0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in

ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত


দ্বিতীয় পর্ব


গুহামুখে বুনোফুলের ঘন লতাপাতা সরিয়ে যখন গোরাচাঁদ গুহার ভিতরে ঢুকেছিলেন, তখন সেখানকার গুপ্ত প্রহরী ঢাকে সংকেত বোল তুলে খবর একটা পাঠিয়েছিল পেরোর কাছে। একজন দিকু(বহিরাগত লোক) গুপ্ত প্রবেশদ্বারে ঢুকে পড়েছে। পেরো ও জোহার সেইমুহূর্তে সঙ্গীন অবস্থা।জনজাতিদের সেখানে আশ্রয় দেওয়ার প্রায় একমাস পার হয়েছে। ওদের আচার ব্যবহার এতো রুক্ষ ও আদিম ছিল যে স্বামী স্ত্রীর যৌন সম্পর্কও গোপন রাখতে জানতো না। ঘর নিকোনো পরিষ্কার করে রাখা, যেখানে সেখানে মলত্যাগ না করা, আবর্জনা এক নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা ও যখন তখন বাধাহীন মদ্যপান না করা, এইসবের প্রশিক্ষণ চলেছে। ওরা ধীরে ধীরে সহবত শিখে নিয়েছে। ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে জোহাদের ওই অতি গোপন স্থান, বলতে গেলে এক পৃথিবীবিচ্যুত বিশল্যকরনী বাগানের পরিধি বিস্তৃত করতে হল। তার জন্যে জঙ্গল কেটে পাথর কেটে অনেকগুলো কুটির বানানো ও পথ তৈরি করা ও চাষের জমি তৈরি করতে প্রচুর মেহনত করতে হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু অমূল্য দুর্লভ ভেষজ ও ব্রাহ্মীপাতার রস সেবন করতে ওদের চারিত্রিক আদিম রুক্ষতা কমে এসেছে। ওরা অনেকরকম জ্ঞান ও ধ্যান ধারণা মাথায় নিতে পারছে ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে চাইছে। চেহারা ও গায়ের রঙের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সংস্কার? সংস্কার কোথায় যাবে? যে সময় ঢাকের রিলে মেসেজ পেরো ও জোহার কানে এলো, তখন এক ভয়ানক পরিস্থিতির মোকাবিলা করছিল তারা।

পাঁচ পাঁচটা পরিবারের জন্য পদ্ম দিঘীর পাশে এক একটা পাঁচ বিঘের মতো করে চাষের জমি তৈরি করা হয়েছে। এইভাবে দশটি ছোটোছোটো পরিবার একত্রে রাখা হলো... যাকে ওরা বাখুল বলে। এই বাখুলের মাঝে ধানের গোলা থাকার ও ধান গম ঝাড়াইয়ের ব্যবস্থা করা হলো। খেড়িয়া শবর, দুধ খেড়িয়া, ঢেলকি খেড়িয়া, গোলগো ভুনিয়া, সান্ডি গিদি, নাগো হো এবং আরো অন্য বনাঞ্চলের মানুষদের এমনভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হলো, যেন একই উপজাতির পরিবার এক বাখুলে দুটি না থাকে। জোহা ও পেরোর উদ্যেশ্য এই ধরনের মিশ্রণে এক নতুন উন্নততর প্রজন্ম তৈরি হবে, যাতে তথাকথিত উন্নত সমাজের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। চাঁচর ছাওয়া শক্ত পাথুরে আঠালো লাল মাটির তৈরি ঘর, নিকোনো মেঝে ও উঠোন... সব হলো। অলচিকি ভাষায় এক একটা বাখুলের নাম মস্ত চ্যাটালো পাথরে খোদিত করে পুঁতে দেওয়া হলো বাখুলের বাইরে।ক্ষেতগুলির মাটি তৈরি করে এক একটা ক্ষেতের জন্য বীজ ভাগ করে দেওয়া হলো।

এখন, জঙ্গলবাসীদের মধ্যে এক উপজাতিদের নিয়ম, নতুন জমিতে প্রথম বীজ ফেলার আগে নিজেদের মধ্যে কাউকে বেছে নিয়ে সেখানে তাকে বলি দেওয়া হয়। এই নরবলিকে ওরা ওটাঙ্গা বলে। বীজধান ফেলার আগে একটা অনুষ্ঠান করা হলো। মোরগ বেঁধে তাকে পুজো করে তালি দিয়ে কাঁসা ও মাদল বাজিয়ে গান ও নাচ হলো। দশটি পরিবারের একটি কিশোরকে অর্ঘ্য দেওয়ার জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। তাকে পদ্মমধুর তৈরি মদ আকণ্ঠ খাইয়ে প্রায় বেহুঁশ করা হয়েছিল। সকলে গান গেয়ে গেয়ে তার কড়ে আঙুল কেটে ফেলে সেই রক্ত মস্ত ধানবীজের গাদাতে যেই দিতে যাবে, অন্য তিন চারটি উপজাতি বাধা দিতে এগিয়ে এল। ওরা এই লোকাচার অমঙ্গল বলে মনে করে। তায় আবার নরবলি! কথা কাটাকাটি এবং শেষ অবধি অস্ত্র নিয়ে হানাহানির উপক্রম। জোহা ও পেরো ওদের নিরস্ত করে সমাধানে যেই বসবে, ঢাকের মেসেজ নিয়ে একজন দৌড়ে এসে খবর দিল। জোহা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। এই অঞ্চলের গোপনীয়তা বাইরের জগতে প্রকাশ হলে খুব বিপদ হয়ে যাবে। তাছাড়া যে উদ্দেশ্যে বনাঞ্চলের জাতিভাইদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, তা সফল হবেনা। তাই যে কোনো উপায়ে ওই বহিরাগত মানুষটিকে বাধা দিয়ে তাকে সাময়িক স্মৃতিলুপ্ত করে ফেরত পাঠাতে হবে। এই কাজে তাকে নিজেই যেতে হবে।

জোহা পেরোকে বলল -তুমি ওদের এই সমস্যার সমাধান করো। যত শিগগির আমাকে ওই প্রবেশমুখে যেতেই হবে। আমাদের অস্তিত্বের ভয়ানক শঙ্কট দেখা দিয়েছে। তার মোকাবিলা আগে করা দরকার। যে লোকটি গুপ্ত গুহাপথ দিয়ে ঢুকেছে, তাকে যে কোনো উপায়ে থামানো দরকার। তুমি এখানটা সামলাও। আমাদের বুজুর্গ বিজ্ঞজনেরা এখানে থাকলো। ওদের পরামর্শ আগে নেওয়া দরকার। মনে রাখবে, মানুষ হত্যা এখানে নিষিদ্ধ।আর হিংসা এদের সবাইকে ভুলে যেতে হবে। তাই আমাদের গুণীনকে দিয়ে ভেষজ আরক তৈরি করিয়ে ওদের খাইয়ে দিতে হবে।

-ওদের আদিমকালের সংস্কার কি জড়িবুটি মুছে ফেলতে পারবে? এইসময় গুরুজীকে খুব মনে পড়ছে। গুরুজী ওদের ঠিক বুঝিয়ে দিত।

-গুরুজী কে?

-গোরাচাঁদ। অবশ্য আমাদের সাথে জেরেকা মা আছে। তারও অনেক বিদ্যা। দেখি তার পরামর্শ কতো কাজে লাগে।

-ওই মানুষটিতো এখানে এসেছিলেন। তাকে আবার এখানে নিয়ে এলেই হয়।

জোহা আরও তিনজন বলিষ্ঠ মানুষকে নিয়ে রওনা দিল সুড়ঙ্গপথের দিকে। জোহা যখন সুড়ঙ্গ প্রবেশ মুখে পৌছল, তখন বেলা গড়িয়ে বিকেল।সেখানে সাবধানে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে এসে দেখে, মসৃণ সাদা গ্রানাইট চট্টান পাথরে গোরাচাঁদ ঘুমিয়ে রয়েছে। গুহার ভিতরে তখনো দিনের আলো। জোহা ওঁকে দেখেই চিনতে পারলো। দেখেই মনে মনে ঠিক করলো, ওঁকে নিয়ে যেতে হবে। ওঁর মতো মানুষের সেখানে একান্ত প্রয়োজন। আর কিছুক্ষণ আগে তো পেরোর সাথে কথা হয়েছে, তবে বাইরেটা একবার দেখে নেওয়া জরুরি। যদি ওঁর সাথে বা পিছনে কেউ এসে থাকে! সাথের দুজনকে নির্দেশ দিতে তারা সাবধানে বাইরেটা পর্যবেক্ষণ করতে চলে গেল। জোহার সাথে রইলো ভেষজ অভিজ্ঞ গুণীন। জোহা তাকে সাময়িক স্মৃতিলোপের আরক দু ফোঁটা গোরাচাঁদের মুখে দিতে বলতেই উনি ঘুম থেকে জেগে সরাসরি জোহার দিকে তাকালেন। গোরাচাঁদ দেখলেন, ফর্সা সুন্দরী একটি কমবয়েসী মেয়ে তাঁর দিকে ঝুঁকে রয়েছে। এটি শহরের বা বিদেশী মেয়ে নয়। মুখ ও শরীরের গড়ন অস্ট্রীয়-এশিয়াটিক আদিবাসীদের মতো। মুণ্ডারি বা ওরাওঁ বললে ভুল হবেনা। কিন্তু ফর্সা?

গোরাচাঁদ ঢোক গিললেন। গলা শুকিয়ে কাঠ। খুব তেষ্টা পেয়েছে। দুপুরের অনেক আগে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এখন সন্ধে হব হব সময়ে উঠলেন।এত শান্তিতে আর নিশ্চিন্ত আরামে ঘুম বোধহয় দীর্ঘদিন হয়নি। গোরাচাঁদ হঠাত্‍ একবার মুণ্ডারি ভাষায় জিজ্ঞেস করে বসলেন -আম নুতুম দ?(তোমার কি নাম?)

-জোহা।

গোরাচাঁদ বুঝে গেলেন, এই মেয়েটি ট্রাইবাল সম্প্রদায়ের। মেয়েটির মুখে স্মিত সরল হাসি দেখে মুগ্ধ ও নিঃসন্দেহ হয়ে উনি জোহাকে বললেন-দা এম মে (আমাকে একটু জল দাও)।

জোহা এর অপেক্ষাতেই ছিল। আসার সময় গুহার ভিতরে জলাশয় থেকে জল পান করে সঙ্গে করে নিয়েও এসেছে। ওই সরোবরের জলে নিশ্চয়ই কিছু রয়েছে যা পান করলে গায়ে শক্তির অনুভব হয়। জোহা সেই জলে দু ফোঁটা ভেষজ ওষুধ মিশিয়ে ওঁকে দিতেই উনি সবটাই খেয়ে ফেললেন।জোহা নিজের ভাষায় এই জঙ্গল পাহাড় এলাকা নিয়ে গোরাচাঁদের সাথে গল্প জুড়ে দিল। কিছুক্ষণ পর যখন বাইরে থেকে সাথী দুজন ফিরে এসে বলল সব ঠিক আছে, তখন জোহা গোরাচাঁদকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাবেন? কিছুক্ষণ মুখ ঢেকে বসে থেকে বললেন, আমার এখন কিছুই মনে পড়ছেনা... কোথা থেকে এসেছি... কোথায় যেতে হবে। জোহা বুঝলো, ওষুধে কাজ হয়েছে। সে গোরাচাঁদকে উঠে ওদের সাথে চলতে বলল। সন্ধে হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে যেতে হবে। না হলে জলাশয়ের ভিতরে অনেকগুলো গুহামুখের গোলকধাঁধায় ঘুরে মরতে হবে।এইভেবে ওরা দৌড়ে দৌড়ে গুহাপথ দিয়ে নিচে নামতে লাগলো। গোরাচাঁদ এই বয়েসেও তাদের সঙ্গে দৌড়তে লাগলেন এবং অবাক হয়ে গেলেন, তাঁর শরীরে এত জোর এলো কি করে?

0 comments: