0

গল্প - সজল কুমার মাইতি

Posted in



বেহেশত্ এর সন্ধানে
সজল কুমার মাইতি



"জাহাঁ তেরা নস্ক ই কদম দেখতে হ্যঁ
খয়াবঁ খয়াবঁ ইরাম দেখতে হ্যঁ"
মির্জা গালিব


এক

নাম মনসুর। মনসুর আলি। ডোমজুড় কলেজের বিএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। লেখা পড়া, খেলাধূলায় চৌকশ। ছাত্র রাজনীতিতে এস এফ আই এর সমর্থক ও সি আর অর্থাৎ ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ। ছাত্র রাজনীতি করে বলে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার মধ্যে নেই। পড়াশোনা ও ফাঁকিবাজির প্রশ্ন নেই। বরং পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো বলে স্যারেদের খুবই প্রিয়। আবার ছাত্রদের মধ্যে ও আলির জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী। যার যা প্রয়োজন আলি হাজির। কোনো কাজে পিছপা হওয়ার ব্যাপারই নেই। পড়াশোনা, আড্ডা, সমাজসেবা সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে সময় ও এগিয়ে চলে। আলি এখন ফার্স্ট ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ার। কলেজের জি এস। কিছু দিন পর ফাইনাল পরীক্ষা। তারপর কলেজ জীবন শেষ।

আজ নতুন ফার্স্ট ইয়ারের ফ্রেশার্স ওয়েলকাম। লাল গোলাপ ও চন্দনের টিপ দিয়ে নতুন ছেলে মেয়েদের বরন করা হল। এরপর জি এসের ভাষণ। হঠাৎ মাইক গেল বিগড়ে। " হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো "। কোন সাউন্ড জেনারেশন নেই। জি এস আলি কিংকর্তব্য অবস্থায় স্টেজের মাঝে দাঁড়িয়ে। আচমকা প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী মনোবীনা স্টেজে উঠে এসে আলির হাত থেকে মাইক প্রায় কেড়ে নেয়। " দিন তো, দেখি একটু"। মনোবীনা মাইক হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে। একটু ঝাঁকুনি দেয়। সুইচটা কয়েকবার অন অফ করে। হঠাৎ মাইকে সাউন্ড।

"তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।
এসো গন্ধে বরনে এসো গানে।"

মনোবীনা দু কলি রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে মাইক টেস্ট করার চেষ্টা করে। মাইক ঠিক হয়েছে বুঝে মনোবীনা আলির হাতে মাইক ধরিয়ে দেয়। " দেখুন, মাইক ঠিক হয়ে গেছে।" যেই আলি তার বক্তৃতা শুরু করতে যাবে ওমনি অডিয়েন্স থেকে একযোগে আওয়াজ ওঠে ' আগে গানটা কমপ্লিট হোক তারপর ভাষণ হবে'। অডিয়েন্সের দাবি। অগত্যা উপায় নাই। মনোবীনাকে সবার অনুরোধ রাখতে হয়। সবাইকে পুরো রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে শোনায় সে।

দুই

মনোবীনা ডোমজুড়ের এক জমিদার পরিবারের মেয়ে। ফর্সা সুন্দরী। একান্নবর্তী বিশাল পরিবার। কাজের লোকসংখ্যা ও অনেক। নায়েব গোমস্তা সবই আছে। ঠাকুরের বিশাল মন্দির। দূর্গা পূজো ও নিত্য পূজোর আয়োজন আছে। মন্দিরের সামনে বিশাল নাটমন্দির। প্রতি বছর এই নাটমন্দিরে দূর্গাপূজোয় যাত্রা পালা হয়। আশেপাশের কয়েক গাঁয়ের মানুষজন যাত্রা দেখতে আসে। বলা ভাল তারা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে এই যাত্রা পালা দেখার জন্য। পূজোর আনন্দ সবাই সমানভাবে ভাগ করে নেয়। বাচ্চা বুড়ো কেউ বাদ যায় না। জমিদার বাড়িতে এত লোকজন প্রত্যেকের খাওয়া দাওয়া হতে হতে বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। বাড়ির মহিলাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। কারণ তারা সবার শেষে খেতে বসে। এতজন লোকের খাওয়ার জন্য ঘন্টার ব্যবস্থা আছে। সকালের জলখাবারের সময় ঘন্টার ধ্বনি। দুপুরে খাওয়ার সময় ঘন্টার ধ্বনি আবার রাতে। রাধুনি যদিও আছে, কিন্তু বাড়ির মহিলারাই এইসব কাজে সবাই মিলে হাত লাগায়।

এদিকে আলির পরিবার ও বনেদী পরিবার। মনোবীনাদের পাশের গাঁয়েই আলিদের বাড়ি। আলির ঠাকুরদাদাকে সবাই এক ডাকে এখানে চেনে। এদের পরিবার বামপন্থায় দীক্ষিত। গরীব শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কার্যকলাপে এদের পরিবারের লোকজন সবসময় যুক্ত থাকে। ফ্যামিলিতে শিক্ষা দীক্ষার যথেষ্ট চলন। এদের বাড়ির মেয়েদের মধ্যে ও লেখাপড়ার চল আছে। সেই কারনেই আলির সমাজসেবী হওয়া যেন জেনেটিক সম্পর্কে যুক্ত। মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা কর্তব্য মনে করে ও আদায়ের জন্য নিরন্তর সংগ্রামের প্রয়োজন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন কর্মে সদা রত থাকে এই পরিবারের লোকজন। অপরপক্ষে মনোবীনার পরিবারের লোকজন অনেকটা ট্রাডিশনাল অর্থোডক্স পরিবারের ঘরানার। ফ্যামিলির জাত্যভিমানই এখানে বড়। দুই পরিবারের মধ্যে বহু বিষয়ে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। কিন্তু বিধাতার মনে কি ছিল তা তিনিই জানেন। আলি আর মনোবীনার সম্পর্কের সূত্রপাত সেই ফ্রেশার্স ওয়েলকাম অনুষ্ঠানের ওই ঘটনা। উত্তরোত্তর তা সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়। সেই সম্পর্ক গভীর হয়। এই সম্পর্কের কথা মনোবীনার বাবার কানে পৌঁছয়। একদিন তিনি মনোবীনার মাকে বলেন " তোমার মেয়েকে বলে দাও তার আর কলেজ যাওয়ার দরকার নাই। যদি নিতান্তই পড়াশোনা করতে হয়, আমি টিচার ঠিক করে দোব। তারা বাড়ি এসে পড়িয়ে যাবে। শুধু পরীক্ষার কয়েকদিন গেলেই হবে।"

" ঠিক আছে। বলে দেখব। সে তো বাপেরই মেয়ে। কথা শুনলে হয়।" মায়ের উত্তর। গজরাতে গজরাতে মনোবীনার বাবা যেতে যেতে বলে যান " জানিনা। তুমি বলে দিও আমি এইকথা বলেছি বলে। ব্যাস।"

পরদিন মনোবীনার মা মেয়েকে বলেন " শোন বীনা। তোর বাবা বলেছেন তোর আর কলেজে যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে টিচার আসবেন। পরীক্ষা সময় কেবল কলেজ যাবি। এখন আর যাওয়ার দরকার নেই। এই আমি বলে দিলুম।" মেয়ে শুনল কোন উত্তর করল না।

এরপর মনোবীনার কলেজ যাওয়া পুরোপুরি আটকানো গেল না। কিন্তু অনেক প্রতিবন্ধকতা আরোপিত হল। এইরুপ কিছুদিন যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন জানা গেল মনোবীনা বাড়ি ফেরে নি। মনোবীনার বাড়িতে একটা চাপা আতঙ্কের পরিবেশ। সবাই ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত। কারণ বাড়ির মেয়ে মুসলিম পরিবারের ছেলের সঙ্গে চলে গেছে। পরিবারের মুখে এ যেন চুনকালির সমান। জাত্যভিমানই বড়। শুধু তাই নয়। শোনা গেল পালিয়ে গিয়ে তারা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছে। এতো অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। এই ঘটনা দুই পরিবারের মধ্যে এক প্রাচীর তুলে দিয়েছে। মুখোমুখি বিবাদের দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

তিন

আলি তার সমাজসেবার কাজে কোন ঢিলেমি দেয় নি। মানুষের সংগ্রামের পথে সবসময়ের সাথী। সংগ্রামী বন্ধু। কয়েকজন বন্ধু জোগাড় করে এই জেলায় ডি ওয়াই এফ আই এর প্রতিষ্ঠা করল। নিজে তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়ে কাজ এগিয়ে নিয়ে চলল। নতুন সংসার করেছে অথচ আয়ের কোন ব্যবস্থা নেই। কতদিন আর মা বাবার কাছে হাত পাতা যায়। অগত্যা, একটি চাকরির জন্য মরিয়া চেষ্টা চালায় আলি। ছাত্র হিসেবে তো মন্দ নয়। অবশেষে পরীক্ষা দিয়ে সরকারি হসপিটালে গ্রুপ সি পদে জয়েন করে। 'ঢেঁকি স্বর্গে গেলে ও ধান ভানে'। কিছুদিনের মধ্যে এই হসপিটালে কর্মচারি সংগঠনের পদাধিকারী নির্বাচিত হয় আলি। হসপিটালের কাজ ও সংগঠনের কাজ সমানতালে চলতে থাকে এই কাজ পাগল আলির হাত ধরে।

বাড়িতে একদিন রাতে মনোবীনা আলিকে বলে " শোন, একবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কবে যাবে ঠিক কর।"

" কেন? কি হল?"

" এ মেয়েদের ব্যাপার। তোমার বোঝার দরকার নেই। একজন গাইনীর কাছে গেলেই ভাল। তোমাদের হসপিটালে কোন মহিলা গাইনী নেই?"

" হ্যাঁ। আছে তো। অম্বিকাদি, সিনিয়র আর মাই ডিয়ার মানুষ। আমায় খুব স্নেহ করেন। চল, কাল তোমায় নিয়ে গিয়ে দিদিকে দেখিয়ে আনি। সকাল সকাল রেডি থেকো।"

পরদিন সকালে মনোবীনা রেডি হয়েই ছিল। আলি পাড়ার এক ছোট্ট সমস্যা সমাধানে বেরিয়ে গেছে। হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে " তুমি রেডি তো?"

" কখন থেকে রেডি হয়ে বসে আছি। বাবুর আসার সময় হল এখন।"

" সরি সরি। এবার চল।"

দুজনে মিলে হসপিটালে পৌঁছে যায়। আলি দৌড়ে গিয়ে টিকিট করে আনে। অম্বিকাদির চেম্বারের সামনে লাইন। আলি এগিয়ে গিয়ে গেটের ভেতরে যায়। গেটে দারোয়ান আলিকে দেখে বলে" আলিভাই ভাল তো?"

" হ্যাঁ। দিদি এসেছেন?" আলি দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে।

" হ্যাঁ। দিদি অনেকক্ষন এসেছেন।"

আলি পর্দা ঠেলে জিজ্ঞেস করে " দিদি আসব?"

" আরে আলি! তুই? কি ব্যাপার? আয় আয়। ভেতরে আয়।"

অম্বিকাদি একজন পেশেন্ট দেখছিলেন। আলিকে পাশের চেয়ার দেখিয়ে বললেন " বোস।"

আলি চেয়ারে বোসল। দিদি জিজ্ঞেস করলেন " কেমন আছিস বল? অনেকদিন পরে এলি। দিদিকে ভুলে গেলি নাকি?"

" না না। দিদি আপনাকে ভোলা যায়? ব্যস্ততার জন্য সময় করে উঠতে পারি নি। দিদি একটা কথা ছিল।"

" কিছু বলবি? একটু বোস। আমি এই পেশেন্টটা ছেড়ে দি।" অম্বিকাদি হাতের পেশেন্ট দেখা কমপ্লিট করে বলেন " হ্যাঁ এবার বল?"

" দিদি আমার মিসেসকে নিয়ে এসেছি। একটু দেখে দিতে হবে। "

" বলিস কি? কবে বিয়ে করলি? জানাস নি তো?"

" না দিদি। চাকরিতে জয়েন করার আগে হয়ে গেছে। সেজন্য কাউকে বলতে পারিনি।"

" আর লজ্জা করতে হবে না। এক্ষুণি নিয়ে আয়। আমি দেখে দিচ্ছি।"

আলি প্রায় দৌড়ে গিয়ে মনোবীনাকে নিয়ে আসে। মনোবীনাকে দেখে অম্বিকাদি বলেন " এসো এসো। আলি তোর বৌ তো খুব সুন্দরী রে।" মনোবীনা লজ্জাবনত হয়ে অম্বিকাদিকে প্রনাম করে। " আরে থাক মা থাক। ভাল থেকো। তোমার এই পাগল বরটাকে একটু সামলে রেখো।" এবার আলির দিকে তাকিয়ে বলেন " তুই একটু বাইরে যা। আমরা মা বেটি একটু গল্প কোরব।" আলি বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করে।

" হ্যাঁ মা বল। তোমার কি সমস্যা হচ্ছে?" মনোবীনা বিশদে সব জানায় ডাক্তার দিদিকে। দিদি যত্ন সহকারে সবরকম পরীক্ষা করেন। এবার বুঝতে পারেন। বলেন " মা। ভাল খবর। নতুন অতিথি আসছে। পাগলা তো ছুপা রুস্তম।" চেম্বার থেকেই অম্বিকাদি ডাক ছাড়েন " কই রে আলি। তাড়াতাড়ি আয়। " আলি সন্তর্পনে ঢোকে। দিদি বলেন " এই যে ছুপা রুস্তম। কোনো খবর তো দিস না। তোর সংসারে নতুন অতিথি আসছে। বৌয়ের যত্ন নিবি। বিশ্রামে রাখবি। আমি প্রেশক্রিপশন করে দিচ্ছি। নিয়ম মেনে এগুলো খাওয়াবি।"

বৌকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরে আলি। মনে এক অজানা আনন্দের অনুভূতি ফিল করে। আলি বাড়িতে মাকে সব জানায়। ধীরে ধীরে একান্নবর্তী পরিবারের সবার কাছে এই আনন্দ সংবাদ আর অজানা রইল না।

চার

মনোবীনার কোল আলো করে ফুটফুটে সুন্দর এক ছেলে এসেছে। সারা পরিবারে আনন্দের উৎসব। নাতি হওয়ার খুশিতে ঠাকুর্দা ঠাকুমা সবাই ডগমগ। পরিবারে আনন্দের চোরা স্রোত বয়ে চলে। ওদিকে মনোবীনার বাপের বাড়িতে ও এই আনন্দ সংবাদ পৌঁছে গেছে। দাদু দিদু ও এই খবরে যারপরনাই খুশি। দাদুভাইকে দেখার আগ্রহে পুরোনো সব বিবাদ বিসম্বাদ ভুলে দুই পরিবার এক হয়ে ওঠে। তত্ত্ব দিয়ে পালকি বরকন্দাজ ও লোকলস্কর পাঠিয়ে দাদু মেয়ে জামাই নাতিকে নিয়ে যায়। দুই পরিবারের মধ্যে মিলনের সেতুবন্ধন হয় শিশুর আগমন দিয়ে। দুই পরিবার এতদিনে আত্মীয়তায় আবদ্ধ হয়।

' মঞ্জির' দাদু দিদুর পছন্দের নাম নাতির জন্য। দাদু নাতির তিন বছরে হাতে খড়ি দিয়ে কলকাতার নামী স্কুলে ভর্তি করে দেন। নাতিও চৌখস। লেখাপড়া খেলাধূলায় সমান দড়। বয়সের তুলনায় অন্যদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। রেজাল্টে ক্লাসে প্রথম সারিতে। দেখতে দেখতে নাতি ক্লাস টেন, টুয়েলভ ভাল মার্কস নিয়ে পাশ করে। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বি টেক এ আই টি তে ভর্তি হয়। বি টেক ফাইনালে সস্মানে উত্তীর্ণ হয়। ক্যাম্পাসিং এ একটি সংস্থায় ভালো অফার ও পায়। জয়েন করে কিছু দিন কাজ ও করে। মন মানে না। অগত্যা চাকরি ছেড়ে এম টেক এ ভর্তি আরও পড়াশোনার জন্য। ছেলের এই কাজে বাবা মা কোন বাধা দেয় না। ছেলের ইচ্ছেই প্রাধান্য পায়। এম টেকে ও ভাল রেজাল্ট করে পাশ করে। অল্পকিছু দিনের মধ্যে একটি সরকারি সংস্থায় চাকরি জুটে যায়। কয়েক মাস কাজ করার পর মন টেকে না। অগত্যা কর্ম ত্যাগ। এই ছেলে তো বসে থাকার নয়। আবার একটি নামী বেসরকারি কোম্পানিতে একেবারে সিস্টেম ম্যানেজার। কিছুদিনের মধ্যে কোম্পানিতে সবার মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে যায় মঞ্জির। কোম্পানির ওপরওলারা মঞ্জিরের পরামর্শ ছাড়া কোন বড় সিদ্ধান্ত নেন না। বলা ভাল নেওয়ার চিন্তা করতে পারেন না। এমনই ভরসার জায়গা তৈরি করেছে মঞ্জির।

কয়েক বছরের মধ্যে দুই পরিবারের সুখের ছন্দে পতন ঘটে। মনোবীনার বাপের বাড়িতে দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। কয়েক মাসের মধ্যে মনোবীনার মা বাবা দুজনই মারা যান। এর বছর খানেকের মধ্যে আলির পরিবারে ও মা বাবার অল্প সময়ের ব্যবধানে সংসার মুক্তি ঘটে। এই ঘটনায় আলি কিছু সময়ের জন্য ভেঙে পড়ে। তবে সংগ্রামী ছেলে অল্প সময়ে নিজেকে সামলে নেয়। বটবৃক্ষ সরে গেলে অনেকে যেমন অনাথ বোধ করে, আলিদের পরিবারের এই বটবৃক্ষের পতন সবকিছু নাড়িয়ে দেয়। সংসারের বন্ধন আলগা হতে থাকে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাদ বিসম্বাদ শুরু হয়ে যায়। কারণে অকারণে তা চলতেই থাকে। এর বেশি আঁচ মনোবীনাকে পোহাতে হয়। আলি বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে, সেজন্য এই উত্তাপ তার কাছ অব্দি খুব একটা পৌঁছয় না। কিন্তু এই বিষয় আর উপেক্ষা করার অবস্থায় রইল না। অগত্যা, আলি কলকাতায় কোয়ার্টার জোগাড় করে ছেলে বউ নিয়ে সেখানে চলে যায়। মন না চাইলে ও যেতে বাধ্য হয়। তবে নিজের ও ছেলের কাজে সুবিধা হল। দুজনের অফিস কলকাতাতেই। এই সুযোগে মঞ্জির কলকাতার এক কলেজে আই টি টিচারের পদে অ্যাপ্লাই করে দেয়। অবশ্যই নিজের অফিস বসের অনুমতি নিয়েই। আসলে এই শিক্ষকতার কাজটি আংশিক সময়ের জন্য। সেইজন্য অনুমতি পেতে অসুবিধে হয় নি। নির্দিষ্ট দিনে ইন্টারভিউর জন্য কলেজে উপস্থিত হয়। ইন্টারভিউতে সবার প্রশংসা আদায় করে ও চাকরি পাকা করে। একই সঙ্গে অফিস ও কলেজে পড়ানো দুই কাজই চলতে থাকে। আলির খুব ইচ্ছে ছেলে পিএইচডি করুক। এই কলেজের এক স্যারের সঙ্গে মঞ্জিরের ঘনিষ্ঠতা হয়। ছেলের কাছ থেকে স্যারের সম্বন্ধে সবকিছু আলি জানতে পারে। এই সূত্রে স্যারের সঙ্গে পরিচয় ও হয়। স্যারকে আলি অনুরোধ করে ছেলের পিএইচডির জন্য গাইড করার জন্য। স্যার মঞ্জিরের মতো ছেলেকে সুপারভাইজ করার জন্য এক কথায় রাজি।

পাঁচ

অফিসের রাজনীতি বড়ই জটিল। কার কোন অঙ্কে প্রমোশন পাকা। কার কোন সাপ্লায়ারের সঙ্গে যোগসাজস। কার ইগোর সমস্যা। মঞ্জিরের মতো সহজ সরল পরোপকারী ছেলের মনে পাপ নাই। এই অফিস সংক্রান্ত জটিলতা কূটিলতা সে কিছুই বোঝে না। সাদা মনে কাদা না নিয়ে মঞ্জির অফিসের ওপরওলাদের কাছে কোম্পানির ভাল হবে এই ভেবে কিছু প্রস্তাব দেয়। প্রথম প্রথম উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তত সিরিয়াসলি নেন নি। পরে এই ব্যাপারে মনে মনে বিরক্ত হন। অফিসে মঞ্জিরের গুরুত্বের জায়গা ক্রমে অবহেলা বা ইগনোরে পর্যবসিত হয়। মঞ্জিরের মতো স্বাধীনচেতা ছেলের পক্ষে এই কর্মপরিবেশ মোটেই সুখকর ঠেকে না। সে এই চাকরি ছেড়ে দেয়। বাড়ি ফিরে বাবাকে বলে " আব্বু, এই কোম্পানির চাকরিটা আজ ছেড়ে দিলাম।"

" কেন? কি হল? এত ভাল চাকরি। মজু বেটা, তোকে তো অফিসে সবাই ভালবাসতো? কি এমন হোল যে একেবারে চাকরি ছেড়ে দিলি?"

" না আব্বু, বাইরে থেকে বোঝা যায় নি। ওদের ভেতরে অনেক অংক। আমি হয়তো না জেনে ভীমরুলের চাকে ঢিল ছুঁড়ে ফেলেছি। অফিসে আমার প্রায় কোন গুরুত্বই নেই। এরকম জায়গায় কাজ করার চেয়ে না করা ভাল।" বাপ ছেলের কথার মাঝে মা এসে হাজির। দুজনকেই জিজ্ঞেস করে " কি হল? বাপ ছেলের কি এমন গোপন শলাপরামর্শ?"

" না আম্মি, এমন কিছু গোপন কথা নয়। এই কোম্পানির চাকরি আজ ছেড়ে দিলাম।"

" কেন রে? কি হোলো? কিছু গন্ডগোল?" আম্মির উৎকন্ঠার শেষ নাই।

" না তেমন কিছু নয়। ওদের সঙ্গে কাজ করে আমার তেমন ভাল লাগছিল না। কাজের পরিবেশ যদি ঠিক না হয়, তবে শুধু মাইনের জন্য কাজ করার মানে হয় না। তাই ছেড়ে দিলাম।"

" যা ভাল বুঝিস তাই কর।" আম্মির মনের খটকা যেন থেকেই যায়।

এরপর কলেজ আর নিজের রিসার্চ নিয়ে মঞ্জির মেতে থাকে। যতই কাজে নিজেকে নিমজ্জিত রাখুক। নিজের মধ্যেকার হতাশা ধীরে ধীরে মঞ্জিরকে গ্রাস করতে থাকে। একে চাকরি খোয়ানো, তার ওপর সংসারে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আর্থিক সাহায্য করতে না পারা। এই বিষয়গুলি ধীরে ধীরে মঞ্জিরকে কুরে কুরে খেতে থাকে। মঞ্জির আরও হতাশার পথে এগিয়ে চলে। ডিপ্রেশানের শিকার হয়।

ছয়

এদিকে আলির বয়স হয়েছে। অফিস থেকে রিটায়ার করেছে। কিন্তু অফিসে কর্মচারি ইউনিয়নের নেতা হওয়ার খাতিরে অফিস যাতায়াতের রুটিনে কোন পরিবর্তন হয় নি। ছেলেকে বলে" বাবা, আমি তো রিটায়ার করে গেছি। এবার পার্মানেন্ট একটা কিছু দেখ। বয়স ও তো হচ্ছে? সংসার সামলানো কঠিন হয়ে যাবে।" ছেলে শুধু শুনে যায়। কোনো উত্তর করে না। এইভাবে চলতে থাকে। ধীরলয়ে বাপ ছেলের মধ্যে সম্পর্কে টেনশন দেখা দেয়। একজন অপরজনকে অ্যাভয়েড করতে থাকে। এ ওকে এড়িয়ে চলে। এই ঠান্ডা লড়াই বাড়ে বই কমে না। একদিন রাতে আলি প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়। যমে মানুষে টানাটানি। মনোবীনা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। মঞ্জির আব্বুর পরিচিত এক ডাক্তারবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারবাবু হসপিটালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। সিভিয়ার লাংগস ইনফেকশন। ফুসফুসে জল জমে গেছে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। ডাক্তারবাবুর কথায় " পঁয়ত্রিশ শতাংশ চান্স বাঁচার। বাকিটা ভগবানের ওপর।" যমে ডাক্তারে টানাটানির পর প্রায় দুসপ্তাহ হসপিটালে কাটিয়ে অবশেষে আলি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। এই পুরো চিকিৎসা তদারকি, ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা, খরচ সামাল দেওয়া পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিল মঞ্জির। এরপরে আব্বুকে কিছুটা নিজের শাসনে আনতে সমর্থ হয় সে।

সারা বিশ্ব আজ করোনা অতিমারিতে আক্রান্ত। লকডাউনে সারা পৃথিবী নিশ্চল, স্তব্ধ। মানুষ গৃহবন্দি। আলির পরিবারে ও তাই। এর কোন ব্যতিক্রম কোথাও কল্পনার অতীত। সবকিছুতে একদা অচ্ছুৎ ' অনলাইন ' ই ভরসা। বাজার হাট থেকে ওষুধপত্র সবই অনলাইন। এক গভীর রাতে আলির বুকে প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়। মনোবীনা ছেলেকে ঠেলে ঘুম ভাঙান। মঞ্জির গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে। আব্বুকে কোনরুপে লিফট দিয়ে নামিয়ে গাড়িতে তোলে। কাছেই আমরি হসপিটাল। সেখানে নিয়ে যায়। তড়িঘড়ি ডাক্তার নেমে আসেন। দেখে বলেন " সবই তো শূন্য। ভর্তি করার দরকার নাই। এতো 'ব্রট ডেড'। ভর্তি করালে পুলিশে রিপোর্ট করাতে হবে। পোস্টমর্টেম করাতে হবে। তার চেয়ে আপনি বাড়ি নিয়ে চলে যান। ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানকে দিয়ে একটা ডেথ সার্টিফিকেট লিখিয়ে নেবেন। তাহলে কোনো ঝামেলা থাকবে না।" অগত্যা মঞ্জির বাড়ি ফিরে ডাক্তার আঙ্কেলকে সব জানায়। ডাক্তার আঙ্কেল বলেন সকালে এসে ডেথ সার্টিফিকেট কালেক্ট করে নিতে।

পরদিন সকালে স্যার এক সহকর্মীর কাছ থেকে জেনে মঞ্জিরকে ফোন করেন। মঞ্জিরের ফোন ব্যস্ত। একটু পরেই মঞ্জির স্যারকে কলব্যাক করে। ডাক্তারের বাড়িতে ডেথ সার্টিফিকেট আনতে গেছে। কথা হয় ফেরার পথে স্যারকে বাড়ি থেকে গাড়িতে নিয়ে মঞ্জির বাড়ি যাবে। গাড়িতে যেতে যেতে মঞ্জিরের চোখ কান্নায় ঝাপসা হয়ে আসে। কান্নায় ভেঙে পড়ে। স্যার সান্ত্বনা দেন। " মজু, স্টিয়ারিং এ বসে এসব কোরো না। যে কোনো মুহূর্তে বিপদ ঘটে যেতে পারে। শান্ত হও। তোমার দায়িত্ব এখন অনেক। তুমি দুর্বল হলে মা ভেঙে পড়বেন। " স্যারের কথায় কিছুটা কাজ হয়। মঞ্জির স্যারকে ড্রাইভ করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে থাকে। স্যার রাস্তার দুদিকের গাছপালা লোকজন দেখতে দেখতে এগোন। নিউ টাউনের এই জায়গাটা খুব গুছোনো। ছবির মতো। নজরুল তীর্থ, রবি তীর্থ, অ্যাক্সিস মল। মেট্রোর লাইন ছাদের মতো ওপর দিয়ে চলে গেছে। কলকাতার তুলনায় এখানে লোকজন অনেকটাই কম। গাড়ি ঘোড়া হৈচৈ ও কম। ছবির মতো রাস্তা দিয়ে গাড়ি পৌঁছে যায় গন্তব্যে।

সাত

ফ্ল্যাটে ঢুকে স্যার দেখেন মেঝেতে আলির মৃতদেহ শোয়ানো। সাদা কাপড়ে ঢাকা সারা শরীর। স্যারের সহকর্মী ছোট্টখাট্টো চেহারার দেব ইতিমধ্যে হাজির। সবাইকে দেখে স্যারের কেমন অগোছালো মনে হোলো। মৃতদেহ সৎকারের কোন তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। মঞ্জিরের এক আঙ্কেল একের পর এক ফোন করে যাচ্ছেন। প্রথমত, কাছাকাছি কোন ইমামকে দরকার বডিকে গোসল করানোর জন্য ও নতুন কাপড়ে বডি জড়িয়ে শবশকটে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। দ্বিতীয়ত, কবরস্থানে কবরের জমি চিহ্নিত করা। এই কাজই করছিলেন আঙ্কেল। একেক জন এই কাজের জন্য দশ থেকে কুড়ি হাজার টাকা দাবি করে বসছে। তিনি লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কম খরচে কোথাও এই গোসল কাজ করা যায় কিনা। আলির দাক্ষিণ্যে প্রতিষ্ঠিত মির্জা ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে কবরস্থানে জমি চিহ্নিত করার ব্যাপারে কিছুটা সুরাহা হয়। এইসব কাজ যখন চলছে স্যার সহকর্মী দেবকে নিয়ে বেরিয়ে যান। দেবের গাড়ি নিয়ে কাছাকাছি মার্কেটে স্যার পৌঁছন। কেক বিস্কুট মুড়ি চিড়ে চানাচুর ও কিছু মিষ্টি নিয়ে সবার খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। দেব সকালবেলায় ড্রাইভার নিয়ে চলে এসেছে। তাদের জন্য চা ও টিফিনের ও ব্যবস্থা করেন স্যার। এইসব নিয়ে ফেরেন ফ্ল্যাটে। প্রথমে স্যার সবাইকে জোর করে খাওয়ানো বন্দোবস্ত করেন। সত্যিই রাত থেকে এদের কারুরই কিচ্ছু খাওয়া হয় নি। স্যারের বকুনিতে সবাই অল্প বিস্তর খাবার খায়। এরপর স্যার বলেন " আপনারা শুনুন। এভাবে চললে হবে না। বডি অনেকক্ষন পড়ে আছে। আর বেশি সময় ফেলে রাখা ঠিক হবে না। আমি, দেব ও মজু কবরস্থানে গিয়ে কবরের জমি চিহ্নিতকরনের কাজ করি। আপনারা এখানে গোসলের ব্যবস্থা করুন।" মঞ্জিরের মা ও আঙ্কেল এই কথায় পূর্ণ সায় দেন। এরা তিনজন দেবের গাড়ি নিয়ে পার্কসার্কাসের গোবরা কবরস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। গাড়িতে যেতে যেতে পিতৃশোকাতুর মঞ্জির আব্বুর মৃত্যুর জন্য নিজেকে অপরাধী ভেবে ভেঙে পড়ে। ক্রমাগত কাঁদতে থাকে। দেব ও স্যার অনবরত সান্ত্বনা দিয়ে যান। স্মরণ করান তার বর্ধিত দায়িত্বের কথা। বাইপাশের চওড়া রাস্তা ধরে দ্রুতগতিতে গাড়ি এগিয়ে চলে। ইস্ট ক্যালকাটা ওয়েটল্যান্ডের জলাশয়গুলি ক্রমে পেছনে পড়তে থাকে। সামনে অগুন্তি গাড়ির সারি। সব ঠেলে পার্ক সার্কাসের ঘিঞ্জি এলাকার মধ্যে ধীর গতিতে গাড়ি চলতে থাকে। গোবরা কবরস্থানের দ্বিতীয় গেটে গাড়ি পার্ক করে তিনজনে কবরস্থানে ঢোকে। এই কবরস্থান তিন ভাগে বিভক্ত। এক নম্বর, দু নম্বর ও তিন নম্বর। যদিও লিখিত কোন নিয়ম নেই, তবুও এটাই অলিখিত নিয়ম যে এক নম্বর কবরস্থানে জায়গা পায় রহিস ও বিখ্যাত ব্যক্তিরা। দু নম্বরে মাঝের সারির ব্যক্তিবর্গ। আর তিন নম্বরে হত দরিদ্র সহায় সম্বলহীন। হয়তো সেই কারণে এক ও দু নম্বর কবরস্থান যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আলোবাতাস যুক্ত। সে তুলনায় তিন কবরস্থান তুলনামূলকভাবে অপরিচ্ছন্ন, কাদা প্যাচপেচে। তা যাইহোক, তিনজন মিলে খোঁজ নিয়ে যখন অফিসে পৌঁছল, অফিসের একব্যক্তি জিজ্ঞেস করল" আপনারা কি কোনো প্যাকেজে এসেছেন? তাহলে সব সেইমতো হয়ে যাবে।" মৃত আলির পালিত সেই ব্যক্তি যে কিনা এইসব বেরিয়াল গ্রাউন্ডের একজন হর্তাকর্তা তার নাম করায় হঠাৎ যেন সবকিছু সহজ হতে শুরু করল। অফিসের একজনতো বলেই ফেলল " আপনারা বলবেন তো যে আপনারা মির্জা ভাইয়ের লোক।" পাশে এক ছেলেকে নির্দেশ দিতে শোনা গেল " রকি এদের কবরের জমি দেখিয়ে আয়। " স্যারেদের উদ্দেশ্যে বলে " আপনারা কাগজপত্র দিয়ে যান। ঠিকানা আলাদা করে লিখে দিন। এর সঙ্গে গিয়ে জমি ঠিক করে আসুন। আমরা কাগজ রেডি করে রাখছি। কবর হয়ে গেলে এখান থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে যাবেন। এটা দেখালে আপনারা কর্পোরেশন থেকে ডেথ সার্টিফিকেট পেয়ে যাবেন।" তিনজন মিলে রকিকে ফলো করে। তিন নম্বর কবরস্থানে পৌঁছয়। সেই জায়গা দেখে মঞ্জিরের অস্বস্তি চরমে পৌঁছয়। সে কোনমতে এখানে তার প্রিয় আব্বুকে সমাধিস্থ করতে দেবে না। এক নম্বর ও দু নম্বর কবরস্থানে অসুবিধে কি জিজ্ঞেস করায় রকির উত্তর ওইসব এখন বন্ধ। কেবলমাত্র তিন নম্বরই খোলা। মির্জাভাইকে ফোন করার কথা বলায় রকি তখন দু নম্বর কবরস্থানে নিয়ে যেতে রাজি হয়। এ যেন এক মন্ত্রবলে অবিশ্বাস্য জিনিস কত সহজ সরলভাবে হয়ে গেল। আসলে সব ধর্মেই প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো এই দুর্নীতির চক্র বহাল তবিয়তে আছে। হয়তো থাকবেও বটে। এই দু নম্বর কবরস্থান অনেক পরিষ্কার। আলোবাতাস যুক্ত। রাস্তা পাকা। খুঁজে পাওয়া গেল উত্তর পূর্ব কোনে এক্কেবারে রাস্তার ধারে নিম গাছের তলায় এক পরিছন্ন সুন্দর জায়গা। কবরের জমি। এক কথায় সবার পছন্দ। সবাই খুশি।

কবরস্থান থেকে বেরিয়ে গেটের বাইরে রাখা গাড়িতে উঠতে যায় তিনজন। কবরস্থানের গেটের কাছে ছিন্ন বসন এক ভিখারি বলে উঠল " আল্লাহ কে নাম সে কুছ দে বাবু। সুবা সে কুছ নেহি খায়া।" স্যার কিছু আর্থিক সাহায্য ওই ভিখারির হাতে ধরা ছোট একটি থালায় দেন। এই সাহায্য পেয়ে সেই ভিখারি হাত তুলে দুয়া আদায়ের ভঙ্গিতে বলে " আল্লাহ সবকা ভালা করে।" এই অন্ধ অসহায় হয়তো শিক্ষা বঞ্চিত হতভাগ্য মুসাফির সব ধর্মের গোঁড়া ধর্মগুরুদের কাছে এক জীবন্ত শিক্ষাগুরু। এই ভিখারির সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা সবার ভাল থাকার জন্য। তার বর্ণ, ধর্ম, সম্প্রদায় কোনো বিচার্য নয়। বিশ্বের সবার মঙ্গলই তার কামনা। সব গোঁড়াদের এর কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। কিভাবে উদার হওয়া যায় নিজে নিঃস্ব হয়েও। ওরা তিনজন জমি বুক করে গাড়ি করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আসলে এখানে আর কোনো পার্মানেন্ট কবরস্থান হয় না। প্রতি পাঁচ ছয় বছর অন্তর একজনের কবরের জমি অন্যকে বন্টন করা হয়। বর্ধিত জনসংখ্যা ও কবরস্থানের সীমাবদ্ধতা এই নতুন নিয়ম প্রবর্তনে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছে। তবে তার ব্যতিক্রম ও অনেক আছে। ক্ষমতা বা অর্থ এই ব্যতিক্রমের জন্য দায়ী।

বাড়িতে ফিরে দেখা গেল মৃতদেহের গোসল কমপ্লিট। কাপড়ের আবরন ও শবশকট সবই রেডি। সময় নষ্ট না করে সবাই কবরস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আলির দেশের বাড়ি থেকে লোকজন এসেছেন। পরিচিত আত্মীয় স্বজন অনেকেই এসেছেন। সবাইকে নিয়ে কয়েকটি গাড়ির সারি রওনা দেয় কবরস্থানের উদ্দেশ্যে। মঞ্জির, দেব ও স্যার মিলে দেবের গাড়িতে আরোহী। এই গাড়ি সবার আগে চলে। সবাই একে ফলো করে। কারণ এরা কবরস্থানের ঠিকানা জানে। গোবরায় পৌঁছে দেখা গেল রকি সুন্দরভাবে কবর খুঁড়ে রেখেছে। শুধু তাই নয় এর যা যা সরঞ্জাম দরকার সেগুলো ও প্রস্তুত। তাড়া ছিল সন্ধ্যে ছটার আজান শুরুর আগে বডি সমাহিত করতে হবে। তা না হলে দেরি হয়ে যাবে। কবরস্থানের ইমাম তৈরি ছিলেন। শবদেহ কবরে যথাসম্মানপূর্বক সমাহিত করা হোলো। সব রীতি নীতি পালিত হোলো। কবরে শবদেহের বাঁশের দরমার ছোট ছোট টুকরো দিয়ে শবদেহ ঢাকা হোলো। তার ওপর মোটা বাঁশের অনেকগুলো ছোট টুকরো দিয়ে খুব দৃঢ়ভাবে কভার করা হলো। এর উদ্দেশ্য শবদেহ যেন নিরাপদে থাকে। অন্যকোন প্রানী এই দেহ বাইরে টেনে বের করতে না পারে। এরপর আল্লাহর দুয়া কামনা করে সবাই কবরে মাটি দান করেন। সঙ্গে সবাই সমবেত স্বরে আল্লার দুয়া কামনা করে। সবার সঙ্গে স্যার ও এই মাটি দান করেন, আত্মার শান্তি কামনা করেন। কবরের ওপরে বাকি সব মাটি দিয়ে ঢিবির মতো করে দেওয়া হয়। তার ওপর পুষ্প চাদর চড়ান হয়। এমন সময় কাছের মসজিদে সন্ধ্যের আজানের শব্দ ভেসে আসে। পবিত্র নিমগাছের ছায়ায় ও সুরক্ষায় আলি যেন বেহেশত্ এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

0 comments: