0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in



প্রবন্ধগুচ্ছ 
অনিন্দিতা মণ্ডল 



ভূমিকা

প্রবন্ধ বা নিবন্ধ বলতে যে অর্থে একজন মানুষের প্রজ্ঞা ও বোধির বিস্তৃত পরিসর থেকে উত্তীর্ণ ভাষাস্রোতকে আমরা বুঝে থাকি, বলতে দ্বিধা নেই যে বর্তমান গদ্যকার তার থেকে শত যোজন দূরে। চর্চা অবিরত চলছে প্রজ্ঞাবান মানুষের চিন্তার প্রকাশকে যাতে ধারণা করতে পারা যায়।

এই চর্চা থেকেই কখনও কখনও কিছু গদ্যের জন্ম হয়েছে। প্রায় সবই প্রকাশিত। সম্পাদকের অকারণ বিশ্বাস থেকে একরকম আত্মনির্ভরতা এই গদ্যগুলির কারণ।

ঋতবাক সম্পাদক অশেষ ভালোবাসা দিয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে এগুলি মুদ্রিত থাকা দরকার। অন্তত লেখকের অপরিণামদর্শিতার একটি দলিল তো রইল! তবে বিভিন্ন লেখায় ছড়িয়ে থাকা মহাজনের উক্তি ও চিন্তা হয়ত পাঠককে মূল চিন্তায় প্রবেশ করতে উদবুদ্ধ করবে, এই আশায় সম্পাদকের হাতে পাণ্ডুলিপিটি দিলাম। মোট বারোটি প্রবন্ধ রইল।

অবশেষে, সম্পদে বিপদে যাঁদের স্মরণ করেছি চিরকাল তাঁদেরকেই স্মরণ করি।

মা ও মামনকে, যারা মুদ্রিত আকারে লেখা দেখতে পেল না।


সূচীপত্র

কথামৃত ও কমল কুমার, এবং বৈজু চাঁড়াল ও যশোবতী—একটি কাল্পনিক সংলাপ
দেহপিঞ্জরে বন্দী শুক, কমলকুমারের আত্মানুসন্ধান
শূন্যরূপা
গার্গী যাজ্ঞবল্ক্য ও মৈত্রেয়ী সংবাদঃ সত্যের সংঘাত
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসঃ পটভূমি, প্রভাব ও মর্ম
রঙ যেন মোর মর্মে লাগে
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ও ঈশ্বরত্ব
চেতনরূপিণী
আলো অন্ধকারে যাই
রুদ্র যত্তে দক্ষিণ মুখম
মৈত্রীর মূর্তপ্রতীক বুদ্ধ
ঋতু মধুমতী


কথামৃত ও কমল কুমার, এবং বৈজু চাঁড়াল ও যশোবতী—একটি কাল্পনিক সংলাপ


সদ্য প্রলয়োত্থিত ব্রহ্মাণ্ড যেমত, পুণ্যসলিলা হইতে উদ্ভূত একটি মুহূর্ত, এক্ষণে ক্ষিতি অদৃশ্য হইতে দৃশ্য হইবে। ব্রহ্মাণ্ড ব্যাক্ত হইয়া পুনর্বার প্রলয়বিস্মৃত হইবে। কেননা উহাই জীবনের স্বভাব। প্রলয় ভুলিয়া যায়। জন্ম স্মৃতিতে ধরে। স্থিতি বলিয়া যে কিছুই নাই, মুহূর্তের প্রতি পল মৃত্যু যে নির্দিষ্ট, এমত ভুলিয়া থাকে। একটি বিভ্রম মাত্র স্মৃতিতে রাখিয়া পুনর্বার কপালে করাঘাতজনিত সুখের সন্ধানে পতিতপাবনীর তীরে আসিবে। প্রত্যহ ঘটিয়া থাকে যাহা দেখিয়া পুনরায় ক্রন্দনের সুখ অনুভব করিবে। হায় কি হলো! কোথায় গেলো গো!

একটি বিরল মুহূর্ত আসিয়া সহসা দিক পরিবর্তন করে। হাহাকারের মধ্যে যে স্তনছিন্ন শিশুর আর্তি থাকে তাহা যেন আদিমাতার ক্রোড় হইতে টানিয়া আনিল এই মুহূর্তটিকে। এ পৃথিবীর ঘড়ির নিয়ম তাহার নীতি হইলনা।

ধীর পদসন্চারে একটি পূতজন্ম ঘটিল। কিছুকাল পূর্বের সেই অভ্যাসজনিত অসহায়তা এবং হৃতজীবনের অনুরাগজনিত দুঃখ ও ক্ষোভ এক্ষণে প্রশমিত হইল। মহামানব যেন সমাধির পরে ব্যূত্থিত হইয়াছেন।

ভেড়ী পথের সুউচ্চ আল হইতে তিনি দৃষ্টি সম্মুখে প্রসারিত করিয়াছেন। সম্মুখে কুলপ্লাবিনী, পাপনিবারিনী গঙ্গা। একটি দগ্ধচিতার উপরে জলের উচ্ছ্বসিত আবেগ ধূম্রজালের সৃষ্টি করিয়াছে। তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঐভাবে অপর পাড়ের শ্মশানের গন্ধ নাসিকায় টানিতেন। ভারী মিষ্ট লাগিত। সে কি পিশাচ সাধনার সময় ? এই দেহের পরিণতি যে কি অপূর্ব উপায়ে জগন্মাতা স্থির করিয়া থাকেন তাহা জানিলে মৃত্যু একটি মহৎ উপলব্ধি মাত্র মনে হইবে। দূরে একটি চাঁদোয়া ভাসিতেছে। ঢেউয়ের উপর নৃত্য করিতে করিতে অগ্রসর হইতেছে। তাঁর অধর তির্যক হাস্যে বঙ্কিম। বামুন বেশ গঙ্গা লাভ করেছে। দোসর চাই। শালা! সীতারামের জন্য তাঁহার অনুকম্পা জাগিল। সচরাচর যে অবস্থায় বৈরাগ্য কেন, মানুষ নিজশরীরের প্রতি নির্লিপ্ত হইয়া পড়ে, এ উন্মাদ সেই অবস্থায় দোসর কামনা করিয়াছে। তিনি বিরক্তিতে অধর কুঞ্চিত করিলেন। বলিলেন – মা, একী! মরতে বসেছে তাও দেহবুদ্ধি যায়না ? শুধু তাহাই নহে, এ উন্মাদ স্মশানে পরিণীত বধূর প্রতি নিজ অধিকার বলবৎ করিতে চাহিয়াছে। তাহার স্বর্গযাত্রার তরণীটি যেন একটি নবীনসুন্দর দেহতরণী, যশোবতী। দৃষ্টি আরো প্রসারিত হইল। এবার দেখিলেন একটি কাঠামো। দেবী বিসর্জন হইয়াছে। এ পোড়া দেশে দেবী আরাধনা বিসর্জনের পরিণতিই পাইয়া থাকে। যশোবতী এই কাঠামোটিকে অবলম্বন করিয়াই ভাসিতে ও বাঁচিতে চাহিয়া ছিলেন। বুঝেন নাই, সেই এক, যাহার হস্তপদ নাই, ইন্দ্রিয় নাই, অথচ যিনি নিয়ন্তা, তিনিই একালে যশোবতী নাম্নী প্রকৃতিকে অব্যক্তে লইয়াছেন। তিনি বিচলিত হইলেন না। উপরন্তু, প্রাণী মাত্রই এককালে মহাপ্রাণে মিলিবে। পঞ্চভূতাত্মক সৃষ্টি পঞ্চভূতেই মিলিবে। ইহাতে সন্দেহ নাই। গতরাত্রের রক্তিম চন্দ্রালোক মনে পড়িল। এমন ক্ষণ দুর্লভ। তিনি ভাবিতেছেন। এই স্থান অতি পবিত্র। শিব শব হইয়া পড়িয়া আছেন। শিবানী তাঁহাকে মুক্তি দিতেছেন। তিনি স্বগতোক্তি করিলেন। আহা, মা কোম্পানী। বাপের ক্ষমতা কি ? মা সগুণ। ত্রিগুণময়ী। বাপ নির্গুণ। তাই শব। মা অন্নপূর্ণা হয়ে মুক্তি দিতেছেন। তাঁর ভাঁড়ারে গুণত্রয় অফুরান ঐশ্বর্য লইয়া উপস্থিত। তবে ক্ষুদ্র প্রাণী মায়ের গুণগুলি গুলাইয়া ফ্যালে। তমোকে সত্ত্ব প্রতীতি হয়। সত্ত্বকে তমো। তাঁহার অধর প্রসারিত হইল। যেমত বৈজুনাথ। এসময় আলের উপর দ্বিতীয় উপস্থিতি অনুভব করিলেন। যদু মল্লিকের বাগানে পূর্বে তিনি বহু অশরীরী দেখিয়াছেন। মায়ের কৃপায় উদ্ধার হইয়াছে তারা। কিন্তু এ উপস্থিতি অশরীরী নহে। একটি জড়িত কণ্ঠস্বর শুনিলেন। ঠাকুর, মদ খাওয়া খারাপ নয়। মদ সৎ করেছে আমায়। তিনি দেখিলেন অদূরে উল্টানো নৌকার ন্যায় একটি খড় ও বাঁশের আড়া ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। সেই আড়ার পাশে কর্দমাক্ত বৈজু গড়াগড়ি যাইতেছে। তাহার শয়নাধার ভূমিটি অশ্রুতে নাকি গঙ্গার উচ্ছ্বাসে কাদা হইয়াছে তাহা সুস্পষ্ট ভাবে অনির্ণেয়। সুতরাং তিনি নির্লিপ্ত। এই স্থানটি তাঁর অতি প্রিয়। মা এভাবেই সব বন্ধন মোচন করেন।


পর্ব ২
আলো ক্রমে আসিতেছে। তিনি দেখিতেছেন নীল হিমাভ নভোমণ্ডল মুক্তাফলের ন্যায় মনোরম। শান্ত। মৃত্যুর অব্যবহিত পরে দেহমন অধিকার করিয়া রাখে যে বোধ, তাহা শোক বলিয়া জ্ঞাত বটে তবে শুচী শব্দের সহিত তাহা ওতপ্রোত। এক্ষণে শোকস্তব্ধ নির্জনতা অদ্ভুত শান্তভাব ধরিয়াছে। জাহ্নবী এক্ষণে স্থির ও ধীরগতিসম্পন্না। দেখিলে কেহ বলিবেনা যে মাত্র কয়েক প্রহর পূর্বে উহার প্রলয়নৃত্য ভাসাইয়া নিয়াছে এই শ্মশান। কিছুকাল পূর্বের সেই রক্তিম উচ্ছ্বাস আর নাই। ওই একটি শুভ্র পাতের উপর একটি পুষ্পাভ রশ্মি আসিয়া পড়িতেছে।মৃত্যুর পরেই জন্ম যেন অবশ্যম্ভাবী। একটি ঝর্ণা কলমের ডগা হইতে অবিরাম শব্দস্রোত আসিয়া তাহাকে মসীলিপ্ত করিল। তিনি উচ্চভূমিতে আরোহণ করিলেন। পদ্মে পদ্মে তাঁহার চেতনময়ী উত্থিত হইলেন। তিনি সেই ভগবতীর পদসঞ্চার শুনিলেন। কারণ শব্দই ব্রহ্ম। বাক, এই শব্দে আরাধ্য দেবী ব্রহ্মাণী। তিনি বলিলেন, কমল, আলো এসেছে। ওই একটা আলো আসছে। কিন্তু কোথা হতে আসছে বুঝতে পারছিনা। কমল, যিনি এক্ষণে শব্দের নির্ভুল শরীর খুঁজিয়া খুঁজিয়া কিছু আত্মস্থ। এই আহ্বানে আমূল কাঁপিয়া উঠিলেন। তিনি শুভ্র পাত খুঁজিয়া পত্রের অবতারণা করিলেন। " এই গ্রন্থের ভাববিগ্রহ রামকৃষ্ণের, ইহার কাব্যবিগ্রহ রামপ্রসাদের। " তাঁহার দক্ষিণ হস্তটি উর্ধে উৎক্ষিপ্ত হইল। আপনার অগোচরে তিনি গগনবিহারী হইলেন। চিদাকাশ এক্ষণে জগৎব্যপ্ত হইল। শরীর ভুলিলেন। দেহবোধ নাই। তাঁহার পরনের ধুতিটি খসিয়া পড়িল। নগ্ন দেহে গঙ্গার সম্মুখে তিনি দাঁড়াইলেন। মা মা, এই আর্তস্বরে ব্রহ্মাণ্ড টলিয়া উঠিল। এমত স্বর অব্যক্ত হইতে ব্যক্ত হয়, সচরাচর সেই মুহূর্ত দৃষ্ট হয়না। তিনি পুনরায় বলিলেন, মা মা তুই আমাকে এখানে আনলি কেন ? আমি কি এদের খাঁচার মধ্যে থেকে উদ্ধার করতে পারব ? জড়িত স্বরে বৈজু বলিল, ঠাকুর, খাঁচা কও ক্যানে ? খাঁচাটার মধ্যে যে প্রাণী ধুকপুক করে তাকে যে বড্ড মায়া হয়। আমি মাটি বড় ভালোবাসি ঠাকুর। আকাশ ভালোবাসি না। স্বগ্গ দেখি নাই। তিনি দৃষ্টি বৈজুতে স্থাপন করিলেন। প্রবৃত্তি আর নিবৃত্তি, দুটি আছে। এ ভৈরব দুটিতে টাল খায়। ধীরে ধীরে হস্ত দ্বারা কপাল স্পর্শ করিলেন। বৈজু স্পর্শে উঠিয়া বসিল। মদের নেশা বিলুপ্ত। তিনি চাহিয়া হাসিলেন। কহিলেন, মদ খেয়েছিস ? তা বেশ তা বেশ। মদ মানে আমি রে! মন মদমত্ত করী। মদ খেলে তোর আমি থাকবেনা। বৈজুর অবিশ্বাস হয়না। সে চাহিয়া থাকে। তিনি স্নেহপ্রশ্রয়ে বলিতে থাকেন। তবে তোর একটি ভাগবতী তনু হয়েছে বাবা। বৈজু অনুভব করে। সে শরীরটি যে কি, তাহা কেহ বুঝিবেনা। তাহারও সাধ্য নাই বুঝায়। যদি বুঝিতেই পারিত তবে যশোবতী ভুল বুঝিতনা। পান্না ভৈরবীর নগ্ন শরীরে যেমত লিঙ্গচিহ্ন ছিলোনা, একটি শুভ্র উপবীত দেহকে ঘিরিয়া রাখিয়া ছিল, সেইমত যশোবতীর নগ্ন দেহে সে উপবীত দেখিয়াছিল। তাহার মনে সঙ্গীত বাজিয়াছিল। "জানো না মন পরম কারণ, শ্যামা কেবল মেয়ে নয়। মেঘের বরণ করিয়া ধারণ মাঝে মাঝে সে পুরুষ হয় "। মহামানব লক্ষ করিলেন। বৈজু প্রকৃতির রূপে মোহগ্রস্ত হইয়াছে। তিনি অপেক্ষা করিলেন। বৈজু পুনরায় বলিল, ঠাকুর, কনে বৌ বড় সুন্দর। এমন সুন্দর দেখি নাই। এ শ্মশানে কতশত সতীদাহ হয়েছে। কতশত জ্যান্ত মানুষকে বাউনেরা সোনার লোভে পুড়িয়েছে, কিন্তু এমন সোনার প্রতিমা আগে দেখি নাই। মহামানব হাসিলেন। এ জগৎ তাঁর মায়া। তাঁর ভুবনমোহিনী মায়া। মায়াতে পড়েছিস বৈজু। বৈজু দুর্বল স্বরে কহিল – উপায় ? মহামানব পুনর্বার হাসিলেন। উপায় তাঁর নাম। যিনি মায়ায় বদ্ধ করেন তিনিই মুক্ত করবেন। এ সংসার তাঁর খেলা। কে বুঝবে ? বৈজুর নেশা কাটে নাই। এ মুহূর্তগুলি তাহার কাছে একপ্রকার অস্পষ্ট ও আচ্ছন্ন লাগিল। যশোবতীকে মনে পড়িলে কষ্ট হইতেছে বটে তবে ইহা মনে করিয়া শান্তি হইতেছে যে চিতা সাজাইতে হয় নাই। অগ্নি তাহাকে গ্রাস করে নাই।


পর্ব ৩
শান্ত প্রকৃতির মধ্যে বৈজু দেখিল মহামানব তাঁহার সম্মুখে বসিয়া। তাঁহার দুইটি অঞ্জলিবদ্ধ কর মৃদু উচ্চারণে থরথর। কি বলিতেছেন ? বৈজুর শ্রবণেন্দ্রিয় যেন বিস্তৃত হইয়া দেহকে অতিক্রম করিল। এ জগতে পূর্বাপর সকল উচ্চার সে শুনিতে পাইল। সেই গভীর গম্ভীর উচ্চারণ হইতে প্রতিভাত হইল সৃষ্টির আদিতে শব্দ হইয়াছিল। এক্ষণে মৃত্যুবৎ নীল অন্তরীক্ষ ভেদ করিয়া যে রক্তিম পুষ্পাভ আলোটি আসিয়া ঊষার আগমনবার্তা ঘোষণা করিতেছিল তাহারই খানিক মহামানবের মুখে পড়িয়া ছিল। তিনি কহিলেন – বৈজু, তুই কে ? বৈজু বলিল, ঠাকুর আমি চাঁড়াল। বামুন ত ছাড়, কোনও উঁচু জাত আমার ছায়া মাড়ায় না। কোথা থাকি আর ? এই শ্মশানই ভালো। মরা পোড়াতে বেশ লাগে আমার। ইহার পরই নিম্নকণ্ঠে বলিল – কিন্তু জ্যান্ত মানুষ পোড়াতে কি কষ্ট ঠাকুর! বৈজুর মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হইল। মহামানব গভীর দৃষ্টিতে চাহিলেন। বলিলেন – এমন প্রলয় কালে মা তাঁর সৃষ্টির বীজসকল কুড়িয়ে রাখেন। ঠিক যেমন গিন্নিদের একটি ন্যাতা কাঁতার হাঁড়ি থাকে। তাইতে শশাবীচি নীলবড়ি তোলা থাকে। তারপর আবার সৃষ্টির সময় মা সব বের করেন। এই কথায় বৈজুর দিব্য দর্শন হইল। সে দেখিতে পাইল, অকস্মাৎ ভূ ভূব স্ব ব্যাপিয়া একটি বিশাল জরায়ু যেন। জরায়ুস্থিত এক নবীন বিশ্বপ্রাণ ক্রন্দন জুড়িয়াছে। আকুল ক্রন্দনে মাতৃজঠরের হিমনীল তরল ছিন্ন করিয়া ফুটিতে চায়। নাড়ি ছিঁড়িয়া ভূমিষ্ঠ হইবার কালে রক্তের স্রোত ভুবন ভাসাইল। সেই স্রোত পুষ্পাভ বর্ণে গগন রাঙ্গাইলো। ধরায় নামিয়া পতিতপাবনী হইল। সে বিষ্ময়ে হতবাক হইল। এ কী! ঠাকুর হাসিলেন। বলিলেন – বাবা, ওই একই ভাবে আমরাও জন্মেছি। বৈজু প্রবল বেগে মাথা নাড়িলো। না না ঠাকুর, যশোবতী নিষ্পাপ। ফুল ফুটে নাই ভাবিয়া ঠাকুর পুনরায় হাসিলেন। আশ্বাসহস্তটি না সরাইয়া কহিলেন, বাবু মেয়েমানুষে টানে কেন গা ? বৈজু এক্ষণে স্থির। বাতাহত। ঠাকুর তাহার মনের পাতাল সন্ধান পাইয়াছেন। আকাশ নহে। পাইলে জানিতেন। বৈজু তাহাকে নরকরোটি পাদস্পর্শে পূত করিতে অনুরোধ করিয়া ছিল। সে নাকি সতী হইবে, সুতরাং দেবী। দেবীর পাদস্পর্শে করোটিতে মাংস মজ্জা ত্বক জন্মিবে। সে মূর্তি সিঁদুর পরিবে। ছেলে কোলে করিবে। বৈজু শ্মশানবাসী হইয়াও সংসারী হইবে। গৃহে তাহার স্ত্রী সন্তান থাকিবে। কিন্তু যশোবতী ভয় পাইয়াছে। আপনাকে বিশ্বাস করে নাই। নিজের দেবীত্বে তাহার নির্ভরতা ছিলোনা। করোটি দেখিয়া ভীত হইয়াছে। বৈজূকে কামনা করিয়াছে। প্রাণসংশয়কালে বৈজূকে আশ্রয় মানিয়াছে। অথচ নিকটবর্তী হইলে চণ্ডাল বলিয়া ঘৃণা করিয়াছে। যদিও বৈজু এ শ্মশানে নিত্য কতশত শাস্ত্র শুনিয়াছে। তাহার মার্গ দর্শন হইয়াছে। নিজ অন্তরে সে আত্মদর্শন করিয়াছে। আজ মহামানবের নিকট বৈজু কহিল – কনে বৌ হলে আমি আয়ান হবো, ওই সীতারাম কেলে ছোঁড়া হয়ে লীলে করবে গো ঠাকুর। কনে বৌ তাই পাথ্থনা করেছে। তাঁহার অধর প্রসারিত হইল। পুনর্বার এক অলৌকিক অপার্থিব আলোক দেখিতে পাইলেন। সমাহিতমূর্তি অস্ফুটে কহিলেন – বৈজু তুই চণ্ডাল নোস। তুই নেতি নেতি শুদ্ধাত্মা। এ শ্মশান তোর ঘর। তোর বাসনায় আগুন। তুই সনাতনী জননীর ভিতরের থাম। এক্ষণে আলো আসিয়া আছাড় খাইল। কমল কুমার কলম বন্ধ করিলেন। মনে গীত উঠিতেছে। তাহা শুনিবেন। সে অনাহত গীত তাঁহাকে সাজুয্য দিতেছে। তিনি আলোকে জড়াইয়া ধরিলেন।

[মাতৃশক্তি কল্পতরু সংখ্যা ২০১৯]

চলবে

0 comments: