0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in



রামবল্লভী---এক লোকায়ত সম্প্রদায়
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
.
লোকমুখে শোনা ছিল, বাঁশবেড়িয়া ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে একদা রামবল্লভী সম্প্রদায় নামে একটি গৌণধর্মের শাখার এখনও কিছু মানুষজন আছেন। সেই উৎসাহেই বাঁশবেড়িয়া ও তার আশেপাশে খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। আমাদের সঙ্গী ছিলেন আমার ‘রামায়ণ—লোকায়ত গানে’ গ্রন্থটির ( প্রকাশক—ঋতবাক,কলকাতা) সহ-লেখক শ্রী নিলয় সরকার। নিলয়দার কাছে প্রাচীন ও লোকায়ত নানা ধরনের গানের সংগ্রহ আছে। ‘রামায়ণ—লোকায়ত গানে’ বইটির প্রায় সব গানই তাঁর সংগ্রহের। রামবল্লভী গানেরও কয়েকটি তিনি আমায় দিয়েছেন। তাই খুব উৎসাহভরে এই খোঁজাখুঁজি শুরু করি। গানগুলির জন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু খুবই দুঃখের কথা, রামবল্লভী সম্প্রদায় সম্বন্ধে সেখানকার মানুষজনের কাছ থেকে বিশেষ কিছুই সংগ্রহ করা যায়নি সেদিনের খোঁজাখুঁজিতে। অতি সামান্য কিছু তথ্য ও নানান বই এবং নানাজনের লেখা থেকে যা তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলি অবলম্বন করেই এই লেখাটি লিপিবদ্ধ করা গেল। সঙ্গে রইলো রামবল্লভী সম্প্রদায়ের ভক্তদের কিছু গান।
খোঁজ চলছে, চলা উচিত। বাংলার ধর্মীয় আন্দোলনের ইতিহাসের একটি বড় পরিচ্ছেদ হল এই গৌণধর্মগুলি।
.
অক্ষয়কুমার দত্ত, উপেন ভট্টাচার্য, সুধীর কুমার চক্রবর্তী প্রভৃতির রচনা থেকে জানতে পারি, বাংলার লোকায়ত বা গৌণধর্মগুলির উত্থান প্রায় সমসাময়িক। সব গৌণধর্মগুলিরই বয়স প্রায় দুশো থেকে আড়াইশো বছর। এই সময়ের মধ্যেই ধর্মগুলির উৎপত্তি ও বিকাশ। যেহেতু এই লৌকিক ধর্মগুলির উত্থানের কারণ বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তথা উচ্চবর্ণের বিরোধ, তাই বিভিন্ন লোকায়ত ধর্মগুলির মধ্যে জীবনযাপন, সাধনা পদ্ধতির কিছু অমিল থাকা সত্ত্বেও পারস্পরিক কিছু মিল লক্ষ্য করা যায়। সাহেবধনী, কর্তাভজা, বলাহাড়ি প্রভৃতি বিভিন্ন গৌণধর্মগুলির জেগে ওঠা সমাজে ও জীবনে এক আশ্চর্য মাত্রা যোগ করে। এই সব গৌণ ধর্মগুলি কিন্তু পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে অদ্ভুত এক বন্ধনে জড়িত। তাই এক ধর্মের মানুষের কাছে শোনা যায় আর এক ধর্মের মানুষের গান। আবার আউল-বাউল বলতে আমরা যা বুঝি, তাঁদের গানও অনেকেই ব্যবহার করেন। আসলে, এই সব গৌণ ধর্মগুলির মূল লক্ষ্য হল মানব ভজনা। অর্থাৎ মানুষের নিজের মধ্যে যে সর্বশক্তিমান এক সত্ত্বা বিরাজমান, তাঁকে জাগানো, সে সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠা এবং মানুষের নিজেকে জানা, নিজেকে চেনা। তাই বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষও গান করেন সাহেবধনী সম্প্রদায়ের কুবীর গোঁসাই, লালশশীর গান; রামবল্লভী কিংবা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মানুষও গান করেন সাহেবধনী বা বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের। এ এক আশ্চর্য মিলমিশের জগত। মূল লক্ষ্য যদি এক হয় মানুষকে জানা ও চেনা, মানুষকে ভালোবাসা অর্থাৎ মানবতাবাদই যদি মূল লক্ষ্য হয়, সেখানে সম্প্রদায় বা ধর্ম কোন বাধা হতে পারে না। সুধীর চক্রবর্তী যেমন বলেছেন—‘ সংকীর্ণ শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে নয়, উদার মানবতা নিয়ে সহজ করে বাঁচা।‘ তাই বাংলার এই গৌণধর্মগুলি ভিন্ন হয়েও পরস্পর একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত, মানবতাবাদ আর সহজ জীবনই ছিল যাদের উদ্দেশ্য।
.
আছে মানুষে মানুষে যার ভেদাভেদ জ্ঞান,
সে রাজ্য গমনে তার মিলবে না সন্ধান।
---দুলালচাঁদ (ভাবের গীত)
আঠারো শতকে বৈষ্ণববাদ ও সুফীবাদের মিলন হল কর্তাভজা ধর্মীয় সম্প্রদায়। এই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গুরু হলেন আউলচাঁদ। আউলচাঁদের আটজন প্রধান শিষ্যের মধ্যে একজন ছিলেন রামশরণ পাল, যিনি নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অন্যতম পীঠস্থান এবং সেখানে প্রতিষ্ঠা হয় সতীমায়ের মন্দির। মন্দিরটির নামকরণ পরে করা হয়েছিল, রামশরণের স্ত্রীর নাম অনুসারে, যিনি রামশরণের পর এই ধর্মীয় সম্প্রদায়টির সর্বময় কর্ত্রী হয়ে ওঠেন। রামশরণের স্ত্রীর নাম ছিল সরস্বতী। তাঁর নামের প্রথম ও শেষ অক্ষর দুটি নিয়ে নামকরণ হয় ‘সতী’ এবং মন্দিরটি সতী মায়ের মন্দির নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে।
এই সম্প্রদায় মূর্তিপূজা, ও সমস্তরকম আনুষ্ঠানিক যাগযজ্ঞের বিরোধী। এখানে ‘কর্তা’ অর্থে ঈশ্বর। আউলচাঁদ ঈশ্বরকে ‘কর্তা’ নামে অভিহিত করতেন। সেই থেকে তাঁর সম্প্রদায় কর্তাভজা সম্প্রদায় নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মেরই মানুষ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। হিন্দুর গুরু মুসলমান আবার মুসলমানের গুরু হিন্দু তাও দেখা যায়। কোন রকম ধর্মীয়, জাতি এমন কি নারী-পুরুষের ভেদাভেদও ছিল না এই ধর্মীয় সম্প্রদায়টির মধ্যে।
আল্লা আলজিহবায় থাকেন
কৃষ্ণ থাকেন টাগরাতে।
আল্লা আর কৃষ্ণ নিয়ে আলাদা করে কোন মাথাব্যথা তাদের ছিল না। আঠারো শতকে এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যথেষ্ট প্রভাবশালী থাকলেও বিশ শতকের শুরুতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের সংষ্কার আন্দোলনের ফলে এই ধর্মীয় সম্প্রদায়টি দুর্বল হয়ে পড়ে ও নানাভাগে বিভক্ত হয়। প্রসঙ্গত, একথা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য যে, আউলচাঁদের নেতৃত্বে কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, কৃষক, মুচি, হিন্দু, মুসলমান অর্থাৎ সমাজের উচ্চ থেকে নিম্নবর্গ—অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ –সকলেই এই সম্প্রদায়ের অধীনে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। যেহেতু কর্তাভজা সম্প্রদায় সকল প্রকার মূর্তিপূজা ও যাগযজ্ঞের বিরোধী ছিল, স্বাভাবিক অর্থেই এটি ছিল মহামিলনের স্থান। হয়ত সেকারণেই কর্তাভজা সম্প্রদায়টি জনসাধারণের মধ্যে যথেষ্ট সম্প্রসার লাভ করেছিল এবং গ্রহণযোগ্যও হয়েছিল।
.
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে যে, গৌণধর্মটির স্ফুরণের কিছু পরে হিন্দু- মুসলমান ধর্ম আন্দোলনের প্রভাবে কর্তাভজা ধর্মটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দলের মধ্যে নানান মতবিরোধ দেখা যায়। মনে করা যায়, আনুমানিক উনিশ শতকের শেষভাগে রামবল্লভ নন্দন নামে এক ব্যক্তি যিনি নিজেও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের একজন প্রধান ছিলেন তাঁর নেতৃত্বে সম্প্রদায়ের একটি শাখা হুগলীর বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলে আবার নতুন করে ধর্মীয় সম্প্রদায়টির স্থাপনা করেন। বস্তুতঃ, রামবল্লভী সম্প্রদায়টিকে কর্তাভজা দলেরই একটি উপদল বলা যায়। কর্তাভজা দলের একাধিপত্য এই সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ মেনে নিতে পারেননি, ফলস্বরূপ তাঁরা একটি নতুন দল তৈরি করেন, যেটির মূলে ছিলেন রামবল্লভ নন্দন। এছাড়া হুগলীর শ্রীনাথ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণকিঙ্কর ও মতিলাল নামে তিনজন ব্যক্তির নামও জানা যায়, যাঁরা ছিলেন রামবল্লভী সম্প্রদায়ের মূল হোতা। হুগলীর এক মতিলাল রায়ের কথা জানা যায়, যিনি ছিলেন বিখ্যাত ব্যক্তি। তাঁর জন্ম, চন্দননগর, বোড়াইচন্ডীতলায়। একমাত্র কন্যার মৃত্যুতে সংসারের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মতিলাল রায় সস্ত্রীক বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। পরে তিনি প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও পরবর্তীকালে এই মতিলালের সঙ্গে স্বদেশীদের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল, ওঁর বাসভবন থেকে স্বদেশীদের নানাভাবে সাহায্য করা হত বলেই জানা যায়। হুগলীর এই মতিলাল রায় ও বাঁশবেড়িয়ার রামবল্লভী সম্প্রদায়ের উল্লেখিত মতিলাল রায় এক ব্যক্তি কিনা সেটি ঠিক জানা যায়নি।
শোনা যায়, বর্তমান বাঁশবেড়িয়া পাবলিক লাইব্রেরীর কাছে গঙ্গার তীরে রামবল্লভী সম্প্রদায় একটি আখড়া নির্মাণ করেছিলেন। যদিও সেসব আজ গঙ্গার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়াও জানা যায় যে, কাঁচড়াপাড়ার কাছে পাঁচঘরা গ্রামেও রামবল্লভীদের একটি আখড়া ছিল। এবং আখড়া বা বেদী প্রতিষ্ঠার সময় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় পাঁচহাজার মানুষের একসাথে অন্নসেবা করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের গীতা পাঠ, খ্রীষ্টানদের বাইবেল ও মুসলিমদের কোরাণ গ্রন্থ একসাথে পঠিত হয়েছিল। এমন একটী জাতি-ধর্ম বিরোধী ধর্ম যে জনপ্রিয়তা লাভ করবে এবং করেছিল সেকথা বলাই বাহুল্য।
রামবল্লভী সম্প্রদায়ের একটি গান ছিল --
কালী গাড (গড) খোদা, কোন নামে নাহি বাধা।
বাদীর বিবাদ দ্বিধা তাতে নাহি টলো রে।
মন কালীকৃষ্ণ গাড খোদা বল রে।।
আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশের এই নিভৃত পল্লিতে আজ থেকে প্রায় দুশো বছরেরও অধিক আগে এইধরনের একটি সর্বধর্ম সম্প্রদায় গড়ে তোলা কম কৃতিত্ব নয়। পরবর্তীকালে ‘হুগলীর ইতিহাস’ থেকে জানা গেছে, বাঁশবেড়িয়া বা বংশবাটিতে রামবল্লভী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে ১৬ই ফাল্গুন, ১২৩৭ সালের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় তার একটি বিবরণ প্রকাশিত হয়। সেখানে উপরোক্ত যে তিনজন বাবুর কথা বলা হয়েছে যাঁদের দ্বারা সেদিন ‘রামবল্লভী’ নামে যে সম্প্রদায়টির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তাঁরা হলেন বংশবাটির মথুরানাথ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র শ্রীনাথ মুখোপাধ্যায়, রামলোচন গুণাকরের পুত্র কৃষ্ণকিঙ্কর গুণাকর এবং নবকিশোর বাবুর পুত্র মতিলাল বাবু। মতিলাল সম্বন্ধে আগেই বলা হয়েছে। তার বেশি কিছু আজ আর জানা যায় না। এই সম্প্রদায়ের প্রার্থনা ছিল---
‘হে পরমেশ্বর, তোমার দাসের এই প্রার্থনা যে তোমার আজ্ঞা পালনে সকলে যেন সক্ষম হয়; ইহাতে আপনার যেমন ইচ্ছা তাহাই হউক।‘
কর্তাভজা ধর্মটির নিম্নবর্গ ও অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তো ছিলই, ফলে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে মৎসজীবিরা বাস করতেন ও জীবিকা নির্বাহ করতেন তার একটি বড় অংশ এবং রামবল্লভের নিজস্ব সম্প্রদায় সুবর্ণবণিক সমাজ (অর্থাৎ কাঁসারি সমাজ) এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে রইলেন। তাঁর নেতৃত্বেই শাখাটি পরে উৎকর্ষতা বৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করে।
পরে রামবল্লভের নামানুসারেই সম্প্রদায়টির নাম হয় রামবল্লভী সম্প্রদায়। যদিও পরবর্তীকালে রামবল্লভী সম্প্রদায়ে উপযুক্ত নেতার অভাবে সম্প্রদায়টি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। কৃষ্ণকিঙ্করের পৌত্র গোপীরমণ গুণাকরই ছিলেন এই সম্প্রদায়ের শেষ সভ্য।
একথা অনস্বসীকার্য যে চৈতন্য পরবর্তী বাংলায় ইসলামধর্মের বেগ সামালানোর জন্য এসব উপধর্মের প্রয়োজন এবং অনেকাংশে তা প্রতিরোধের সহায়ক হয়েছিল। ইসলাম ধর্মগ্রহণের আবেগ ও বাধ্যতা অনেকাংশেই মানুষ এই গৌধর্মগুলিতে আকৃষ্ট হওয়ার জন্য কমে যায়। তাই এইসব গৌণধর্মগুলি চৈতন্য পরবর্তীকালে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
.
গৌণধর্মগুলির প্রকাশ, প্রচার ও ভজনার একটি বড় মাধ্যম হল সঙ্গীত। আগেই বলেছি, যেহেতু গৌণধর্মগুলির কোন কোনটির জন্ম একই ধর্ম থেকে কিংবা একই ধর্মের উপদল অথবা একটি বিশেষ স্থানে বিশেষ কোন ব্যক্তির দ্বারা অনুরূপ একটি ধর্মের উদ্ভব এবং গৌণধর্মগুলির প্রায় সকলের মূল লক্ষ্য ছিল মানব ভজনা, তাই তাদের ভাবের আদানপ্রদানও অনেকাংশে এক -- যা হল সঙ্গীত। রামবল্লভী সম্প্রদায়ের সঙ্গীত হিসাবে কিছু গান পাওয়া গেছে, যা আদতে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতার দ্বারা রচিত এবং রামবল্লভী সম্প্রদায় যেহেতু এই ধর্মেরই একটি উপদল, সুতরাং এই গান তাদের পক্ষেও গাওয়া স্বাভাবিক।
মানুষ চিন, মানুষ ভজ, মানুষ কর সার
সকলি মানুষের খেলা, মানুষ বিনে নাই আর।
মানব ভজনার এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মানবসেবার প্রসঙ্গটি এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আরো একটি শাখা হল সাহেবধনী সম্প্রদায়। রামশরণ পালের উত্তরপুরুষদের আধিপত্যের জন্য দলের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হয় এবং ফলে ভাগাভাগি। পরে তা মিটে গেলেও, ভক্তরা মীমাংসা মেনে নেননি। ফলে একদল সম্প্রদায়ের আদি পদকর্তাদের গানগুলিই মাধ্যম হিসাবে মেনে নেন, অপর দল সহজিয়াদের সংকীর্তনে মন দেন। পরবর্তীকালে সাধনা নিভৃতে চলতে থাকে এবং প্রায় সকলেই মূল স্রোতে মিশে যান। মানুষ ভজনাই সকল গৌণধর্মগুলির মূল লক্ষ্য হওয়ার জন্য পদকর্তাদের সাধনসঙ্গীতগুলি সকলের ক্ষেত্রেই গৃহীত হয়। আবার গৌণধর্মগুলির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হিন্দু-মুসলমান এই দুয়েরও কোন পার্থক্য ছিল না। তাই যখন শোনা যায় এই গান--
এই ব্রজধামের কর্তা যিনি
সেই ধনী এইসাহেবধনী
রাই এই সাহেবধনী।
তখন খুব বিস্ময়বোধ হয় না। কারণ ব্রজধামের কৃষ্ণ এবং রাই উভয়ই পুজিত হতেন সম্প্রদায়ের মুসলমান ভক্তদের দ্বারাও।
কত দেবতা গ’নে, সাধন করে মানব রূপ করিয়ে ধারণ
এই ভবে এসে মানুষ বেশে মানুষের করতেছে সাধন
ধন্য কলি মানুষ ধন্য
কলিতে মানুষ অবতার, পাইয়া মানবদেহ এ মানুষ চিনিলি নাকো
ভেবে দেখ মানুষ বিনে গতি নাইকো আর।
---বাঁকাচাঁদ

আরো একটি পদ--
যে ভাবেতে রাখেন গোঁসাই
সেই ভাবেতেই থাকি
অধিক আর বলব কি?
তুমি খাও তুমি খিলাও
তুমি দাও তুমি বিলাও
তোমার ভাবভঙ্গি বোঝা ঠকঠকি!
গানগুলির অর্থ পরিস্কার, বুঝে নিতে কোন অসুবিধা হয় না। লালশশীর একটি পদ আছে এইরকম---
যদি জানতে পারো কোথায় সহজ মানুষ হয়ে
হুঁশ ধরবি আপন জোরে, জীবিত কি আছে
জ্যান্তে মরে, লোকে সেই মানুষকে খুঁজে বেড়ায় যুগে যুগেতে
গুপ্ত ছিল প্রকাশ হল কলির সন্ধেতে
দেখলাম এই মানুষেতে মানুষ মিশিয়াছে
বৃন্দাবনে বাকি ছিল সাহেবধনীতে পূর্ণ হলো
জীবের দশা মলিন দেখে মা ঠাকুর প্রেমের বস্তা খুলেছে... ইত্যাদি।
একথা সত্যি, লোকমুখে শুনে শুনে গানগুলি হয়ত অনেকাংশেই আজ পরিবর্তিত। সকলের কাছে গানের কোন লিপিবদ্ধ খাতা বা তথ্য নেই। কিন্তু তবুও এই গানগুলিই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে সাধনা ও উদ্দীপনার আশ্রয়।
বাংলার সামাজিক ইতিহাসে এই সকল গৌণধর্মগুলির সমাজের তথাকথিত ব্রাত্যজনগোষ্ঠীকে একত্রিত করা এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঠাঁই দেওয়ার জন্য চৈতন্য পরবর্তী যুগে এক প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বাংলার গৌণধর্মগুলির এখানেই সার্থকতা।

0 comments: