স্মৃতির সরণী - সুদেষ্ণা চক্রবর্তী
Posted in স্মৃতির সরণী
স্মৃতির সরণী
আমি ও আমার পরাণবঁধুয়া
সুদেষ্ণা চক্রবর্তী
জ্যোতিষ শাস্ত্রে ভারী পণ্ডিত আমার কর্তা সাত্যকি বলে, কেতু-মঙ্গল নাকি আমার জীবনে ঝঞ্ঝা সৃষ্টি করে। আমি বাপু গ্রহ-গ্রহাদির রহস্য কিছু বুঝিনা। তবে এটা বেশ অবগত আছি যে, আমি একটি আস্ত দুর্ঘটনাপ্রবণ মানুষ। দুর্ঘটনা আমায় গ্রাস করে না আমি তার কন্ঠলগ্না হই, সেটাই গূঢ় প্রশ্ন।
আমি জন্মেছিই নাকি একখানা ভাঙা পা নিয়ে। অন্তত ডাক্তারি শাস্ত্র তাই বলে। যদিও সাড়ে বত্তিরিশ বছর ধেইধেই করে নেত্য করার পর হঠাৎ একদিন তা ধরা পড়ল। বলুন, কি আমোদের কথা... নয়?
আরে, দুর্ঘটনা আমার পরাণবঁধু একথা বাড়ির লোক কিছুতেই মানে না। এইতো গতবছর পুজোর আগে শুকনো ডাঙায় আছাড় খেয়ে পড়লাম। কি ভাগ্যি জায়গাটায় ফাটল ধরেনি, চিড় ধরেছিল শুধু আমার কাঁধের হাড়ে। তা সেও তো জোড়া লেগেছে নাকি। তার দু’বছর আগে চন্দননগরের রাস্তায় জনৈক ব্যক্তির বদান্যতায় ফুটপাত থেকে পড়ে পায়ে তিন জায়গায় চিড় ধরেছিল, মা তখন সেরিব্রাল স্ট্রোকে আইসিউতে ভর্তি আর বাবা বাড়িতে শয্যাশায়ী। ফলে দিন পনেরো প্লাস্টার করারও সময় পাইনি। পা টেনে টেনেই নার্সিংহোম আর বাড়ি করেছি যতক্ষণ না মা নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফিরেছেন। জীবনটা তো এমনই। কোনও কিছু কি আর আমার সুবিধেমাফিক ঘটবে? তবু থেমে তো থাকার উপায় নেই।
সেই আড়াই বছর বয়সে এক দীপাবলীর সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনে জ্যাঠার বাড়িতে বাবা ব্যস্ত বাজি পোড়াতে, মা শব্দদূষণের আতঙ্কে ঘরে খিল এঁটে বসে আছেন। আমি উঁচু দাওয়ায় বসে দাদা দিদিদের আনন্দউৎসব দেখছি। এমন সময় কোন বৃহস্পতিজাতক একখানা জ্বলন্ত ফুলঝুরি আমার হাতে ধরিয়ে গেল কে জানে! আমি তো বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেই অপরূপ আলোকছ্বটা দেখলাম। ধীরে ধীরে আগুন নিভে গিয়ে যখন তারাকাঠি লাল হয়ে উঠল, তখন শিল্পী বাপের রোমান্টিক কন্যা আমি পরম মুগ্ধতায় রক্তিম খণ্ডটিকে শক্ত মুঠিতে চেপে ধরেছিলাম। ফলতঃ --- আর বলতে হবে?
আমার আট বছর বয়স অবধি আমরা উত্তরপাড়ার মাখলায় থাকতাম। প্রতিদিন খেলতে গিয়ে হাতে পায়ে অজস্র কাটাছেঁড়া, এনিয়ে তখন কেউ মাথা ঘামাতো না। সেসব ক্ষত চিহ্ন আমার বয়সী অনেক বন্ধুই এখনো সগর্বে দেহে বহন করছেন। আমরা তো আর ঘরে বসে স্মার্ট ফোনে গেম খেলতাম না, রীতিমতো ছুটোছুটি করে খেলাধুলা করতাম। সে সবতো ঠিক আছে, কিন্তু চ্যাটার্জী পাড়ায় আবার প্রচুর পুকুর। মা তাই আতঙ্কিত থাকতেন কোনদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনবেন তাঁর অতি শান্ত মেয়ে কোন পুকুরে ডুবে গেছে। তা একদিন তাঁর সেই আতঙ্ক খানিকটা সত্যিই হয়ে গেল। মেয়ে হয়ে রাঙালাঠি খেলায় জিতে যাওয়ার অপরাধে আমার এক বালক বন্ধু আমায় বর্ষার ভরাপুকুরের ডুবন্ত সিঁড়িতে ঠেলে ফেলে পিঠের উপর চেপে বসে ছিল। যাঁদের পুকুর সেই বাড়ির নতুন বৌ ভাগ্যিস তাঁর বৈকালিক কেশচর্চাটি তাঁদের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সারছিলেন, তাই তো আজ এই আগডুম বাগডুম লিখতে পারছি।
এরপর দু’বছর শান্তিনিকেতনে আশ্রমে প্রচুর অসুস্থতা সত্ত্বেও বিনা দুর্ঘটনায় কেটেছে কি করে কে জানে! অথচ ওখানেই আমি গাছে চড়তে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলাম। চন্দননগরে আসার পর আরও একবার জলডুবি হতে যাচ্ছিলাম বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে। সেবার পাড়ার এক তথাকথিত গুণ্ডা আমায় রক্ষা করেন, যাঁকে আমার জীবনদাতা হিসাবে এখনো আমি প্রণাম করি।
স্কুল জীবনে আমার একখানা সাইকেলের বড় সাধ ছিল। জানতাম কেনা সম্ভব নয়, তা না হলে বাবা রোজ এত কষ্ট করে দু’তিন বার বাজার যান অতখানি পথ ঠেঙিয়ে? অবশ্য ঐ দু’তিন বার যাওয়ার কারণ, বাজারে গিয়ে গল্পের ঠেলায় অর্ধেক জিনিস নিতে ভুলে যাওয়া বা নিয়ে ফেলে আসা।
কলেজে ভর্তি হতে শেষ অবধি একখানা লেডিস রেসিং সাইকেল কেনা হলো, যা শিখতে গিয়ে মাঠের গোলপোস্টে ধাক্কা খেয়ে এক মারাত্মক দুর্ঘটনাবশত একমাস শয্যাশায়ী আমি মৃত্যুর বন্দনায় গাইতাম “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন ------”। মৃত্যু অবশ্যই আসেনি, তবে ঐ লেডিস সাইকেল বরাবরের মতো আমার বাবার কুক্ষিগত হলো।
ভাইজাগে গিয়ে বেশ কয়েকবছর পর অনেক কাকুতি-মিনতির জোরে মার অজান্তে বাবার কাছ থেকে একটি সানি স্কুটি আদায় করলাম।বাবার নিজের ইচ্ছেও অবশ্য ষোলো আনাই ছিল। তা সে সানিকে প্রথম দিনেই এমন চোট উপহার দিলাম যে সে মালিক হিসেবে আমার থেকে সাত্যকিকেই আপন করে নিল। কিন্তু সাত্যকির তো একখানা বাজাজকাব ছিলই, তাই আমার সানি এক বছরের মধ্যেই মালিকানা বদল করতে বাধ্য হলো।
এর বেশ কয়েক বছর পর পায়ের ত্রুটি ধরা পড়ার জন্য নাচ বন্ধ, নাচের স্কুল বন্ধ। সারাদিন গুমরে গুমরে থাকি। এদিকে সাত্যকির অফিসে প্রচণ্ড চাপ। বাড়ি ফেরে অনেক দেরীতে। আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে নিজের বাহন না থাকলে বাজার দোকান যাওয়া খুব মুশকিল।সবই দূরে দূরে। কি করি? মাকে বলতেই মা জানিয়ে দিলেন মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে যদি তাঁকে গোপন করে একটি টাকাও খরচ করেন বাবা, তাহলে সেই দণ্ডেই মা গৃহত্যাগ করবেন। বৃদ্ধ বয়সে গৃহিণী হারানোর ভয়ে বাবা যখন মুখ ফিরিয়ে নিলেন, তখন স্ত্রী স্বাধীনতার মোক্ষম বাণটিতে সাত্যকিকে বিদ্ধ করা ছাড়া আর আমার উপায় কি ছিল?
এবার এল মেরুন রঙের স্পিরিট। সাত্যকি প্রতিরাতে যত্ন করে ধরে ধরে আমায় স্কুটি চালাতে শেখালো। আমি কি সুন্দর দুপাশে ঠ্যাং ছড়িয়ে মৌখিক হর্ন দিয়ে স্কুটি চালাতে পারছি দেখে ছ' মাসের জন্য জামাই-এর বাড়িতে বেড়াতে আসা মা পুলকিত হলেন, কন্টকিতও বা। তাই প্রতিদিন মাকে বারান্দায় বসিয়ে আমি সামনের রাস্তায় স্কুটাভ্যাস করতাম।
একদিন মায়ের আতঙ্ক দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার কাছে পরাজিত হয়েছে বুঝে আমি স্কুটি নিয়ে ধাঁ। মিশন - পেট্রল ভরা। তখন কাছাকাছি পেট্রল পাম্প অন্ততপক্ষে ছয় কিলোমিটার দূরে, স্টীলপ্ল্যান্ট যাওয়া আসার পথে। “চলি চলি চলি চলি পথের যে নাই শ্যাষ।” আমার গতি ঘন্টায় দশ কিলোমিটার। পাশ দিয়ে সাইকেল চলে যাচ্ছে। যা। আমার কোনও তাড়া নেই। হঠাৎ মনে হলো পেছনে আওয়াজ হচ্ছে, কিন্তু কোনও দু চাকা বাহন তো নজরে আসছে না। তবে কি ভূত? এই নির্জন রাস্তা সম্পর্কে রাত্রিকালীন অনেক কিসসা কাহিনী আছে। আমি থামলে ভূতুড়ে আরোহীও থামছে। বেশ কয়েকবার এমন বিরতির পর বুঝলাম, রামোঃ! কি নজ্জা। এ তো আমারই বাহনের হাওয়া কাটার শব্দ।
এবার কিন্তু আর অশরীরী উপস্থিতি নয়। একেবারে সত্যিসত্যিই কেউ অনুসরণ করছে বুঝলাম। তখন গলায় একটা তিনভরির মোটা লম্বা চেন পরতাম। তবে কি ঐটে ছিনিয়ে নিতে এসেছে? প্রায় পৌঁছে গেছি, সামনে এসে দাঁড়ালো মহাকাশচারী। হেলমেট খুলতেই চিনতে পারলাম, আমার এক ছাত্রীর বাবা। এগিয়ে এসে খুব বিনয়ের সঙ্গে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি কি না। দরকার হলে তিনি আমায় বাড়ি পৌঁছে দিতে পারেন। তাঁকে আসল সত্যিটা বলি কি করে? সুতরাং কিছু একটা ভুজুংভাজুং দিয়ে পেট্রল নিয়ে কেটে তো পড়লাম। কিন্তু ভদ্রলোকের হাবভাব দেখে মনে হলো আমার নিরাপত্তা নিয়ে উনি তখনো যথেষ্ট চিন্তিত।
ধীরে ধীরে দুই প্রসারিত পদযুগল পাদানিতে স্থান পেলো, মুখের বদলে স্পিরিটের হর্ন বাজাতে অভ্যস্ত হলাম। স্পীড বিশ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় উঠল।
ছোটো মেয়ে মিতুলের ক্লাস টু’র পরীক্ষা। বাবাই ওকে গিয়ে নিয়ে আসতেন। ডিপিএস স্কুল আমাদের সেক্টর টেনের ফ্ল্যাট থেকে বেশী দূর নয়। তবে সদ্য দোলপূর্ণিমার পরের দিন। চড়চড়ে রোদ। আমি ঘরের কাজ মিটিয়ে শুয়ে আছি, বড় ঘুম পাচ্ছে। তখন কি আর জানি, আগের বেশ বেশী রাতে আমার হাঁপানির দমক ওঠাতে, সাত্যকি ডেরিফাইলিনের সঙ্গে একখানা সেট্রিজিনও দিয়েছিল।
বাবা এসে বললেন, “তুই কি মিতুলকে নিয়ে আসতে পারবি? আমার শরীরটা তেমন ভালো লাগছে না।”
বাবা সচরাচর নিজের অসুস্থতার কথা প্রকাশ করেননা। আমি তড়াক করে বিছানা ছেড়ে তৈরী হয়ে স্কুটি নিয়ে বেরোলাম। হাওয়ায় বিচ্ছিরি ভাবে উড়ছে কামিজ, আমার খুব লজ্জা করছে। বাঁহাতে সামাল দিতে গেলাম, ঠিক একটা বাঁকের মুখে। এখন ভাবি দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশেই দায়ী মানুষের ভিমরতি। পাশে গ্যারেজ তৈরীর কাজ চলছিল বলে রাস্তায় স্টোনচিপ্স ছড়ানো ছিল। আমি টার্ন নিতে গিয়েই স্কিড করলাম। বাঁহাত তখনও ব্রেক থেকে দূরে। আমার বাহন আমায় চারফুট গভীর নর্দমায় ফেলে ওপারে গিয়ে আর্তনাদ করতে লাগল।
পড়ে গিয়ে সর্বপ্রথম অনুভূতি হলো “এইতো বেশ আকাশ দেখতে পাচ্ছি, তাহলে বেঁচে আছি?” তবে থুতনি, হাত, পা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।আমার স্কুটির ডাকে লোকজন ছুটে এল। আমায় টেনে তোলা হলো। ভাগ্যিস তখন ৬০কেজি ছিলাম। তাই অন্তত ক্রেন দরকার পড়েনি।
সবাই আমায় নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করছে। বলি কি করে? অত কাণ্ডের মধ্যেও জ্ঞান টনটনে। আমার লাইসেন্স নেই। ওখানে ফাঁকা রাস্তায় মহিলারা অনেকেই বিনা লাইসেন্সে মোটরগাড়ীও চালান। অন্য কারুর কি হবে জানিনা, কিন্তু আমায় যদি পুলিস ধরে? বাবারে!
ওদিকে মিতুল এতক্ষণে নিশ্চয়ই গেটের কাছে এসে মাকে খুঁজছে। মেয়েটা সকাল বেলায় জ্বর গায়ে নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেছে। কি হবে?
ভিড়ের মধ্যে কেউ বলছে বাড়ি পৌঁছে দেবে, কারণ আমার স্পিরিটের ঘাড় মটকে গেছে। কেউ বলছে তক্ষুণি আমায় হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার কথা। মুহূর্তে মিতুলের অশ্রুপ্লাবিত মুখটা মনে পড়ল। আমি জোরের সাথে ঘোষণা করলাম, আমার কিচ্ছু হয়নি। উপস্থিত জনগনের কেউ যদি একটু সদয় হয়ে আমার বাহনটিকে তখনকার মতো চালু করার ব্যবস্থা করে দেন। আমি স্থানীয় বাসিন্দা নই,টাউনশিপের বাইরে অনেক দূরে থাকি। লোকে কি বুঝল কে জানে, অমন ভেউ ভেউ করে আমায় কাঁদতে দেখে দু’জন সহৃদয় ব্যক্তি এগিয়ে এসে স্কুটি কোনওমতে খানিকটা সোজা করে স্টার্ট দিয়ে দিলেন। আমি আমার একটিমাত্র চপ্পল পাদানিতে রেখে অন্যটির মায়া ত্যাগ করে নগ্নপদে মেয়েকে আনতে গেলাম। আমাকে অমন রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে মিতুল ককিয়ে উঠলেও, বাধ্য মেয়ের মতো আমাকে জাপটে ধরে চুপ করে বসে রইল। ওকে না উল্টিয়ে ঐ আধভাঙ্গা স্কুটিতে কিভাবে যে বাড়ি পৌঁছলাম, সে বুঝি শুধু মা বলেই।
বাড়ি ফিরতে দেখেই বাবা দূর থেকে ঠিক ঠাওর করতে না পেরে হাসতে হাসতে বললেন, “এখনও হোলি খেলা শেষ হলো না?”
আমি তখন যন্ত্রণার চোটে আর কথাই বলতে পারছিনা।
এতক্ষণের ফোঁপানো মিতুল এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বাবলি সেদিন বাড়ীতে। ওর আবার পরের দিন পরীক্ষা। বোনকে অমন আর্তনাদ করতে দেখে সেও কান্না জুড়ে দিল। আমি ততক্ষণে কোনওমতে দোতালায় উঠে আসতে পেরেছি। আমার প্রকৃত অবস্থা প্রত্যক্ষ করে এবার বিরাশী বছরের বাবার সে কি কান্না! দেখলাম একমাত্র মা-ই মাথা ঠাণ্ডা রেখে তুলো ডেটল খুঁজে পেতে আনলেন। সাত্যকিকে খবর দেওয়ার কথা হচ্ছে, তিনি স্বয়ং হাজির তাঁর বক্সার নিয়ে। প্রচণ্ড বকুনির তোড়ে এবার সমবেত রোদনে আমিও যোগ দিলাম। জানি স্বামীর কথার অবাধ্যতা করেছি, কিন্তু আমার যে আর কোনও উপায় ছিল না। সাত্যকির সেদিন ইউনিয়ানের নেতাদের সাথে জোরদার মিটিং ছিল, আমার নির্বুদ্ধিতার কারণে তাকে ওখান থেকে উঠে আসতে হয়েছে। বুঝলাম, আমি মিথ্যা পরিচয় দিলেও কিছু মানুষ আমায় চেনেন। তাঁদেরই মধ্যে কেউ সাত্যকিকে খবর দিয়েছেন।
হসপিটাল পর্যন্ত সারাটি পথ আমায় ধমকাতে ধমকাতে গেলেও ফেরার সময় যেই দেখলাম বকবকানি থেমেছে, মুখটাও অত পাথরের মতো শক্ত নেই, তখন প্রাণে সাহস সঞ্চয় করে বললাম, “আমার বাঁ পায়ের নূপুরটা না পড়ে গিয়ে হারিয়ে গেছে।" ভাবলাম, এইরে আবার বুঝি দাঁতখিঁচুনি খেতে হয়। কিন্তু না, আমার ফাটা মুখ দেখেই হোক, বা আমার নূপুরপ্রীতির কথা অবগত থাকার জন্যই হোক কিম্বা হঠাৎ বসন্তের হাওয়া লেগে সাত্যকির বুকে তখন বোধহয় প্রেমের ঢেউ উঠেছে। ও বাইক দাঁড় করিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে এদিক ওদিক অনেক খুঁজল।কিন্তু "হায় রে, হায় রে নূপুর ----"।
এরপর বেশ কিছু বছর বিনা দুর্ঘটনায় কেটে গেল। আমার বাড়ির লোক, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় পরিজন, ওখানকার রাস্তার কুকুরবেড়াল, এমনকি পাশের গ্রাম থেকে চরতে আসা ছাগলের পালও নিশ্চিন্ত হলো আমার দ্বিচক্রযান চালনা আয়ত্তে আসা সম্পর্কে।
ডিপিএস স্কুলে বিশ্ব নৃত্য দিবস পালিত হচ্ছে। আমি প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছি। ওঁরা আমায় গাড়ি করে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে আমি বিনয়ের সাথে জানিয়েছি, আমি নিজেই চলে যাব। ওঁরা ভেবেছিলেন আমার স্বামী আমায় পৌঁছে দিয়ে যাবেন। সাত্যকিরও তাই মনোবাসনা ছিল। কিন্তু হঠাৎ আমার স্বাধীনতাপিয়াসী স্বত্তা জেগে উঠল। আমি আমার বাহনেই যাব। তা গেলাম। শাড়ি টাড়ি পরে, সেজেগুজে স্কুটি নিয়ে ডিপিএস-এর গেটের কাছে পৌঁছলাম।
দেখলাম, ফুলের তোড়া হাতে ভিতরে সবাই আমার জন্য প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু মুশকিল হলো, গেটের দারোয়ান আমায় চেনে আমার দুই মেয়ের মা হিসেবে। সে আমায় স্পষ্ট জানিয়ে দিল, এক্ষুনি প্রধান অতিথি এসে পৌঁছবেন, সুতরাং আমি যেন গেটের থেকে দূরে স্কুটি পার্ক করি।
অনুষ্ঠানে ইংরাজিতে আমায় বক্তৃতা দিতে হবে। সাত্যকি বলেছিল, ও কাগজে লিখে দেবে নাকি? কিন্তু ঐ সেই গুমোর পোকার কামড়।আমিই বলবো, তাৎক্ষণিক। এতক্ষণ সেই বক্তৃতার টেনশন, তার মধ্যে দরোয়ান সাহেবের হ্যাটা, মাথার মধ্যে সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। দিলাম অটোমেটিক স্টার্ট বাটনটি টিপে। আমার বাহন আমায় হেঁচড়ে নিয়ে খানিক এগিয়ে গেল। দারোয়ান তখন ছুটেছে ভিতরে, সবাই দৌড়ে এল। প্রধান অতিথি মহোদয়া ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আতিথ্যবরণ করলেন। অবশ্যি ভাষণটি জব্বর দিয়েছিলাম। এরপর, অনেকবার ঐ স্কুলে নাচের প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছি, এবং প্রত্যেকবারই ওঁরা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মুশকিলটা অন্য জায়গায় হলো। এরপর থেকে আমায় স্কুটিতে চেপে দূর থেকে আসতে দেখলেই ডিপিএস-এর প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নিজের সবুজ রঙের অল্টো রাস্তার একঠেরে দাঁড় করিয়ে দিতেন। আমি পেরিয়ে গেলে তবে নিশ্চিন্তে গাড়িতে স্টার্ট দিতে তাঁর সাহস হলো।
মিতুল যখন ক্লাসএইটে উঠল, সাত্যকির এক বাল্যবন্ধু ও সহকর্মীর হঠাৎ পিতৃবিয়োগের খবর এল চন্দননগর থেকে। সাত্যকি তৎক্ষণাৎ ছুটল যাবার টিকিটের ব্যবস্থা করতে। সময় খুব কম। ওদের জন্য রান্না করার আর অবকাশ নেই তখন। কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে দেওয়া যেতে পারে। আমি স্কুটি নিয়ে দোকানে বেরোতে যাব, বাবা বললেন টুপি মাথায় দিয়ে যেতে, যা রোদ! যদিও আমি টুপি পরতে এবং পরাতে দু’টোই ঘোর অপছন্দ করি, তবু পিতৃআজ্ঞা বলে কথা। মাথায় সাত্যকির একখানা ক্যাপ পরে বেরোলাম।
বাড়ি থেকে মোড় নিয়েই বড় রাস্তা। সাত্যকির মস্ত মাথার মুকুট কি আর আমার মাথায় শোভা পায়! টুপি সামনে নেমে এসে আমার চোখ ঢেকে দিল। অতিপক্ক আমি মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে স্বস্থানে ফেরত পাঠাতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে দড়াম করে বাহন শুদ্দু কেতরে পড়লাম। শুনশান রাস্তায় তখন একটিমাত্র দর্শক এক বাইক আরোহী তাড়াতাড়ি এসে আমায় উদ্ধার করলেন। দেখা গেল, শেষ মুহূর্তে দুহাতে ব্রেক চেপে ধরায় আমার বাহন একটু বেঁকে গেছে আর আমি হাতেপায়ে অজস্র চোট পেয়েছি।
আমি কোনওমতে উঠে দাঁড়ানোর পর আমার উদ্ধারকর্তা আমায় আমার নাম ঠিকানা শুধোলেন। বোধহয় ইচ্ছা, বাড়ি পৌঁছে দেবার। হুঁ, ঠিকানা বলি আর কি? এইপাশেই বাড়ি শুনলে উনি আমায় বাড়ি দিয়ে আসুন আর আমার বাবা তখন ঐ ঘায়েল অবস্থায় আমাকে যেন বন্ধুকৃত্য করতে দেবেন? সুতরাং আমি আর কি করি, বোকার মতো প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে থাকলাম। ভদ্রলোকএবার জিজ্ঞাসা করলেন,“Where are you going?”
নির্মল প্রশ্ন। সহজ ভাবে উত্তর দেওয়া যেত, এই সামনে দোকানে, বা বন্ধুর বাড়ি। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় আমার মাথাটা তখন কিঞ্চিৎ ঘেঁটে গেছে। বললাম, “My husband's friend's father is no more. So I am going to his house.”
“Oh! Where?”
“In Calcutta.’’
ভদ্রলোক আমার বাক্যের শুরুর prepositionটা খেয়ালই করলেন না, বোধহয় ভাবলেন, আমি স্কুটি চালিয়ে কলকাতা যাওয়ার কথা বলছি।ফলে আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে ওঁর প্রবল সন্দেহ দেখা দিল। উনি আর একবার আমার নাম, স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করলেন। আমাকে নিরুত্তর দেখে এবার সম্ভবত ওঁর সন্দেহ দৃঢ়মূল হলো। খুব আতঙ্কের গলায় বললেন, “Are You Ok madam?”
“I am perfectly alright” বলে আর দাঁড়ানো সমীচিন হবে না বুঝে, আমার উদ্ধারকর্তাকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে, লগবগে স্কুটিতে স্টার্ট দিয়ে কেটে পড়লাম। যাওয়ার পথে দোকানে চিপস, বিস্কুট ইত্যাদি কেনার পর সেই পরিচিত দোকানদারের কাছে একটু ডেটল চাওয়াতে, উনি আমার দিকে একখানা হাফ লিটারের ডেটলের বোতল এগিয়ে সেটিরও দাম ধরে, দন্ত বিকশিত করে জানালেন, অবিলম্বে কেটে যাওয়া ক্ষতে অ্যান্টিসেপ্টিক না লাগালে তা বিষিয়ে উঠবে। আমি ওঁর ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও, ডেটল নিতে প্রত্যাখ্যানই করলাম।
এরপরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত।
সাত্যকির বন্ধুর পিতৃশোক ভুলে আমার শুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়ে পড়া।
আমার বাহনটিকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো।
সমবেত বিচারে আমার দ্বিচক্রযানে স্বাধীন ভ্রমণে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিতাদেশ।
হিহিহি। এত শাসনে রেখেও আমার প্রিয়তমের সঙ্গে কি আমার প্রণয়ে ইতি টানা গেছে?
অসাধারণ বর্ণনা এতটা না হলেও অনেক মিল পেলাম
ReplyDeleteএই অসাধরণ বর্ননাটি পড়ে আমার শুধু একটি ই প্রশ্ন। জ্যেতিষ শাস্ত্রে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয় কখন থেকে? মাতৃ গর্ভে প্রবেশের সময় থেকে, নাকি মাতৃ গর্ভ থেকে বেরোনোর পর থেকে?
ReplyDelete