undefined
undefined
undefined
ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল
Posted in ধারাবাহিক১১
মেনকা গ্রাম থেকে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়েছে।এম.এ পড়ছে।লেডিস হোষ্টেলে থাকে।অনেক বান্ধবী আছে।ঠিকমত সময়ে খেয়ে নিয়ে একসাথে যাওয়া আসা করে।মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি যায়।ছুটি থাকলে গ্রামে যায়।একদিন সকলে চিড়িয়াখানা গেলো।সেখানে পশু পাখিদের দেখে খুব আনন্দ পেলো সবাই।মেনকা খাবারের জোগাড় করলো।ডিম টোষ্ট আর শস,সঙ্গে স্যালাড।মেনকা বললো বান্ধবী সোমাকে,জানিস আমাদের গ্রামের বাড়ি মাটির ছোটো বাড়ি।বাবা বলেন যতই ছোটো হোক বাড়ি হলো মন্দির।জানিস আমার মা ছোটোবেলা থেকে আমাকে শেখাতেন, একটা পাখির বাসাও ছোটো। কিন্তু অবহেলার নয়।কত পরিশ্রম করে তিলে তিলে একটা বাসা তৈরি হয়। কোনো মন্দির,মসজিদ,গির্জা ছোটোবড় হয় না।সবখানেই সেই একই মালিকের বাস। সোমা বললো,তোর কথা শুনতে ভালোলাগে।আমদের ভারতবর্ষ মহান।
চিড়িয়াখানা থেকে ফিরে রাতে ভাত, তরকারী আর মাছের ঝোল খেলো ওরা।তারপর ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে উঠে সকলে প্রাতঃরাশের পরে গল্প করতে বসলো।আজ ছুটির দিন।মেনকা তার গ্রামের মেলা যাবার বর্ণনা করলো।সবাই মন দিয়ে শোনে তার সত্যি গল্প,তার জীবনের গল্প।বুঝলি সোমা একবার গ্রাম থেকে
গোরুর গাড়ি চেপে দধিয়া বৈরাগ্যতলার মেলা যাচ্ছি। পিছনে বাঁধা রান্না করার সরঞ্জাম। মেলা গিয়ে রান্না হবে। বনভোজন। সঙ্গে মুড়ি আছে। বড়দা বললেন,গিয়ে প্রথমে মেলা ঘোরা হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মা বললেন,তোরা ঘুরবি আমি আর মানা রান্নাবান্না করবো। তারপর দুপুরে মেলা ঘুরবো। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে। গোপাল কাকা বললেন,আরে, দেখ দেখ জিম চলে এসেছে। বড়দার ভয়ে ব্যাটা গাড়ির তলায় হাঁটছে।
জিম নেড়ি কুকুর হলেও, আমরা ওকে জিম বলেই ডাকি। কুকুর ভাবি না। অনেক মানুষের থেকেও ওর ভব্যতা অনেক বেশি।
আর একটা মেলায় যেতাম। পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা ছোটোবেলায় বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভরতি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য। যাইহোক, গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম,একটা আখ খাবো। তামালদা বললো, না পরের জমি।
--- একটা তো, কিছু হবে না।
--- যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।
তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম।
গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা।
মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন,প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল।
জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা।
তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে।
বড়দা বললেন,অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ।
মানা পিসি বললেন,চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন,সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।
তামাল দা মাকে বললো,দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না।
মা বললেন,যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও।
মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে
তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো? তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।
আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়।কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে।জাতিতে জাতিতে,বললেন গোপাল কাকা।
এই মেলায় হরিনাম এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ভক্তের মায়া।
আমার ঈশ্বর,আমার অনুভব,ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের শুরু হয়েছে। মনে পরছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।
দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন,থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই।
তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পরলাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়,স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বার বার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।
সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই।
তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন,তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে,হুট্ হুট্,চ,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন,বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।
হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পরছে। সবগুলো শুয়ে পরে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন,ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।
তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে,আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন,অন্যায় করবি না,আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না।
মনমতো পছন্দের মামা আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে মামা নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। মামা কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই মামা বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের। আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। মামা ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেল অনেক গল্প শুনেছিলাম দাদুর বীরত্বের গল্প। মা তার নিজের গল্পও বলেছিলেন অনেক।আমার মনে পরে সেইসব কথা।
গল্প বলতে বলতে কখন যেনো মেনকার চোখে জল এসে গিয়েছিলো।সোমা জল মুছে দিলো।বললো,আর পনের দিন পরেই পুজোর ছুটি।সবাই বাড়ি যাবো।কি মজা বল।মেনকা বললো,ঠিক বলেছিস।
0 comments: