! এখানে বোস দেখি। আর হ্যাঁ, একটু আগে বের হওয়ার চেষ্টা করিস।

সহযাত্রীদের এসব উৎকণ্ঠা, উপদেশ, সহানুভূতি রীনার কানে প্রবেশ করছে ঠিকই, কিন্তু তা হৃদয়ে পৌঁছনোর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। আর পাবেই বা কি করে? দীর্ঘ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে তার বুক ওঠা-নামা করছে। শুধু নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নয়, কি যেন একটা কিছু তাকে তাড়া করছে ওতপ্রোতভাবে।

এই ট্রেনটা যে সে পাবে, প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি। পরিচিত মুখগুলো দেখে একটু আশ্বস্ত হয়ে ওড়নার খুঁট দিয়ে ঘাম মুছছে।

ট্রেন কম্পার্টমেন্টে বাইরের থেকে গরম একটু বেশি। লোকের ভিড় যথেষ্ট। ফাল্গুন শেষ হতে প্রায় সপ্তাহ খানেক বাকি। একটা গরম গরম ভাব। দৌড়ে আসার জন্য আরো বেশি গরম বোধ হচ্ছে।

তার চোখে মুখে উদ্বেগ। পিছনে তাকাচ্ছে বারবার।

…কিরে, আয়। জানালার ধারে বোস না। আর বারবার পিছনে তাকাচ্ছিস কেন বলতো দেখি?

সহযাত্রী কমলদা উঠে দাঁড়াতেই রীনা জোরে জোরে দম নিতে নিতে তার পিছনে দাঁড়ানো বছর দশের মেয়েটাকে বলল …যা, তুই বোস।

মেয়েটা লোকের গা ঘেঁষে, ঠেলে জানালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রীনার ওড়নার এক খুঁট তার ডান হাতের মুঠোয় ধরা দেখে অমলাদি বলল

…কে রে রীনা?

অমলাদির দিকে তাকিয়ে রীনা একটু হেসে বলে …আমার মেয়ে কবিতা।

অমলাদি কবিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল …বোস। বাহ, বেশ মিষ্টি তো। চুলগুলো বেশ লম্বা। তোর মুখ পেয়েছে রে! দেখ তো ও কেমন হাঁপাচ্ছে। যখন ওকে নিয়ে বেরিয়েছিস, তখন হাতে একটু সময় নিয়ে বের হ, তা নয়। কেমন কাঁপছে দেখ দেখি?

বলছে আর তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দেখছে, জানালা দিয়ে হাওয়া এসে তার চুল উড়িয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে। গায়ের জামার রঙের সঙ্গে কবিতার দুধে আলতা রঙ মিশে তাকে বেশ মোহনীয় করে তুলেছে। সরু সরু ঠোঁট দুটো লিপস্টিক ছাড়াই লাবণ্য ছড়াচ্ছে নিজের মহিমায়। ভ্রুযুগল প্রায় জোড়া। ছোট্ট একটা সরস্বতীর মতো ডাগর ডাগর চোখে ভয়ে ভয়ে তার মার দিকে তাকিয়েছিল। রীনা তাকে চোখের ইশারায় কি যেন একটা বলতেই এখন সে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ ফেরালো।

…কিরে, তুই ওর কানে একটা কিছু পরিয়ে দিসনি কেন? দেখ না কান কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে!

…ছিল তো। কই দেখি, এদিকে ঘোর।

সত্যিই তো এক কানে একটা রয়েছে। অন্যটা ফাঁকা। নিমেষে রীনার বুক দুর দুর করে উঠল।

…কোথায় ফেললি রে?

…কানেই তো ছিল!

…ছিল মানে? গেল কোথায়?

রীনা কি সাত পাঁচ ভাবতে লাগল। ঠিক তখনই কবিতা বলল …মনে পড়েছে। জানো মা, জানলার ফাঁক দিয়ে বের হওয়ার সময় পর্দার সুতোয় কানে একটু টান পড়েছিল। তখন...

কবিতার মুখের কথা শেষ না হতে হতে অমলাদি উৎকন্ঠার সঙ্গে রীনাকে প্ৰশ্ন করল।

...জানলা দিয়ে বের হয়েছে মানে?

…ও-ও কিছু নয়। ঐ লুকোচুরি খেলছিল কিনা। তাই। ব-ব-ব-বল না, বল।

অমলাদিকে সামাল দিলেও মেয়ের কথাগুলো তার কানে ঢুকতেই চোখের সামনে সেই দৃশ্যগুলো ছবির মতো ভেসে উঠছে… রীনা বাইরে থেকে মেয়েকে টানছে। মেয়ের অর্ধেক শরীর ঘরের মধ্যে। মেয়ে চাপা কান্নায় বলছে …মা, লাগছে। মা লাগছে…

বারান্দার দিকে কারা বুঝি কথা বলতে বলতে আসছে …বারান্দা হাট করে খোলা!

…ঘর অন্ধকার! কি ব্যাপার বলতো?

…ভেতরে কেউ আছে মনে হচ্ছে!

বন্ধ দরজার বাধা ভেদ করে কবিতার সেই ক্ষীণ আর্তনাদ হয়তো তাদের কানে পৌঁছাচ্ছে! তাদের সন্দেহ, কৌতূহলে ভর করে আবছা আবছা হয়ে এপারে আসছে…

…ঘরে কি কেউ আছো? কবিতা কাঁদছিস নাকি রে?

ঠিক সেই সময় কবিতাকে টেনে বের করে নিল রীনা। রড ছাড়িয়ে তাকে এপারে টানতে গিয়ে জানালার গরাদে কবিতার পিঠ গেল চিরে। জামা ছেঁড়েনি ঠিকই, কিন্তু জামার ভেতরটা চিড় চিড় করছে।

…চল, দৌড় দে।

ঘরে ঢুকলেই বুঝতে পারবে। তার আগেই পালাতে হবে। দে দৌড়।

ঘরের কানাচ ধরে লতাপাতা মাড়িয়ে দিল দৌড়। লতায় পা জড়িয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ল কবিতা। তাকে টেনে নিয়ে রীনা এখন রাস্তায়। দৌড়াচ্ছে আর পিছনে তাকাচ্ছে, কেউ তাদের ধাওয়া করছে কিনা! রীনার কানে আসছে, কে যেন পিছন থেকে চেঁচাচ্ছে …ধর, ধরররর...

এদিকে পাড়ার লোকজন কেমন হকচকিয়ে গেছে।

অন্ধকারে দুটো অসম ছায়া শরীর দৌড়ে যাচ্ছে। যারা দেখছে তারা বুঝে উঠতে পারছে না। তবে কিছু যে একটা ঘটেছে, তা তারা অনুমান করছে আর পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে।

ততক্ষণে কবিতারা গলি টপকে এসেছে। তিন রাস্তার মোড়। কিন্তু স্টেশনে যাবে কি করে? রাস্তায় এই মুহূর্তে কিছুই চোখে পড়ছে না। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে রীনা। একটা গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে তারা।একটা আবছা অন্ধকার তাদের ঘিরে ধরেছে চারদিক থেকে।

দু-একটা বাড়ি থেকে আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ছে। শাঁখের আওয়াজ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট গুলো থেকে আলো জ্বলছে টিমটিম করে।

রীনা মেয়ের হাত ধরে আছে। কিন্তু স্থির হতে পারছে না। রাস্তার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

আর অপেক্ষা না করে ওরা পা বাড়ালো স্টেশনের দিকে। দ্রুত পায়ে হাঁটছে।

একটু এগিয়ে দেখে একটা ভ্যান পিছনে থেকে তাদের দিকে আসছে। হর্ন বাজাচ্ছে জোরে জোরে আর তাদের উদ্দেশ্যে সুর করে প্রলম্বিত লয়ে চেঁচাচ্ছে …স্টেশন, স্টেশন...

ভ্যানে দুজনকে দেখা যাচ্ছে। ভ্যানওয়ালাকে রীনা জিজ্ঞাসা করল …স্টেশন যাবে?

উত্তরের অপেক্ষা না করেই রীনারা উঠে পড়ল ভ্যানে। ওড়নাটা নিজের মাথায় ঢেকে বসল। কারা যেন তাদের রাস্তার মোড়ে এসে চেঁচাচ্ছে

…ঐ, ঐ দিকে গেছে!


(২)

এদিকে ডাউন শান্তিপুর লোকাল অন্ধকার চিরে এগিয়ে চলেছে শিয়ালদার দিকে। অমলাদির পাশে বসে রীনা চুপ করে আছে। অমলাদির প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছিল ঠিকই। উত্তর দেওয়ার মতো মানসিকতা তখন তার ছিল না।

জানালা থেকে ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগছে তার গায়ে। ঘাম জুড়িয়ে এসেছে। শরীরের উত্তাপ কমেছে। চোখ বুজে রয়েছে।

লোকের চেঁচামেচি যেন তার কানে ঢুকছে না। ঢুকবেই বা কি করে?

ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে কবিতার মুখে শোনা কথাগুলো তার গায়ে এখন কাঁটা দিচ্ছে। সে যেন চোখ বন্ধ করে সে সব দেখছে বিস্ময়ে বিস্ময়ে।

...ইদানিং নাকি পবন বটতলার যায় না। সেখানকার পাট প্রায় তুলেই দিয়েছে।

পবন আর ঐ আফগানি শালওয়ালা মিলে এই ভাড়া ঘরে রীনার অনুপস্থিতিতে মাঝে মাঝে রাতে মদের আড্ডায় মেতে ওঠে। কত রাতে সে আসর ভাঙত, তা কবিতা টের পেত না। ফিসফিস করে কি সব কথা বলত দুজনে। পবনের হাতে মাঝে মাঝে টাকা গুঁজে দিত। কেন দিত, আর তার বাবাই বা কেন নিত, তা তার ছোটো মাথায় ধরা দিত না।

যে সব রাতে পবন যখন বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকত, সেই সময় ঐ শালওয়ালা কবিতাকে জোর করে কাছে ডেকে নিত। জড়িয়ে ধরে, জোরে জোরে তাকে আদর করত। লোকটার মুখ থেকে মদের গন্ধ ভুর ভুর করে বেরত। কবিতার দম আটকে আসত সেই গন্ধে। গা গুলিয়ে উঠত, বমি পেত। খোঁচা খোঁচা দাড়ি তার নরম মুখে, বুকে ফুটে যন্ত্রনা দিত। বুকটাতে যখন খামচে ধরত, তখন কেমন জ্বালা করত!

হাঁসফাঁস করত সে। কোনোক্রমে জোর করে ছাড়িয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে দিত। এমন কতদিন হয়েছে তার হিসেব নেই।

কবিতা দিন দিন ভয়ে কেমন জড়সড় হয়ে যাচ্ছে। কাউকে কিছু বলতে পারে না। একদিন চেঁচিয়ে উঠেছিল বলেছিল …মা ফিরলে, মাকে বলে দেবো।

তখন তাকে ভয় দেখিয়েছিল …ঔর একবার চিল্লায়েগি তো তেরে বাপকো হম মার ডালেঙ্গে। বলেই ধারালো চাকুটা বের করে তার চোখের সামনে ঘোরাচ্ছিল। …ঔর সুন, কিসিসে কুছ নেহি বতানা।

চকচকে চাকুটা আলোয় ঝলসে ঝলসে উঠছিল বারবার। ভয়ে কাউকে কিছু সাহস করে বলতে পারেনি।

স্কুল থেকে তার আর ফিরতে ইচ্ছে করত না। প্রতিদিনই ভাবে আজ মাকে বলে দেবে। কিন্তু মা তো রোজ বাড়ি থাকে না। বাবা নেশা করে বুঁদ হয়ে থাকে। সে মনে মনে ভাবে, শোনালে বাবা হয়তো বিশ্বাস করবে না।

শেষে ভেবেছিল পড়ার আন্টিকে বলে দেবে। কিন্তু কিসের লজ্জা আর ভয় তার মুখ যেন চেপে ধরে আর বলতে দেয় না। প্রতিদিন পার হয়ে যায়, একদিনও হয়ে ওঠে না।

এসব ঘটনা এখন রীনার মাথায় কিলবিল করছে। মেয়েকে নিয়ে এখন সে কি করবে? কোথায় যাবে? তবে কি কাজের বাড়ি যাবে? কিন্তু সেখানে ক'দিনই বা থাকবে? তাহলে কি কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে মেয়েকে রেখে আসবে?

না, না! রাখলে তা কেউ তাকে ঠিক খুঁজে নেবে।

পবনের জন্যই তারা আজ এই অনিশ্চিতাময় জীবনে পা বাড়িয়েছে। মেয়ের জীবনটা বুঝি নষ্ট হয়ে গেল। এই বিপদের জন্য তাকেই বেশি দায়ী বলে মনে হচ্ছে তার। অকর্মণ্য, মাতাল, স্ত্রী-কন্যা-সংসার কিছুর কর্তব্য করতে অপারগ। কোথা থেকে ঐ আফগানি শালওয়ালাটা এসে জুটেছিল কে জানে!

তার সঙ্গে জুটে দিনরাত তাস পিটে বেরিয়েছে আর মদ গিলে বুঁদ হয়ে থেকেছে।

এতদিনে সে যে পবনকে চিনত, এ পবন সে পবন নয়! তবে কি সে তাকে এতদিনে চিনে উঠতে পারেনি? আর সে এতদিন ঐ লোকটার সঙ্গে ঘর করল কি করে? নিজের পরিবার-স্বামী-সংসার করে করে হাড় মাস জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেল তার। একটুখানি শান্তি সে কোথাও পেল না।

না পবনের কাছে, না শ্বশুরবাড়িরতে, না এই ভাড়া বাড়িতে। অথচ পবনের জন্য নিজের গহনা বিক্রি করে তার অপারেশনের টাকা দিয়েছে। নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে ওকে সারিয়ে তুলেছে! দিন নেই, রাত নেই, ওর পাশে থেকেছে।

ওদের যৌথ পরিবারে গায়ে-গতরে খেটেছে। আয়ার কাজ করে টাকাও ঢেলেছে সাধ্যমত। অথচ ওর বিপদের দিনে ওর গোটা পরিবার, আত্মীয়-স্বজন কেউ কুটোটিও দেয়নি। রাগে, ক্ষোভে, অসহায় হয়ে একটা ঘর ভাড়া করেছে।

পবন তখন হাসপাতালে।

তাকে জানতেও দেয়নি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে তাকে সরাসরি নিয়ে এসেছে এই ভাড়া বাড়িতে। ঘর ভাড়ার টাকা, সংসার খরচ, মেয়ের পড়াশুনা, সবই তার টাকায় চলে। সব কিছু চালাতে তার নাভিশ্বাস যেন ফুরিয়ে আসছে। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে চলেছে।

আর এদিকে পবন সেই থেকে ড্রাইভারি ছেড়ে কয়েক মাস ঘরে বসে। একটা পয়সাও উপার্জন করে না।

সকাল-বিকাল মোড়ের বটতলার চা দোকানে তাস পিটে চলেছিল। তাও মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে মেয়েটাকে দিনের পর দিন ওই নরকে ঠেলে দিয়েছিল, তা সে ঘুণাক্ষরেও জানতেও পারেনি।

কেমন একটা অপরাধ বোধ তাকে যেন কুরে কুরে খাচ্ছে।

পবনকেও ক্ষমা করতে পারছে না। একটা অনিশ্চিত ভয়ঙ্কর অদৃষ্ট তাকে যেন গিলে খেতে আসছে।


(৩)

আজ শরীরটা রীনার ভালো লাগছিল ছিল না । গা'টা বেশ গরম গরম। খুকখুক করে কাশি হচ্ছে। রাতে তাই কাজে যাবে না বলে অলস দৃষ্টিতে পড়ন্ত বিকেলে বাইরে তাকিয়ে ছিল। আজ যেন অন্যরকম লাগছিল বাইরের জগতটা।

শীতের শরীরে একটু একটু করে বসন্তের আগমন ঘটছে। গাছের ফাঁকা ডালে নতুন নতুন পাতা গজিয়েছে। পড়ন্ত বিকেলের নরম রোদে তারা একটা অমোঘ আকর্ষণে রীনাকে টানছে দূরে, দূরে কোথায়!দূরের আকাশটার নানা রঙের মেঘ তাকে যেন ডাকছে আর ভেসে যাচ্ছে কোন ঠিকানায়।

মনে মনে সেই মেঘেদের রথে চড়ে সে তাদের নানান প্রশ্ন করে চলেছে।

কোনো প্রশ্নের উত্তর তারা দিচ্ছে না। শুধুই তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে দূরে, বহু দূরে। কিছুই তার চেনা লাগছে না। একঝাঁক পাখিও একটা লম্বা সারি দিয়ে ভেসে যাচ্ছে উত্তর আকাশে। তার মনে হচ্ছে …ইস, সে যদি ঐ পাখিদের মতো হতো, তাহলে তার এত কষ্ট থাকত না।

সঙ্গে সঙ্গে কবিতার মুখটা মনে পড়ে যায়। সে আবার ফিরে আসে। চোখ পড়ে তার বাড়ির পিছনটায়।

তার বাড়ির পিছনটায় হাত তিনেক পরেই একটা পুকুর, তাকে যেন হাত বাড়িয়ে কতবার ডাকছে। সে দিকে তার কানই নেই। কেবল তাকিয়ে থাকে ঐ পুকুরের পরেই ছোট্ট এক টুকরো জমিটায় আর ঝোপঝাড়ে অর্ধেকটা ঢাকা কয়েকটা বাড়ির দিকে। ছোট্ট জমিটার কচি কচি ঘাসের সবুজ মখমলে আভা তার দিকে তাকিয়ে কিসের যেন ইশারা করে। সে বুঝেও ধরা দিতে চায় না।

গাছেদের ছায়া পড়া ঐ পুকুরের দিকে তাকিয়ে দেখে, জলে হাঁসগুলোর কেউ আলতো করে ভেসে আছে, কেউ পাড়ের গায়ে কাদায় ঠোঁট দিয়ে কি খুঁজছে তো খুঁজছে।

জানালার রড ধরে, গা এলিয়ে, হেলান দিয়ে এসব দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সে। গায়ের আঁচল কখন গেছে খসে, তার খেয়াল নেই।

তার উন্নত, সুডৌল স্তনযুগল ব্লাউজের বন্ধনী ছাপিয়ে ঘরের আবছা আলোয় যেন ভেসে আছে। গোলাপি ঠোঁট দুটোও জেগে আছে অনাবিল স্নিগ্ধতায়।

পাখার হাওয়ায় দু'একটা খোলা চুল মুখের কোমলতায় বিচরণ করছে সন্তপর্ণে।

হাঁসগুলো কাঁক কাঁক করে ডানা ঝাপ্টাতে ঝাপ্টাতে চেঁচিয়ে উঠতেই সে যেন নিজের মধ্যে ফিরে আসে। পিছন ফিরে ঘরে তাকাতেই আঁতকে ওঠে।

দরজায় হেলান দেওয়া সেই শালওয়ালা। লম্বা শরীর নিয়ে দরজা আটকে শিকারীর মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক লোলুপ দৃষ্টিতে। কতক্ষণ ধরে সে তার অর্ধ-অনাবৃত শরীরে সাঁতার কাটছিল কে জানে! চোখাচোখি হতেই এখন সে যেন এই আধো-আলোকিত ঘরে তাকে গিলে গিলে খাচ্ছে।

…আপনি এখন এখানে কেন? কি-কি-কি দরকার এখানে? যা-যা-যা-যান এখন।

বলতে বলতে শাড়ির আঁচলটা গায়ে তুলছে। নজর রয়েছে তার দিকে। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দেওয়ালে সেঁটে যাচ্ছে সে।

লোকটা জিভ বের করে ঠোঁটে উপর নিচ বোলাতে বোলাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। গায়ের গেঞ্জিটা জোর করে টান মেরে খুলে বাঁ হাতে ছুঁড়ে ফেলল কোন দিকে তার খেয়াল নেই। কেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তাকে।এগিয়ে আসছে তার দিকে।

…আমি চেঁচাবো কিন্তু। যা-যা-যা-যান ব--ব-লছি।

ততক্ষণে লোকটা রীনাকে জাপ্টে ধরেছে। তার বাহুবন্ধে রীনার শরীর ছটফট করছে। জিভ দিয়ে তার গলা, বুক চাঁটছে। নরম গোলাপি ঠোঁট চুষে চুষে রক্তাভ করে তুলেছে। রীনা মরিয়া হয়ে উঠেছে।

দুহাতে লোকটাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ব্যর্থ হচ্ছে বারবার।

এখন বৃথা চেষ্টায় চেঁচাতে সুরু করল। তাদের ভাড়া বাড়ির লাগোয়া বাড়ির কেউই নেই। কোথায় তারা বেড়াত গেছে, তা তার অজানা। অন্য বাড়িগুলো তাদের ভাড়াটে বাড়ির থেকে একটু দূরে। সেই আওয়াজ কোথায় যেন ব্যর্থ হয়ে ফিরছে।

যতই ব্যর্থ হচ্ছে ততই সে কোথায় যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।

লোকটা রীনাকে জোর করে মেঝের উপর ফেলে তার বিধ্বস্ত শরীরের উপর উঠে ব্লাউজটা টেনে ছিঁড়ে নিটোল সুঠাম স্তনের উপর কামড় দিচ্ছে পিশাচের মতো।

গলা বুজে এসছে রীনার। পরনের শাড়ীটাও নেই। কোমরের সায়াটা রয়েছে অবিন্যস্ত হয়ে। মাথার একরাশ চুল মেঝে রয়েছে লুটিয়ে। অসহায়ের মতো কাঁদছে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে কানের পাতা বেয়ে।

…আমাকে ছেড়ে দাও। তোমার দুটো পায়ে পড়ি। আমাকে ছেড়ে দাও...

কবিতা মাঠে গিয়েছিল খেলতে। ফিরে ঘরের ভেতর ঢুকতে গিয়ে থমকে যায় দরজার কাছে। পড়ন্ত বিকেলে ঘরের এই আবছা আলোয় তার মায়ের শরীরের উপর লোকটা শুয়ে এ কি করছে ! রাতের অন্ধকারে তাকে যেমন জোর করে তার কচি বুকে খামচে খামচে ধরে, দাঁতের কামড় দেয়, ঠিক তেমনি লোকটা তার মায়ের বুকে খামচে খামচে ধরছে, কামড়াচ্ছে। তার মনে হলো, তার মতো তার মাও বুঝি যন্ত্রনায় তেমন করে কাঁদছে।

দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। ভয়ে চেঁচাতে ইচ্ছে করছে। কান্না পাচ্ছে। কান্না গিলে পাথরের মত দাঁড়িয়ে ছিল সে। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।

এখন তার কানে তার মায়ের অসহায় আর্তি বিঁধছে …আমাকে ছেড়ে দাও। তোমার দুটো পায়ে পড়ি। আমাকে ছেড়ে দাও...

বারান্দায় রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে গেল সে। শিলের উপর থেকে নোড়াটা দুহাতে তুলে নিয়ে লোকটার পিছন থেকে এসে সজোরে মারল তার মাথায়।

...আআআআ…

দীর্ঘ আর্তনাদে লোকটা তার মায়ের শরীর থেকে গড়িয়ে পড়ল মেঝে।

রীনা উঠে বসল মেঝের উপর। কবিতা রীনার কোলের মধ্যে বসে জড়িয়ে ধরল তাকে।

…এ কি তুই করলি মা! এ কি করলি?

লোকটার সাড়া নেই। ঘর প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে।

লোকটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে মেঝে। মাথার নিচ থেকে কি একটা কালো জলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে বেয়ে যাচ্ছে মেঝ দিয়ে।

আতঙ্ক চেপে বসেছে তাদের শরীরের কণায় কণায়।

মা-মেয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। চোখের সামনে সবকিছু যেন আরো অন্ধকার হয়ে এল।

বাইরে থেকে সরলার মা চেঁচাচ্ছে

… ও বউ কি হল রে? চেঁচাচ্ছিলি কেন রে? কি হল সাড়া দিচ্ছিস না কেন?

ঘরের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছে আর বলছে …কি জানি বাপু, এদিকে ঘর অন্ধকার। কারো সাড়া নেই। যা পারে হোক গে! কেউ নেই নাকি! ছোঁড়াটাই বা গেল কোথায়?

সরলার মায়ের আওয়াজ পথ ধরে মিলিয়ে যেতেই দরজার কোণ থেকে মায়ে-ঝিয়ে বেরিয়ে এল। রীনা পাগলের মতো নোড়াটা হাতে নিয়ে জানালার রড গুলোয় ঠুকতে থাকল। কাঠের থেকে রড গেল ছেড়ে। নড়াটাকে পুকুরের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এখন অন্ধকারে পাথরের মতো বসে রয়েছে মেয়ের হাত ধরে। ভয়ে ঘাম আসছে সারা শরীর জুড়ে।

কবিতা রীনাকে ডাকছে আর গা নাড়া দিচ্ছে …মা, মা।

সেই মা ডাক তার কানে ঢুকলেও কোনো সাড়া দিচ্ছে না। একটু দূরে পাশের বাড়ির থেকে শাঁখের আওয়াজ বাতাসে ভাসছে। ভাবছে, এমন সময়ে তার ঘরের প্রদীপ জ্বলত। কিন্তু আজ এ কি ঘটে গেল! কবিতাকে আরো জোরে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কপালে ঘনঘন চুমু খেতে খাচ্ছে।

এদিকে বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কারা যেন জটলা পাকিয়ে কি সব বলছে। যা ভয় করছিল তাই।

শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তার। হাত-পা যেন ভেতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে।

তড়িঘড়ি করে রীনা পোশাক পাল্টে জানালা দিয়ে গলে লাফিয়ে পড়ল পিছনে। মেয়ের হাত ধরে টানছে। কারা যেন বারান্দা দিয়ে ঘরের দিকে আসছে। কবিতা আটকে গেছে। জোর করে টেনে নিয়ে মেয়ের হাত ধরে রাস্তার দিকে দিল দৌড়।

অন্ধকারে তাদের চেনা যাচ্ছে না। ঠিক সেই সময় কারা যেন তাদের গলির দিক থেকে তাদের দিকে দৌড়ে আসছে আর চেঁচাচ্ছে

…ঐ দিকে গেছে। ঐ দিকে…


…এই রীনা, রীনা, নামবি না? গাড়ি উল্টোডাঙায় তো ঢুকে গেল। চল, চল, চল!

রীনা হুড়মুড় করে ওঠে পড়ে। অমলাদির কোলে মাথা রেখে কবিতা কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেও পারেনি।

ঠেলাঠেলি করে মেয়েকে নিয়ে রীনা নামলো স্টেশনে। মেয়ের একহাত রয়েছে রীনার হাতে। তাকে টেনে নিয়ে চলল ভিড় ঠেলে। মায়ের হাতের টানে কবিতাও এলোমেলো পা ফেলে চলল এক হাতে চোখ ঘসতে ঘসতে।

গাড়ির পর গাড়ি টপকে, ফুটপাত অতিক্রম করে রীনারা পথের বাঁকেই মিলিয়ে গেল বড় বড় বাড়িগুলোর আড়ালে।

0 comments: