0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - চিত্তরঞ্জন হীরা

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


কিছুটা বাস্তব, কিছুটা কল্পনা
চিত্তরঞ্জন হীরা 



#

ভাবছি, ভেবেই চলেছি। বোধ চেপে ধরছে বিবেককে, বিবেক সত্তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে - ইতিহাস তো থেমে থাকে না, তাহলে সমাজ-সভ‍্যতাকে যখন পাল্টে যেতে দেখি, তখন পুরোনো বাস্তবের সঙ্গে নতুন বাস্তবের সংঘাত নিয়ে আমাদের সংশয়টা কীসের! নতুনকে আমরা সহজে মেনে নিতে পারিনা কেন?

এই 'কেন'র দ্বন্দ্বমূলক বিস্ময়গুলিই আমাদের কিছুটা নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে। কিন্তু আমরা কি সঠিকভাবে প্রশ্ন করতে শিখলাম! মাঝে মাঝে আমরা ভুলে যাই, অতীত মানেই সবটুকু ছেড়ে যাওয়া নয়। কালচেতনায় নিত্য বর্তমানের সঙ্গে কাছের অতীত এবং দূর ভবিষ্যতের একটা নিরন্তরের বন্ধন রয়েছে। কারণ মুহূর্তের বর্তমান যেমন মুহূর্তেই অতীতের দিকে ঢলে পড়ছে, তেমনি সময় তার চরাচর থেকে নাদেখা ভবিষ্যতকেই বর্তমানের হাতে তুলে দিচ্ছে। যা কিছু ঘটনা তার সবটুকুই এর মধ্যে ঘটছে, ঘটে চলেছে। এটা বিশ্বসংসারের আবহমান রীতি, এটাই সংস্কৃতি। আজ আবার নতুন করে সময়ের এক বিশেষ আবর্তে সে এসে দাঁড়ালো আর আমরা দুলে উঠলাম তার অন্তরের অন্তে স্থিত গভীর আলোড়ন নিয়ে। এই দুলে ওঠাটাই স্রষ্টার অনুভব।

# # #

এটা কোনও বিশেষ ভূমিকা নয়। শুধু ভাবছি আর ভাবা অভ‍্যেস করছি। ভাবতে ভাবতে প্রশ্ন জাগছে এই মুহূর্তে আমাদের অবস্থান নিয়ে। পুরোনো বাস্তবের সংঘাতটাকে আসলে দেখব কীভাবে! আমাদের বাইরের যাত্রার সঙ্গে ভেতরের অস্থিরতাকে মেলাবো কোন বিন্দুতে! কিছুটা দিশেহারা তো বটেই। এ কোথায় চলেছি আমরা! 

আরও একটা বড় কথা হল, এখন আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতার হাত ধরে ব‍্যক্তিবোধের বৃত্তটা বড় হতে হতে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেচে যে, কেউ কারো থেকে নিজেকে ছোট ভাবতে একটুও রাজি নই। এই ব‍্যক্তিবোধের নিরিখে বা ব‍্যক্তিস্বাতন্ত্রের আলোয় ইতিহাসকে বিচার করতে বসলে সে নিজেই তো বিবর্ণ হয়ে যাবে!

#

এতটা নেতিবাচক না হয়ে আমরা নাহয় একটু অন‍্যভাবেও ভাবি। এই যেমন সময়কে কি একেবারে নিরাবসানে দেখা সম্ভব! অর্থাৎ, যার কোনও শুরু নেই, শেষও নেই! আমরা দেখছি, চারপাশের বিন‍্যাস ভাঙছে,শাসন ভাঙছে, শাসনতন্ত্র ভাঙছে, এর কি কোনও দীর্ঘসূত্রতা নেই! নিশ্চয়ই আছে। আমরা যারা দেখতে চাইনি তাদের কথা আলাদা। কিন্তু প্রতিটি নতুন সৃষ্টির পেছনেও তো একটা ভাঙন থাকে। আলোড়ন থাকে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই একদিন একটা গোলাপের শিশুমুখ ঠিক জেগে উঠতেই পারে। জাগরণের জন্যেই আরেকটু বেশি জাগা। আরেকটু অপেক্ষার পা নয় সামনে বাড়িয়ে রাখা হল!

#

এভাবেই শুরু করা যেতে পারে এমন এক নতুনের খোঁজ, যার মধ্যে ব‍্যক্তিসুখের লালসা থাকবে না, উৎসমুখের দ্বারটি খুললেই জ্বলে উঠবে এমন একটি শিখা, যার আলোয় সীমার বাঁধন কেটে যাবে, শুরু হবে আত্মোৎসব। এ হল একটি সরলরেখার দুটি মুখ দুদিক থেকে টেনে বাড়িয়ে ধরা। অনিঃশেষের গন্তব্যে আর কোনও দুঃখ থাকবে না।

তাহলে আমাদের এটাও ভেবে দেখা দরকার, এই অনিঃশেষের প্রতিটি মুহূর্তকেই বা কীভাবে উপলব্ধি করতে চাই আমরা! শাশ্বত প্রাণ খেলছে ধুলোমাটিতে আপন শৈশব নিয়ে। হেসে খেলে সে যে ধুলোতেই লুটায়। এ কি প্রাণের মহিমা নয়!

#

একে যিনি গর্ভে ধারণ করতে পারেন, তিনিই স্রষ্টা। সে যখন গর্ভমুক্তি চায় তখন ভাষাই তার প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে। ভাষাক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রভূমির উপর দাঁড়িয়েই আগামীকে দেখার ইশারা আসে। একটা চলমান সিঁড়ি আমাদের নিয়ে চলেছে এমন এক গন্তব্যের দিকে, যেখানে কোনও বিষাদ নেই, অবিকল্প নেই। চলতে চলতে শববাহকেরা গাইছে পুনরুজ্জীবনের গান।

চলমানতার বিরুদ্ধে সবসময় একটা ষড়যন্ত্র করেই চলেছে অচলতা। কিন্তু একটু নিবিড় হলেই অনুভব করা যায়, সমস্ত স্থবিরতার মধ্যেই ঘুমিয়ে থাকে শিশুর পিতা। এখন আমরা বলতে চাই সেই-ই হল প্রাণের অস্তিত্ব। তাকে জাগাতে হবে। গাইতে হবে - "জাগাও পথিকেরে, ও যে ঘুমে অচেতন…"।

#

এর মধ্যে কি চেতনার প্রতিচ্ছায়া নেই! এও আমাদের ভাবতে হবে যে, সেখান থেকেই এক একটা অনিশ্চিত, এক একটা অসম্ভব এবং এক একটা অবাস্তবের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে চেতনার নতুন নতুন বাস্তবতা। যা তার অভিমুখ, অথচ ধরা দিচ্ছে না। তাকেই ধরতে হবে। 

যা ঠিক অবচেতনা থেকে উদ্ভূত নয়। পুরোনো বাস্তব এবং নতুন বাস্তবের মধ্যবর্তী এক আশ্চর্য কাল্পনিক অবস্থা। যেহেতু ভাবনা সত্য, সেইহেতু এই অবস্থাও বাস্তব। অবস্থার পুনরাবৃত্তি নয়, উজ্জীবনের হাত ধরে আরেকটি নতুন অবয়বের বাস্তবতাই সত্য হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে একজন বিজ্ঞানীর সৃষ্টি এবং একজন কবির সৃষ্টির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।

#

ঘটনাটি কীভাবে ঘটছে! অন্তর্নিহিত শক্তির জাগরণের প্রভাবে। প্রতিটি কাল্পনিক বাস্তবতা প্রতি মুহূর্তে একটি নতুন কাঠামোর জন্ম দিতে চায়। এ তার স্বভাব অভ‍্যেস। এভাবেই অনিশ্চিতকে নিশ্চিত করে,অবাস্তবকে বাস্তবের সম্ভাবনা দেখায়। যেভাবে চাঁদের লাবণ্যে একটি নারীর মুখ বাস্তব হয়ে ওঠে, যেভাবে পূর্ণিমার গোটা চাঁদ ঝলসানো রুটির বাস্তবতাকে বোঝাতে সাহায্য করে। এভাবেই আরেকটি নতুন সম্ভাবনার জন‍্যে আবার একটা অনিশ্চয়তার দিকে হেঁটে যাই আমরা।

কিন্তু যখনই কোনও নতুন সম্ভাবনাকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে কোথাও, তখনই বিরুদ্ধতার রব ওঠে। কেন? নতুনকে মেনে নেওয়ার ঔদার্য নেই বলে! নাকি অভ‍্যাসের চলনে আঘাত পড়ছে বলে? কে কিভাবে উস্কানি দেবেন বা বিবর্তনের ছাপ কোথা থেকে উঠছে, তার মধ্যে কোনও ঔপনিবেশিকতা রইলো কিনা, তাকে বুঝে ওঠার জন্যেও তো কিছুটা সময় চাই, অপেক্ষা চাই। কথা হল বিষয়টাকে দেখছেন কে কিভাবে!

#

বহুবারই একটি প্রসঙ্গ মনের দরজায় এসে টোকা মেরেছে যে, রবীন্দ্রনাথের lyricism-এর সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের intellectuality-র দ্বন্দ্বটি কি অবশ‍্যম্ভাবী ছিল না! এই সম্ভাবনাই বাস্তবে কবিতাকে নতুন বাঁকে এনে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এবং আজ যদি আমরা অবচেতনার পরবর্তী স্তর খুঁজতে বসি, তাহলে কি বাংলা কবিতার খুব সর্বনাশ হয়ে যাবে! সময়ের চলমানতায় অবচেতনা বা পরাবাস্তবই শেষ কথা হতে পারে না। বা এখানেই থেমে থাকা সে অর্থে ইতিহাসের পক্ষেও খুব স্বাস্থ্যকর কি!

আরেকটু অন‍্যভাবেই নাহয় বিষয়টাকে ধরা যাক - বিষয়চেতনা বস্তুর রূপান্তরিত সত্তার গঠনকে বুঝতে ও চিনতে সাহায্য করে। এই চেতনা মনের এমন একটি অবস্থা যে প্রতি মুহূর্তের বর্তমানের মধ্যে আগামীর সম্ভাবনাকে খুঁজে চলেছে। বর্তমানের সঙ্গে আগত ভবিষ্যতের সংযোগ ঘটাতে অস্থির হয়ে উঠছে। স্রষ্টা এভাবে বিষয়চেতনার অস্থিরতার মধ্যে ছায়া ছায়া নতুন একটা অবয়বকে দেখতে পান। আবার কখনও কখনও ইতিহাসের পায়ের শব্দ শুনতে পান। যে ধ্বনি বাদ‍্যযন্ত্রের সমাহারও হতে পারে, নাহলে একাকী নৈঃশব্দ‍্যের কুহুতান হবে! একজন স্রষ্টার বিচিত্র অনুভূতি বিচিত্র সব দৃশ্যের অবতারণা করতে পারে। পাঠক যতক্ষণ না সেই অনুভূতির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারছেন, ততক্ষণ তা অবাস্তব। যখনই ছুঁয়ে ফেললেন, তখনই তার মধ্যেও বেজে উঠল সেই সিম্ফোনিটা, যা থেকে তিনিও উপলব্ধি করতে পারছেন -

মগজ বাজছে মালকোষে।আর তুমি একাদশীর রাত
হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যাচ্ছ আবাহন মুদ্রায় দাঁড়ানো
ঝাপসা এক ঘরের ভেতর।
(রামকিশোর ভট্টাচার্য)

একে আমরা ভাবনার সঙ্গে বোধের বা ধ্বনির সঙ্গে বাদ‍্যের সংযোগসাধন বলতে পারি, বা তার একটা দিশা …।

#

রবীন্দ্রনাথের lyricism-এর মধ্যে কি কোনও intellectuality ছিল না! বিষয়টা তা নয়, এর মধ্যে যে অতিক্রমণের আপ্রাণতা রয়েছে, তারই উদ্দেশ্যপ্রণোদনা। একদিকে স্বভাবসংযোগ অন‍্যদিকে ঐতিহ‍্যের প্রতিষ্ঠিত প্রবণতাগুলো থেকে বেরিয়ে এসে নতুন রূপকে শব্দকে বাজিয়ে তোলার সচেতন প্রক্রিয়া। এ হল টেকনিক বদলের পরিক্রমা। ইতিহাসে যা বারবার ঘটেছে।

আমরা আসলে একটা বৈজ্ঞানিকদর্শনের পথে হাঁটতে চাই, জীবনানন্দ যাকে বলেছিলেন 'বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিদিব‍্যতা'। এপথেই ধ্বনির আণবিক সত্তাকে উপলব্ধি করতে চাই। ধ্বনি থেকে শব্দ, শব্দ থেকে বস্তু, গোটা বিশ্ব এভাবে যখন বস্তু এবং অবস্তুর আণবিক সত্তায় একাত্মতা অনুভব করতে পারবে, তখন জীবন ও মৃত্যু নিয়ে আর কোনও কোলাহল থাকবে না। আমরা গেয়ে উঠতে পারবো -

এখনো তোমার চোখে আমার জীবন
এবং মৃত্যুর নড়াচড়া
যেভাবে আভোগ স্থায়ী বেঁধে রাখে সঞ্চারী অন্তরা।…
(মঞ্জুষ দাশগুপ্ত)

এখানে আরও একটু বলে রাখা ভালো, সত্যকে নতুন রূপে খুঁজে পাওয়া তখনই সম্ভব, যখন বস্তু-অবস্তুর কণাতরঙ্গে ধ্বনির প্রাধান্যকে অনুভব করা যেতে পারে। যার মধ্যে থেকে শব্দ আসছে নতুন ধ্বনিতরঙ্গ বেয়ে। ধ্বনিপ্রভাবেই সে বিশেষ হয়ে উঠছে।

#

বিশেষের বিশেষ‍্যও একটি চিহ্নমাত্র। বস্তুকে এবং অবস্তুকেও চেনা আমাদের এই চিহ্নায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ভাষা যেমন সময়ভেদে, স্থানভেদে তার চিহ্ন বদলায়। বস্তুও ভাষাভেদে তার চিহ্ন বা নাম বদলায়। এই সরলসত‍্যটি বুঝে নিতে কেন যে আমাদের বিলম্ব ঘটে তা আজও উদ্ধার করা গেল না। আমরা শুধু অভিধানে অর্থ খুঁজে মরি। কিন্তু শব্দ কালে কালে অর্থের আধার বদলাচ্ছে, নতুন ধারকে সে নতুন নতুন বোধের জন্ম দিচ্ছে। স্বর, স্বরভূমি, স্বরক্ষেত্র তার বিস্তার ঘটাতে ঘটাতে পূর্ববর্তী চিহ্ন থেকে সরে আসছে। অর্থাৎ, আগের চেনা থেকে সরে আসছে। মুখের ভাষাও যেমন। আমরা একে তো 'বলাকথার বিবর্তন'হিসাবেও চিহ্নিত করতে পারি! অলৌকিক জ‍্যোৎস্নার ঘ্রাণ নিতে হলে আগে মধুচন্দ্রিমা চাই। চাই অনন্ত বাদাম ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া দানা দানা উপশম। আর তুলোর বিষাদ থেকে উত্থিত অনতিদূরত্বের সবুজবাগান গড়ে তোলা -

আপনার মণিবন্ধে কাঠবিড়ালির মত উঠছে, নামছে
আশৈশব স্বরবর্ণগুলি।
আপনার শাখায়, শিরায় দোল খাচ্ছে তাদের অজর নখর।
(ইন্দ্রনীল বিশ্বাস)

আপনার মানে আমার, আমাদের এবং অসংখ্য বহুবাচনিক ঘুলঘুলির প্রত‍্যাশা। যার মধ্যে বিবর্তিত কালের সেই উপশম, সেই শুশ্রূষা।

#

সময়ের কথা সময় বলবে। আমরা বলছি আমাদের একান্ত সহবাসের কথা, উপলব্ধির কথা। নিজেদের কথানদীর কথা। কিন্তু সময় কখনও পিছু ছাড়ে না। এই যে নিজের কথা বলব বলে সাতকাহন গাওনা বাজনা, সেও তো সময়ে দাঁড়িয়ে। অতএব দেখা যাচ্ছে সময় এবং কথা দুই-ই বহমান। সময় চলছে, শব্দও প্রবাহিত হচ্ছে নদীর মত। এক্ষেত্রে ছবিটা এমন, শব্দ=নদী, নদী=সময়, সময়=জল। অতএব জল=শব্দ। তাহলে কবিতা যেহেতু শব্দনির্ভর এবং শব্দ মূলত ধ্বনিনির্ভর, ফলে চলমান সময়ের ধ্বনিবৈচিত্রে কবিতার শব্দযোজনাও পাল্টে যেতে পারে। এই জলতরঙ্গে জীবনের ভাষাও বাজছে। প্রতিমুহূর্তে সুর পাল্টে পাল্টে পৌঁছে দিচ্ছে আমাদের কানে কানে।

এই বিজ্ঞান ও দর্শনকে আমরা গ্রহণও করতে পারি, আবার নস্যাৎও। জীবনকে যে যেভাবে দেখছে। শিল্প চলবে শিল্পের মত। আমাদের ব‍্যক্তিসত্তা এবং সৃষ্টিসত্তা এক নয়। ব‍্যক্তির ভেতরবাড়ি অস্থির না হলে সৃষ্টির আলোড়ন ঘটতে পারে না। এই আলোড়ন হল সত্তার জাগরণ। এই আলোড়ন একজন স্রষ্টাকে বাইরের সমস্ত টানাপোড়েন, অসঙ্গতি, হর্ষ-বিষাদ একেবারে অন‍্যভাবে দেখতে শেখায়। সবটা ভেতরে নিয়ে তিনি এবার খেলায় মাতবেন। অক্ষরের বীজ নিয়ে খেলা। নানা রহস্য তাঁকে টানছে-

ছবিতে যে সন্ধ্যামালতী পাঠিয়েছিলে
সে আমায় একা রাস্তায় ফেলে যায়,
রোবট পাখির দোয়া লাগা
সমানুপাতে।
(ধীমান চক্রবর্তী)

এই হল রহস‍্যের আরেক রূপ। ভাঙতে ভাঙতে অবাককেই দেখছি বাঙ্ময় হয়ে উঠতে, কখনও তরঙ্গ রূপে, কখনও তরঙ্গ-অভিভূত আলো রূপে, কখনও বুদবুদ-আভাসে। সে এক আশ্চর্য গর্ভমুক্তির খেলা। সমস্ত রহস‍্যই রয়েছে ঐ সৃষ্টির উৎসমুখে। আলোর অশ্বদল ছুটছে, ধাবিত হচ্ছে আসঙ্গ নিঃসঙ্গের অনুষঙ্গ নিয়ে।

# # #

এভাবে আমরা বারবার উৎসেই ফিরে যেতে চাই, আর উদ্ধার করতে চাই চিরনতুনের অপরূপ আত্মাকে। রূপ থেকে অরূপে, অরূপ থেকে অপরূপে যার নিরন্তর যাত্রা। এর মধ্যেই জীবন ও মৃত্যু, আলো ও অন্ধকারের জাগতিক লীলাখেলা। রাত্রির যখন প্রসব হল নাম রাখা হল নৈঃশব্দ্য।

#

যাহোক, বস্তু থেকেই বাস্তব। একটি বস্তুকে ভাঙতে ভাঙতে যা পাব, সেই এককেই তার প্রাণবিন্দু। ধরা যাক তাকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে নিক্ষেপ করা হল, সেখানে তার রূপের স্বরূপ কি? আমরা কীভাবে জানব! এখানেই কল্পনার বাস্তবতা। বস্তু বা অবস্তুর ভিন্নবাস্তব। কল্পনাই পারে তাকে একেবারে কাছে এনে দিতে। আর সেটি পারেন একমাত্র কবিই -

এককোণে জন্মদিন পড়ে আছে। আজ এই মৃত্যুবার্ষিকীতে
হে শ্মশানপাড়ার বন্ধু, তুমি স্রোতমাঝে এই দেহখানি রাখলে -
এতে যদি হাসি পায়
সাক্ষী থাকো চন্দ্রালোক, শীতে
(অরুণাংশু ভট্টাচার্য)

দুটি প্রাণ তখন যেন অবাধে এপিটাফ ফেলে অবাধে গেয়ে উঠছে একই গান - 'আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে'।

#

তো সেই আনন্দ এবং ধ্বনির সংযোগে রচিত হল বিশ্বটি, সেখানে কেন্দ্রের আর নির্দিষ্ট কোনও অবস্থান নেই। বিকেন্দ্রিক বা বহুকেন্দ্রিক। যদিও শিল্প যখনই তার চলাচলের কেন্দ্রকে অচল হতে দেখে, নস্যাৎ করতে চায়, বাতিল ঘোষণা করতে চায়। সে নিজের মতই ঘুরতে ঘুরতে অনির্দিষ্টের দিকে চলে যেতে চায়। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিদিব‍্যতার অভাবে আমরা শুধু পেছন পানে টানি। কিন্তু এই চাওয়াটা তার অভীষ্ট। তা নাহলে শিল্প বা সভ‍্যতার ক্ষেত্রে বিবর্তন কখনোই সম্ভব হতো না। সে একটা সম্ভবকে প্রথমে অসম্ভব করে। তারপর অসম্ভবের সম্ভাব‍্য বাস্তবগুলো ছড়িয়ে রাখে আলোর অন্ধকারে।

আসলে শিল্পবোধ বা পাঠের ক্ষেত্রে আমরা বেশির ভাগ সময়েই প্রভাবের উস্কানিতেই আটকা পড়ে থাকি। এটা স্বভাব অভ‍্যাস। অভ‍্যাস থেকে স্বভাবে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডী কাটা রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বভাব হল সংকটতাড়িত, এই সংকট জন্ম নেয় তলে তলে ভাবের বসত থেকে। মন এবং চরিত্রকে সে চালিত করে, নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণাধীন ভাবের মধ্যে অভাবই বেশি। একটা সীমাবদ্ধতা, একটা দৈন‍্য আমাদের পেয়ে বসছে, আমরা বুঝতে পারছি না। কেউ কেউ বুঝতে চাইছিও না। যখন বাঁধন কেটে খোলা হাওয়া প্রাণে লাগাবো, তখনই সংকটমুক্তি ঘটবে। আমাদের মনে রাখা বিশেষ জরুরি -

যেহেতু কবিতা শব্দশিল্প, সেহেতু শব্দের প্রচলিত দ‍্যুতি ব‍্যবহারে ব‍্যবহারে কমে আসতে থাকে এবং এই ক্রমক্ষীয়মান দ‍্যুতির উপর নির্ভরতা নতুন কবি যত দ্রুত কমিয়ে আনতে পারবেন ততই তার পক্ষে তা মর্যাদাব‍্যঞ্জক হবে।
(মঞ্জুষ দাশগুপ্ত)

এক্ষেত্রেও সেই ভাব - অভাবের কথা বলতে হয়। অভাবকে যতক্ষণ না আমরা সম‍্যক দেখি, ততক্ষণই নিজের ভেতর রচিত দৈন‍্যে বিচরণ করতে থাকি। আর ভাবি আপন আলোর ঐশ্বর্যে পৃথিবীকে কতই না আলোকিত করে চলেছি!

#

যেকোনও শিল্পকর্মে শোধন প্রক্রিয়াটি ভীষণই আবশ্যিক। প্রথমত আত্মসংশোধন। লেখকের বিশেষ চাতুর্যে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আবেগের তারতম্য থাকে, চোরাস্রোত থাকে। পাঠক যদি আবেগের ফাঁদে পড়েন বা অভ‍্যাসের ফাঁদে আটকা পড়ে থাকেন, তাহলে নতুন আলোর দ‍্যুতিকে স্পর্শ করতে পারবেন না। একজন লেখকের ক্ষেত্রেও যে কথা খাটে।

জীবন বড় একা। কবি তারচেয়ে আরও বেশি। একাকীত্ব কবির স্বপ্নভূমি। সেই ভূমিতে অষ্টচরণ ষোলো হাঁটু তিনি ছড়িয়ে দিয়ে আলোর পরত খুলবেন, এটাই বাস্তব। সমস্ত ঘোর কাটিয়ে তিনি নিজেকে টেনে নিয়ে যাবেন সেই অনির্দিষ্টের দিকে, যা হল একটা অতলগহ্বর, সেখানেই লুকিয়ে আছে যাবতীয় অসম্ভবের সম্ভবতা। বাকিটুকু নিছক কল্পনা…।

0 comments: