প্রবন্ধ - ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
গীতারহস্যামৃতম
ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী
(১৪)
যুক্তাহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্মসু।
যুক্তস্বপ্নাববোধোস্য যোগো ভবতি দুঃখহা।। (১৭তম)
(১৭তম - উপযুক্ত আহারবিহারশীল, কর্মে উপযুক্ত চেষ্টাসম্পন্ন,
উপযুক্ত নিদ্রাজাগরণশীল পুরুষের সিদ্ধি দুঃখনাশক হয়।)
আমার মনে হয়, বর্তমান কালের জীবনযাত্রায় এই সংযম যাকে পরিমিতি বলা যেতে পারে তার প্রয়োজন সর্বাপেক্ষা বেশি।
এই প্রসঙ্গে সেই ইংরেজি বাক্যটি গীতার উপরিউক্ত শ্লোকদুটির অনুরণন মাত্র – Too much of everything is bad.
এইবার বর্তমানকালে গীতা মহাগ্রন্থটি কতটা প্রাসঙ্গিক সেই আলোচনাতে আসা যাক।
এই রচনার প্রথমেই সেই শিশু ভিক্ষুক আর আমার দপ্তরের উপরওয়ালার দার্শণিক উক্তি দিয়ে মহাগ্রন্থ গীতা বর্তমানে কতটা আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে চলেছে তার একটা খন্ডচিত্র দেখানোর প্রচেষ্টা ছিল।
এছাড়া কর্মযোগে শ্রীকৃষ্ণের ব্যখ্যা - বুদ্ধিযুক্ত কর্মই যে আসল কর্ম। এই অর্থে আমরা বর্তমান কালের ম্যানেজমেন্ট গুরুদের Smart Work আর Hard Work এর ওপর তৈরি করা PPT-গুলো একবার দেখে নিতেই পারি।
বহু ম্যনেজমেন্ট গুরু, রাজনিতীবিদ আর ধর্মগুরুদের ক্লাস আর টেলিভিশন ও খবরের কাগজে প্রচারিত বক্তব্য পাঠ করে আমার এমন একটা ধারণা হয়েছে যার থেকে কেমন যেন মনে হয় যে এনারা সবাই, হ্যাঁ, সবাই মহাগ্রন্থ গীতাটিকে বেশ ভাল রকম ভাবে গুলে খেয়েছেন। তারপর নিজেরা নিজেদের মত করে সেটাকে ব্যক্ত করে হাততালি কুড়িয়ে চলেছেন।
বহু ম্যানেজমেন্ট বই খুলে বসলে দেখা যাবে যে তাঁদের মৌলিক বক্তব্যটি গীতা মহাগ্রন্থেরই হুবহু কপি। ঠিক একই ভাবে টেলিভিশনের ভক্তিমূলক চ্যানেলেগুলোতে প্রতিদিন যে লক্ষ্-লক্ষ, কোটি-কোটি বক্তব্য পরিবেশিত হচ্ছে তা মহাগ্রন্থ গীতায় কম-বেশী মাত্র চারশতাধিক শ্লোকেই শ্রীকৃষ্ণ বিস্তারিত ভাবে বলে গেছেন।
যে কোন হতাশাগ্রস্ত মানুষ, সে আমাদের কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী অথবা পরিবারের যে কোন সদস্য বা সদস্যাই হতে পারেন, তাঁকে আমরা আজও সান্ত্বনা দিয়ে থাকি ঠিক একই ভাবে যেভাবে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় সখাকে অর্জুনকে দিয়েছিলেন – “হে পার্থ, ক্লৈব্য পেয়ো না, হৃদয়দৌর্বল্য ত্যগ করে ওঠ।“ (সাংখ্যযোগ-৩নং শ্লোক)।
আমরা আজকাল প্রচুর Positive Frame of Mind বা Positive Thinking-এর কথা শুনে থাকি আবালবৃদ্ধবনিতার মুখ থেকে। নেতিবাচক মনোবৃত্তি নিয়ে জীবনে সফলতা প্রাপ্ত হওয়া অসম্ভব কিনা জানি না তবে সহজসাধ্য নয় মোটেই। সাংখ্যযোগের ৬৫তম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “প্রসন্নচিত্তের বুদ্ধি শীঘ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।“ (প্রসন্নচেতস্যে হ্যাসু বুদ্ধিঃ পর্যবতিষ্ঠতে।)
প্রসন্নচিত্ত যে Positive Frame of Mind, সেটা আশা করি মেনে নেওয়া যেতে পারে আর সেই অবস্থায় সঠিকভাবে বুদ্ধি সঙ্গে থাকলে সিদ্ধিলাভ স্বয়ং সিদ্ধিদাতা গণেশবাবাজীও আটকাতে পারবেন বলে মনে হয় না।
(১৫)
একই ভাবে Management গুরুরা “Stay Focused”, “Un-divided Attention”, “Power of Concentration”, Power of Mind ইত্যাদির কথা বলে থাকেন। এমন কি ধর্মগুরুরাও একই কথা ভগবানকে উপলব্ধি করার পাথেয় হিসেবে আমজনতার নির্দেশিকায় দাখিল করে দিয়েছেন।
এনারা সবাই কিন্তু একত্রে সেই মহাগ্রন্থ গীতার নির্দেশকেই অনুসরন করতে বলেন কিন্তু কোনরকম কৃতজ্ঞতা স্বীকার ব্যতীত। আমার ব্যক্তিগত মত অনুযায়ী পৃথিবীর সমস্ত দর্শণ শাস্ত্র এবং Management Course-এ এমন কোন নতুন দিশার সঙ্কেত নেই যা মহাগ্রন্থ গীতায় আলোচিত হয় নি। মহাগ্রন্থ গীতা সঠিক ভাবে চর্চিত হলে এই মহাগ্রন্থটি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আসমুদ্র হিমাচল ব্যপী আস্তিক-নাস্তিক সমস্ত মানুষের পরম ভরসা স্থল হতে পারে এ বিষয়ে অন্তত আমার কোন সংশয় নেই।
দেখা যাক এই প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ গীতা কি বলে – ধ্যানযোগ – ২৫/২৬নং শ্লোক।
“শনৈঃ শনৈঃরুপরমেদ্ বুদ্ধ্যা ধৃতিগৃহীতয়া।
আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ।।(২৫তম)
যতো যতো নিশ্চলতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্।
ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশং নয়েৎ।। (২৬তম)
(২৫তম - ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধি দ্বারা মনকে আত্মস্থ করে ক্রমে ক্রমে একাগ্রতা অভ্যাস করবে; কিছু মাত্র চিন্তা করবে না।)
(২৬তম – যে যে বিষয়ে চঞ্চল অস্থির মন ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় থেকে তাঁকে সংযত করে আপনার বশে আনবে।)
কিছুদিন আগে পঞ্চতারকা খচিত এক হোটেলে আয়োজিত কোন এক Corporate Seminar-এ মনে পড়ছে “Everything in Mind” কথাটার ওপর অনেক অগ্নিগর্ভ ভাষণ শুনেছিলাম।
তখন মনে হয়েছিল ম্যানেজমেন্ট গুরুরা গীতার থেকে এই তথ্যটি অতি সুকৌশলে Lift করে নতুন চকচকে প্যাকেটে মুড়ে জনসাধারনকে নিয়মিত ভাবে পরিবেশণ করে চলেছেন। কেন একথাটা বলছি তা নিচের শ্লোক দুটি পড়লে (ধ্যানযোগ – ৫ম এবং ৬ষ্ঠ শ্লোক) বুঝতে মোটেই অসুবিধে হবে না।
উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ।
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।।(৫ম)
বন্ধুরাত্মাত্মনস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ।
অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্তেতাত্মৈব শ্ত্রুবৎ।। (৬ষ্ঠ)
[ ৫ম - নিজের চেষ্টায় নিজেকে উন্নত করবে, পতিত (ছোট) করবে না; মানুষ নিজেই নিজের বন্ধু বা শত্রু।]
[৬ষ্ঠ - যে নিজের চেষ্টায় আত্মজয়ী হয়েছে সে নিজের বন্ধু; যে হয়নি সে নিজের শত্রু।]
উপরিউক্ত শ্লোকদুটির কল্যাণে মানুষের মনই যে সমস্ত শক্তির আধার এই বিষয়ে কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়।
আবার অক্ষরব্রহ্ম যোগের ৮নং শ্লোকের দিকে যদি একটু নজর দেওয়া যায় তবে আমরা দেখতে পাব যে Management গুরুদের Stay focused & achieve goal এই মহামূল্য বাণীটি মহাগ্রন্থ গীতায় লিপিবদ্ধ আছে।
(১৬)
অভ্যাসযোগযুক্তেন চেতসা নান্যগামিনা।
পরমং পুরুষং দিব্যং যাতি পার্থানুচিন্তয়ন্।
(হে পার্থ, অভ্যাস যোগযুক্ত অনন্যগামী চিত্তে সর্বদা চিন্তা (ধ্যান) করলে (লোকে) দিব্য পরমপুরুষ প্রাপ্ত হয়)
এইবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক।
আমাদের দেশে এক বলিউডি নায়কের গত অলিম্পিক গেমসের ব্র্যান্ড অ্যামবাসেডর নিয়োগ নিয়ে হইচই চলেছিল। সেই বিষয় নিয়ে কোনরকম মন্তব্য নিস্প্রোজন। তবে সেলিব্রিটিদের এইসকল পদে কেন নির্বাচন করা হয় তার কারনও মহাগ্রন্থ গীতায় উল্লেখিত আছে।
দেখা যাক কি এমন কথা আছে গীতায়। সেটা জানার জন্য আমাদের মহাগ্রন্থ গীতার কর্মযোগ অধ্যায়ের ২১তম শ্লোকটির দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাকঃ
যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।।
[শ্রেষ্ঠ যে যে আচরণ করেন, ইতরজনও সেই আচরণ করে;
তিনি যা পালন করেন লোকে তাঁর অনুবর্তী হয়।]
আমরা হামেশাই জাতিস্মরের কথা শুনি। সত্যি-মিথ্যে নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হয়েছে এবং হচ্ছেও। সত্যজিতের “সোনার কেল্লা” এই বিতর্কে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে।
আবার সৃষ্টির আদিতে ছিল এমন বহুকিছু উৎকৃষ্ট জ্ঞান এমনকি প্রাণী পর্যন্ত যা প্রাকৃতিক বিপর্যয় অথবা অন্য কোন অজ্ঞাত কারণে আজ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।
আধুনিক বিজ্ঞান এই প্রাচীন জ্ঞান ভান্ডারের বিলুপ্তি মেনে নিয়েছে। পিরামিড তৈরির রহস্য, মমিতে ব্যবহৃত পদার্থ, প্রাগ-ঐতিহাসিক প্রাণীদের অব্লুপ্তি, গুহামানবদের আঁকা গুহাচিত্র, পেরুতে দৃশ্যমান বেশকিছু জ্যামিতিক আঁকিবুঁকি ইত্যাদি এরকম অনেক কিছু আমাদের বর্তমান জ্ঞানবিজ্ঞানের পরিচিতির পরিধির বাইরে।
এই দুটি বিষয়ও গীতা মহাগ্রন্থে আলোচিত হয়েছে । নিম্নলিখিত জ্ঞানযোগের – ১ম এবং ২য় শ্লোক দুটিতে তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়।
শ্রীভগবানুবাচ
ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম।
বিবস্ববান্ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষবা কবেহব্রবীৎ।। (১ম শ্লোক)
এবং পরম্পরাপ্রাপ্তমিমং রাজর্ষয়ো বিদুঃ।
স কালেনেহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তপঃ।। (২য় শ্লোক)
[১ম শ্লোক - আমি বিবস্বান্কে (সূর্য) এই অপরিবর্তনীয় যোগ বলেছিলাম; বিবস্বান্ (তৎপুত্র) মনুকে বলেছিলেন; মনু (তৎপুত্র) ইক্ষাকুকে বলেছিলেন।]
[২য় শ্লোক - এইভাবে রাজর্ষিগন পরম্পরাপ্রাপ্ত এই যোগ জেনেছিলেন; হে পরন্তপ, তা দীর্ঘকালক্রমে ইহলোকে নষ্ট হয়েছে।]
কৃষ্ণের কথায় এটা প্রমাণিত হয় যে কালের প্রভাবে ইহলোকে যে বহু কিছু হারিয়ে যেতে পারে সেটা মোটেও আশ্চর্য নয়।
(১৭)
কিন্তু কৃষ্ণের এই জাতিস্মরতার দাবি অর্জুন এককথায় মেনে নেননি।
যথেষ্ট কঠিন প্রশ্ন করে কৃষ্ণের এই দাবিকে অবজ্ঞা করে বলেছিলেন যে তোমার জন্ম তো অল্পকাল আগে আর বিবস্বানের জন্ম তো বহু আগে। তাহলে তুমি যে আদিতে বলেছিলে এটা কি করে বিশ্বাস করব!
এর উত্তরে কৃষ্ণ বলেছিলেন,”হে অর্জুন, আমার ও তোমার বহু জন্ম আগে অতীত হয়েছে; আমি সেসব জানি; হে পরন্তপ, তুমি জান না।“ (রাজশেখর বসু কৃত জ্ঞানযোগের ৫ম শ্লোকের বঙ্গানুবাদ ।) অতএব শ্রীকৃষ্ণ যে জাতিস্মর ছিলেন সেটা তিনি নিজেই জানিয়েছেন।
এইভাবে যদি মহাগ্রন্থ গীতাকে বিশ্লেষন করে যায় তবে এই মহাগ্রন্থটি শুধু যে একটি স্বর্ণখনি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে তা নয়, এই মহাগ্রন্থটি যে ভীষণ ভাবে আজকের যুগেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলেই যে বিবেচিত হবে সে বিষয়ে কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়।
রাজশেখর বসুর মতে এই মহাগ্রন্থটি বহু পূর্বে প্রাচীন সংস্কারের মধ্যে রচিত হলেও এতে সর্বকালের উপযোগী শ্রেষ্ঠ সাধনা-পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু গীতা মহাগ্রন্থটি সর্বসাধারণের জন্য নয়। মোক্ষযোগের ৬৭নং শ্লোকটি কি বলে দেখা যাকঃ
“ইদং তে নাতপস্কায় না ভক্তায় কদাচন।
ন চাশুশ্রউষবে বাচ্যং ন চ মাং যোহভ্যসুয়তি।।“
[এ (গীতার্থ) তোমার কদাচ তপস্যাহীনকে বক্তব্য নয়, অভক্তকে নয়, অ-শ্রবণেচ্ছুকে নয়;যে আমাকে অসূয়া করে তাকেও নয়।]
আমার ব্যক্তিগত ধারনা হল যে মহাগ্রন্থ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ দার্শনিক এবং ধার্মিক আলোচনার মাধ্যমে যে বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তার বিরোধিতা করার জন্য সেইসময়ে লোকের অভাব ছিল না। তাই শ্রীকৃষ্ণের উপরিউক্ত প্রিকশানারি পদক্ষেপটা নেওয়া তাঁর দরকার হয়ে পড়েছিল।
কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কর্মফল লোভী সকাম কর্মযোগী আপামর সাধারণ জনগনকে গীতা মহাগ্রন্থটি মুখস্থ করালে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা থেকে যাবে। কিছু তার্কিক জনগন দ্বারা মহাগ্রন্থ গীতার ভুল ব্যাখ্যা সমাজের সাধারন মানুষকে বিপথগামী করে দিতে পারে।
তা হলে উপায়?
উপায় আছে। আগেই বলেছি অমাবস্যার অন্ধকার রাতে সঠিক দিক নির্ণয় করে দেবার জন্য একজন জ্ঞান আলোক প্রাপ্ত পথ প্রদর্শকের প্রয়োজন। সবচেয়ে সহজ সরল ভাবে যিনি এই মহাগ্রন্থটিকে সাধারন মানুষের কাছে সহজপাচ্য করে তুলেছিলেন তিনি হচ্ছেন স্বর্গীয় গদাধর চট্টোপাধ্যায় যিনি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ নামে আমাদের হৃদয়ে বিরাজমান। প্রচলিত শিক্ষার মাপকাঠিতে যিনি অশিক্ষিত সেই ব্যক্তি কি করে সহজ কথায় এত উচ্চমার্গের এই দার্শনিক মহাগ্রন্থটির ব্যাখ্যা করেছেন এটা ভাবলেই শিহরিত হতে হয়।
মহাগ্রন্থ গীতার মূল বাণীটি কি – এই ছোট্ট আপাত নিরীহ প্রশ্নটি সমস্ত দার্শনিকতার মূল চিন্তাধারাকে ধাক্কা দিয়ে গভীর জলে ফেলে দিতে পারে। নানা মুনির নানা মত নানা ভুলভুলাইয়ার গলিঘুঁজিতে পাক খেতে খেতে চিরকালের তরে হারিয়ে যাবার আগে আমরা একবার ঠাকুরের ব্যাখ্যাটা শুনে নিতেই পারি।
ওনার কথায় “গীতা” কথাটি বার দশেক উচ্চারণে “তাগী” কথাটা কানে ধরা পড়ে যা “ত্যাগী” কথারই নামান্তর মাত্র।
(১৮)
এক কথায় মহাগ্রন্থ গীতার এই ব্যাখ্যা যেমন সহজ সরল ঠিক তেমনই অতিমাত্রায় দার্শণিক। এর থেকে আর ভাল ব্যাখ্যা সম্ভব নয় বললে নিশ্চয় অত্যুক্তি করা হবে না বলেই আমার ধারনা। এই ছোট্ট কথাটি মহাগ্রন্থ গীতায় নিম্নলিখিত রূপে বিবৃত আছে ভক্তি যোগের ১২নং শ্লোকের মাধ্যমেঃ
শ্রেয়ো হি জ্ঞানমভ্যাসাজ্জ্ঞানাদ্ধ্যানং বিশিষ্যতে।
ধ্যানাং কর্মফলত্যাগস্ত্যাগাচ্ছান্তিরনন্তরম্।।
(অভ্যাস অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেয়, জ্ঞান অপেক্ষা ধ্যান বিশিষ্টতর,
ধ্যান অপেক্ষা কর্মফলত্যাগ; ত্যাগ থেকে অবিলম্বে শান্তি)
এই প্রসঙ্গে এবার একে একে দেখা যাক ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মহগ্রন্থ গীতার অসাধারন দার্শনিক মতবাদ সমৃদ্ধ শ্লোকগুলোর কি সুন্দর সহজ সরল ব্যাখ্যা আমাদের মত ম্যাঙ্গোম্যান পটলবাবুদের জন্য সহজপাচ্য হিসেবে পরিবেশন করে গেছেন।
সংসার ধর্ম পালন কালে মানুষ যখন কুম্ভীপাকে নিমজ্জিত তখন সৎ আর অসৎ-এর মধ্যে সূক্ষ বিভাজন রেখাটি অনেক সময়েই মিলিয়ে গিয়ে সাধারন মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। এই প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ গীতায় “স্থিতপ্রজ্ঞ” হিসেবে জীবন ধারনের নির্দেশ আছে। এই প্রসঙ্গে সাংখ্যযোগের ৭১নং শ্লোকের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাকঃ
বিহায় কামান্ যঃ সর্বান্ পুমাংশ্চরতি নিস্পৃহঃ।
নির্মোহ নিরহংকারঃ স শান্তিমধিগচ্ছতি।।
( যে পুরুষ সকল কামনা ত্যাগ করে নিস্পৃহ নির্মম নিরহংকার হয়ে চলেন, তিনি শান্তি পান )
সংসারে দৈনন্দিন জীবন যাপন কালে যাতে পিছলে পড়তে না হয় তার জন্য মহাগ্রন্থ গীতা নির্দেশিত এই আলোকিত পথটি এক্কেবারে আদর্শ।
মহাগ্রন্থ গীতার সন্ন্যাসযোগের ১০নং শ্লোক বলছেঃ
ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্তা করোতি যঃ।
লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমি বাম্ভসা।।
(যিনি ব্রহ্মে অর্পণ করে আসক্তি ত্যাগ করে কর্ম সকল করেন,
তিনি জলদ্বারা পদ্মপত্রের তুল্য পাপদ্বারা লিপ্ত হন না।)
দেখা যাক এই প্রসঙ্গে ঠাকুর কি বলেছেন। তিনি বলেছেন সংসারে পাঁকাল মাছের মত থাকতে। এক কথায় অসাধারন এক উপদেশ। সংসার ষড়রিপু, সুখ, দুঃখ, হতাশা, স্নেহ, মমতা, পারিবারিক সম্পর্ক, সৎকার্য-অসৎকার্যের পাঁকে পরিপুর্ণ। এই পঁংকিল সংসারে নিমজ্জিত থেকে শান্তি পেতে হলে যে স্থিতপ্রজ্ঞ অবস্থায় উত্তরণের প্রয়োজন সেই চরিত্রের সর্বজন গ্রাহ্য একটি রূপক হিসেবে পাঁকাল মাছের অবতারনা এককথায় যাকে বলে অনবদ্য। এই জন্যই রামকৃষ্ণদেব শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত সর্বসাধারনের কাছে এত সহজবোধ্য।
ভারতীয় দর্শনের আপাত দূরূহ বিষয়গুলো রামকৃষ্ণদেব যে সাবলীল ভাবে সাধারন মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করে গেছেন তা দর্শণ শাস্ত্রের বহু জ্ঞানী ব্যক্তিকেই লজ্জায় ফেলে দিতে পারে। মনে পড়ছে স্কুলে পাঠ্য পুস্তক পড়াকালীন একটি সহায়ক পুস্তকের সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠ্য বিষয়ের সঠিক রসটি আহরণ করতে পারে। মহাগ্রন্থ গীতা পড়া কালীন একটা কথা আমার বারবার মনে হয়েছে যে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হচ্ছেন গীতা মহাগ্রন্থের সেই সহায়ক পুস্তক ইন হিউম্যান ফর্ম।
0 comments: