0

ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in

ধারাবাহিক


পায়ের শব্দ 
সোমঙ্কর লাহিড়ী



১৬ 

পরদিন অফিসে যখন পুর্নবাবুর মৃত্যু সংবাদটা দিতে হল তখন পরেশ সামন্তর নিজেরই গলা বুজে আসছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে অফিসের সবাইকে বললেন, 

লোকটা ভয়ঙ্কর তাই আপনাদের সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছি। নিজেরা সাবধানে কাজ করুন। চোখ কান খোলা রাখুন। সন্দেহজনক কোন লোক বা কোন কিছু যদি দেখেন তবে অন্যের সাথে কথা বলুন। প্রয়োজনে পুলিসকেও জানান। 

নিজের চেম্বারে গিয়ে মিমিকে ডাকলেন, 

খুব ভালো কাজ করেছ। এখন আমাদের কোনো ক্লায়েন্টের কাজ না নিজেদের ফ্যামেলীর একজনের কাজ করতে হবে সেটা মনে রেখ। 

মিমিকে কিছু বলতে হল না, একটা ফাইল বার করে সামন্তের টেবিলে রেখে বলল, স্যার লাস্ট ছ মাসে আমরা যে কটা ম্যান হান্টের কাজ করেছি এখানে তার রিপোর্ট রয়েছে। খুব বেশী নয় নাম্বারটা, মাত্র কুড়িটা। যে যে ডেটে ক্লায়েন্টরা এসেছিল সেই ডেটের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ নিয়ে রেখেছি। আপনি বললেই দিয়ে দেবো। 

পরেশ সামন্ত অবাক চোখে মিমিকে দেখতে লাগলেন, মিমির কথা শেষ হওয়ার পরে বললেন, 

তোমার জন্য তো আমার নিজের গর্ব হচ্ছে মিমি। ডান আ ব্রিলিয়ান্ট জব। 

মিমি কিছু বলতে গিয়ে মাথাটা নীচু করে নিল, তারপরে চোখের জল আটকানর জন্য রুমাল বার করল। খানেকটা বাদে যখন নিজেকে সামলাতে পারল, তখন ভারী গলায় বলল, 

স্যার পুর্নদা আমার দাদার চেয়েও বেশী ছিলেন। এটুকু করব না? 

সামন্ত বললেন, 

এনিওয়ে, তুমি এখন ডেট ধরে ফুটেজ গুলো দেখতে থাকো, কোনকিছু অস্বাভাবিক দেখলে আমাকে জানিও, আমি এই ফাঁকে আমার পুরানো বন্ধুদের সাথে একটু কথাবার্তা বলে সব ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টা করি। 

ঠিক এক ঘণ্টা বাদে মিমি এসে বলল, 

স্যার দুটো আন ইউজুয়াল জিনিস পেয়েছি। 

কি? 

স্যার আমাদের অফিসের দরজার উপরে যে ক্যামেরাটা রয়েছে আর ওয়েটিং এরিয়াতে যে ক্যামেরাটা রয়েছে সেই দুটোতে একটা অদ্ভুত ইন্টারফিয়ারেন্স শুরু হয়ে যাচ্ছে ফলে ছবি কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এর ফলে অফিসের দরজার কাছে কে এসেছে আর ওয়েটিং হলে কে বসে রয়েছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। 

চল দেখি। 

সামন্ত দেখতে লাগল মিমি ল্যাপ্টপের মনিটরে। একটা লোক আসছে মাথায় স্ন্যাপব্যাক টুপি। সাধারণ প্যান্ট শার্ট পরা। দরজার কাছে আসতে না আসতেই ক্যামেরার ছবি লাফাতে শুরু করে দিল। তারপরে লোকটাকে দেখা গেল দ্বিতীয় ক্যামেরায়। লোকটা ক্যামেরার দিকে এগিয়ে এসে বসল আর ওয়েটিং হলের ক্যামেরার ছবি লাফাতে শুরু করে দিল। মুশকিল হল সামনে শেড থাকার জন্য মুখটা দূর থেকে পরিষ্কার নয়। আর দুটো ক্যামেরাই উপরের দিকে। ফলে লোকটাকে কেমন দেখতে সেটা বোঝা যাচ্ছে না ঠিক করে। জুম করেও একই অবস্থা। 

দ্বিতীয় যেটা পাওয়া গেছে সেটাতেও ঐ এক ব্যাপার। সামন্ত আর মিমি দুটোদিনের ফুটেজ খুব ভালো করে দেখে তারপরে ঐ দুটো দিনের ফাইল নিয়ে বসল। প্রথম কেসটা নিয়েছিল শুভেন্দু ঘোষ। এখন অন্য কোম্পানীতে কাজ করে। যদিও সাহায্য চাইলে অবশ্যই করবে। কিন্তু কেসটা ম্যান হান্টের নয়। একটা মুভমেন্ট রেকর্ডের কেস। 

সামন্ত দেখল লোকটার নাম রমেশ রাওয়াত, তিলজলা এলাকার একটা ঠিকানা। পুরো রিপোর্টের কপিটা পড়ে সামন্ত নিজে গিয়ে হাজির হল সেই ঠিকানায়। রমেশের স্ত্রীকে জানাল একটা লোকের ব্যাপারে খবর নিতে সে রমেশের কাছে এসেছে, খবরটুকু নিয়েই চলে যাবে। বিমর্ষ মুখে রমেশের স্ত্রী বলল, 

কার কাছ থেকে কি জানবেন? আমার ঘরের লোক না পারছে দেখতে আর যন্ত্রনায় সারাদিন ছটফট করছে। 

কেন কি হয়েছিল ওনার? 

মুখে কেউ অ্যাসিড মেরেছিল স্যার, দুটো চোখ নষ্ট হয়ে গেছে সারাজীবনের মতো। আর যন্ত্রনায় সারাদিন ছটফট করছে। 

কোথায় হয়েছিল এটা? 

পার্টির একটা মিটিং এ গেছিল হাওড়ায় সেখানেই অন্য দলের গুন্ডারা আমার হাসব্যান্ডকে অ্যাসিড মেরেছে। 

সামন্ত মুখে একটা চুক চুক করে শব্দ করল। বুঝতে আর কিছু বাকী রইল না। এবারে গেল সেই ডান্স বারে। সেখানে গিয়ে তো আর তদন্ত করতে এসেছি বললে হবে না। অনেক কষ্টে একটা সিকিয়োরিটির লোকের কাছে নিজেকে বেশ বড়ো একটা বাংলা দৈনিকের সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়ে, তার নাম কোথাও ফাঁস হবে না এই আস্বাস দিয়ে, বেশ কিছু টাকা হাতে দিয়ে তারপরে প্রশ্ন করল সেই অ্যাসিড অ্যাটাক নিয়ে। 

সেই সিকিয়োরিটির স্টাফ যখন বুঝল যে ভয়ের কিছু নেই, তখন বলল, 

স্যার আমি তখন ডিউটিতে ছিলাম না, আমি অজয় বলে একটা বেয়ারার কাছ থেকে দিনকয়েক পরে ব্যাপারটা শুনি। লোকটা আগে থেকে এসে সবকিছু দেখে বুঝে গেছিল, অজয়কে বলেও ছিল যে এখানে কাজ করবে। এই বলে হাত করেছিল। আমাদের এখানে নাচত একজন সেও তো ঐদিন ছিল সেই লোকটার সাথে, তবে কপাল ভালো মেয়েটার কিছু হয়নি। ওকে শুধু অজ্ঞান করে মুখে টেপ মেরে দিয়ে পালিয়েছিল লোকটা। বহুত খতরনাক লোক স্যার। 

তোমার ঐ অজয়ের সাথে আর ঐ মহিলার সাথে কথা বলা যাবে? 

যাবে স্যার, তবে একটু দেখবেন যাতে আমরা পুলিসের ঝামেলায় না পড়ি। বুঝতেই তো পারছেন, চাকরি গেলে... 

তুমি পুলিস আর চাকরীর ব্যাপারে কিছু ভেবো না, সেটা যাতে কোন রকম প্রবলেম না হয় সেটা আমি দেখব তোমায় কথা দিলাম। এখন তুমি অজয় আর ঐ মহিলার সাথে কোথায় দেখা করা যাবে যদি একটু বলে দাও। 

অজয়ের বাড়ীর ঠিকানা পাওয়া গেল সিকিয়োরিটির সেই লোকটার কাছে। পোস্টাল নয়, কি ভাবে যেতে হয় তার পথ নির্দেশ। 

অজয়ের কাছেও সেই এই একই গল্প, সেই বাংলা দৈনিকের সাংবাদিক, সেই গোপনীয়তার আশ্বাস। টাকা দেওয়া, সব করে তারপরে জানা গেল পুরো ঘটনা। অজয় যেহেতু বোকা বনে গেছে লোকটার কাছে তাই তার প্রতিশোধ স্পীহাটাও বেশ ভালো রকমেরই কাজ করছিল। সামন্তর মোবাইলে ছবি দেখে সে বলল, 

কাছাকাছিই দেখতে স্যার, কিন্তু এই বুড়ো লোকটা বা ঐ ছেলেটা যখন আমার কাছে এসেছিল ওর একটা গোঁফ ছিল, সেটা ফলস ও হতে পারে। 

তা পারে। 

স্যার যদি একবার হাতের কাছে পাই না.... 

সে আমার ও ঐ একই কথা অজয়, যদি একবার হাতের কাছে পাই.. দেখা যাক। 

সেই ডান্স বারের নর্তকীর ঠিকানাও পাওয়া গেল ঐ অজয়ের কাছে, সেখানেও সেই একই গল্পের পুনরাবৃত্তি। তবে যে হেতু সেই মহিলার চোখে রুম ফ্রেসনার ছিটিয়ে দিয়েছিল, তাই তার চোখের জ্বালা মনের জ্বালা দুই বাকীদের থেকে অনেক বেশী। ঐ মেয়েটির সাথে কথা বলতে বলতে এবারে সামন্তর মনে স্বাভাবিক যে প্রশ্নটা জাগল সেটা হল মোটিভ? কেন করেছে সেই লোকটা এই কাজটা। এত ঝুঁকি নেওয়ার পিছনে কি কোন ব্যাক্তিগত আক্রোশ নাকি পেশাদার মানসিকতা, কোনটা কাজ করেছে এক্ষেত্রে? 

আচ্ছা পাম্মি তোমাকে রমেশ কি কোনদিন বলেছিল যে কেউ ওর উপরে এই রকম একটা আক্রমণ করতে পারে? 

না স্যার। আর কেনই বা করবে? রমেশজী খুব ভাল মনের মানুষ ছিলেন। কোনদিন আমাকে লুকোননি কি ওনার ফ্যামেলী আছে সব কিছু আছে। আমাদের বারে আসতেন প্রথম দিকে প্রায় সপ্তায় দু তিন দিন, তারপরে সেটা কমতে কমতে সপ্তায় একদিন হল। বারের সবার সাথে ভাল করে কথা বলতেন। কোনদিন মদ টদ খেয়ে কোন রকম অসভ্যতা করতেন না। ওয়েটারদের ভালো টিপস দিতেন। আমাকেও দিতেন। তারপরে আমার সাথে একটু ভালবাসা হয়ে গেল... 

তখন কি আর টিপস দেওয়া বন্ধ করে দিলেন? 

না স্যার সবার সামনে ঐ রকমভাবে টাকা ফেকতেন না, যে ভাবে সবাই টাকা ছড়ায় ডান্সবারে। তখন আমাকে আলাদা করে আমার সংসারের সব খরচ খরচা দিতেন। খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন স্যার। এই রকম লোককে কেউ চোখে অ্যাসিড মারে? ছিঃ! মানুষ না শয়তান কে জানে। 

তোমাকে সংসার খরচের টাকা দিতেন শুধু? কোন গিফট টিফট দিত না? মানে তোমার সংসারে তো রমেশজী কোনদিন যেতেন টেতেন না। তাই জানতে চাইছি আর কি। 

না স্যার উনি কোনদিন আমার বাড়িতে আসতে চায় নি, আমিও বলিনি। এমনিতেই স্যার নাচনেওয়ালী বলে এলাকায় বদনামের শেষ নেই, তার উপরে ঘরে লোক আনলে তো স্যার একেবারে পাড়াছাড়া করে দেবে। তবে ওনার খুব মেয়ের শখ, নিজের ঘরে দুই ছেলে তো তাই। আমাকে বেশ কিছু গয়না দিয়েছিলেন ইদানিং বলেছিলেন আমার যদি কোনদিন মেয়ে হয় তার বিয়েতে যেন আমি দিই। স্যার বিয়েই নেই তো মেয়ে। তবে সত্যি বলতে কি স্যার সেটাও ঐ মাস দুয়েক হল দিচ্ছিলেন। 

রমেশ রাওয়াতের স্ত্রী দরজা খুলে সামন্তবাবুকে আবার দেখে একটু অবাকই হলেন। বললেন, 

আপনি তো দিন দুয়েক আগেই এলেন, আপনাকে বললাম যে ওনার চোখের অবস্থা খারাপ কথা বলতে পারছেন না। দেখা করছেন না কারো সাথে। 

সামন্ত এবারে পুলিসের খেলাটা খেলল। পুরানো একটা আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে বলল, 

লালবাজার। উনি এমনি যদি কথা বলেন তো পাঁচ মিনিট সময় নেব। আর যদি রাতে তুলে নিয়ে যাই তো পাঁচ বছর, কোনটা পছন্দ? 

আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? জানেন আমার হাসব্যান্ড লোকাল.... 

কথাটা শেষ হওয়ার আগে সামন্ত বলল, 

দেখুন আপনার হাসব্যান্ড লোকাল কাউন্সিলারের খুব কাছের লোক। কাউন্সিলার রুলিং পার্টির একজন হোমড়া চোমড়া সব ঠিক আছে। কিন্তু আপনার হাসব্যান্ডের উপরে অ্যাসিড অ্যাটাকটা একজন টেররিস্ট করেছিল। অন্য একজনকে মারতে গিয়ে আপনার হাসব্যান্ডের চেহারার সাথে গুলিয়ে ফেলে তাকে মারে। তা আপনার দুজন কি চান না যে এই অ্যাটাকের একটা সুরাহা হোক? যদি না চান তো ঠিক আছে, আমি এখন চলে যাচ্ছি, রাতে গাড়ি এনে তুলে নিয়ে যাবো, আর টেররিস্ট লিঙ্ক দেখিয়ে দেবো, তখন ঐ কাউন্সিলারকে দেখবেন সবচেয়ে আগে দৌড়ে পালাচ্ছে। 

রমেশ রাওয়াতের বৌয়ের হাত কাঁপা আর মুখের ভাব দেখে সামন্তর একটা কথাই মনে হল, 

এই রে পেচ্ছাপ ফেচ্ছাপ করে দেবে না তো? 

রমেশ রাওয়াতের ঘরে ঢুকে তার অবস্থা দেখে সামন্তর নিজেরই মায়া হল, 

আহা রে! কেউ এমন করে কাউকে অ্যাসিড মারে তাও আবার চোখে? সাহুর বৌয়ের দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে কথাগুলো বলার পরে দেখল তাঁর চোখে সেই ভয়টা কিছুটা হলেও কমেছে। একটু ম্লান গলায় বলল, 

দেখলেন তো কি অবস্থা হয়েছে মানুষটার। পলিটিক্স তো অনেকেই করে কারো এমন হয় দাদা বলুন? 

বলেই খেয়াল হল দাদা বলাটা ঠিক হয়নি, আবার তড়িঘড়ি বলে উঠল, 

না না দাদা না, দাদা না, ভুল হয়ে গেছে স্যার। 

সামন্ত হেসে বলল, 

ঠিক আছে বোন, তুমি একগ্লাস জল নিয়ে এসো তোমার এই পুলিস দাদাটার জন্য। 

রমেশের বৌ একটু আস্বস্ত দৃষ্টতে তাকাল তারপরে জল নিয়ে আসতে গেল। 

সামন্ত রমেশের দিকে ফিরে বলল, 

টাকার সোর্সটা বলবেন? নাকি বৌয়ের সামনে পাম্মির মেয়ের বিয়ের গয়নার কথাটা বলে দেবো? 

কি টাকা? কে পাম্মি? কি বলছেন আপনি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না? 

এই খানকির ছেলে, তোর কি মনে হচ্ছে, সাত সকালে তোর বাড়িতে আমি কোন খবর না নিয়ে এমনি এমনি গাঁড় মাড়াতে এসেছি? সোজাসুজি সব বলবি? না কি লালবাজারে তুলে নিয়ে গিয়ে সারারাত ধরে কেলিয়ে সব কিছু ওগরাবো? 

কাঁচা খিস্তি যে সব সময় চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে দিলেই কাজ হয় তা নয়, একদম ঠান্ডা গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে দিলেও খুব ভালো কাজ হয় সেটা সামন্ত আগেও প্রমাণ পেয়েছে এবারেও পেলো। 

রমেশের বৌ জল নিয়ে ঢুকল। রমেশ ওর বোউকে চা করে আনতে পাঠিয়ে ঠিক দু মিনিট নিল টাকার সোর্সের ব্যাপারটা জানাতে, তারপরে বলল, 

স্যার দেখবেন আমার ওয়াইফ যেন কিছু.... 

আরে না না, তাকে আমি বোন ডেকেছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাক। 

রমেশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামন্ত বুঝল এই দুই মালদার মক্কেলকে ভাঙতে তার একার শক্তিতে কুলোবে না। কিন্তু এখনো হাতে দ্বিতীয় কেসটার ব্যাক ট্র্যাক করা বাকি। সামন্ত বেলঘড়িয়া থানার পঙ্কজমুখার্জীকে ফোন করল।

0 comments: