0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in


ধারাবাহিক


আহিরণ নদী সব জানে
রঞ্জন রায়


৬) 

অবশেষে এসে গেল এতওয়ার বা রোববার। 

গোটা ছুরি গাঁয়ে লোকজন শনিবারের রাত প্রায় জেগে কাটিয়েছে। দিল্লি থেকে মন্ত্রীজি আসবেন, সোজা কথা! অনেকেই জানে না দিল্লি ঠিক কতদূরে। 

রাজপরিবারের সঝলা কুমার, মানে সরপঞ্চ গেছেন বটে সে অনেক বছর আগে। উনি বললেন – উও ভারী সহর হ্যাঁয় জী। বড়ে বড়ে সড়ক, লাখো লোগ, বহোত গাড়ি –সব দৌড়তে হ্যাঁয়। রাস্তে মেঁ লালবাত্তি জ্বলতে হ্যাঁয়, গাড়ি রুক জাতী হ্যাঁয়। সব লোগ আংরেজি মেঁ গোঠিয়াতে; মাইপিলা টুরা-টুরি সব্বোঝন। অউ আব্বর উঁচা মকান। তঁয় সর উঠাকে দেখবে তো গর্দান টেরা হো জাহী। 

দেখে কে বহোত চীজ হ্যাঁয় জী; লালকিলা, কুতুবমিনার, বাদশাহ লোগোঁ কে মকবরা। পর মোর শির চকরাথে; দুবারা নহী জানা। কহ দিয়ে ব্যস। 

সবাই সেজেগুজে সকাল ন’টা থেকে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার দুপাশে সদর মহকুমা থেকে পুলিশের দল এসে দুপাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে হঠো হঠো করছে। ভীড় দেখে পঞ্চু ওর গুপচুক (ফুচকা) এর ঠেলা এককোণে লাগিয়েছিল। তারপাশে মঙ্গলুর পানঠেলা। পুলিশের লাঠির গুঁতোয় ওরা পাততাড়ি গোটালো। রাস্তায় জল ছেটানো হচ্ছে বার বার। মন্ত্রীজি কি ধূলোর মধ্যে হাঁটবেন নাকি? 

ওদিকে ব্যাংকের সামনের দেওয়ালে গজাল মেরে সাইনবোর্ড লাগানো হয়ে গেছে। বারান্দায় দুটো টেবিল। 

একটা টেবিলে উপর ব্রিফ কেস খুলে ম্যানেজার ছেলেটি একের পর এক অ্যাকাউন্ট খুলে সাইন নিয়ে পাসবুক তৈরি করছে। আর পাশের টেবিলে হেড অফিস থেকে আসা চাপরাশি একটা বেগনি কালি লাগানো স্ট্যাম্পপ্যাড নিয়ে নতুন গ্রাহকদের হাত ধরে ধরে অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফর্মে টিপছাপ নিচ্ছে। 

খাতা খোলার জন্যে চাই মিনিমাম পাঁচটাকা। সরযুবাঈ আঁচলের খুঁট থেকে গিঁট খুলে যে পাঁচটাকা বের করল সেটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। ম্যানেজার বলল এই নোট চলবে না। সরযূর মাথায় বাজ! এটা ও স্বামীর থেকে লুকিয়ে চালের হাঁড়ির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। ওর কাছে আর তো নেই। অনুনয়-বিনয় করে বলল যে পরে নোট বদলে দেবে। আজ যেন ওকে ফেরানো না হয়। ম্যানেজার নোট ফেরত দিয়ে বলল খাতা খুলে গেছে। যেদিন ভাল নোট বা পাঁচটাকার সিক্কা নিয়ে আসবে সেদিন পাসবুকে এন্ট্রি করে ওর হাতে দেওয়া হবে। 

সরযূর পেছনে লাইনে দাঁড়ানো বিসাহু অধৈর্য হচ্ছিল। আওরত জাত হলো বেওকুফ। ওদের ব্যাংকে আসার দরকার কি? ওরা এসব নিয়মকানুনের কী বুঝবে! খামোখা সময় বরবাদ করা। আরে বাবা এসব হলো পুরুষের আঙিনা। 

ও সরযূকে একরকম খসকো-খসকো করে ঠেলে সরিয়ে গর্বিত মুখে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ম্যানেজারকে বলল খাতা খুলে দিন, আমি বিসাহুরাম যাদব। কিন্তু মুখভর্তি পান, ফলে কথা স্পষ্ট হলো না। বিরক্ত ম্যানেজার বলল পান ‘বাহর থুককে আও’। 

আট আনার পান বাইরে থু করে ফেলে দিতে হবে? এই চ্যাঙড়া ছোঁড়া ভেবেছে কী! সে যাকগে, বিসাহু ওকে পরে দেখে নেবে। একদম নাপ দেঙ্গে সালে কো! সারে হোঁশিয়ারি নিকল জায়েগি। কিন্তু এখন ও বারান্দার কোনায় গিয়ে পিক গিলে হাত দিয়ে মুখ মুছে কামিজের পকেট থেকে দশটাকার নোট বের করে টেবিলের সামনে হাজির হলো। 

বিসাহুর দশটাকার নোটে পানের পিকের দাগ। 

ম্যানেজার আবার বিরক্ত। এই গেঁয়োগুলোকে ব্যাংকের আদব-কায়দা রীতি রেওয়াজ শেখাতে কতদিন লাগবে কে জানে! 

হতভম্ব বিসাহু ক্রুদ্ধ চোখে ম্যানেজারের দিকে তাকায়। বলে যে ওর সরকারি নিয়মকানুন ভালই জানা আছে। ও এই গাঁয়ের গেঁয়ো লোক নয়। মহকুমা সদরে কৃষিবিভাগের চাপরাশি। থাকে অফিসের পাশের গাঁ ফরসাবাহারে। ছুরি হলো ওর শ্বশুরবাড়ি। এখানে ব্যাংক খুলছে তাই শালাশালীর অনুরোধে ও খাতা খুলতে এসেছে। নইলে এই গেঁয়োদের জন্যে খোলা গ্রামীণ ব্যাংকে ও সু-সু করতেও আসত না। ওর নোটে কোন খারাবি নেই,খুঁত নেই। নম্বরটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এখন ম্যানেজার বেশি নাজ-নখরা করলে ওর শ্বশুরবাড়িতে ‘পেস্টিজ’ যাবে। ফলে ও বাধ্য হয়ে সোজা মন্ত্রীজির কাছে কমপ্লেইন করবে। ও সরকারি আদমি, মন্ত্রীজি অবশ্যই ম্যানেজারের বেয়াদপি সহ্য করবেন না। এখন ছোকরা ভেবে দেখুক। 

ছোকরা তিরিশ সেকেন্ড ওর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। নিঃশ্বাস নেয়, ইনডাকশন ট্রেনিং এর ম্যানুয়াল আওড়ায়। তারপর শান্ত গলায় বলে—অগলা আদমী আ জাও, নেক্সট! 

ভীড়ের মধ্যে একটা হুররে গোছের আওয়াজ ওঠে। কেউ বলে –আরে দামাদবাবু, জাও; শ্বশুরাল জাকে আরাম করো। 

কেউ ফক্কুড়ি করে চিমটি কাটে। চল না গা! তোলা ছোটি শালী বুলাথে। আহিরনতির ঘুমায়ে বর লে যাবে ওলা! 

যা না রে! ছোট শালী ডাকছে যে; ওকে আহিরণ নদীর পাড়ে ঘুরিয়ে আন। 

ক্রুদ্ধ অপ্রস্তুত বিসাহু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চায় কে এই ছ্যাবলা ! 

অন্যদিক থেকে শোনা যায়—হাঁ হাঁ; জা। ছুপাছুপি খেল গা। অব হমন লা কাম করে দে। 

হ্যাঁ হ্যাঁ; যা। গিয়ে লুকোচুরি খেল গে। কিন্তু আমাদের কাজ করতে দে! 

এবার বিসাহুকে সামলানো মুশকিল হলো। ওর মুখগহ্বর থেকে সিগরির কয়লার আগুনের হলকার মত বেরিয়ে আসতে লাগল অদৃশ্য মক্কারদের উদ্দেশ্যে মা-বাপ তুলে গালাগালি এবং সামনে আসার চ্যালেঞ্জ। 

সেই চ্যালেঞ্জ কোন পুরুষ গ্রহণ করল না। কিন্তু ভীড় ঠেলে বেরিয়ে এল একটি মেয়ে। সে অনায়াসে বিসাহুর হাত ধরে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল- হঠ রে রোঘা! জব মন্ত্রীজি আহি তব নালিশ কর লেবে। অব খসক। 

মেয়েটি সোজা ম্যানেজারের সামনে গিয়ে বলল খাতা খুলানা হ্যাঁয়। দশ রুপিয়া। 

স্তম্ভিত ভীড় থেকে আওয়াজ উঠল। লাইন মেঁ নহী থী। ওকর খাতা লা ঝন খুলিহ সাহাব। 

লাইনে ছিল না; ওর খাতা যেন খুলো না সাহেব! 

ম্যানেজার বিপন্ন বোধ করে, হেড অফিস থেকে আসা অভিজ্ঞ চাপরাশির দিকে তাকায়। সে চোখ সরিয়ে নেয়। সমস্যার সমাধান মেয়েটি নিজেই করে নেয়। 

ভীড়ের দিকে তাকিয়ে কেটে কেটে বলে—কেইসে? সবঝন একহী লাইন মে কেইসে? মরদ আঊরতমন সব জগাহ মা অলগ অলগ লাইন লগাথে; এতি একহী লাইন? ছুরি গাঁওকে অলগ কানুন হবে কা? ই হ্যাঁয় আউরত মন কে লাইন। পহেলা ম্যায়। সারে বাঈমন মোর পাছু আ জাও। 

এবার হেড অফিসের চাপরাশি গলা তোলে। বলে ঠিক কথা। দুটো লাইনে সব লেগে পড়। মেয়েরা এই মেয়েটির পেছনে এস। একজন ছেলের লাইন থেকে, তার পর একজন মেয়েদের লাইন থেকে। এক কে বাদ এক; আমি দেখব যাতে কোন অন্যায় না হয়। 

ম্যানেজার কৃতজ্ঞ বোধ করে। সে ফর্ম নিয়ে নাম জিজ্ঞেস করে। দ্রুপতী বাঈ। তারপর মেয়েটি ব্লাউজের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা দশটাকার নোট বের করে। ম্যানেজারের চোখে পড়ে সুডৌল স্তন; কপালের ঊপর একটা কাটা দাগ, সেলাইয়ের। ও বুঝতে পারে মেয়েটির চোখ সজাগ, ওর দৃষ্টিকে অনুসরণ করছে। ও লজ্জা পায়। সামান্য ঘামে ভেজা উষ্ণ নোটটি ড্রয়ারে ঢোকায়। তারপর মেয়েটির দিকে না তাকিয়ে ওকে টিপছাপ দিতে পাশের টেবিলে যেতে ইশারা করে। মেয়েটি কোন কথা না বলে টেবিল থেকে ম্যানেজারের কলমটি তুলে নিয়ে ফর্মে দাগ দেয়া জায়গায় একটু বড়ো বড়ো তেরছা অক্ষরে লেখে দুরুপতী বাঈ। 

ম্যানেজার আবার ওর দিকে তাকায়। এবার ও লাইন থেকে সরে গেলে পাশের লাইন থেকে এক আধবুড়ো বলে ওঠে- আব্বর টেইম লাগিস; অব মোর কাম লা কর দেহ জী! 

ম্যানেজার নেক্সট বলার আগেই রাস্তার দিক থেকে হল্লা শোনা যায়—মন্ত্রীজি আ গয়ে! মন্ত্রীজি আ গয়ে! লাউড স্পীকারে বেজে ওঠে দেশভক্তির গান—মেরে দেশ কী ধরতী সোনা উগলে, উগলে হীরামোতি। 

মাথায় লালবাতি লাগানো গোটা কয়েক সাদা অ্যামবাসাডর গাড়ি পুকুর থেকে উঠে গা ঝাড়া দেওয়া রাজহাঁসের গরিমায় এগিয়ে আসছে। তার আগে চোখে রোদচশমা পরনে সাফারি স্যুট জনাকয়েক হোমরাচোমরা দ্রুত পায়ে ব্যাংকের প্রবেশপথ আড়াল করে দাঁড়িয়ে গেছে। মাথায় গান্ধীটুপি গলায় উত্তরীয় পরনে দামি খাদির স্যুট স্থানীয় বিধায়ককে সবাই চেনে। উনি ইংরেজ আমলে রায়বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন। পৈতৃক সম্পত্তি ছুরি গাঁয়ে এবং আহিরণ নদীর ওপারে ও বাঙ্গো নদের কুলে অজগরবাহার বনের ধারে সতরেঙ্গা, জেঙ্গা আদি গাঁয়ে এর কত হাজার একর জমি পতিত পড়ে আছে তা বোধহয় উনি নিজেও জানেন না। থাকেন বিলাসপুরে দুর্গের মত একটি বিশাল বাড়িতে। তার আউট হাউসে একটি ধর্মশালা মত আছে, যাতে ছুরি গাঁ থেকে কেউ শহরে গেলে ওখানে রাতটা কাটাতে পারে। 

গত তিনটি বিধানসভা নির্বাচনের সাতদিন আগে ওঁকে সবাই এ গাঁয়ে দেখেছে। উনি মধ্যাহ্ন ভোজন সেরেছেন রাজবাড়িতে। ওঁর জীপ গাড়ি নিয়ে চেলাচামুন্ডারা ছুরির সাতটি পাড়া চষে বেরিয়েছ্বে। আর সহিস মহল্লা ও ধনরাস বানচর এসব পড়োশি ছোট ছোট গাঁয়ে –যাদের জনসংখ্যা মেরেকেটে ৬৯৭ কি ৫৩৪—গরীবগুর্বোদের পাড়ায় গিয়ে নোটের বান্ডিল খুলে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে। কোমরে ঘুনসি বাঁধা ন্যাংটোপুটো কালোকোলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল মহানন্দে গাড়ির পেছনে দৌড়েছে ঘুড়িধরার মত আনন্দে। আর বড়োরা হাত জোড় করে দাঁড়িয়েছে ঝোলাভর্তি নারঙ্গি বা ধেনোমদের বোতল পাবে বলে। দেখ, কথা দিয়েছ, কোন গড়বড়ো না হয়। সবাই কৃতজ্ঞতায় গলে যায়। বলে নুন খেয়ে গুণ না গাইলে ধম্মে সইবে। আমরা বাপ-পিতামোর সময় থেকে শুধু আপনাকেই চিনি; মারলেও আপনি, বাঁচালেও আপনি। আমাদের দিক থেকে কথার খেলাপ হবে না। একটু দয়াদৃষ্টি রাখবেন গো! বিলাসপুরে আমাদের মুখিয়া কোন কাজ নিয়ে গেলে ওর মাথায় যেন রায়বাহাদু্রের বরদহস্ত থাকে। দারোয়ান যেন দেখা করতে দেয়। সেবারের মত না হয়। 

থাকবে, থাকবে! সেবারে নতুন দারোয়ান ছিল যে! কিস্যু জানত না। ওটা অ্যাকসিডেন্ট। সে কি রোজ রোজ ঘটে? 

আজকে বিধায়কজি কাউকে দেখছেন না; ওঁর লক্ষ্য শুধু মন্ত্রীজির গাড়ি। এটা যে ওনার পৈতৃক গাঁ। আও-ভগতে যেন ত্রুটি না হয়। কোন ব্যাটা মুখ্যু-মাতাল যেন সামনে না পড়ে। 

গাঁয়ের লোকজন মন্ত্রীমশাইকে প্রথম দফায় চিনতে ভুল করল। মালা দিল কলেক্টরকে। সরপঞ্চ ধমক খেয়ে তোতলাতে লাগল। মন্ত্রীজি ভাল মানুষ; কিছু মনে করেন নি, বরং প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছেন। যথারীতি অনেকগুলো মালা পরানো হলো। স্বাগতগীতের সময় ছিল না। স্কুলের বাচ্চারা ‘ভারত মাতা কী জয়’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। কলেক্টর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে মাইকে ঘোষণা করে দিলেন যে ওঁদের আরও অনেকগুলো কার্যক্রম আছে। ব্যস্ত কার্যক্রম। তাঁর মধ্যেও মন্ত্রীজি দয়া করে এসেছেন এ ছুরিগাঁয়ের পরম সৌভাগ্য। তবে এখানে এই প্রোগ্রামের বরাদ্দ সময় আধাঘন্টা। ওঁর ভাষণের পর পাসবুক বিতরণ করে উনি ফিরে যাবেন বিলাসপুর। সেখানে আরও কার্যক্রম আছে। 

মন্ত্রীজি গাঁয়ের জনতা ও বিধায়কজিকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন যে এই ব্যাংক গরীবদের জন্যে খোলা হয়েছে। শুধু গরীবরাই এখানে কর্জ পাবে, বড়োলোকেরা নয়। তারা টাকা জমা রাখলে ভাল সুদ পাবে। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীজি আমাদের মাতা সমান। উনি চান যে গাঁয়ে গাঁয়ে মহাজনী শোষণ বন্ধ হোক। তাই এই ব্যাংক। গরীবেরা এখানে ঢুকে অধিকারের সঙ্গে কর্জ চাইতে পারে। এমনকি বিয়েশাদি, বালবাচ্চার পড়াশুনো সবকিছুর জন্যে কর্জ দেওয়া হবে। কেউ যেন সুদখোরের কাছ থেকে ঘটিবাটি বন্ধক রেখে লোন নিয়ে ভিটেমাটি চাটি না করে। 

সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। আবার শোনা গেল ভারতমাতার নামে জয়ধ্বনি। এবার পাসবুক বিতরণের পালা। মোট দশটি পাসবুক মন্ত্রীজি দেবেন। উনি চলে গেলে বাকি পাসবুক সরপঞ্চ কুমারসাহেব দেবেন। 

প্রথম পাসবুক খাতা ক্রমাংক ১/১, রসেলু। হ্যাঁ, ম্যানেজার কথা রেখেছে। চারদিকে হাততালি, ক্যামেরার ঝলক। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে রসেলু, মন্ত্রীজির পায়ে হাত দিয়ে কপালে ঠেকায়। ১/১০ পাসবুকটির গ্রাহক দ্রুপতী বাঈ। ও পায়ে হাত দিতে গেলে মন্ত্রীজি মানা করে মাথায় হাত ছুঁইয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন যে ওর আদমি কী কাজ করে? উত্তরে দ্রুপতী জানায় যে ওর কোন মরদ নেই। মন্ত্রীজি মুচকি হেসে কলেক্টরকে ইংরেজিতে বলেন যে এটা কি ঠিক হলো? মহাভারতে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী এই গাঁয়ের দ্রৌপদীর একটাও না ? ঘোর কলি! 

সবাই মুচকি হাসে। সঙ্গের এলিট গোষ্ঠীর একজন ইংরেজিতে বলে—আপনার আশীর্বাদে জুটে যাবে। আপনি ব্রাহ্মণ। আবার হাসি। 

উনি প্লেট থেকে গুণে দুটি কাজু আর দুটো কিসমিস তুলে মুখে দিয়ে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে হাত নেড়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি এগিয়ে গেল। জনতা জয়ধ্বনি করল। 

এবার বাকি পাসবুক দেওয়ার পালা। সরপঞ্চের নির্দেশে বনরাজ সিং চোঙা ফুঁকে ঘোষণা করে দিল যে সবাই যেন চা খেয়ে যায়। এর খরচ গ্রাম পঞ্চায়েতের। 

ধীরে ধীরে ভিড় কমতে লাগল। এই সু্যোগে ম্যানেজার মাইক খোলার আগে পাবলিকের উদ্দেশে একটা ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে বোঝাল যে ব্যাংকে লেনদেন এর জন্যে কী কী জরুরি আর ব্যাংক খোলা ও বন্ধ হওয়ার সময় সারণী কী। এটা জানাতেও ভুলল না যে এই ব্যাংক সোমবার বন্ধ থাকবে, শনিবার আদ্দেক দিন। কিন্তু রবিবার খোলা থাকবে, যাতে সেদিন ছুরির হাটের দিন, লোকজনের কোন অসুবিধে না হয়। 

একঘন্টার মধ্যে সরপঞ্চের ‘যাও সবে নিজ নিজ কাজে’ নির্দ্দেশ পেয়ে সবাই ঘরে ফিরে গেল। ক্লান্ত ম্যানেজার চাপরাশিকে বলল কালকের দিনটাও থেকে যাও। একটা দিন তোমার সাহায্যে নর্মাল ব্যাংকিং তো হোক। 

বেলা চড়ছে। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দূর। ব্যাংকের সামনের রাস্তায় একটা কালো গোরু চরে বেড়াচ্ছে। অন্যমনস্ক ম্যানেজার ভাবে কালো গোরুর দুধ নাকি মিষ্টি হয়। রসেলুর ছেলে ঠুল্লু কাল থেকে সকালে এসে ঝাঁটপাট দিয়ে ব্যাংক খুলবে। বলল কালো গরুর দুধ নিয়ে আসবে যদি সাহাব খেতে চান। আর চায়ের জন্যে আনবে গুঁড়ো দুধ। 

এমন সময় শোনা গেল চেনা সুরে কেউ গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে আসছে। 

উৎকর্ণ ম্যানেজার চিনতে পারে যে সুরটা হলো নাগিন সিনেমার হিট ‘মন ডোলে রে, তন ডোলে রে’। 

কিন্তু কথা গুলো ছত্তিশগড়ি। 

ঠুল্লু হেসে বলল—সাহাব ও হলো ঝোলটু পাগলা। ওর বৌদি খাবারে বিষ মিশিয়ে ওকে পাগল করে দিয়েছে, বাড়ি থেকে বার করেও দিয়েছে। ও এর তার দ্বারে মেগে খায় আর সারাদিন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গান গায়। 

‘তোর দাঈ মর গয়ে, তোর দদা মর গয়ে। তোর লেইকা পড়ে বিমার রে, 

অব কউন চরায়ে ছেরি-বোকরা’। 

তোর মা গেছে মরে, তোর বাপ গেল মরে; তোর ছেলেটাও হবে বিমার, 

আজ কে চরাবে তোর ছাগলছানা?

0 comments: