গল্প - অনির্বাণ জানা
Posted in গল্প
গল্প
লাইফ লাইন
অনির্বাণ জানা
মিতা খুব অসহায় বোধ করে। শঙ্কর যে হঠাৎ করে এরকম অসুস্থ হয়ে পড়বে, কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। পঁচিশবছরের সংসার জীবনে কখনো নিজের জন্য ডাক্তারখানা যায়নি শঙ্কর। সকাল থেকে গ্যাস গ্যাস বলছিল বটে। কিন্তু দুপুরবেলায় খাওয়ার পরে যে একেবারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে, তা ভাবতেও পারেনি মিতা। ছেলেটার মোবাইলে ফোন ঢুকছেনা। চেনা ডাক্তারবাবুকে ফোন করেছিল। তিনি কলকাতার বাইরে, পরামর্শ দিলেন হাসপাতালে ভর্তি করার। কেঁদে ফেলে মিতা। ছেলেকে না পেয়ে অন্য একটা নাম্বারে ফোন লাগায়।
..................
এ বড় জটিল খেলা। ছেলেটা প্রাণপণে দৌড়চ্ছে। পেছনে মৃত্যুভয় তাড়া করছে। কখনো সামনে বিশাল খাদ, সেটাকে ঠিক সময়ে লাফিয়ে পেরিয়ে যেতে হচ্ছে। কখনো বা মাথার ওপর আগুনের তোরণ, মাথা না নিচু করলেই শেষ। তার ওপর রাস্তায় মুহুর্মুহু বাঁক তো আছেই।
পাশের ভদ্রলোক অনেকক্ষণ সাগ্নিককে সহ্য করছিল। এবার বিরক্ত হয়ে বলে ওঠেন, “আপনি কি ক্যারাটে স্কুলের টীচার নাকি? সারাক্ষণ গরুর মতো কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে যাচ্ছেন?” বাসটায় যথেষ্ট ভিড়। গরু ছাগলরাও এইভাবে নিয়ে গেলে প্রতিবাদ করতো। মানুষ বলে সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। গরু হলে সাগ্নিক মোটে এই বাসে উঠতো না। সাগ্নিক মোবাইলের গেমটার দিকে তাকিয়ে দেখে ও খাদে পড়ে গেছে। গভীর একটা শ্বাস ফেলে পাশের ভদ্রলোককে বলে “দিলেন তো খাদে ফেলে।”
ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ সাগ্নিককে মেপে নিয়ে ভদ্রলোক স্বগতোক্তি করেন, “গরমটা পড়ে পর্যন্ত পাগলদের সংখ্যা বড়ই বেড়ে গেছে।”
সত্যি, বিশ্রী একটা গরম পড়েছে। তার ওপর সকাল থেকে একবারও স্কোর তিনলক্ষ পেরোয়নি। তিনলক্ষ না পেরোলে ওর মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে থাকে। ঘুম থেকে উঠে মাথার বালিশের তলা থেকে মোবাইলটা বার করে গেম খুলেছিল। সকালবেলায় রিফ্লেক্সগুলো বেশ ধারালো থাকে। তরতর করে খেলাটা এগোচ্ছিল। গেমের ভেতরে একটা ছেলে গুহা থেকে বার হয়ে দৌড়চ্ছে। পেছনে বড়বড় প্রাগৈতিহাসিক পাখি তাড়া করে আসে। জীবন বাজী রেখে ছেলেটা দৌড়য়। আস্তে আস্তে ছেলেটার ভেতর ঢুকে পড়ে সাগ্নিক। পায়ের তলায় ভেজা ঘাস টের পায়। সোঁদা একটা গন্ধ নাকে আসে। রাস্তায় পড়ে থাকা কয়েনগুলো টুকটাক করে তুলে নিয়ে দৌড়য়। ঝাঁপ দিয়ে বড় একটা ফাটল পেরিয়ে যায়। ডানদিকে না বামদিকে বাঁকবে ঠিক করার মাঝে রিমির ফোন। মেয়েটার ফোনের টাইমিং বিশ্রী রকম খারাপ। দুবার বাথরুমে থাকাকালীন ফোন করেছিল, বাবা ধরেছিল। একবার বন্ধুর দিদি আরেকবার মাসি বলে চালিয়ে দিয়েছে। বাবা দ্বিতীয়বার গম্ভীর হয়ে বলেছিল “তোমার বন্ধুর দিদি বা মাসি সবার নামই কি রমাপদ?” মনেমনে জিভ কেটেছিল সাগ্নিক। বাবা ব্যাঙ্কে চাকরি করতো। লোকে বলে শঙ্করবাবুর চোখ এড়িয়ে কোনো বদ লোক ব্যাঙ্কে ঢুকতে পারতোনা। শঙ্করবাবুর চোখে নাকি একটা সিসি ক্যামেরা ফিট করা আছে। রিমির নামটা বিভিন্ন ধরণের বিপদ এড়াতে রমাপদ বলে সেভ করা আছে।
এই সুযোগে রিমির ছোট করে একটা পরিচয় দিয়ে রাখা যাক। রিমিদের বাড়ি একই পাড়ায়। রিমির বাবার সাথে সাগ্নিকের বাবার আদা এবং কাঁচকলার মতো মধুর সম্পর্ক। পাড়ায় পুজো কমিটির মীটিং থেকে মোহনবাগান না ইস্টবেঙ্গল, ধোনি না বিরাট, বাম না ডান, এমনকি অ্যাপেল না স্যামসুঙ, সব ব্যাপারে দুজন দুমেরুতে বসবাস করে। সাগ্নিক এমনও দেখেছে, বাবা ফার্স্টহাফ ব্রাজিলকে সাপোর্ট করে হাফটাইমে চা পাতা ফুরিয়ে গেছে বলে দোকানে গেল। ফিরে এসে সেকেন্ড হাফে গুয়াটেমালা না ইকুয়েডর, যারা বিপক্ষ টীম ছিল তাদের ভয়ংকর সাপোর্টার হয়ে গেল। ইকুয়েডরবাসীরা বাবাকে সেই অবস্থায় দেখলে নির্ঘাত তাদের কোচকে বরখাস্ত করে বাবাকে নিতো। পরে জানা গেল, মুদির দোকানে বাবার সাথে রিমির বাবার দেখা হয়েছিল। আর রিমির মায়ের ঝগড়াতে পোস্ট ডক্টরাল করা। এমিলে বারনাইলার নামে এক ভদ্রলোক মাইক আবিষ্কার করেছিলেন। রিমির মায়ের গলার জোর শুনলে তিনি মাইক্রোফোন আবিষ্কারের ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেন। এই তথ্যগুলো সবাই জানে, তাই রিমিকে আলাদাভাবে মনে করানোর প্রয়োজন বা সাহস সাগ্নিকের হয়নি। দুটো বাড়ির সব ব্যাপারে তুমুল অমিল থাকলে উত্তম সুচিত্রার আমল থেকে বাড়ির একমাত্র ছেলের সাথে অন্যবাড়ির একমাত্র মেয়ের যা হয়, তাই হয়েছে রিমি আর সাগ্নিকের মধ্যে।
রিমি বেশ সুন্দরী। তার ফলে যা হয়, পাড়ার যুবসমাজ রিমির বাবার পক্ষে। এবারকার পুজো কমিটিতে রিমির বাবা সেক্রেটারি হচ্ছে বিপুল সমর্থন পেয়ে। পুজোয় সাগ্নিকরা সুন্দরবন বেড়াতে যাচ্ছে। পুজো কমিটির মীটিং থেকে ফেরার পথে বাবা একদম ট্রাভেল এজেন্টের সাথে ফাইনাল কথা সেরে ফিরেছে। মা একটু গাঁইগুঁই করেছিল - পুজোর সময় বনেবাদাড়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকা কি ভালো দেখায়? বাবা পাত্তা দেয়নি।
সাগ্নিকের আবার নতুন চাকরী। পূজোর সময় ও আর রিমি লুকিয়ে চারদিন চার জায়গায় যাবে বলে ঠিক করা আছে। এমনিতেই একটা টানাপড়েন আছে - চাকরীর পরে প্রথম পুজো বলে বস চায় সেইসময় সাগ্নিক অফিসের এমার্জেন্সি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সাইটে থাকুক। আবার প্রেমের পর প্রথম পুজো বলে রিমি চায় সাগ্নিক ওর সাইডে থাকুক।
আবার সাগ্নিককে নিয়ে পড়া যাক। সাগ্নিকরা দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। পাটুলি অঞ্চলে যে সময়ে কলকাতার গন্ধ লাগতে শুরু করেছে, সেই সময় থেকে বাবা উত্তর কলকাতার ভাড়াবাড়ি ছেড়ে এইখানে চলে আসে। সাগ্নিকের জন্মও পাটুলিতে। সেক্ষেত্রে রিমিরা তো মাত্র কয়েকবছর হল এসেছে। বাইপাসের ধার ঘেঁষে রিমিদের ফ্ল্যাট। রিমিরা আসার আগে পর্যন্ত সাগ্নিকের বাবা পাড়ার অন্যতম মাথা ছিল। রিমির বাবা আস্তে আস্তে পাড়ার সমস্ত মাথাদের কণিষ্ক সিরিজের স্ট্যাচু বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
সাগ্নিক ছোটবেলা থেকেই পড়ুয়া ছেলে। পাড়ায় খুব একটা মেলামেশা করতো না। ফলে হেমা মালিনী, শ্রীদেবী, মাধুরী দীক্ষিত, সানি লিওনের উত্তরসূরি হিসেবে রিমি নামের একজন যে পাটুলি অঞ্চল আলো করতে আবির্ভূত হয়েছে, সে খবরটা সাগ্নিকের কাছে ছিলনা। বেচারি শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় বেশিরভাগ দিনই হোস্টেলে কাটাতো। ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময় এসি টুয়েন্টি ফোরে চড়ে হাওড়া যাওয়ার পথে প্রথমবার রিমিকে দেখে। তারপর হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে বাড়ি থেকে যাতায়াত করারই সিদ্ধান্ত নেয়। পাড়ায় ভোটপ্রার্থীর মতো জনসংযোগও বাড়িয়ে দেয়। ভুতো, ঝিকমিক, টপ্পা ইত্যাদি বিচিত্র নামের ওর বয়সী স্ট্রং নেটওয়ার্ক সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের সাথে দোস্তিও হয়ে যায়। জানা যায়, রিমি আসার পরে বাইপাসের ধারে সব মাল্টিস্পেশালিটি নার্সিংহোমগুলোয় অস্বাভাবিকভাবে হার্টের রোগী বেড়ে গেছে।
ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্টটা সাগ্নিকের বিশ্রী রকম খারাপ হয়েছিল।
তবু ভালোই একটা চাকরি জুটে গেছে সাগ্নিকের। নিজের শহরে প্রথম পোস্টিং কটা লোকে আর পায়? আর চাকরি পাওয়ার পর ভুতো, ঝিকমিকদের ট্রীট দিতে হয়েছিল। ঝিলের ধারে মাছরাঙা নামের একটা রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে বন্ধুদের মনের কথা খুলে বলে সাগ্নিক। টপ্পা সিলিংএর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে - “স্থানীয় মদের দোকানগুলো চেনা আছে তো গুরু?” ওর মতে ঝাড় খাওয়ার পরে বাধ্যতামূলক দেবদাস হতে হয়। দেবদাসদের নাকি একটা আস্ত ফেসবুক গ্রুপ আছে। তার প্রোফাইল পিক নাকি দূরে মিলিয়ে যাওয়া রিমির পা। হাফসোল খাওয়া নাকি জীবন থেকে সরে যেতে যেতে স্মৃতি রেখে যাওয়ার প্রতীক, সেটা নিয়ে মুনিরা নানা মত দিয়েছেন। মোট কথা, প্রোপোজ করা আর চিড়িয়াখানায় বাঘের খাঁচায় ঢুকে বাঘের গলায় মালা পরানো একই ব্যাপার। ভুতো আর ঝিকমিকের ভোটও টপ্পার দিকে গেলো। গুগল ঘেঁটে আশেপাশের মদের দোকানেরও সুলুকসন্ধান জানা হয়ে গেল।
তবু একদিন সাগ্নিক সাহস করে রিমির পড়তে যাওয়ার বাসটায় উঠে পড়লো। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে যাওয়ার পরে সকালের দিকের এই বাসটায় ওঠার কোনো প্রয়োজন হয়না সাগ্নিকের। একটা গোলাপি রঙের সালোয়ার পরেছিল রিমি। স্ট্রবেরি ফ্লেভারড আইসক্রিমগুলোও ওকে দেখলে লজ্জায় গলে যাবে। আর সবথেকে যেটা আনন্দের ব্যাপার, বাসে একটা মাত্র বসার জায়গা খালি রয়েছে এবং সেটা রিমির পাশে। ঝুপ করে ওর পাশে বসে সাগ্নিক আবিষ্কার করলো, ওর গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছেনা। কি কাণ্ড! নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান দিয়ে একটা ডায়াগনোসিসে আসা গেল - সাউন্ডবক্স বসে গেছে। ভোকাল কর্ডগুলো না বদলে নিলে আওয়াজ বেরোবেনা। এখন রেডিমেড ভোকাল কর্ডের দোকান ডাক্তাররা ছাড়া আর কারো জানার কথা নয়। খুব অসহায় ভাবে জানলার বাইরে তাকায় সাগ্নিক। বেশিক্ষণ রিমির চোখে চোখ রাখলে টপ্পার কথামতো সত্যিই ওর হার্ট অ্যাটাক হবে।
বাইরে ঝকঝকে একটা রোদ উঠেছে। দুটো খুব সুখী সুখী ছেলেমেয়ে নিজেদের মধ্যে কি একটা কথায় খুব হাসছে। বাইপাসের ধারে ঝিলের ওপর দিয়ে দুটো পাখি এক সরলরেখায় উড়ে গেল। একটা স্কুলপড়ুয়া ছেলে মুগ্ধদৃষ্টিতে পাটুলিমোড়ের কৃশানু দের মূর্তিটা দেখছিল। এসি বাসের ভেতরে হালকা ঠান্ডা, এফ এমে একটা পরিচিত গলা বাজে বকছিল। তার বকার রেশ ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বেজে ওঠে “ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে…”। আর সেই মুহূর্তে রিমির চোখে চোখ পড়ে যায় সাগ্নিকের। সাগ্নিক বুঝতে পারে বুকের ভেতরের তটরেখায় এক সমুদ্র ঢেউ আছড়ে পড়ে। আর কি আশ্চর্য, ভোকাল কর্ডের গোলমেলে জটটা সেই আঘাতে হঠাৎই খুলে যায়। “কলেজে যাচ্ছেন বুঝি?” বলে উঠে নিজেই সাগ্নিক বুঝতে পারে কথাটা খুব বোকাবোকা হয়ে গেল।
পুরো দক্ষিণ কলকাতা জানে রিমি কলেজ যাচ্ছে। এই ধরণের প্রশ্নের যা খুশি তাই উত্তর হতে পারে। উত্তর না দিলে আরো এক হাঙ্গামা। ঝাড়খণ্ডি ফেসবুক গ্রুপে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বসে থাকতে হবে। রিমি মৃদু হেসে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ায়। “ভালবেসে সখি”কে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে রেখে রিনরিনে গলায় জিজ্ঞেস করে “আপনি?”
এইরে, আরো এক যন্ত্রণা। সাগ্নিক যাচ্ছে কোথায়? প্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলতে হলেও সহজে গলা দিয়ে সেটা বেরোতে চায়না। সাগ্নিক উত্তর খোঁজে। ছোটবেলায় “বাঙালী জীবনে রবীন্দ্রনাথ’ বলে একটা রচনা আসতো। এফ এমে রেডিও জকি সেই রচনাটাই শোনাচ্ছিল। গদগদ কণ্ঠে বলে ওঠে “কোনো প্রেমিক হয়তো এই মুহূর্তে তার মনের মানুষকে এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটাই শোনাতে চায়।” ভ্যাবাচ্যাকা মুখ করে রিমির দিকে তাকায় সাগ্নিক। রিমিও কথাটা শুনেছে। মুখ নামিয়ে নেয় ও। খুব নরম গলায় সাগ্নিক বলে ওঠে - “এমনিই”, তারপর একটু সাহসে ভর দিয়ে বাসের সাউন্ডবক্সের দিকে ইঙ্গিত করে বলে - “হয়তো, ওই গানটা শোনাবার জন্য।”
সেতো বেশ কয়েক মাস হয়ে গেলো। এখন ট্রাফিক সিগনালে ঘোর বৈশাখে “ফাগুন লেগেছে বনে বনে” শুনলেও বিরক্ত হয়না সাগ্নিক। রবীন্দ্রনাথ কার কখন কাজে লেগে যায় তার ঠিক আছে? বরং প্রখর রোদ্দুরের মাঝে দুএক টুকরো সাদা মেঘ দেখলে কবিগুরুর দাড়ি ভেবে একটা প্রণাম ঠুকে দেয়।
কিন্তু বিপদটা অন্য জায়গায়। রিমির থিম সঙ হচ্ছে “ও যে মানে না মানা”। রিমি যে সময়ে ডাকবে সেই সময়েই যেতে হবে সাগ্নিককে। যেমন আজ বিকেল তিনটেয় ওকে প্রিয়া সিনেমা হলের সামনে যেতে হবে। কিন্তু আজ বিকেল চারটেয় অফিসে একটা মীটিং আছে। রিমিকে সেটা জানাতে বেশ কয়েকটা লালমুখের ইমোজি পাঠিয়ে দিয়েছে ও। এই রকম পরিস্থিতিতে আগে বেশ কয়েকবার বসকে টুপিটাপা দিয়ে বেরোতে হয়েছে। কিন্তু টুপির ব্যবসাটা বস ধরে ফেলেছে মনে হয়। আজ সাগ্নিককে মীটিং-এ থাকতেই হবে। অফিসে ঢুকে ঠিক দুটো নাগাদ একটা “সরি, আটকে গেলাম” বলে মেসেজ ছেড়ে দিয়ে ফ্লাইট মোডে চলে যাবে ঠিক করে নেয় সাগ্নিক।
মীটিংটা একদম জোলো। বসের চেম্বারে একদম পেছন ঘেঁষে বসেছে সাগ্নিক। ফ্লাইট মোডে থাকা মোবাইলে সেই গেমটা সবার চোখ এড়িয়ে টুকটুক করে খেলছিল ও। বিপদ বুঝলে ‘পজ বাটন’ টিপে খুব মনোযোগ দিয়ে মীটিং শোনার ভান করছিল। জীবনটাও তো একটা গেম। কুড়িয়ে রাখা কয়েন থেকে কখন একটা লাইফ পাওয়া যায় তার ঠিক আছে? মীটিং যখন শেষ হল তখন সাগ্নিক আড়াই লাখ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে। অফিস থেকে বেরিয়ে ঠিক করে নেয় একদম তিনলক্ষ করে মোবাইলটার ফ্লাইট মোড বদলাবে। এরমধ্যে বেশ কটা কয়েন কুড়িয়ে নেয় সাগ্নিক। একটা লাইফ জমা হয়ে থাকলো। তিনলাখ দশ হাজারে গিয়ে খাদে পড়লো সাগ্নিক। খুব একটা খুশি খুশি মন নিয়ে বাসে চড়ে মোবাইলটা স্বাভাবিক মোডে ফিরিয়ে দেয় সাগ্নিক। আর তখনি মায়ের ফোনটা যেন আছড়ে পড়ে - “তোর বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, তুই শীগগির আয়।”
সাগ্নিক বুঝতে পারে ও একটা অতলস্পর্শী খাদে তলিয়ে যাচ্ছে। অস্থিরভাবে লাইফলাইন খুঁজতে থাকে ও।
..................
বাইপাসের ধারে নার্সিংহোমটার একতলা যেন দুঃখ, যন্ত্রণা আর আতঙ্কে মিশমিশে কালো হয়ে আছে। সাগ্নিক কয়েকবার রিমিকে ফোনে করার চেষ্টা করেছে। সুইচ অফ। মা নার্সিংহোমের বাইরে সাগ্নিকের জন্য অপেক্ষা করছিল। সাগ্নিককে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ে মিতা। জড়ানো গলায় পুরো ঘটনা বলতে থাকে।
সাগ্নিককে না পেয়ে রিমিকে ফোন করে মিতা। আজ সকালেই নাকি রমাপদের নাম্বারটা বাবা লিখে নিয়েছিল। খোঁজখবর নিয়ে জেনেও গিয়েছিল কার নাম্বার। বাবা মা সকালেই জেনে গেছে রিমি কার মেয়ে। একটু দুঃখ তো হয়েইছিল। দুপুরবেলা ওরকম বিপদে মিতার মনে হয়েছিল একমাত্র রিমিকে ফোন করলে ও সব কাজ ফেলে ছুটে আসতে পারে। মায়ের মন।
ডাক্তার বলেছে আর কিছুক্ষণ দেরি করলে শঙ্করবাবুকে নাকি বাঁচানো যেতোনা। এখন জ্ঞান ফিরেছে। কাল কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করে পেসমেকার বসানো হবে।
“রিমি কোথায় মা?” ভয়ে ভয়ে সাগ্নিক জিজ্ঞেস করে।
“দেখনা ভিজিটিং আওয়ার শেষ হতে চললো, জ্ঞান ফেরার পর থেকে কিছুতেই তোর বাবা মেয়েটার হাত ছাড়ছেনা। ওরও আবার মোবাইলে চার্জ ফুরিয়ে গেছে। রিমিদের বাড়িতে আমিই ফোন করে জানিয়ে দিলাম ওর যেতে দেরি হবে।”
চোখ ভর্তি জল নিয়ে লাইফলাইনের ওপর থেকে নেমে আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে সাগ্নিক।
Osadharon sundor
ReplyDelete