0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক

সোয়ানার রহস্যময় মানুষ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত


পুরো ব্যাপারটা শুনে ফ্রান্সেস্কো চমকেছিল না ভয় পেয়েছিল সেটা সে নিজেও ঠিকঠাক বুঝতে পারছিলো না। সে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল; তবে সৌজন্য হারায়নি। যথেষ্ট শান্ত এবং ভদ্রভাব বজায় রেখেই কোনোমতে নগরপালের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল সে। 

‘লুসিনো স্কারাবোটা’র ঘটনা এবং যেটুকু সে নগরপালের কাছ থেকে শুনেছিল, সবকিছু বিস্তারিত জানিয়ে ফ্রান্সেস্কো চিঠি লিখে পাঠালো তাঁর উর্দ্ধতন বিশপকে। আট দিন পরে বিশপের উত্তর এলো। তিনি ফ্রান্সেস্কোর বিশেষ প্রশংসা করেছেন। তাঁর প্রদেশের সমস্ত খবর সে জানিয়েছে, সেটা খুবই ভালো কথা। তবে এলাকায় এরকম পাপ এবং দুষ্কর্ম সংঘটিত হয়ে থাকলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর বিচলিতবোধ করার কথা; ভারাক্রান্ত বোধ করার কথা। কিন্তু সে যে বিশেষভাবে দুষ্কৃতকারীদের মুক্তির কথা ভাবছে, সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছে-- এটাও এই যুবক যাজকের প্রশংসনীয় কৃতিত্ব। উর্দ্ধতন বিশপ এবং চার্চ, সব্বার বিশেষ আশীর্বাদ এবং সান্ত্বনা থাকবে তাঁর এই উদ্যোগে, যাতে কোনো পাপাত্মা ঈশ্বরের কৃপা থেকে বঞ্চিত না হয়। 

প্রদেশের মন্ত্রণালয় ও গির্জা থেকে আইনগত অনুমতি পাওয়া এবং তুষারপাতের জন্য ঠাণ্ডা শীতল আবহাওয়া, এই দুটো কারণে আল্পসের সান্টা ক্রোস অবধি যেতে পারছিলো না ফ্রান্সেস্কো। যাই হোক, তাকে অনুমতি দেওয়া হল এবং সঙ্গে গ্রামের একজন লোক দেওয়া হল। এই সব ব্যবস্থা করতে করতে মার্চ মাস প্রায় শেষ হয়ে এলো। সামনেই ইস্টার; পাহাড়ে প্রচুর ধস নেমেছিল; জলপ্রপাতের নিচে খাদের দিকে পাহাড়ের ঢালের কিছুটা অংশ ধসে ক্ষয়ে তলিয়ে কেমন যেন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছিলো। অবশ্য পাহাড়ে যেসব জায়গায় সূর্যের আলো পৌঁছায়, সেখানে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছিল রঙে রঙে। 

ফ্রান্সেস্কো সচেতন ছিলনা যে সোয়ানা আর আশেপাশের পাহাড়ি এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করছে কিনা! কিন্তু পথে চলতে চলতে বসন্তের রঙের দোলা কখন যেন তাঁর রক্তে এসে মিশে গেলো। নতুন পাতার আর রঙিন ফুলের স্বর্গীয় রং যেন কখন তাঁর মনে এক অপার্থিব ভাবের স্পর্শ এনে দিলো। গ্রামের মাঝখানের মাঠের চারপাশে চেস্টনাট গাছগুলো যেন সবুজ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাঁর দিকে। বাচ্চাগুলোর চেঁচামেচি, গির্জার ছাতের উপরে বাসা করা চড়াইপাখিদের কিচিরমিচির, সমস্ত আওয়াজ তাঁর কাছে ভারি মধুর বলে মনে হতে লাগলো। রঙবেরঙের সোয়ালো পাখির ঝাঁক পাহাড়ের পাথুরে দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে বাসা করেছে। অনেক উঁচুতে যেখানে মানুষ পা রাখতে পারবেনা, সেখানে বাজপাখিদের ইতিউতি উড়ান দেখা যাচ্ছে। একজোড়া বিশাল বাদামী বাজ রাজকীয় ভঙ্গিমায় উড়ে যাচ্ছে, আকাশের শূন্যে বিছিয়ে দিয়েছে তাদের ডানার আধিপত্য।

সবজায়গায়, শুধু বাতাসে বা চেস্টনাটের মুকুলিত শাখায় নয়, ঘাসের ফাঁকে ফুটে থাকা ড্যাফোডিলে নয়, মানুষের মনে, চাষাভুষোরা যারা পাহাড়ের ধাপের গমের ক্ষেতে বা আঙুরের কুঞ্জে কাজ করছিল, তাদের পুড়ে যাওয়া উজ্জ্বল তামাটে বাদামী মুখে, তাদের লাঙলের আগায়, কাস্তের বা ছুরির ডগায়, নেমে এসেছিল রবিবারের সকালের মত উজ্জ্বল বসন্তের খুশি। ইস্টারের ভোজের জন্য কারো কারো বাড়িতে আবার ভেড়া জবাই করা হয়েছিল; তাদের বাড়ির সামনের দরজায় পিছনের পা দুটো বেঁধে সেগুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। 

মেয়েরা যারা কাপড় কাচার ঝুড়ি নিয়ে মার্বেলের ফোয়ারার সামনে জমায়েত হয়েছিল আর নিজেদের মধ্যে জোরে জোরে কথাবার্তা আর হাসিমস্করা চালিয়ে যাচ্ছিল, তারা তরুণ যাজককে আর তাঁর সঙ্গীকে দেখে একটু চুপ করলো। গ্রাম থেকে বেরোবার মুখে আরও একটা ফোয়ারা আছে ম্যাডোনার একটা মূর্তির সামনে। সেখানেও ধোপানীরা কাচাকুচি করছিল। সেই ফোয়ারাটা বেরিয়ে এসেছে একটা পাথুরে ফাটলের ভেতর থেকে আর বিশাল একটা প্রাচীন মার্বেলের আধারে এসে জমছে সেই জল। এই দু জায়গায় ফোয়ারার মার্বেলের আধার কিছুদিন আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে। চা বাগিচার একপাশে চেস্টনাট আর ওক গাছের জঙ্গলের ভিতরে প্রায় হাজার বছরের পুরানো এই আধারদুটি মাটিচাপা পড়ে ছিল আইভিলতা আর বুনো চিরহরিৎ গুল্মের নিচে। সেগুলো নিয়ে এসে ফোয়ারার সামনে স্থাপন করা হয়েছে জল ধরে রাখার জন্য। 

ফ্রান্সেস্কো চলে যাচ্ছিল, হ্যাঁ... কি মনে হতে ফিরে এসে একটু থামলো মাতা ম্যাডোনার মূর্তির সামনের কুঞ্জে। হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নিচু করে প্রার্থনা করতে গিয়ে লক্ষ্য করল সে রঙিন ফুলে মৌমাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদিকটায় সে আগে আসেনি। গ্রামের উপরের দিকের ধাপে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাবার অংশটা আগে সে দেখেনি। গ্রামের মূল অংশটা নিচের ধাপের দিকটায়, যেখানে চার্চ এবং তাকে ঘিরে সাজানো বাগান, মাঠের চারপাশে চেস্টনাট, কমলালেবু আর সাইপ্রাস গাছের বাগান। কিন্তু উপরের দিকে অল্প কিছুটা, যেমন একশ পা গেলেই, গ্রামটা আর ততটা সাজানো নয়। সেখানে রয়েছে প্রকৃতির আপন খেয়ালে বেড়ে ওঠা আল্পাইন অরণ্য; মাঝেমধ্যে এক আধটা মেষপালকের ডেরা আর গরুভেড়ার খোঁয়াড়। নুড়িপাথরের চড়াই রাস্তা উঠে গেছে উপরে; দুবেলা মানুষ এবং গরুভেড়ার পাল যাতায়াত করে করেই হয়ত সেই নুড়িপাথরগুলো অনেকটা মসৃণ হয়ে গিয়েছে। ফ্রান্সেস্কো জনপদ ছাড়িয়ে উঠে যেতে লাগলো উপরের দিকে। সাভাগ্লিয়া নদী, যেটা নিচে সোয়ানার কাছে সুন্দর জল্প্রপাত তৈরি করেছে, সেই নদীর পাশ দিয়ে দিয়ে চলতে লাগলো সে। জল্প্রপাতের পরে নদীটা একটা গিরিখাতের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়ে মিশেছে আরও নিচের লুগানো হ্রদে।

যাজক আর তাঁর সঙ্গী কিছুক্ষণ চলবার পরে জিরিয়ে নেবার জন্য একটু থামলো। ফ্রান্সেস্কো তাঁর আলখাল্লার পকেট থেকে ডান হাত দিয়ে বের করলো একটা বড় রঙচঙে রুমাল। মুছে নিলো কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম। সাধারণভাবে একজন ইতালিয়ান যাজকের কাছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিশেষ পৃথক কোনো আবেদন নেই। কিন্তু এতটা উঁচুতে উঠে এসে এবং প্রায় পাখির চোখ দিয়ে দেখবার মত দৃষ্টিতে নিচের প্রকৃতিকে দেখবার পরে, যেকোনো কাঠখোট্টা অনুভূতিহীন মানুষও বিস্ময় প্রকাশ করবে। 

ফ্রান্সেস্কো নিচে সোয়ানার গির্জা আর গ্রামটা দেখতে পাচ্ছিল। ছোট্ট ছোট্ট পুতুলের ঘরবাড়ির মত দেখতে লাগছিলো সবকিছু। এখন তাঁর চারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়ের উঁচু উঁচু দেয়াল, মনে হচ্ছে সেগুলো আকাশ ভেদ করে আরও উপরে উঠে গিয়েছে। বসন্তের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে এক অলৌকিক ভাব এসে মিশলো তাঁর মনে। প্রকৃতির কোলে এই অসীম বিশালত্বের সামনে এসে তাঁর মন হারিয়ে গেলো কোন সুদূরে। অনুভব করছিল সে ঈশ্বরের মহিমার স্বরূপ, এবং একই সঙ্গে এই মহিমার সামনে সে কত ক্ষুদ্র সেটাও বুঝতে পারছে। এই ভাবনায় জারিত হয়ে সে তাড়াতাড়ি তাঁর বুকে এবং কপালে ক্রস ছুঁইয়ে নিল অভ্যস্ত মুদ্রায়; নাহ, কোনো অশুভ শক্তি কিংবা শয়তানকে কোনোভাবেই সে ঘেঁষতে দেবেনা তাঁর এই পবিত্র ভাবনায় এবং ধ্যানে। 

পথে চলতে চলতে আবার ধ্যানস্থ অবস্থা থেকে বাস্তবে ফিরে এলো তাঁর মন। কিছুক্ষণ পরে পাহাড়ের বাঁকে একটা উপাসনালয়ের ধ্বংসস্তুপের সামনে এসে দাঁড়িয়ে এলাকার আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনের ব্যবহারিক কর্মপদ্ধতি নিয়ে ভাবতে বাধ্য হল সে। খুবই ভগ্নদশা এই বাড়িটার, কোনোমতে ইটের পাঁজা দিয়ে খাড়া করে রেখেছে হয়তো এলাকার রাখাল আর মেষপালকেরা। তাঁর এলাকা থেকে এত কাছে এরকম কিছু রয়েছে সেটা সে জানতো না। একটু দেখে শুনে মোটামুটি ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করতে লাগলো সে। তাঁর নিজের গির্জায় প্রথম থেকেই পুরোহিতের বসবাস করবার ব্যবস্থা ইত্যাদি আছে। আগেই বলা হয়েছে যে সেটা গ্রামের একদম কেন্দ্রস্থলে। সুরক্ষিত প্রাচীর রয়েছে তাকে ঘিরে। একপাশে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে বয়ে যাচ্ছে উচ্ছল ঝর্ণা। সেই ঝর্ণা সোয়ানার গায়ে পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে চলেছে। গ্রামের ভেতরে সেতুর আর্চের নিচ দিয়ে, অজস্র বর্জ্য সঙ্গে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে; চা বাগিচা আর ফুলের বাগানে জলের যোগান আসে এই ঝর্ণা থেকেই। 
সেই জায়গা থেকে কিছুটা উপরে, পাহাড়ের মধ্যে একটু সমতল জায়গায় সে দেখতে পাচ্ছে এই বাড়িটা। সম্ভবত এটা এলাকার সবচেয়ে পুরানো উপাসনালয়; ছোট বাড়ি, মেরী মাতার। একখানা বাইজানটাইন মোজেইকের অবয়ব দেখা যাচ্ছে আসনের উপরে। খুবই পুরানো, জরাজীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সোনালি রঙের সূক্ষ্ম টানের সুন্দর ছবিখানি থেকে সর্বশক্তিমান যীশুর মুখখানি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। 

প্রধান গির্জা থেকে এই উপাসনালয়ের দুরত্ব খুব বেশি হলে তিনটে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে হবে। একই দুরত্বে সেন্ট আনার পাহাড়ে একটা খুব সুন্দর চ্যাপেল আছে। সোয়ানার উপরের দিকে এবং পেছন দিকে খুব উঁচু উঁচু খাড়াই পাহাড় আছে, যার মাঝে মাঝে সুন্দর উপত্যকা; সেই উপত্যকা ঘিরে মালার মত সেজে আছে জেনারাসো পর্বত। পেছনের দুর্গম খাড়াই পর্বতের নাম সেন্ট আগাথা; সেন্ট আগাথার নামে এই পর্বত, কারণ সেখানে তিনি আরও তিন জন সন্ন্যাসীকে নিয়ে সেখানে একটা চ্যাপেল বা উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কাছেই আরও একটা গ্রামে একখানা গির্জা আর তিনখানা উপাসনালয় আছে। এখানকার প্রায় প্রতিটা পাহাড়ে, হঠাৎ করে চলে আসা কোনো বাঁকে কিংবা কোনো ঝর্ণার ধারে ঈশ্বরের আসন, উপাসনালয় এসবের নির্মাণ দেখতে পাওয়া যায়। খ্রিস্টধর্মের উদ্ভবেরও বহু আগে থেকেই এই অঞ্চলে ভক্তির ঢেউ উঠেছিল। হয়তো বা প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ঈশ্বরের শরণাপন্ন হত মানুষ এখানে। তাই বহুযুগ থেকেই এই অঞ্চলে উপাসনালয়ের কোনো কমতি নেই। 

বর্তমান সময়ে অবশ্য এই সব উপাসনালয় রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের অধীনে। তরুণ ধর্মযাজক ফ্রান্সেস্কো টিসিনো প্রদেশের এই বৈশিষ্ট নিয়ে বিশেষ গর্বিত। অবশ্য একই সঙ্গে সে এটাও অনুভব করে যে মানুষের মনে এখন আর আগের মত ভক্তিভাব নেই, এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত তাঁর সহকর্মীদের মধ্যেও সে দয়ামায়া, ভক্তিভাবের বিশেষ অভাব লক্ষ্য করেছে। নাহলে কি আর এই পাহাড়ের মধ্যে এত সুন্দর জায়গায় একটা উপাসনালয় এরকম অযত্নে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকতে পারে? 

(চলবে) 
গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা

0 comments: