0

ছোটগল্প - সুবর্ণা রায়

Posted in


ছোটগল্প


মীড়-গমক
সুবর্ণা রায়



বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। জমা জল ছিটকে পায়ের ওপর কালো আস্তরণ পড়েছে, অনেকটা চশমার কাঁচে হাত লেগে ঝাপসা হওয়ার মতো। শ্রীকে ঘিরে বেশ কিছু লোক, বাসস্ট্যান্ডের আপাত ভরসার তলায়। শ্রীর পায়ে হলুদ সালোয়ার লেপটে ভিজে একসা।

একটু আগেও একটা সোনালী সূর্য ছিল প্রতীক্ষারত। সন্ধ্যের আগেই কালো মেঘ তাকে চুরি করে নিয়ে গেছে পুরনো দিনের কাছে। একটু উষ্ণতার প্রয়োজন ছিল পুরনো দিনের জন্য, আর অনেকটা আলোর।

পুরনো দিনের সাথে শ্রীর ঠিক এখন থেকে আবার ভাব। আঙ্গুলে চুল পাক খায়, পাক খায়, পাক খায়...

বৃষ্টির বেগ কমল, বাস-ট্যাক্সির আনাগোনা শুরু হলো আবার। পুরোপুরি থামলে, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে জনজীবন, শেডের তলায় আর কেউ থাকবে না। একটা বুড়ো প্লাস্টিক পেতে রাতের বিছানা করবে কোণটায়। বাকি রাতটুকুর রাজা হবে সে, সাতটি তারা তিমির বিদীর্ণ করে তার রাজপাটের খবর নেবে ঘুরে ঘুরে। কোমরে ঝুলবে তার অসি, জোছনার আলোয় ঝিকমিক করবে তার খাপ। শ্রীর চোখভরা জ্যোৎস্নায় হুবহু এক রাজকুমারের ছবি ভাসে, ভাসে আবার ডুবে যায়। এত তলায় ডুবে যায় যে, খুঁজে বার করতে নিজের ভিতরটা হাতড়ায় শ্রী, তোলপাড় করে হাতড়ায়। হারিয়ে ফেলার ভয়টা ঠিক কেমন, এখন চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে ও।

দুদণ্ড বসে, কেউ দেখে না ফেলার মতো হাঁ করে চোখের দিকে দেখা, যেন ওই চোখেই শুরু আর শেষ - শ্রীর কাছে একটু আগে ঘুরে গেছে পুরনো দিনের একটা রোঁয়া। কোনওদিন খোলেনি চশমা, হাজার বলা সত্ত্বেও। কি হতো খুললে? আর একটু বেশী দেখলে ক্ষতি কি ছিল? আজ কিন্তু খুলেছিল নিজে থেকেই। কি জানি কি অছিলা!। শ্রীর পলক পড়েনি। মরা মাছের মতো নিষ্প্রাণ মণিদুটো দেখে একসময় কেমন একটা অস্বস্তিতে কেঁপে গিয়েছিল ভিতরে। এর থেকে না খোলাই ভালো ছিল। কিছু জিনিস অধরা থাকাই ভালো।

অনেক ঝরে বৃষ্টিটা থামল অবশেষে। দীর্ঘ একটা গুমোট হালকা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে রাজপথের কালো পিচে। ফিরে আসছে গুনগুন কথা, ইঞ্জিনের যান্ত্রিক আওয়াজ, মেয়েদের হাসির রিনরিন, হর্ণের কর্কশতা। ধীরে ধীরে সাদাকালো থেকে বর্ণময় হচ্ছে শহরের ব্যস্ত একটা মোড়। শুকনো খটখটে রাস্তায় হলুদ ট্যাক্সির লাল আলো দুটো দেখছে শ্রী। এই নিয়ে দুশো হলো। আর দশটা দেখে ফিরে যাবে বাড়ি। কি জানি, যদি ফিরে আসে, মত বদলায়?

ঘন্টাখানেক আগে সাত বছরের সম্পর্ক হলুদ ট্যাক্সির কালো ধোঁয়ায় ব্যস্ত শহরের দীর্ঘ রাস্তায় হারিয়ে গেছে, আর ফিরবে না বলে।



নির্দিষ্ট জায়গায় ছোট্ট গাড়িটা পার্ক করে বেরিয়ে, রিমোট লকের চাবিটা টিপতে টিপতে আড়চোখে সাদা ক্যাডিলাকটাকে দেখে নিল রিনি। আজকেও আগে আসতে পারল না। তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে রিসেপশনের দরজাটা খুলতে খুলতে নিকির দিকে ছোট্ট হাসিটা ছুঁড়ে দিয়ে লিফটের প্রায় বন্ধ দরজাটার দিকে উড়ে গেল রিনি। কিছু করার আগেই দরজাটা খুলে গেল আবার। বোতামে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে স্যাম, সমীর নাহাটা। রিনি উষ্ণ হেসে থ্যাংকস জানিয়ে পাঁচ নম্বরটা টিপে দিল। স্যামের 'গুড মর্নিং' এর প্রত্যুত্তরে রিনির 'গুড মর্নিং' টা একটু দায়সারা হলেও স্যামের উত্তেজনায় একটুও ভাঁটা পড়ল না। ঝকঝকে হেসে বলল - ক্যান উই হ্যাভ লাঞ্চ টুগেদার টুডে? রিনি মনে মনে একরাশ বিরক্তি চেপে নিঃস্পৃহভাবে বলল - আই উড লাভ টু, বাট আই হ্যাভ আ মিটিং উইদ মিঃ নাগার্জুনা অ্যাট ওয়ান পি এম শার্প। স্যাম বেজার মুখে কাঁধটা শ্রাগ করতেই লিফটের দরজাটা খুলে গেল। রিনি বেরিয়ে চট করে বাঁ দিকের কনফারেন্স রুমটায় চোখ বুলিয়ে নিল। নাহ, এখনও পাঁচ মিনিট বাকি। আর একটু দেরী হলেই ইন্দ্রনীলদার একরাশ কথা শুনতে হতো।

রুদ্র নিজের ডেস্কে ওয়ার্কস্টেশনে পিপিটি-টা লাস্ট মিনিট টাচ আপ করছিল। পরিচিত গন্ধটা নাকে আসতে মুচকি হাসল, চোখ তুলে তাকাল না। দুহাত তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গার ভঙ্গি করতে পরিচিত স্পর্শ ছুঁয়ে চলে গেল। রিনির মুখের হাসিটাও লেগেছিল। শুধু ইন্দ্রনীলদার গোল গোল কড়া চোখের সামনে পড়েই একটু চুপসে গেল। চুপচাপ নিজের কাগজপত্র, ল্যাপটপ নিয়ে সুড়সুড় করে ইন্দ্রনীলকে ফলো করে কনফারেন্স রুমে পৌঁছে গেল রিনি। অনসাইট, অফসাইট টিমেদের ক্লায়েন্টের সাথে ভিডিও মিটে তুমুল আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে রিনির সাথে রুদ্রের চোখে চোখে হাসি কারওর নজরে পড়ে না। একটা গোপন চোরাস্রোতে ভেসে যাওয়ার মধুরতায় মাতাল দুজনের কাছে ইন্দ্রনীলের উচ্চস্বরের ডাক কোথায় মিলিয়ে যায়। ঋষভের আলতো ধাক্কায় রুদ্র ফিরে আসে বাস্তবে। এবার তার প্রেজেন্টেশনের পালা। সপ্রতিভভাবে উঠে প্রজেকশন পর্দাটার দিকে যেতে যেতে রিনির ঝকঝকে চোখের 'অল দ্য বেস্ট'-টা আলতো করে লুফে নিল রুদ্র।



খবরটা রটত না, যদি না মালতী সকালবেলা একঘর লোকের সামনে হাটে হাঁড়ি ভাঙত।

রমেন্দ্র অভিনয়টা সেভাবে করতে পারেননি কোনওদিন, তাই আজ মালতীর অত্যুৎসাহী প্রশ্নের উত্তরে যথারীতি তোতলাতে লাগলেন।

“আআআআমি বুউউউঝতে পারছিইইই না ...”

“তোমার ঘরে অত্তবড় ছবিটা... উঁহু! আমি ভুল দেখিনি, দাদাবাবু!” মালতীও ছাড়বার পাত্রী নয়।

শ্রী মন দিয়ে দুধ কর্ণফ্লেক্স খাচ্ছিল। রমেন্দ্রকে বাঁচাতে সরব হলো, “বাবা বুঝতে পারছে না পিসী, প্লীজ ডোন্ট বাগ হিম!”

রুদ্র বুঝতে পারছিল, কিছু একটা ঘটেছে, আর সেটার সাক্ষী একমাত্র মালতী। কাকা কাগজ থেকে মুখ তোলেনি এখনও। কাকিমা চায়ে দ্বিতীয় চামচ চিনি গুলছিল, স্ট্যাচু হয়ে মালতীর দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

সত্তরের দশকের উঠতি তারকাদের নিয়ে ডকুমেন্টরিটা রমেন্দ্রও দেখেছেন কাল। সেই সময় ছোটখাটো সিনেমায় অভিনয় শুরু করে অনেকে প্রথিতযশা হয়ে এখন অবসরে। বেশীরভাগ যদিও হারিয়ে গেছে কালের গোলকধাঁধায়। রমেন্দ্র দ্বিতীয় দলে। শখের থিয়েটার থেকে শুরু করে সিনেমা – কোনওটাতেই কিছু করে উঠতে পারেননি। অথচ তাঁর সাথে শুরু করে কমলিকা আজ শেষবেলাতেও সবার মুখে একডাকে।

কমলিকাকে দেখানোর সুবাদেই বেশ কয়েকবার রমেন্দ্র চলে এসেছেন স্ক্রিনে। ভেবেছিলেন কেউ খেয়াল করবে না, কিন্তু শেষরক্ষা হল না। অস্থির লাগছে রমেন্দ্রর, গুটিয়ে নিজের ভিতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। হেরে যাওয়া মেনে নিতে কেই বা পারে সহজে!

খাবার টেবিল থেকে প্লেটগুলো গুছিয়ে তুলে নিয়ে যেতে যেতে মালতী ফিক করে হাসল রমেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে। রুদ্র চোখের কোণ দিয়ে অস্বস্তি পড়ে নিয়েছিল, শব্দ করে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখে নিয়ে, কিছুই হয়নি ভাব করে বলল, “আমি উঠলাম। গেটিং লেট!”

রমেন্দ্র তখনো মাথা হালকা ঝুঁকিয়ে দুহাত অনবরত ঘষে যাচ্ছেন, ভিতরের ঝড়টাকে আটকানোর চেষ্টায়।



ভাড়া মিটিয়ে হলুদ ট্যাক্সিটা ছেড়ে সিকিউরিটির সামনে এসে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল ইন্দ্রনীল। বারোতলা অফিস বিল্ডিংটা যেন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছে মাথার ওপর। বৃষ্টি থেমে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। চশমার কাঁচে ঝিলিক লেগে গেল, পড়ে যাচ্ছিল ইন্দ্রনীল, সিকিউরিটির লোকদুটো দৌড়ে এসে ধরে ফেলল।

নিজের চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবছিল ইন্দ্রনীল। ফোনটা নিঃশব্দে বাজছিল বুকপকেটে, খুলে দেখার সাহস পর্যন্ত হচ্ছিল না – যদি শ্রী হয়! তিনবারের বার ধরল। মা।

সপ্রতিভ মা’কে এত নার্ভাস হতে দেখেনি আগে। কাল রাতের পর থেকে ঘোরের মধ্যে আছে দুজনেই। সাজানো গোছানো পৃথিবীটা হঠাৎই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। শ্রীর সাথে মায়ের প্রথম আলাপটা বাড়িতেই করিয়েছিল ইন্দ্রনীল, মা এখন আর বাড়ি থেকে বেরোয় না বলে। শ্রীর বাবার নাম শুনে কপাল কুঁচকেছিল। তখনই টিভিতে ডকুমেন্টরিটা শুরু হয়েছিল আর রমেন্দ্রকে দেখে শ্রী প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল চেয়ার ছেড়ে, “বাবা আপনার সাথে কাজ করেছেন, আন্টি?”

কমলিকা কোনরকমে শুধু বলতে পেরেছিলেন, “ইনি তোমার বাবা?” তারপর মাথা ঘুরে যাওয়ায় শোওয়ার ঘরে চলে গিয়েছিলেন। ঝড়ের সেই শুরু।

অনেক পরে, রাতে, অবিন্যস্ত অবস্থায় টলমলে পায়ে ইন্দ্রনীলের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

“শ্রীকে তুই বিয়ে করবি না, বাবান।’’

মালাপরানো ছবির লোকটা তার বায়োলজিক্যাল বাবা নয়, জেনেছিল ইন্দ্রনীল।



সাদা ক্যাডিলাকটা নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করে গাড়িতেই বসে রইল খানিক রুদ্র। রিনি আসেনি এখনও। আজও হারিয়ে দিয়েছে ওকে। জেতাটা একটা নেশার মতো হয়ে গেছে। একবার জিতলে বারবার জিততে ইচ্ছে করে।

অথচ ভাবতেও অবাক লাগে রুদ্রর, যে তার বাবা হয়েও রমেন্দ্র এরকম ভীতু আর ঘরকুনো কেন! কেন তার বাবা গুটিয়ে রাখে নিজেকে, কেন এত আনস্মার্ট! এরকম কম কথাবলা মানুষকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারে না কেউ। নিজের ভিতরে একটা গুহার মধ্যে আদিম মানবের মতো একলা বাস করা মানুষকে রুদ্ররই বাবা হতে হলো! বিরক্তিটা চেপে রাখতে পারল না রুদ্র! একটা বিজাতীয় কথা তেতো স্বাদের মতো জিভে কুটকুট করে উঠল।

লিফটের সামনে এসে গেছিল, ইন্দ্রনীল ভ্রূ কুঁচকে একবার তাকাল। জিভ কাটল রুদ্র। এইবার ইন্দ্রদা বকেই শেষ করে দেবে ভেবেছিল রুদ্র। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। এই আর এক কম কথাবলা মানুষ! রুদ্র অবাক হবে না যদি ইন্দ্রদা বিব্রত হলে মাথা নীচু করে দুহাত ঘষে! বাবার মতো!

কিন্তু না, ইন্দ্রদা সত্যিই খুব হ্যান্ডসাম। বাবার থেকে হাজার গুণ বেশী স্মার্ট! আশ্চর্য! বাবার সাথে তুলনা করছে কেন নিজেও বুঝতে পারছে না রুদ্র।

লিফট এসে গেছে। রিনি দৌড়ে আসছে, পিছনে স্যাম নাহাটা। রিনির মুখটা মুহূর্তে কোমল হয়ে গেল রুদ্রর দিকে চোখ পড়তে। জেতার আনন্দ ফিরে আসছিল রুদ্রর, ইন্দ্রনীল আস্তে টোকা মারল পিঠে। যার মানে হলো, নট নাউ, বাডি, নট নাউ!



6
“হ্যালো! আমি কি রমেন্দ্র বসুর সাথে কথা বলতে পারি?”

“হ্যাঁ, বলছি।’’ ... “হ্যালো! হ্যাঁ, বলুন! আমিই রমেন্দ্র বসু।’’ ... “হ্যালো! কথা বলছেন না কেন?”

“আমি... কমলিকা বলছি।’’

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না রমেন্দ্র, অস্ফুটে বললেন শুধু, “কমল!”

“তোমার সাথে খুব জরুরী কথা আছে রম। আমি তো বাড়ি থেকে বেরোই না, নাহলে আমিই যেতাম তোমার কাছে।’’

“আমার ফোন নম্বর তুমি কোথা থেকে পেলে?”

“তোমার মেয়ে শ্রীকে আমি চিনি।’’

“সেকি! কি করে?”

“সেসব বলব তোমায়, তুমি একবার এসো। আজকেই।’’

ফোন রেখে দিয়েছে কমলিকা। রমেন্দ্রর ঘোর কাটেনি এখনও। অনেক স্মৃতি ভিড় করে চোখের সামনে একের পর এক চলে যাচ্ছে। নিজের ভিতরের অস্থির উন্মাদনাটা ফিরে এসেছে। না, কিছুতেই যাবেন না, কিছুতেই না! কেনই বা যাবেন!

বিকেলের আলোটা ছাদের কার্নিশ থেকে সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। দুটো তিনটে পাখি ডানা ঝাপটিয়ে সামনের গাছটার ঘন পাতার আড়ালে কোথায় চলে গেল। অন্ধকার হয়ে যাবে একটু পরেই, গিলে নেবে চরাচর। তবু তারই মধ্যে এদিক ওদিক আলো জ্বলে উঠবে। চোখ সয়ে গেলে ততটা খারাপ লাগবে না। রমেন্দ্র হালকা হচ্ছেন একটু একটু করে। নাহ, এত বছর বাদে আর কিছু মনে করে রাখা উচিৎ নয়। যা গেছে তা যাক বরং।





একদম হঠাৎ করে প্রোপোজালটা এল। রিনি আশা করেনি। এক বছরের অনসাইট। ক্লায়েন্টের ইন্টারভিউতে অনায়াস দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। তবে ভাবে নি হয়ে যাবে। পাঁচজনের মধ্যে তার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে, মাত্র দুবছর হলো ঢুকেছে, কেই বা ভাবতে পারে!

“কঙ্গোস, রিনি!” স্যাম নাহাটার মুখটা একটু দুঃখিত মনে হলো।

“থ্যাঙ্কস!” পাশ কাটিয়ে সাঁৎ করে ইন্দ্রনীলের কিউবিকলে ঢুকে পড়ল রিনি।

টেবিলের ওপর হাতে মাথা রেখে শুয়ে থাকার পাত্র প্রোজেক্ট লিড নয়! তবু ছিল।

“আর ইউ ওকে, ইন্দ্রদা?” একটু ইতস্তত করে পিঠে হালকা হাত রাখল রিনি।

ওর দিকে না তাকিয়ে মাথা তুলে চশমার ফাঁকে আঙ্গুল গলিয়ে চোখের কোণ মুছল ইন্দ্রনীল, “ইয়েস! আয়্যাম ওকে।’’ বলেই রিনির দিকে ফিরল হাসিমুখ করে, “খাওয়াবি না?”

হাত ধরে যত্ন করে কাজ শিখিয়েছে যে, তার এইটুকু ওঠানামা শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থেকে বুঝে নিতে পারে রিনি। খুব বড় কিছু একটা হয়েছে, নাহলে ইন্দ্রদা অফিসেও আপসেট থাকত না।

ইন্দ্রনীল ভ্রূ নাচিয়ে হাসল এবার, “কিন্তু, ওই ছাগলটার কি হবে রে? মজনু হয়ে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে তো!”

রিনির মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল, কিছু বলার আগে পিছন থেকে রুদ্র ঝাঁঝিয়ে উঠল, “মজনু, মাই ফুট! আই গিভ আ ফিগ!”

ইন্দ্রনীল হাহা করে হেসে উঠল, কিন্তু রিনির কোথাও একটা বজ্রপাত হলো যেন! একটা আয়না হাজার টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে গেল, প্রত্যেকটা টুকরোয় হৃদয় ভাঙ্গার লালচে দাগ। রুদ্রর কিছুই যায় আসে না, তার থাকা বা না-থাকাতে! এত কঠিন রুক্ষ স্বরে এভাবে বলল যেন সত্যিই ওর কিছু যায় আসে না!

রেস্টরুমের দিকে ছুটে গেল রিনি। রুদ্র গেল উল্টোদিকে স্মোকিং জোনে। আর একটা অ্যাপ্রুভালের মেইল ঠিক তখনই স্ক্রিনে ভেসে উঠল ইন্দ্রনীলের সামনে।



মাটির দিকে মুখ করে বসে আছেন কমলিকা। আটপৌরে একটা শাড়ি পরনে, লম্বা চুল আলতো খোঁপায় ঘাড়ের কাছে লতিয়ে আছে।

রমেন্দ্রর মনের কুয়াশা কেটে যাচ্ছে, তিরতিরে একটা ভালোলাগা ন্যাপথালিনের গন্ধওয়ালা পুরনো বালাপোষের মতো জড়িয়ে উষ্ণতা দিচ্ছে যেন। একটা পালকের মতো হালকা হয়ে ভাসতে ভাসতে কমলিকার আশেপাশে ঘুরঘুর করছেন তিনি।

“শ্রী খুব সুন্দর হয়েছে রম। নিশ্চয়ই ওর মায়ের মতো?” মুখ তুললেন কমলিকা, দীঘির মতো চোখ মেলে হাজার বছরের ক্লান্তি নিয়ে।

“তুমি শ্রীকে চিনলে কি করে? শ্রীও তো কই আমাকে কিছু বলেনি!”

“ইন্দ্রনীলকে তোমার চেনার কথা নয়। শ্রী আর ইন্দ্র, ওরা দুজনে দুজনকে ভালোবাসে। আমি কালই জানতে পেরেছি। শ্রী এসেছিল প্রথমবার আমার বাড়ি। ওর কাছেই তোমার নাম শুনলাম।’’

“আমি বোধহয় ওদের থেকে অনেক দূরে সরে গেছি কমল। ছেলেমেয়েরা কেউ আমার সাথে কথা বলে না ভালো করে, কতদিন হয়ে গেল। কিন্তু, ইন্দ্র কে? তোমার ছেলে! এত ভালো কথা!’’’

“কিন্তু...”

“কিন্তু কি কমল? ওরা যদি দুজন দুজনকে ভালোবাসে, তাতে তোমার আপত্তি কেন?”

“এটা হতে পারে না, রম!”

“কেন হতে পারে না কমল? তুমি লব্ধপ্রতিষ্ঠ, আর আমি সাধারণ বলে?”

“রমেন্দ্র! এসব কি বলছ!”

“একদিন তো এই কারণটাই একমাত্র ছিল কমল, তাই ভাবছি আজও সেইটাই কি না...”

“ভুল বোঝা তোমার পুরনো অভ্যাস, রম!”

“বেশ! তাই সই! তাহলে ঠিকটা তুমিই বুঝিয়ে দাও!”

“শ্রী ইন্দ্রকে বিয়ে করতে পারে না রম!”

“কেন কমল? কেন? কোথায় অসুবিধা হচ্ছে তোমার?”

“কারণ ...”

“কারণ?”

“কারণ ইন্দ্র আমাদের ছেলে!”

প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে সজোরে আছড়ে পড়লেন রমেন্দ্র। একটা ঘূর্ণির ভিতর তলিয়ে যেতে যেতে হাতড়ালেন যখন, হাতে এলো শুকনো কাঠ, চেয়ারের হাতল। শক্ত করে চেপে ধরলেন সেটাই।



অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ি যেতে ইচ্ছে হল না রিনির আজ। সামনের রাস্তায় গায়ে গায়ে লাগা ভিড়। ব্যস্ততাটা ছুঁয়ে গেল না রিনিকে, কোনওই তাড়া নেই যেন। কোথাও যাওয়ার নেই, কারোও সাথে কথা বলার নেই, কিচ্ছু করার নেই।

মিন্টুর চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে ফোনটা এহাত ওহাত করছিল, বেজে উঠল সেটা। ইন্দ্র।

“কি রে? তুই কি চলে গেছিস?”

“আছি। বলো।“

“শিগগির আয় একবার। অ্যান্ডারসন মেইল শ্যুট করেই যাচ্ছে। বিশাল এস্কালেশন হয়েছে।“

“আসছি। চাপ নিও না।“

অফিস ফাঁকা হয়ে গেছে প্রায়। লম্বা ঘরটার সারি সারি কিউবিকলগুলো নির্জীব পড়ে আছে। শুধু সাপোর্টের কয়েকজন আর ইন্দ্র হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে কম্পিউটারের ওপর।

না, রুদ্র কোথাও নেই। থাকবেও না হয়ত। অন্তত হাবভার সেরকমই বলছে। সারাদিনে কথা তো দূরের, তাকায়নি অবধি রিনির দিকে। আর তো দশ দিন। তারপরে এক বছর থাকবে না রিনি। রুদ্রর কি একবারও মনে পড়বে না তার কথা? মনে মনে যা ভেবেছে এতদিন, সেসব মিথ্যে! পরিষ্কার মনে হয়েছে রুদ্রর চোখ, মন সব তারই জন্য। কিন্তু সব ভুল ছিল! আর ভাবতে পারে না রিনি। খালি খালি কান্না পাচ্ছে।

“হ্যালো রুদ্র, কোথায় রে তুই?” ইন্দ্রদার মুখে রুদ্রর নামটা শুনে ভিতরে কেমন একটা করে উঠল রিনির। আর কান্নাটা ফিরে এল আবার।

“বলো ইন্দ্রদা”, রিনির পিছনে ভারী গলাটা বলে উঠতে জোর চমকাল ও। পেটের ভিতর অনেক প্রজাপতি জেগে উঠল, আবার গলার কাছটা দলা পাকিয়ে কি এক কাণ্ড হয়ে গেল।

“ওহ, এই তো! আচ্ছা শোন। অ্যাই রিনি, আবার কোথায় যাচ্ছিস? শুনে যা।’’ ইন্দ্র গুছিয়ে বসল চেয়ারটায় হেলান দিয়ে। মুখে মিটিমিটি হাসি।

“রুদ্র, তুই বলবি না আমি বলব?”

“আমার কিছু আর বলার নেই ইন্দ্রদা।“

“প্লীজ এবার থাম রুদ্র, নাহলে মার খাবি!”

কিছুই বুঝতে পারছিল না রিনি। হাঁ করে একবার একে দেখছে, আর একবার ওকে।

“না না ইন্দ্রদা, তুমি প্লীজ ইনসিস্ট কোরো না, আমি পারব না!”

“অ্যাই রিনি, ওয়েট! শোন্‌ শোন! রুদ্রও যাচ্ছে তোর আথে অনসাইট।“

প্রজাপতিগুলো ফিরে এসে হুল্লোড় শুরু করেছে এবার। রিনি কিছু বলতে পারছে না। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু পারছে না।

চোখ নাচিয়ে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে রুদ্র বলল, “ইন্দ্রদা জোর করল বলে, নাহলে আমার কোনওই ইচ্ছে ছিল না, বুঝলি?”

ইন্দ্রর বুকে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রিনি, টাল সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াল ইন্দ্র। পিছন থেকে রুদ্র বলল, “ওটা দাদা, আমি এদিকে রে!”

বুকের ভিতরের জ্বালার ওপর একটা হালকা বৃষ্টি অনুভব করল ইন্দ্রনীল, চশমা খুলে ঝাপসা চোখে ঠাহর করার চেষ্টা করল কতটা আগুন জ্বললে পোড়ার অনুভূতিটা টের পাওয়া যায় না। পারল না।

0 comments: