0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১৪


বুড়ি নিজের গাড়িতে রাখা ফলের ঝুড়ির দিকে একবার তাকাল।

তারপর আবার তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলে উঠল … ‘থলি? কী ভাবে দেব?’

গ্রেক মাথা নাড়ল।

বুড়ি মহিলার কণ্ঠস্বর গম্ভীর এবং একটা উষ্ণতা আছে। গ্রেক তাকিয়ে দেখতে থাকে মহিলা তার গাড়ির পাদানিতে দাঁড়িয়ে গোড়ালি উঁচু করে গাড়ির মাথায় ফলের ঝুড়ির দিকে হাত বাড়াল। মহিলার পা দুটো বেশ লম্বা, ভাবতে লাগল গ্রেক। গ্রেকের জিভে জল চলে এল অ্যাপ্রিকটগুলো দেখে। ইসস, মা যদি এরকম অ্যাপ্রিকট পেত! অথচ এখানে বাজারে ফেলে ছড়িয়ে রয়েছে এই ফল। শশাও। গ্রেক গাড়ি থেকে একটা ফল তুলে মুখে দিল। বেশ ডাঁটো অথচ মিঠে। আবার নরম, একটু উষ্ণ।

- ‘দারুণ!’ বলে উঠল সে।

বুড়ি মহিলা আবার তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। আলগা কাগজের টুকরো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একটা ঠোঙার মত বানিয়ে সাবধানে ফলগুলো রাখল সে। বুড়ির চোখের দৃষ্টিটা একটু অদ্ভুত।

-‘আর দেব?’ জিজ্ঞেস করল বুড়ি।

মাথা নাড়ল গ্রেক। বুড়ি কাগজটা সাবধানে পেঁচিয়ে একটা পুলিন্দার মত বানিয়ে তার হাতে দিল।

সে পকেট থেকে বড় অঙ্কের কাগজের নোটটা বের করল। ‘এই যে!’

‘ওহহো হো… নাহ!’ বুড়ির চোখের দৃষ্টি বিস্ফারিত হল। বুড়ি মাথা নাড়তে লাগল। কিন্তু সে নিয়ে নিল নোটটা। এক মুহূর্তের জন্য গ্রেকের কব্জি শক্ত করে ধরে রইল বুড়ি। যদিও কব্জিটা ধরে রাখার সেরকম কোনো প্রয়োজন ছিল না, তবুও। গ্রেকের কব্জিটা ধরে বুড়ি নিজের ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরে রইল একশ’র নোটটা। তারপর নিজের স্কার্টের নিচ থেকে পয়সার থলিটা বের করে সাবধানে।

‘না’… নরম ভাবে বলে গ্রেক। … ‘রেখে দাও, রেখে দাও টাকাটা’… ত্রস্ত চোখে সে তাকায় চারিদিকে। সবাই কি তাকিয়ে আছে তার দিকে?

ব্যস্ত রাস্তা। একটা ট্রাম বেরিয়ে গেল। ‘ছেড়ে দাও’ সে চেঁচিয়ে ওঠে… ‘ছেড়ে দাও’… সে নোটটা আবার নিয়ে নেয়।

বুড়ি ঠোঁট কামড়ে ধরে। সে জানে না বুড়ি মহিলা রেগে যাচ্ছে, নাকি মজা পাচ্ছে।

সে রাগতভঙ্গিতে দ্বিতীয় একটা অ্যাপ্রিকটে কামড় দেয়। অপেক্ষা করে। মোটা মোটা ঘামের ফোঁটা জমতে থাকে তার কপালে। কাগজের ঠোঙায় সামলে ধরতে থাকে ফলগুলি। তার মনে হয় বুড়ি মহিলা ইচ্ছে করে সময় নষ্ট করছে।

দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় তার।

কিন্তু বুড়িটা যদি পাগলের মত চেঁচিয়ে ওঠে। লোক জড়ো হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া হাঙ্গেরি ওদের মিত্রশক্তি। শত্রু নয়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অপেক্ষা করে। একজন সৈন্য বেরিয়ে আসে সরাইখানাটা থেকে। এ আরেকজন। যে একটু আগে ঢুকেছে, সে নয়। এর বুকে মেডেল ঝোলানো আছে; তিনটে … তার উপরে হাতেও শিল্ড আছে। গ্রেককে অভিবাদন করল এই সৈনিক। গ্রেক মাথা নাড়ল।

আবার একটা ট্রাম চলে গেল। পথের আরেক দিক দিয়ে লোকজন চলাফেরা করছে। অনেক লোকজন যাচ্ছে আসছে। তার পেছনে কাঠের বেড়ার ওপাশে নৌকা নাগরদোলাটা আবার হাল্কা হাল্কা দুলতে শুরু করেছে।

বুড়ি বোধ হয় তার থলেতে যত নোট আছে, সব গুছিয়ে বের করছে। তার পর কয়েনগুলো। গাড়ির বাক্সের সামনে কয়েনের স্তুপ হয়ে গেছে।

বুড়ি তারপর গ্রেকের হাত থেকে নোটটা নেয়। তারপর খুচরো নোটগুলো প্রথমে গুছিয়ে পাটপাট করে ফেরত দেয়। তারপর কয়েনগুলো প্যাকেট করে দেয়।

‘আটানব্বই’… বলে বুড়ি। গ্রেক চলে যাবে, এমন সময় আবার বুড়ি তার কব্জিটা চেপে ধরে। বুড়ির হাতটা বেশ চওড়া, গরম আর শুকনো। মুহূর্তে বুড়ি তার মুখটা গ্রেকের কানের কাছে নিয়ে আসে।

‘মেয়েছেলে?’ ফিসফিস করে ওঠে বুড়ি… ‘লাগবে নাকি? সুন্দরী মেয়েছেলে?’

-‘ন্‌না… সত্যিই না’… গ্রেক ছিটকে সরে যেতে চায়। বুড়ি স্কার্টের তলা থেকে হাতড়ে একটা কাগজের টুকরো বের করে তার হাতে গুঁজে দেয়।

‘আছে’… বুড়ি আবার ফিসফিস করে… ‘সব লেখা আছে।‘

গ্রেক টাকার নোটগুলোর সঙ্গে রেখে দেয় কাগজের টুকরোটা।

বুড়ি ঘোড়ার লাগাম হাতে নিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। গ্রেক ফলের পুলিন্দা সামলে রাস্তা পেরিয়ে ফিরে আসে সরাইখানার খাবার ঘরে।

যে টেবিলে ওই প্রেমিকযুগল বসে আছে, সেটা এখনও পরিষ্কার করা হয়নি। গ্রেক এই দেশের লোকজনকে একেবারেই বুঝতে পারে না। প্লেটের উপর, গ্লাসের কিনারাতে ঝাঁক বেঁধে মাছি বসে আছে; তারি মধ্যে তরুণ প্রেমিক তার প্রেমিকার কানে ফিসফিস করে উদ্দাম প্রেমালাপ চালিয়ে যাচ্ছে।

সরাইখানার মালিক গ্রেকের দিকে এগিয়ে এলো। গ্রেক ফলের পুলিন্দাটা টেবিলে রাখল। সরাইখানার মালিক আরেকটু কাছে এগিয়ে আসবার পর গ্রেক বলে উঠল,

‘একটু হাতমুখ ধোবার ব্যবস্থা আছে?’

লোকটা চোখ বড় বড় করে তাকাল। গ্রেক বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠল… ‘হাতমুখ ধোয়া… দুত্তোর… হাত ধোব’… সে নিজের হাত ঘষে ঘষে হাত ধোয়ার ভঙ্গি করে।

লোকটা হঠাৎ বুঝতে পেরে মাথা নাড়ে, ঘুরে দাঁড়িয়ে গ্রেককে পিছনে আসবার জন্য ইশারা করে। গ্রেক লোকটাকে অনুসরণ করে। সামনে একটা সবুজ পর্দা ফেলা। লোকটার চাহনি একটু অন্যরকম ঠেকছে এখন। লোকটা কি কিছু বলতে চায়?

সরু, লম্বা একটা করিডোর পেরিয়ে লোকটা একটা দরজা খুলে দেয়।

-‘আসুন’ লোকটা বলে। জায়গাটার পরিচ্ছন্নতা দেখে গ্রেক অবাক হয়। সিমেন্টের বাঁধানো বেসিন। দরজাগুলো সাদা রঙ করা। বেসিনের পাশে সাদা তোয়ালে রাখা। লোকটা সঙ্গে করে সবুজ একফালি সাবান নিয়ে এসেছে।

-‘আসুন’ লোকটা আবার বলে। গ্রেক ধন্দে পড়ে যায়। লোকটা বেরিয়ে যায়। গ্রেক তোয়ালেটা একবার শুঁকে দেখে। পরিষ্কার মনে হচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি জ্যাকেটটা খুলে ঘাড়ে, গলায়, মুখে জল দেয়, ধুয়ে নেয়। ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেয় কনুই অবধি দুই হাত। তারপর জ্যাকেটটা পরে। ধীরে ধীরে একটু সময় নিয়ে হাত ধোয়।

আগের সেই সৈনিকটি ঢোকে। মেডেল ছাড়া সেই লোকটা। গ্রেক একটু সরে যায়, যাতে লোকটা ভেতরে টয়লেটে যেতে পারে। গ্রেক পোশাকের বোতাম আটকে সাবানটা তুলে নিয়ে কাউন্‌টারে ফিরে যায়, সেখানে ফেরত দেয় সাবানটা।

‘ধন্যবাদ!’ বলে সে আবার বসে টেবিলে।

সরাইখানার মালিকের মুখটা কেমন যেন কঠিন দেখায়। গ্রেক অবাক হয়ে ভাবে ওই সৈনিকটা কোথায় ছিল! কোণের ওই প্রেমিকযুগল চলে গেছে। টেবিলটা এখনও অপরিষ্কার। গ্রেক ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফিটা শেষ করে। ব্র্যান্ডিতে চুমুক দেয়। তারপর ফলে কামড় বসায়। রসালো, ডাঁটো ফলের জন্য তার ভেতরে একটা পাগলের মত খিদে জেগে উঠেছে। সে পর পর ছটা অ্যাপ্রিকট খেয়ে ফেলে। খাওয়ার পরে তার হঠাৎ বিরক্তি ধরে। ফলগুলো খুব গরম। সে ব্র্যান্ডিতে চুমুক দেয়। ব্র্যান্ডিও গরম।


সরাইখানার মালিক কাউনটারের পেছনে দাঁড়িয়ে ঝিমোয়, ধোঁয়া ছাড়ে। আরেকজন সৈনিক ঢুকে আসে। মনে হয় সরাইখানার মালিকের চেনা। দুজনে গুজগুজ করে। সৈনিকটা বিয়ার পান করে। মেডেল আছে একটা। ওয়ার মেরিট ক্রস। যে সৈনিকটা টয়লেটে ঢুকেছিল, সে এখন বেরিয়ে আসে। কাউনটারে পয়সা মিটিয়ে যাবার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে অভিবাদন করে। গ্রেক অভিবাদন ফিরিয়ে দেয়। তারপর শেষে যে সৈনিক এসেছিল, সে বেরিয়ে যায়।

বাইরে নাগরদোলাটা দুলছে। নাগরদোলার ধীর অথচ বন্য গতির ছন্দে গ্রেকের মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। সে কোনোদিন ভুলবে না আজ নাগরদোলায় উঠবার স্মৃতি। যদিও সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল; সেটা অবশ্য একটা বিশ্রী ব্যাপার। সেটা বাদ দিলে ব্যাপারটা স্মরণীয়।

বাইরে যানবাহনের সংখ্যা আর গতিবেগ বেড়ে চলেছে। আরও জীবন্ত হয়ে উঠছে চারপাশ। বাইরে একটা আইসক্রিম পার্লারের সামনে লাইন দিচ্ছে মানুষ। পাশের সিগারেটের দোকানটা খালি ছিল, সেখানেও লোকজন যাতায়াত করছে।

কোণের নোংরা সবুজ পর্দাটা সরে গেল। একটা মেয়ে বেরিয়ে এল। সরাইখানার মালিক সঙ্গে সঙ্গে গ্রেকের দিকে তাকাল। মেয়েটাও তাকাল গ্রেকের দিকে। গ্রেক মেয়েটাকে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছে চোখের কোণ দিয়ে। মেয়েটা বোধ হয় লাল পোশাক পরেছে। গাঢ়, সবজেটে আলোয় পোশাকটা বর্ণহীন দেখাচ্ছে। গ্রেক শুধু মেয়েটার সাদাটে মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল; ভারি মেকাপ করা, ঝকঝকে লাল রঙের লিপস্টিকে এঁকে ঠোঁটদুটো আকর্ষণীয় করবার চেষ্টা করেছে।

(চলবে)

0 comments: